তেত্রিশ
শাংহাই শহরের ব্যস্ত রাস্তায় চলতে চলতে ক্রিচ্ আওয়াজে ব্রেক কষল বিশাল ডাবল ডেকার বাস। নিচু হলো ইঞ্জিনের গর্জন। ঝাঁকি খেয়ে চুপ হয়ে গেছে সবাই। নতুন করে গতি তুলছে বাস। দু’পাশের ফুটপাথে গিজগিজ করছে ছোট সব দোকান। চিরুনি থেকে কমপিউটারের পার্টস, কী নেই সেখানে। সামনের এক লেন মেরামত করছে সড়ককর্মীরা। খুব ধীরে এগোচ্ছে গাড়িঘোড়া।
বাসের নিচতলায় দাঁড়িয়ে আছে আসিফ রেজা। দু’হাতে ধরেছে সিলিং থেকে ঝুলন্ত স্ট্র্যাপ। পাশের সিটে বসেছে ওর স্ত্রী তানিয়া। ওয়্যারহাউস থেকে বেরিয়ে নতুন পোশাক ও জুতো কিনেছে ওরা। আলাপ করেছে, কীভাবে সবার চোখ এড়িয়ে ঢুকবে শাংহাই-এর আমেরিকান কনসুলেটে।
শাংহাই টুরস্ লিমিটেডের ব্রোশিওর দেখে বুদ্ধিটা এসেছিল আসিফের মগজে। দু’ঘণ্টা পর ওরা উঠল রঙচঙে প্রকাণ্ড বাসে। এখন ওটা ওদেরকে নিয়ে চলেছে শহরের কেন্দ্রে।
চারপাশে বসে আছে টুরিস্ট। বেশিরভাগই আমেরিকান বা ইউরোপিয়ান। আসিফ ও তানিয়া আশা করছে, চট্ করে ওদেরকে এখানে খুঁজবে না চাইনি পুলিশ।
যাওয়ার পথে পড়ছে ঐতিহাসিক মন্দির, রাজ প্রাসাদের মত সরকারী সব দালান। একটু পর দেখা গেল প্রকাণ্ড এক কংক্রিটের উঁচু দালান। আগে ওটা ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কসাইখানা। চালু করেছে নতুন করে। ওখানে রয়েছে দেশ সেরা সব দোকান ও রেস্টুরেন্ট। সুনাম অর্জন করেছে বেশ কিছু ভেজিটেরিয়ান রেস্টুরেন্ট ও দোকান।
কিছুক্ষণের জন্যে বাস থামল ওরিয়েন্টাল পার্ল টাওয়ারের সামনে। শাংহাই শহরের সবচেয়ে জনপ্রিয় দালান ওটা। বাণ্ডিল করা বলয় ও বিশাল পাইপ আকৃতির কলাম ও বিম সোজা উঠেছে পনেরো শ’ ফুট ওপরের আকাশে।
‘দেখলে মনে হয় বিগড়ে গেছে কারও বৈজ্ঞানিক __ রিমেন্ট,’ বলে উঠল কে যেন।
খুব মুগ্ধ, এমন ভাব করছে আসিফ ও তানিয়া। বাস্তবে অপেক্ষা করছে যাত্রার শেষাংশের জন্যে। বাস পৌঁছে দেবে ওদেরকে শহর কেন্দ্রে আমেরিকান কনসুলেট বাড়ির কাছে।
একটু পর গন্তব্যে পৌঁছুবে ওরা। জ্যাম বেশি বলে ধীর হয়েছে বাসের গতি। কিন্তু একটু দূরে চোখ যেতেই মুখ শুকিয়ে গেল তানিয়া ও আসিফের।
‘কনসুলেটের কথা ভুলে যাও,’ নিচু গলায় বলল তানিয়া।
মাথা দোলাল গম্ভীর আসিফ। চারপাশ থেকে কনসুলেট ঘিরে রেখেছে চাইনি পুলিশ ও সেনাবাহিনীর লোক। নানাদিকে ব্যারিকেড। কেউ ওদিকে গেলেই দাঁড় করিয়ে পাসপোর্ট চেক করছে অফিসাররা। তাদের চোখ এড়িয়ে গলবে না ছোট সুঁই-ও। ‘কারও কিছু বলার নেই। বো__ সরকার জানিয়ে দিয়েছে, ব্যবস্থা নিয়েছে আমেরিকানদের নিরাপত্তার জন্যেই। ‘
‘বাংলাদেশ দূতাবাসে যেতেও বাধা দেয়া হবে,’ বলল তানিয়া। ‘আমরা বাঙালি। তাই ওখানেও চোখ রাখবে এরা।’
ট্রাফিক সিগনাল পড়তেই থামল বাস। এক দম্পতির ওপর চোখ পড়ল আসিফের। সিকিউরিটির লোকদের দিকে আঙুল তাক করে কী যেন বলছে তারা। একটু ঝুঁকে জানতে চাইল শান্ত দানব, ‘জানেন, কেন ওখানে এত পুলিশ?’
ঘুরে ওকে দেখলেন বয়স্ক দম্পতি। গেঞ্জিতে মেপল লিফ। আসিফ ধারণা করল, এঁরা কানাডিয়ান। মহিলা বললেন, ‘শুনলাম ওখানে নাকি হামলা করবে ইসলামি জঙ্গিরা। ভাবুন কী ভয়ানক কথা! আজ সকালে আমাদের হোটেলে পুলিশ এসেছিল। তখনই জানলাম, কানাডিয়ান আর ব্রিটিশ কনসুলেটও ঘিরে রেখেছে। বোমার কথা ভাবলেই গলা শুকিয়ে যায় আমার। ভাল করতাম এখানে না এসে অন্য কোথাও গেলে। এখন তো বাড়িই ফিরতে পারব না। বেইজিঙে আমাদের বন্ধু আছে, কিন্তু ওখানেও যেতে দেবে না। বন্ধ করে দিয়েছে এয়ারপোর্ট আর ট্রেন স্টেশন।’
‘আমি তো এসব কিছুই শুনিনি,’ আকাশ থেকে পড়ল আসিফ। ‘আমাদের তো ফ্লাইট আগামীকাল!’
আফসোসের হাসি হাসলেন বয়স্কা মহিলা। ‘দেরি না করে এয়ারলাইনের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। শুনলাম, অন্তত এক সপ্তাহের জন্যে আটকে গেছি আমরা সবাই।’
মাথা নাড়ল আসিফ। ‘তা হলে তো যোগাযোগ না করে উপায় নেই।’ মহিলাকে মিষ্টি হাসি উপহার দিল ও। ‘দয়া করে আপনার মোবাইল ফোনটা একটু দেবেন? খুব জরুরি কল। আমারটা চুরি হয়ে গেছে।’ আগে দেখেছে আসিফ, কেউ বিপদে পড়লে বেশিরভাগ সময় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় কানাডিয়ানরা।
‘কাজ হবে না, বাছা,’ বলল মহিলার স্বামী। ‘শহরের ভেতর সেল ফোনের নেটওঅর্ক বন্ধ করে দিয়েছে ওরা।’
‘বাদ পড়েনি ইন্টারনেটও,’ বলল মহিলা। ‘আমরা যেন পৌঁছে গেছি পাথর যুগে।’
‘বা উনিশ শ’ ত্রিশে,’ বলল স্বামী।
মৃদু হাসল আসিফ। আগে জানত না এত কাছেই ছিল পাথর যুগ। ‘ল্যাণ্ড ফোনে কল দেয়া যাবে?’
‘ওটাই ব্যবহার করেছি,’ বলল কানাডিয়ান মহিলা। কল করেছি হোটেল থেকে।’
তথ্যের জন্যে স্বামী-স্ত্রীকে ধন্যবাদ দিয়ে তানিয়ার পাশে বসে পড়ল আসিফ। পরিষ্কার বাংলায় বলল, ‘শুনেছ?’
‘হুঁ। সব পথ আটকে দিচ্ছে কেউ। এসব করা হচ্ছে আমাদের জন্যে?’
‘তাই তো মনে হচ্ছে,’ বলল আসিফ, ‘ইন্টারনেট বা মোবাইল ফোন নেটওঅর্ক নেই, কাজেই আমাদের তথ্য কোথাও পাঠাতে পারব না।’
চুপ করে থাকল তানিয়া। তবে কিছুক্ষণ পর সামনে চেয়ে বলল, ‘সব পথ বন্ধ হয়নি।’ সামনের সিটের পেছনে ছোট্ট টিভি স্ক্রিন দেখাল। লাইভ ব্রডকাস্ট করছে সিএনএন-এর সংবাদ-কর্মী। দুনিয়াকে জানাচ্ছে জঙ্গি হামলার আশঙ্কায় বন্ধ করে দেয়া হয়েছে শাংহাই শহরের ইন্টারনেট।
‘নেটওঅর্ক এখনও কাজ করছে,’ বলল তানিয়া। ‘ওদের নিজেদের স্যাটেলাইট আছে। লিঙ্ক করছে ওয়াশিংটন আর নিউ ইয়র্কের ব্যুরোর সঙ্গে। আমরা যদি এক মিনিটের জন্যে ওদের…’
তানিয়া চুপ হয়ে গেলেও বক্তব্য বুঝে গেছে আসিফ। নিচু গলায় বলল, ‘কাজটা বিপজ্জনক। তবে কখনও এমন কোনও সাংবাদিক দেখিনি, যে কিনা দুর্দান্ত কোনও খবর পেয়েও চুপ করে বসে থেকেছে। আমরা যদি বড় টোপ ফেলি, হয়তো সাহায্য করতেও পারে।’
‘কোনও অফিসে গেলে ধরা পড়ব,’ বলল তানিয়া, ‘আমাদের চাই ওদের কোনও মোবাইল ট্রাক।’
স্ক্রিনের রিপোর্টারের দিকে তাকাল আসিফ। ‘বেশিক্ষণ লাগবে না ওখানে পৌঁছে যেতে। জায়গাটা চিনতে পেরেছ?’
‘চেনার কথা? বংশাল, না সূত্রাপুর?’
একঘণ্টা আগে ওখানেই ছিলাম,’ বলল আসিফ, ‘ওই যে পেছনে ওরিয়েন্টাল পার্ল টাওয়ার। চলো, বাস থেকে নেমে পড়ি।’
পরের স্টপেজে টুরিস্ট বাস থেকে নামল ওরা। ট্যাক্সি নিয়ে গেল সরাসরি ওই টাওয়ারের কাছে। পার্কিং লটে ঢুকে ভাবল, খনি পেয়েছে সোনার। বিশাল উঁচু স্তম্ভের নিচে পার্ক করা হয়েছে বেশ কয়েকটা স্যাটেলাইট টিভি নেটওঅর্কের সাংবাদিক বহনকারী ট্রাক। নামকরা এই ল্যাণ্ড মার্ক টাওয়ারটাকে নিজেদের ব্যাকগ্রাউণ্ড হিসেবে ব্যবহার করছে সবাই।
উদাস ভাব ধরে প্রথম দুটো মোবাইল ট্রাক পাশ কাটাল আসিফ ও তানিয়া। গাড়িগুলোর ছাতে স্যাটেলাইট ডিশ। এই জিনিসই চাই ওদের।
‘এগুলো লোকাল নেটওঅর্কের ট্রাক,’ বলল তানিয়া। ওর চোখ পড়েছে একটু দূরে কয়েকটা গাড়ির ওপর। ‘আমাদের দরকার আমেরিকান নেটওঅর্ক। সিএনএন, ফক্স বা…’ চুপ হয়ে গেল ও। এইমাত্র নতুন শট দেয়ার জন্যে একটা ট্রাক থেকে নেমেছে এক মহিলা সাংবাদিক। ‘আইএনএন,’ বিড়বিড় করল তানিয়া। ‘ইণ্ডি নেটওঅর্ক নিউয। ওটাই চাই। ওই নেটওঅর্কে সর্বক্ষণ চলছে নানান ষড়যন্ত্রের থিয়োরি।’
মৃদু হাসল আসিফ। ‘কবে থেকে এসব দেখো?’
‘রাতে, সুযোগ পেলে… হাতে চকলেট আইসক্রিমের বড় বক্স,’ অপরাধী সুরে স্বীকার করল তানিয়া।
‘ও, তাই বলি ট্র্যাশক্যানে কোথা থেকে আসে খালি আইসক্রিমের এত বাক্স,’ বলল আসিফ। ‘যাক গে, মোটা বউ পেলে তোষকের কী দরকার! রেডি হও, মহিলা সাংবাদিকের রিপোর্ট শেষ হলেই কথা বলব।’
ক্যামেরাম্যানের পেছনে গিয়ে দাঁড়াল ওরা। থেমে শুটিং দেখছে কয়েকজন টুরিস্ট। কানে ইয়ারপিস পরে সংক্ষিপ্ত রিপোর্ট দেয়ার পর মহিলা-সাংবাদিক বলল, ‘আগেরবার কথার সময় মিলিটারি হেলিকপ্টারের আওয়াজ ছিল। ওটা জুড়ে দিতে হবে। উত্তেজনা আসবে দর্শকের মনে।’
‘ঠিক আছে,’ সায় দিল ক্যামেরাম্যান। ইকুইপমেন্ট গুছিয়ে রাখতে লাগল সে। পাশাপাশি কয়েকটা মোবাইল ট্রাকের একটার দিকে চলল রিপোর্টার। গাড়ির পেছন দরজা খুলে উঠবে, এমনসময় ডাকল তানিয়া, ‘মিস হিউবার্ট, সরি, বিরক্ত করছি। আমি আপনার মস্তবড় ফ্যান। হুভার ড্যামের নিচে কী আছে, তা নিয়ে যে ডকুমেন্টারি করেছিলেন, ওটা দেখে আত্মা কেঁপে গিয়েছিল আমার।’
বিরক্তি কেটে গেল মিস হিউবার্টের। মিষ্টি করে হাসল। ‘থ্যাঙ্কস্! তবে স্বীকার করতে দোষ নেই, নিজে কিন্তু কোনও দিনও নেভাডায় যাইনি। অনেক তথ্য জোগাড় করে তৈরি করেছি ওই ডকুমেন্ট। ভাল লাগল যে আপনার খারাপ লাগেনি। এ থেকে বুঝতে পারছি, কাজটা মন্দ হয়নি।’ এবার জানতে চাইল, ‘আমাকে কি আপনার সঙ্গে সেলফি তুলতে হবে?’
‘একটা সই দিলে খুশি হব,’ ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে ছোট নোটবুক ও কলম নিয়ে বাড়িয়ে দিল তানিয়া। ওগুলো নিয়ে কিছু লিখতে গিয়ে ভুরু কুঁচকে কী যেন পড়তে লাগল মিস হিউবার্ট।
কাগজে তানিয়া লিখেছে কেন এসেছে। সাহায্য দরকার ওদের।
মুখ তুলে তাকাল রিপোর্টার। ‘আমার অফিসের কেউ আপনাকে পাঠিয়ে দিয়েছে মজা করতে?’
‘মজা করছি না, বিশ্বাস করুন,’ বলল তানিয়া। ‘আমরা কি আপনার ট্রাকে বসে আলাপ করতে পারি? সব খুলে বলতে একটু সময় লাগবে।’
কয়েক সেকেণ্ড কী যেন ভাবল মেয়েটা, তারপর দরজা খুলে ক্যামেরাম্যানকে বলল, ‘জনি, কিছুক্ষণ পর কথা বলব, ঠিক আছে?’
মাথা দোলাল ক্যামেরাম্যান। মিস হিউবার্টের পিছু নিয়ে ট্রাকের পেছনে উঠল তানিয়া ও আসিফ।
ব্রডকাস্ট ভ্যান, অ্যাম্বুলেন্সের মত, তবে ভেতরে রয়েছে মেডিকেল ইকুইপমেন্টের বদলে কমপিউটার ও প্রোডাকশন গিয়ার। কফিনের মতই বদ্ধ জায়গা। পেছনে দুটো ছোট সিট। তার একটায় বসল মিস হিউবার্ট। অন্যটা দখল করল তানিয়া। কেবিনেটে পিঠ কুঁজো করেও মাথা হেঁট হয়ে গেল লম্বু আসিফের।
‘সরাসরি মূল কথায় আসা যাক,’ বলল মিস হিউবার্ট। ‘আপনারা ইউএস সরকারের গোপন এজেন্সির এজেন্ট। আপনাদেরকে খুঁজছে চিনা পুলিশ ও মিলিটারি। যাতে ওয়াশিংটনে ব্যুরোর সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পারেন, তাই এত কিছু করছে। আমি কি ঠিক বুঝতে পেরেছি?’
‘আসলে… নুমা গোপন এজেন্সি নয়,’ শুধরে দিতে চাইল তানিয়া।
‘আমি জীবনেও ওটার নাম শুনিনি,’ বলল রিপোর্টার। ‘আমরা ঠিক বিজ্ঞাপন প্রচার করি না,’ জানাল আসিফ। ‘আচ্ছা, ঠিক আছে, বুঝলাম, অন্য প্রসঙ্গে গেল মিস হিউবার্ট, ‘কিন্তু তা হলে আপনাদেরকে এত কষ্ট করে খুঁজছে কেন চাইনিয সরকার? কেন তারা আস্ত একটা শহরের সব স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড বন্ধ করে দেবে?’
‘সব শুনলে বুঝবেন,’ বলল তানিয়া।
‘ব্যাখ্যা করে বলুন, যেন বুঝতে পারি, বলল মহিলা রিপোর্টার। ‘সাধারণ মানুষ মনে করে আমার কাজ স্রেফ পাগলামি। তবে কপাল ভাল, প্রডিউসাররা তা মনে করেন না। তাই পাবলিকের কাছ থেকে সহায়তা নিতে হয় না। বরং আমরাই নতুন খবর জানিয়ে চমকে দিই।’
‘বিশ্বাস করুন, আমরা কাউকে চমকে দিতে বা মজা করতে এখানে আসিনি,’ বলল তানিয়া। ‘আমরা কোনও সিক্রেট এজেন্ট নই। আমি গুপ্তচর নই, সাধারণ মেরিন বায়োলজিস্ট। আসিফ জিয়োলজিস্ট। আমরা চাইনি সাগরে দেখেছি মানুষের তৈরি অস্বাভাবিক কিছু জিনিস। সোনার রিডিং পেয়েছি। ফলে ধারণা করছি, চিনের কারণে হচ্ছে গোটা পৃথিবী জুড়ে ইকোলজিকাল বিপর্যয়। যা আবিষ্কার করেছি, তাতে চিন সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক সংগঠন থেকে প্রচণ্ড চাপ আসবে। তাই তারা চাইছে আমাদেরকে গ্রেফতার করে সরিয়ে ফেলতে। অথচ, খুব জরুরি এসব তথ্য ওয়াশিংটনে পাঠিয়ে দেয়া।’
‘ভাল কথা, বুঝলাম,’ বলল মিস হিউবার্ট, ‘কিন্তু আমার তো জানা আছে, তাদের নিজেদের এলাকায় যা খুশি করতে পারে চিন সরকার। ওই সাগর তাদের এলাকায় পড়ে। ইণ্ডাস্ট্রিয়াল বিপর্যয় হলে সেজন্যে আপনাদেরকে কেন গ্রেফতার করতে চাইবে তারা?’
‘কারণ চিনের পুব সাগরের এ কেলেঙ্কারি প্রকাশ পেলে হৈ-চৈ শুরু হবে আন্তর্জাতিক আঙিনায়,’ বলল তানিয়া। ‘ছি-ছি করবে সবাই। প্রচণ্ড চাপ আসবে সরকারের ওপর।’
তানিয়া থামতেই সোজা হয়ে বসল মিস হিউবার্ট। ‘তা হলে কি আপনারা বলতে চান, আগের চেয়ে দ্রুত উঠে আসছে সাগর সমতল? আর সেটা হচ্ছে চিনের কারণে?’
‘হু-হু করে বাড়ছে পৃথিবীর প্রতিটি সাগরের উচ্চতা, তবে সেটা হচ্ছে তাদের কারণেই, এমন প্রমাণ এখনও আমাদের হাতে নেই। প্রতি বছর দশ ফুট করে সাগর উঠে এলে, তলিয়ে যাবে বহু দেশ। আগামী ছয় মাসে ডুববে সাগরের কাছের অনেক নিচু দেশের উপকূল।’
‘এটা নিউয পেপারের বিশাল হেডলাইন হবে,’ বলল মিস হিউবার্ট।
‘চিনের পুব সাগরে তদন্তের সুযোগ এ দেশের সরকার দেবে না,’ বলল তানিয়া। ‘এসব তথ্য ওয়াশিংটনে পাঠাতে চাই বলেই নানাভাবে বাধা দিচ্ছে। এটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, আস্ত সাগর ডাঙায় উঠে এলে সর্বনাশ হবে বহু দেশের। ওটাকে বলতে পারেন সত্যিকারের মহাপ্লাবন।
‘ঘনিয়ে আসছে অকল্পনীয় মহাপ্লাবন!’ বিড়বিড় করল মিস হিউবার্ট। ‘পরে একসময় কমপিউটার গেম ছাড়বেন। তাতে আসবে কোটি কোটি টাকা।’
‘মিস হিউবার্ট,’ ডাকল তানিয়া।
‘আমাকে মেরিয়ান বলে ডাকলে খুশি হব।’
‘আমি মিথ্যা বলছি না,’ কাতর গলায় বলল তানিয়া। ‘একবার ভেবে দেখুন কী হচ্ছে। পুলিশ ও সেনাবাহিনীকে দিয়ে ঘিরে রেখেছে পশ্চিমা সব কনসুলেট। বন্ধ করে দেয়া হয়েছে এয়ারপোর্ট ও রেল স্টেশন। গোপন এবং বিপজ্জনক তথ্য ফাঁস হবে, সে ভয়ে বন্ধ করে দিয়েছে ইন্টারনেট আর সেল ফোনের নেটওঅর্ক। ওই মারাত্মক তথ্য রয়ে গেছে আমাদের কাছে। দুনিয়াকে জানাতে হবে কী ঘটছে। অথচ, সে সাধ্য আমাদের নেই। তবে আপনি একবার স্যাটেলাইট ডিশ ব্যবহার করতে দিলে, এসব জরুরি তথ্য পাঠিয়ে দেব আমেরিকায়। মানুষ অন্তত জানবে, কী ভয়ানক সর্বনাশের দিকে চলেছে তারা।’
পরিচিত সাহসী এক মহিলা সাংবাদিকের কাছে সাহায্য চেয়েছে তানিয়া। দ্বিধায় পড়ে গেছে মেরিয়ান হিউবার্ট।
এবার অন্যদিক থেকে তার মনের দুর্গে ঢুকল আসিফ। সহজ সুরে বলল, ‘এটা একজন সাংবাদিকের সারাজীবনের সেরা কাহিনী। হয়তো পাবে পুলিত্যার পুরস্কার। তার চেয়েও বড় কথা, সেধে কাজ দেবে বিশাল সব নেটওঅর্ক থেকে। আগামী বছর হয়তো থাকবে সে ২০/২০ নেটওঅর্কে। তখন বিগফুট বা এলিয়েনরা লোক তুলে নিয়ে যাচ্ছে, সেসব ছোটখাটো রিপোর্ট নিয়ে ব্যস্ত হতে হবে না। হয়তো পাবে নিজস্ব শো।’
হেসে ফেলল মেরিয়ান। ‘হয়তো, অথবা আপনারা দু’জন আসলে খেপা পাগল!’
‘আমাদের কাছে রয়ে গেছে ভিডিয়ো আর সোনার ডেটা,’ বলল তানিয়া। আসিফের কাছ থেকে ল্যাপটপ নিয়ে মহিলা সাংবাদিকের হাতে দিল ও। ‘নিজেই দেখুন।’