1 of 2

মহাপ্লাবন – ২৯

ঊনত্রিশ

ছলাৎ-ছলাৎ শব্দে জাহাজে বাড়ি মারছে ঢেউ, পরিষ্কার শুনছে তানিয়া। কিন্তু ক’সেকেণ্ড পর শুনল প্যাট্রল বোটের ইঞ্জিনের জোরালো গর্জন। ফেরির বো ঘুরে স্টারবোর্ডে গেল ওটা। ওদিকেই আছে ওদের কেবিনের জানালা দিয়ে নিচে নেমে যাওয়া কেবল।

আসিফ ও তানিয়া আছে নিচের ডেকে। শেকলের স্তূপ থেকে স্বামীর দিকে তাকাল ও। মৃদু হেসে বলল, ‘ভাল বুদ্ধি। জানালায় কেবল দেখে ভাববে নেমেছি সাগরে। নিশ্চয়ই যাচ্ছি তীরের দিকে। ওদিকে খুঁজতে শুরু করবে আমাদেরকে।’

অ্যাংকর চেইন লকার মানেই তেলতেলে, সংকীর্ণ বদ্ধ জায়গা। মেঝেতে শত শত ফুট ভারী চেইন। লোহার ছোট্ট ঘর স্বস্তিকর নয়, তবে লুকিয়ে পড়ার জন্যে চমৎকার।

‘সুযোগ পেলে লুকিয়ে পড়তাম কার্গো হোল্ডে, কিন্তু সৈনিক দেখার পর উবে গেছে সে ইচ্ছে,’ বলল আসিফ।

আরেকটু হলে কার্গো হোল্ডের কাছে এক দল সৈনিকের সঙ্গে দেখা হতো ওদের, তখনই নোঙর রাখার ঘরের কথা ভেবেছে আসিফ। দেরি না করে এসে ঢুকেছে লকারে, পেছনে ভিড়িয়ে নিয়েছে হ্যাচ। লোহার রেঞ্চ ব্যবহার করে গোঁজ দিয়েছে, যাতে হঠাৎ করে বন্ধ না হয় ল্যাচ।

‘সত্যিই সবাই ভাববে কেবিন থেকে সাগরে নেমেছি,’ স্ত্রীর প্রশংসা করল আসিফ। ‘তুমি না বললে বুটও খুলতাম না।’ দু’পায়ের বুড়ো আঙুল নাড়ল ও।

তানিয়ার কথায় বুট, ব্যাকপ্যাক ও অন্যান্য প্রায় সবই ফেলে এসেছে ওরা। সঙ্গে আছে শুধু ল্যাপটপ কমপিউটার। ওটা এখন প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরে শার্টের নিচে রেখেছে আসিফ।

‘লাগেজ নিয়ে সাঁতার কাটে না কেউ,’ বলল তানিয়া। ‘নির্ঘাৎ ধরা পড়তাম। কপাল ভাল, ঠিক সময়ে সরে আসতে পেরেছি।’

‘ওরা কী করছে দেখতে পাচ্ছ?’ জানতে চাইল আসিফ।

মেঝেতে স্তূপ হয়েছে ভারী শেকল। লোহার দেয়ালের গায়ে ফাটলের মত হওসহোল। শেকল ও খোলের পাশ দিয়ে স্টারবোর্ডের অংশ দেখছে তানিয়া। ‘স্টার্নের দিকে গেছে। চেক করে দেখছে ফ্যানটেইলের নিচে।’

ক’মুহূর্ত পর জাহাজের পেছন ঘুরে ওদিকে গেল নেভির বোট। এদিকে এগিয়ে আসছে আরেকটা বোট। এরপর তৃতীয়টা। ‘আরও সৈনিক,’ বলল তানিয়া।

কিছুক্ষণ পর ওরা শুনল আবছা বিস্ফোরণের আওয়াজ। লোহার খোলের জন্যে বিকৃত হয়েছে শব্দ। একটু পর ফাটল আরও বোমা। দূর থেকে দূরে যাচ্ছে বিস্ফোরণের আওয়াজ। থরথর করে কাঁপছে জাহাজের খোল। আসিফ ও তানিয়ার মনে হচ্ছে, ওরা আছে বিশাল কোনও ঢাকের ভেতর।

‘কী করছে বুঝতে পেরেছ?’ জানতে চাইল তানিয়া।

‘মৎস্যশিকার বলতে পারো,’ বলল আসিফ। ‘সেজন্যে ব্যবহার করছে ডিনামাইট অথবা গ্রেনেড।’

‘বোমা মেরে জলের নিচে খুন করবে আমাদেরকে?’

মাথা দোলাল আসিফ। ‘শকওয়েভে না মরে উপায় নেই ডুবুরির।’

সাগরের নিচে এক শ’ ফুটেরও বেশি দূরে ছড়িয়ে পড়ে প্রচণ্ড আওয়াজ ও বোমার শকওয়েভ। ফেটে যায় ডুবুরির কানের পর্দা, তৈরি হয় মারাত্মক কংকাশন। কাছাকাছি বোমা বিস্ফোরণ হলে মৃত্যু নিশ্চিত।

পরবর্তী বিশ মিনিট পানির নিচে ফাটল একের পর এক গ্রেনেড। আওয়াজ মিলিয়ে যাওয়ার পর শোনা গেল ফেরির ইঞ্জিনের গর্জন। একমিনিট পর রওনা হলো বিশাল জাহাজ।

‘একটু পর ডক করবে,’ বলল তানিয়া।

‘খুশি হতাম জাপানে ফিরতে পারলে,’ বলল আসিফ। ‘রাজি আছি এখানে বসে থাকতে। তবে কপাল মন্দ, সবার সঙ্গে আমরাও নেমে যাচ্ছি কি না সেদিকে চোখ রাখবে কর্তৃপক্ষ।’

‘আর তারপর যখন দেখবে আমরা নেই, বা সাগরে পাবে না লাশ— তখন?’ আসিফের দিকে তাকাল তানিয়া।

‘নতুন করে আবারও খুঁজবে ফেরি, এবার তন্নতন্ন করে, ‘ বলল আসিফ। ‘এরপর কবে ফেরি আবার ফিরবে ওসাকায়, তারও ঠিক নেই। রয়ে যেতে পারি এখানে, অথবা প্রথম সুযোগে চেষ্টা করতে পারি নেমে পড়তে।’

‘আমার ভোট বেরিয়ে যাওয়ার পক্ষে,’ বলল তানিয়া। ‘হয়তো কোনও পিয়ারে বাঁধবে ফেরি। তখন নিচে ফেলবে নোঙর। তখন জড়িয়ে পেঁচিয়ে মরতে চাই না।’

‘নামার সময় লোহার ছোট্ট ঘরে প্রচণ্ড আওয়াজ করবে নোঙর,’ বলল আসিফ। ‘শেকলের প্যাচে পড়ে মরেও যেতে পারি। তবে এখান থেকে বেরিয়ে কার্গো হোল্ডে গেলে? এরই ভেতর ওই জায়গা সার্চ করেছে সৈনিকরা। ভাল দেখে একটা কন্টেইনারে উঠলে কেমন হয়?’

‘শুনে ভালই তো লাগছে,’ বলল তানিয়া, ‘চলো, সেটাই করি।’

নোঙরের লকার ছেড়ে পঁচিশ মিনিট ব্যয় করে কার্গো হোল্ডে পৌছুল সতর্ক আসিফ ও তানিয়া। খুঁজে নিল তালা ছাড়া এক কন্টেইনার। ভেতরে চারভাগের তিনভাগ ভরা চালের বস্তা। কিছু বস্তা সরিয়ে ওদের চারপাশে কন্টেইনারের ছাত পর্যন্ত নকল, উঁচু দেয়াল তৈরি করল ওরা। জাহাজে করে চাল নিলে বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা থাকে, তাই শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে কষ্ট হবে না ওদের।

এবার অপেক্ষার পালা।

একটু পর ডক করল ফেরি। মাল নামাতে এল একদল দক্ষ মজুর। দু’ঘণ্টা পর খুলে আবার আটকে দেয়া হলো কন্টেইনারের দরজা। ফোর্কলিফ্ট ভারী কন্টেইনার তুলল ফ্ল্যাটবেড ট্রাকে। জাহাজ থেকে নেমে গেল যান্ত্রিক দানব। থামল ঘণ্টাখানেক চলার পর।

তানিয়া নিচু গলায় বলল, ‘সরে এসেছি অন্তত দশ মাইল। আমরা আছি বোধহয় কোনও গুদামের ভেতর।’

আওয়াজ শোনার জন্যে কান খাড়া করল ওরা।

থমথম করছে চারপাশ।

‘চলো, দেখি কোথায় আছি,’ বলল তানিয়া।

বস্তা সরিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে কন্টেইনারের কোণে পৌঁছুল আসিফ। আগেই দেখেছে ওখানে আছে ভেন্টিলেশন স্লিট। চাপা স্বরে বলল ও, ‘আছি ওয়্যারহাউসে। চারপাশে শুধু সারি সারি কন্টেইনার।’

‘আশপাশে কেউ না থাকলে বেরিয়ে যাব।’

ভারী কিছু বস্তা সরিয়ে দরজা সামান্য ফাঁক করল ওরা। ছাতে জ্বলছে স্বল্প ওয়াটের বাতি।

দেখা গেল না কাউকে।

‘প্রথম সুযোগে ঢুকব আমেরিকান কনসুলেটে,’ বলল আসিফ, ‘ওখান থেকে নুমায় পাঠাব সংগ্রহ করা ডেটা।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *