একত্রিশ
পুরনো আমলের স্যান ফ্রান্সিসকোর মতই নাগাসাকি শহর। একপাশে সাগর, অন্যদিকে পাহাড়। সমতল জমি না পেয়ে পাহাড়ের স্তরে স্তরে বাড়ি তৈরি করেছে বাসিন্দারা। অত্যন্ত ব্যস্ত বন্দর-নগরীর দু’অংশের মাঝে সংকীর্ণ উপসাগর, মাঝে কমলা রঙের ঝুলন্ত সেতু। যে-কোনও দিকের পাহাড় থেকে দেখা যায় অন্যদিকের বাড়িঘর।
বিজ্ঞানী শিমেযুর সংগ্রহ করা পুরনো আরেক গাড়িতে চেপে নাগাসাকি শহরে পৌঁচেছে রানা, সোহেল ও হিনা। গাড়িটা উনিশ শ’ বাহাত্তর সালের জিটি-আর চার দরজার সেডান। সত্যি বলতে, জাপানের প্রথম গাড়ি, যেটা সংগ্রহ করতে চাইবে গাড়ি-প্রেমিক যে-কেউ। অবশ্য আসার পথে বিড়বিড় করেছে সোহেল, ‘হাড্ডির মত শালার সিট! ভর্তা হয়ে গেল পেছনের কুমড়ো!’
‘কেউ কেউ ভাববে, আমরা গরীর বলেই মেরামত করে চালাচ্ছি গাড়িটা,’ কিছুক্ষণ পর মন্তব্য করল সোহেল। ‘আবার এ কথাও ঠিক, চালাতে হলে বেন্টলির চেয়ে জিটি-আর বেশি পছন্দ করব।’
সিটে ঘুরে ওকে দেখল হিনা। ‘আপনার ভাল লেগেছে বলে ধন্যবাদ। প্রভু শিমের জন্যে এ গাড়িটা প্রথম মেরামত করি। মনে আছে হাড়ভাঙা পরিশ্রমের কথা।’
‘গাড়িটা ক্লাসিক, তেমনি আগ্রাসী চেহারার, ‘ বলল সোহেল।
সেতুর র্যাম্পে গাড়ি তুলল রানা। বুঝে গেছে, মেয়েটার সঙ্গে খাতির করতে চাইছে সোহেল। নীরস সুরে বলল ও, ‘আমাদের ভাড়া গাড়ি হলেই চলত। হিটারও আধুনিক হতো। এত ঠাণ্ডা লাগত না।’
দৃঢ়ভাবে মাথা নাড়ল হিনা। ‘ভাড়াটে গাড়ি আধুনিক, তা ঠিক। তবে সেটা সবসময় সবার জন্যে ভাল হয় না। আপনারা কি জানেন, নতুন গাড়িতে আরএফআইডি ট্যাগ রাখে গাড়িকোম্পানি? স্যাটেলাইট রেডিয়ো রিসিভারের মাধ্যমে যে- কোনও সময়ে জেনে নিতে পারবে, কোথায় আছে তাদের তৈরি কোন্ গাড়ি। বুঝলেন তো? লোজ্যাক বা অন্য সিস্টেম লাগেই না। নতুন কিছু গাড়িতে আছে রিমোট অপারেশন অথোরিটি ইকুইপমেন্ট। ইচ্ছে করলে কমপিউটার টার্মিনাল ব্যবহার করে যখন তখন বন্ধ করে দিতে পারে আপনার ইঞ্জিন। অর্থাৎ, সর্বক্ষণ তাদের হাতের মুঠোয় আছেন আপনি।
‘কিন্তু গোপনে কোথাও যাচ্ছি না আমরা,’ মৃদু হাসল রানা। ‘এ প্ল্যানের বড় দিক হচ্ছে, সরাসরি মুখোমুখি কথা বলব লো হুয়াং লিটনের সঙ্গে। কোনও লুকোছাপা নেই।’
‘কথা বলার সুযোগ দেবে?’ জানতে চাইল সোহেল।
‘দেবে,’ বলল রানা। ‘সোজা গিয়ে সাহায্য চাইব।’ হিরাডো ব্রিজে উঠে পেরোল নাগাসাকি উপসাগর। উত্রাই পথে চলল ডকের দিকে বিলিয়নেয়ারের ফ্যাসিলিটি লক্ষ্য করে। এক শ’ একর জমিতে তৈরি হয়েছে হেডকোয়ার্টার, দেখলে মনে হবে ভবিষ্যতের কোনও শহর। দালানগুলোর পাশে রয়েছে ভাস্কর্য করা বাগান। মাঝে দিয়ে গেছে ফুটপাথ ও পাশে কংক্রিটের সরু সব নালা। দেখা গেল, ফ্যাসিলিটির পেছনে সাগরতীরে অত্যাধুনিক গাড়ি পরীক্ষার জন্যে প্রমাণ আকারের ট্র্যাক আছে।
পাহাড়ি পথে নামতে শুরু করে বলল রানা, ‘তো ওটাই লো হুয়াঙের নতুন কোম্পানি। নিপ্পন-চায়না রোবটিক্স। লোকটার সঙ্গে জুটে গেছে ক’জন জাপানি শিল্পপতি। আজ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন হচ্ছে কোম্পানি। বড় ধরনের দুটো অনুষ্ঠানের প্রথমটা। উপস্থিত হবেন জাপানি প্রধানমন্ত্রী, নাগাসাকির মেয়র এবং পার্লামেন্টের বেশ ক’জন সদস্য।’
‘বুঝেছি, ফালতু রঙিন ফিতা কাটতে গিয়ে সাধারণ মানুষের কান পচিয়ে ছাড়বে রাজনৈতিক নেতারা,’ মাথা দোলাল সোহেল।
‘কালকের অনুষ্ঠান আরও গুরুত্বপূর্ণ,’ বলল রানা। ‘চিন- জাপানের মাঝে হচ্ছে পারস্পরিক সহায়তা চুক্তি। তবে ওই অনুষ্ঠান হবে ফ্রেণ্ডশিপ প্যাভিলিয়ন নামের নতুন বড় এক অডিটোরিয়ামে। ওটা তৈরির পুরো টাকা দিয়েছে লো হুয়াং লিটন।’
‘টাকা দিয়ে বন্ধু কিনছে,’ বলল সোহেল। ‘এরপর ওসব বন্ধুদের মাধ্যমে প্রভাবিত করবে দু’দেশের ক্ষমতাশালী নেতাদের। ভাল বুদ্ধি।
‘ঠিকই ধরেছিস,’ বলল রানা, ‘ওই অনুষ্ঠানে আমরা গেলে কেউ খেয়াল করবে না।’
‘যেহেতু এদের তুলনায় আমরা পিঁপড়ের চাইতেও খুদে মানুষ,’ সায় দিল হিনা।
‘এই দুই জমজমাট অনুষ্ঠান করা হচ্ছে ট্রেড শো-র মত করে,’ বলল রানা। ‘চাইলে যোগ দিতে পারবে যে-কেউ। আর এই সুযোগটাই নেব আমরা।’
টিলা বেয়ে নেমে সরু রাস্তা ধরে সরাসরি কোম্পানির পাতাল পার্কিং গ্যারাজে ঢুকল রানা। গাড়ি রেখে ওরা একটু দূরেই পেল এস্কেলেটর। ওটায় করে উঠে এল ওপরতলায়। চারপাশে গুঞ্জন তুলছে শত শত মানুষ। নানাদিকে জ্বলজ্বল করে জ্বলছে শক্তিশালী বাতি। এদিক ওদিক চলেছে ছোট ছোট সব মেশিন। রানা, সোহেল ও হিনা এস্কেলেটর থেকে নামতেই ওদের দিকে চেয়ে হাসল হলোগ্রাফিক এক মেয়ে। মিষ্টি করে বলল, ‘আপনারা যা ভাবছেন, তার চেয়েও অনেক কাছে সত্যিকারের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ!’
চারপাশে তাকাল ওরা। ঝিকমিক করছে নিয়ন বাতি। বাজছে জোরালো মিউযিক। যে-কেউ ভাববে, সে ঢুকে পড়েছে ডিস্কো ক্লাবে। এস্কেলেটরের সামনে দু’পাশে ক’ফুট দীর্ঘ দেয়ালে ফিট করা আছে কৃত্রিম কয়েকটা হাত। নখে লাল নেইলপলিশ। চাইছে হ্যাণ্ডশেক করতে।
বিরক্ত হয়ে মাথা নাড়ল হিনা। ফিসফিস করল, ‘আকুমু।’
‘কেন দুঃস্বপ্ন?’ জানতে চাইল রানা।
আরেকবার মাথা নাড়ল হিনা। ‘এটা হচ্ছে নরকের সাত চত্বরের মতই ভয়ঙ্কর বাজে জায়গা।’
রানা ও সোহেল দেখল, মুষড়ে পড়েছে মেয়েটা। হঠাৎ পতিতালয়ে নিজেকে আবিষ্কার করলে এমনই হতাশ হবেন যাজক।
‘এখান থেকে বহু কিছু শেখার আছে,’ বলল রানা।
‘আমার বমি আসছে,’ তৃতীয়বার মাথা নাড়ল হিনা। অটোমেটেড হাত এড়িয়ে সামনের ডেস্কের কাছে এল ওরা। ওখান থেকে সংগ্রহ করল হেডসেট। আধুনিক যন্ত্রটার কারণে শুনবে যে-কোনও ভাষার বক্তৃতা। সামনে বেশ কিছু বুথ। প্রথমটা জেনেরিক ইণ্ডাস্ট্রিয়াল ডিসপ্লে। এ সম্পর্কে ইংরেজিতে রেকর্ড করা মিষ্টি কণ্ঠের এক মেয়ে বলতে লাগল: ‘আধুনিক রোবটের জন্যে ভবিষ্যতে হাজাররকমের কাজ থেকে রক্ষা পাবেন আপনি। আজ থেকে এক দশক পর বিরক্তিকর কোনও কাজ করতে হবে না আর আপনাকে। দীর্ঘ পথে ড্রাইভ? লাগবে না। ওয়্যারহাউসে হাড়ভাঙা পরিশ্রম? লাগবে না। আসলে ভারী সব কাজই করবে রোবট। আপনি চাইলে বিশাল সব মেশিন পাহাড় কেটে তৈরি করে দেবে চওড়া রাস্তা। যা চান, সবই পাবেন হাতের নাগালে।’
‘কাজ না থাকলে নগদ টাকাও পকেটে আসবে না,’ বলল হিনা।
ভুরু কুঁচকে ফেলল সোহেল। ‘এখন আর ভালবাসতে পারছি না রোবটগুলোকে!’
‘তা হলেই বুঝুন,’ বলল হিনা, ‘টাকা নেই বলে শেষে না খেয়ে মরে যাব আমরা!’
ফ্যাসিলিটির আরেক দিকে গেল ওরা। ওখানে বাড়ছে ভিড়। গমগম করে উঠল দরাজ এক কণ্ঠ: ‘এবার আপনারা দেখবেন আমাদের নতুন পরিচারক রোবট। ওর জন্যে আর প্রয়োজন পড়বে না বাড়িঘরে কাজের মানুষ। মিষ্টি মেয়েটির নাম: ন্যাম-নাইন-এক্স।’
ছাত থেকে নিচের অন্ধকার জায়গায় ফেলা হলো উজ্জ্বল আলো। সবাই দেখল, ফ্রেঞ্চ পরিচারিকার পোশাক পরনে এক মহিলা। মুখটা কোমল, লাল লিপস্টিক চর্চিত ঠোঁটে মৃদু হাসি। অবশ্য চোখ কাঁচের মতই, কোনও আবেগ নেই।
‘আমি মিস রেবেকা,’ সুরেলা কণ্ঠে বলল রোবট। ঠোঁট নড়ছে কথা বলার সময়। ‘আমি আছিই তো আপনাদের সব কাজ করে দেয়ার জন্যে।’ দর্শকদের দিকে চেয়ে চোখ টিপল সে।
বিস্মিত হয়েছে রানা। রোবটের কণ্ঠে নেই আড়ষ্ট কমপিউটার জেনারেটেড বাক্য। কাছে গিয়ে মেশিনটা দেখল ও। গুছিয়ে রাখা একটা কিচেনে দাঁড়িয়ে আছে ওটা। দেখতে না দেখতে কল খুলে পানি দিয়ে পরিষ্কার করল হাঁড়িকুড়ি। তোয়ালে দিয়ে সব মুছে তুলে রাখল র্যাকে। রানার মনে পড়ল রাঙার মা-র কথা। এবার ব্যাগ থেকে ফলমূল, সব্জি, মাংস ও মাছ বের করে ফ্রিজের ঠিক জায়গায় রাখল রোবট। গুঁড়ো করে নিয়ে পারকোলেটর মেশিনে তৈরি করল কফি। একদানা গুঁড়োও কোথাও পড়ল না।
‘বুঝলি, এবার কারও চাকরি নেই,’ হতাশ সুরে বলল সোহেল। চট করে দেখল হিনাকে। ‘বিবিও লাগবে না!’
মাথা দোলাল মেয়েটা। ‘একগাদা মেশিনের মাঝে চুপ করে বসে থাকবে সবাই। বিয়ে করার দরকার কী? কোনও প্রয়োজন নেই আর কারও সঙ্গে সম্পর্ক রাখার।’
কথাটা শুনে করুণ চেহারা করল সোহেল। ‘বলেন কী, বাচ্চা না হলে তো…’
‘ভবিষ্যতে আধুনিক মেশিন উৎপাদন করবে মানুষের বাচ্চা,’ ভরসা দিল হিনা। ‘যে যার বাচ্চা নিয়ে বাড়ি ফিরবে। কোথাও সমস্যা নেই। বাচ্চাগুলোকে পেলে দেবে মা রোবট। চাইলে আপনাকেও ঘুম পাড়িয়ে দেবে মাথায় হাত বুলিয়ে। আর আপনার ঘুম না এলে…’ সোহেলকে দুর্দান্ত একটা চোখ টিপ দিল হিনা।
বিমর্ষ হয়ে অন্যদিকে চেয়ে বিড়বিড় করল সোহেল, ‘দুশশালা!’
মৃদু হাসল রানা। ‘অফিসে আর প্রেম-প্রেম ভাব করতে হবে না নীলা, ববি, পলি… বা আর কারও সঙ্গে! …এবার, চল্, অনুষ্ঠান শেষ হলে গিয়ে ধরব লো হুয়াং লিটনকে।’
বেশ ক’টা দেখার মত ডিসপ্লে এড়িয়ে গ্রেট হল-এ ঢুকল ওরা। এ ঘর তৈরি করা হয়েছে অডিটোরিয়াম হিসেবে। একদিকে উঁচু মঞ্চ। ওখানে দাঁড়িয়ে রোবট নিয়ে বকবক করছে না লো হুয়াং লিটন। আজকে তার বক্তব্য অনুযায়ী: সহযোগিতার বিশাল এক সুযোগ এসেছে চিন-জাপানের। এখন সময় হাতে হাত রেখে এগিয়ে যাওয়ার।
‘এশিয়ার মহান এ দুটি দেশ চাইলে বদলে দিতে পারবে গোটা পৃথিবী। তবে তার আগে চাই সম্পর্ক উন্নয়ন। ভুলতে হবে তিক্ত অতীতের কথা। গত শতাব্দীগুলোতে যেসব ভুল হয়েছে, সেগুলো পড়ে থাকুক ইতিহাসের পাতায়। আমরা যেন সেসব থেকে শিক্ষা নিয়ে এগিয়ে যেতে পারি ভবিষ্যতের স্বর্গপুরীর দিকে।’
‘বড় বড় কথা বলছে,’ নিচু গলায় রানাকে বলল সোহেল, ‘দক্ষিণ চিন সাগর আর সেনকাকু দ্বীপ নিয়ে দুই দেশের যে কামড়া-কামড়ি, সেটা সামলাবে কীভাবে?’
মিনিটখানেক পর ওই বিষয়ে কথা বলল লো হুয়াং লিটন। ….বেশ কয়েকটি বিরোধ নিষ্পত্তি করতে পদক্ষেপ নিয়েছে চিন সরকার। কিছু দিনের ভেতর জাপান সরকারের হাতে তুলে দেয়া হবে কয়েকটি দ্বীপের কর্তৃত্ব। ভবিষ্যতে জাতিগত কোনও বিরোধ থাকবে না আমাদের। তার বদলে থাকবে শুধু বন্ধুত্ব এবং সহযোগিতা। আর এ থেকে হাজারো ধরনের সুবিধা পাবে দুই দেশ।’
হাততালি দিল অন্তত চার শ’ জাপানি ও চিনা।
‘লোকটার কথা শুনে মনে হচ্ছে সে স্রষ্টা, যা খুশি তাই করতে পারবে,’ মন্তব্য করল হিনা।
‘উবোন হিমুরা বলেছেন, জাপান আর চিন— দুই দেশেই কূটনৈতিক সুবিধা পায় লোকটা,’ বলল সোহেল।
‘কথা শুনেছেন?’ নাক কোঁচকাল হিনা। ‘জাপানের দ্বীপ জাপানকে ফেরত দিয়ে কৃতজ্ঞ করতে চায়! লোকটা গর্বের ডিপো!’
চুপচাপ লো হুয়াং লিটনের বক্তৃতা শুনছে রানা। তার কথা শেষ হলে মস্তবড় এক কমলারঙা কাঁচি দিয়ে কাটা হলো মখমলের লাল ফিতা। আনুষ্ঠানিকভাবে ব্যবসা শুরু করল নিপ্পন-চায়না রোবটিক্স। বুফেতে সার্ভ করা হলো শতখানেক পদের খাবার। যে যার মত ভরে নিল প্লেট। ওয়েট্রেসরা অকাতরে বিলাতে লাগল শ্যাম্পেইনের গ্লাস। তবে এ অনুষ্ঠানে যোগ দিল না রাজনৈতিক নেতারা। পাহারা দিয়ে মঞ্চ থেকে তাদেরকে সরিয়ে নিল সিকিউরিটি টিম। অবশ্য রয়ে গেছে লো হুয়াং লিটন। এখানে ওখানে থেমে আগ্রহীদের সঙ্গে হ্যাণ্ডশেক করছে এবং আন্তরিকভাবে আলাপ জুড়ছে।
‘এবার নিজ পরিচয় দেয়ার সময় হয়েছে,’ বলল রানা।
‘অডিটোরিয়ামের নিচের গ্যারাজে দেখা হবে,’ জানাল সোহেল। ‘দেখা যাক খোলে কি না তোর কপাল।’
ফাঁকা হতে শুরু করেছে অডিটোরিয়াম। ব্যস্ততার ছাপ পড়ছে লো হুয়াং লিটনের আচরণে। হ্যাণ্ডশেক করছে আগের চেয়ে দ্রুত। কম কথায় সারছে বক্তব্য। বিদায় নিতে চায়। সারি সারি চেয়ারের মাঝের চওড়া পথে বিলিয়নেয়ারের দিকে চলল রানা। এক লোকের সঙ্গে হ্যাণ্ডশেক করে ঘুরে দাঁড়াল লো হুয়াং লিটন। এবার কাছের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাবে।
কিন্তু তখনই তার সামনে গিয়ে দাঁড়াল রানা। ‘মিস্টার হুয়াং, কপাল ভাল, আপনাকে পেয়ে গেলাম। চমৎকার লাগল আপনার বক্তৃতা।’
রাবারের মুখোশের মত চেহারায় অনুভূতির ছাপ নেই লোকটার। কিন্তু রানার কথা শুনে মৃদু মাথা দোলাল সে। ‘সরি, আমি কিন্তু আপনাকে ঠিক চিনলাম না।’
‘ব্যক্তিগতভাবে আমাকে চেনেন না,’ বলল রানা, ‘আমার নাম মাসুদ রানা। নুমা বা দ্য ন্যাশনাল আণ্ডারওঅটার অ্যাণ্ড মেরিন এজেন্সিতে আছি অনারারি ডিরেক্টর হিসেবে। সংগঠনটি কাজ করে ওয়াশিংটন ডি.সি. থেকে। আগে পরিচয় হয়নি, তবে আপনার টেকনিকাল ব্রেনের… বা সোজা কথায়, আপনার ভক্ত আমি।’
বিরক্তি কেটে গেল বিলিয়নেয়ারের মুখ থেকে, স্মিত হাসল। ‘কীভাবে ভক্ত হলেন, বলুন তো?’
‘আজকাল গভীর সাগরে অসংখ্য রোবট ও অটোমেটেড ভেহিকেল ব্যবহার করি আমরা,’ বলল রানা, ‘আপাতত জরুরি এক এক্সপিডিশন হবে চিনের পুব সাগরে। ওখানেই আপনার রোবটের কাজ দেখে মুগ্ধ হয়েছি। দেখার মত ওগুলোর কর্মদক্ষতা। তাই মনে হলো, আপনার রোবট ও অটোমেটেড ভেহিকেল কাজে লাগতে পারে আমাদের।’
কিছুক্ষণ নীরবতার পর বলল লো হুয়াং, ‘নিপ্পন-চায়না রোবটিক্সের আমরা অত্যন্ত আনন্দিত হব নুমার মত নামকরা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেলে। গভীর সাগরে কাজ করবে এমন কিছু রোবট আছে আমাদের প্রোডাকশন পাইপলাইনে। পরে হয়তো ওগুলো কাজে লাগবে আপনাদের। সোমবার অফিসে ফোন করুন আমাকে। পরিচয় করিয়ে দেব অপারেশন্স ডিরেক্টরের সঙ্গে।
সোমবার দেরি হয়ে যায়,’ বলল রানা, ‘আমাদের কাজ শুরু হবে আগামীকাল থেকে। হাতে সময় নেই।’
‘এত তাড়া কীসের?’ প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক রাখতে গিয়ে দুই ভুরু কুঁচকে ফেলল বিলিয়নেয়ার।
‘আমরা লড়ছি চিনের পুব সাগরে উদ্ভব হওয়া এক. জিয়োলজিকাল সমস্যার বিরুদ্ধে,’ বলল রানা, ‘সাগরতলে হচ্ছে একের পর এক অত্যন্ত অস্বাভাবিক ভূমিকম্প। এলাকার সুনামির ইতিহাস ও টেকটোনিক বিপর্যয়ের কথা মাথায় রেখে দেরি না করে তদন্ত করব। এটা জানা খুব জরুরি, কী হচ্ছে ওখানে। …ভাল হতো আমরা আজ রাতেই মিটিঙে বসলে।’
মাথা নাড়ল লো হুয়াং। ‘সম্ভব নয়। তবে অফিসে জানিয়ে দেব আপনি যোগাযোগ করবেন। এনসিআর খুব খুশি হবে আপনাদেরকে সহায়তা দিতে পারলে।’ রানার সঙ্গে হাত মেলাল সে। ‘গুড লাক। এনজয় করুন এক্সপো। এবার বিদায় নেব।’
রানাকে পাশ কাটিয়ে দরজার দিকে চলল লোকটা। তার সঙ্গে জুটে গেল ক’জন বড় কর্মকর্তা। সবাই বেরিয়ে যাওয়ার পর গ্যারাজে নামল রানা।
গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে আছে সোহেল ও হিনা।
‘কী বুঝলি?’ জানতে চাইল সোহেল। ‘ঘাবড়ে গেছে?’
‘হয়তো,’ বলল রানা, ‘তবে চেহারা ছিল ওক গাছের গুঁড়ির মত। চোখের পলক ফেলেনি।’
‘ভালমত টোকা দিয়ে দেখেছিস?’
‘টোকা নয়, ওর জন্যে চাই ইলেকট্রিক করাত।’
‘হয়তো ঠিকই বলেছেন পুলিশ অফিসার হিমুরা,’ বলল হিনা, ‘ভুল জায়গায় টোকা দিয়েছেন আপনি।’
‘আমার তা মনে হয় না,’ বলল রানা। ‘এবার এগোতে হবে ভেবেচিন্তে। এসবে জড়িত হলে উল্টো টোকা দেবে লো হুয়াং লিটন।’
‘কিন্তু নিরপরাধ হলে?’ জানতে চাইল সোহেল।
‘অফিসে ফিরে মুচকি হাসবে— বদ্ধ উন্মাদের পাল্লায় পড়েছিলাম!’