আটাশ
ফেরির ওপরের ডেক থেকে শাংহাই বন্দর দেখছে আসিফ রেজা। দূর দিগন্তে হারিয়ে গেছে অত্যাধুনিক মেট্রোপলিস। নানাদিকে রঙিন নতুন বাড়ি। শহরের বুক চিরে গেছে হাই- স্পিড ট্রেনের লাইন, চওড়া সব রাস্তা। শাংহাই ঘুরে দেখার ইচ্ছে আছে আসিফের… যদি নামতে পারে জাহাজ থেকে।
‘হঠাৎ থামল কেন?’ জানতে চাইল তানিয়া।
বন্দরের ডক থেকে এক মাইল দূরে থেমেছে ফেরি। ওদেরকে পাশ কাটাচ্ছে একের পর এক মালবাহী জাহাজ। কোনওটা যাচ্ছে বন্দরে, আবার কোনওটা যাচ্ছে সাগরে। দু’ঘণ্টা আগে ফেরিতে উঠেছে পাইলট, তারপর রাজহাঁসের মত সাগরে বসে দুলছে ফেরি।
‘ব্যাপারটা বুঝছি না,’ বলল আসিফ, ‘ফেরির ইঞ্জিন চলছে। ওঠেনি মেইনটেন্যান্স ক্রু। দুনিয়ার সবচেয়ে ব্যস্ত বন্দর শাংহাই। পাইলট হয়তো অপেক্ষা করছে ডকে ভিড়তে।’
‘কেন যেন মনে হচ্ছে, এই থেমে যাওয়াটা স্বাভাবিক কিছু নয়,’ বলল তানিয়া।
সায় দিয়ে মাথা দোলাল আসিফ।
ডেকে উঠে নিচু গলায় আলাপ করছে কয়েক শত যাত্রী। বেশিরভাগই ফিরছে শাংহাই শহরে। দ্বিধা বা দুশ্চিন্তা নেই জাপানিস ব্যবসায়ী ও বিদেশি টুরিস্টদের মনে।
একটা ধূসর প্যাট্রল বোট আসতে দেখল সবাই। ওটায় রয়েছে মেশিনগান, ছোট কামান ও ভয়ঙ্করদর্শন মিসাইল র্যাক। পতাকা চিনা নেভির।
‘মনে হচ্ছে না বন্দরের কর্তৃপক্ষ।’ আসিফের হাত ধরল তানিয়া। ‘চলো, কেবিনে ফিরে কিছু খেয়ে নিই।’
‘তাই ভাল,’ বলল আসিফ। ‘তা ছাড়া, কেবিনে জরুরি কাজও আছে।’
কাঁধে ব্যাকপ্যাক তুলে ভিড় এড়িয়ে সুপারস্ট্রাকচারে ঢুকল ওরা। সরু সিঁড়ি বেয়ে নামল নিচের ডেকে। করিডোর ধরে হেঁটে পৌছে গেল ওদের কেবিনের কাছে। তখনই ইন্টারকমে শুনল ঘোষণা। প্রথমে প্রচার করা হলো চিনা ভাষায়, তারপর জাপানি ভাষায়, এরপর ইংরেজিতে। ‘যাত্রীগণ, ফিরে যান যে যার কেবিনে। পাসপোর্ট এবং মালামাল চেক হবে। তৈরি থাকুন।’
‘বুঝলাম,’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল আসিফ। ‘লুকিয়ে পড়তে হবে, অথবা নামতে হবে ফেরি থেকে।’
দরজা খুলে কেবিনের ছাতে গুঁতো না খেয়ে ভেতরে ঢুকল ও। পিছু নিল তানিয়া। ‘মনে হয় না কেবিনে থাকা ঠিক হবে।’
‘চট্ করে সারতে হবে একটা কাজ,’ জানালার পাশে পৌছে নিচের সাগর দেখল আসিফ। ‘আমাদের কপাল প্যাট্রল বোট ফেরির ওদিকে।’ তানিয়াকে হাতের ইশারায় কটের পায়া দেখাল ও। ‘ট্র্যান্সমিশন কেবল ওখানে বাঁধো।’
‘সাঁতার কেটে তীরে উঠব?’ জিজ্ঞেস করল তানিয়া।
‘বাধ্য হলে,’ বলল আসিফ, ‘হাত লাগাও। বেশি সময় পাব না।’
.
নিচের ডেকে মেইন হ্যাচের কাছে মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে আছেন ফেরির ক্যাপ্টেন, নার্ভাস। দেখছেন গ্যাংওয়ে নামিয়ে দেয়া হলো প্যাট্রল বোটের ডেকে। আটকে গেল লক। ফেরিতে উঠল বিশজন সৈনিক। পেছনে ক’জন অফিসার ও সিভিলিয়ান পোশাক পরা এক লোক।
কর্তৃপক্ষ হঠাৎ করে যে আটকে দিয়েছে ফেরি, এ নিয়ে প্রশ্ন তোলেননি ক্যাপ্টেন। ভাল করেই জানেন, বাড়তি কথা বললে বিপদে পড়বেন। এতেই সন্তুষ্ট, বেআইনী কোনও মাল নেই তাঁর ফেরিতে।
সৈনিক ও অফিসারদের পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন সাদা পোশাক পরা বয়স্ক ভদ্রলোক। সুট আরামদায়ক হলেও স্টাইলিশ নয়, কুঁচকে আছে। এগোতে গিয়ে ভারসাম্য টলে যাওয়ায় ধরলেন রেলিং। উঠে এলেন ফেরিতে। অ্যাটেনশন হয়ে দাঁড়াল সৈনিক ও অফিসাররা। নরম সুরে ক্যাপ্টেনকে বললেন বৃদ্ধ, ‘আমার নাম যেইন নিং।’
আরও নার্ভাস হলেন ক্যাপ্টেন। অত্যন্ত জরুরি কোনও কারণ দেখা না দিলে বন্দরের পুরনো ফেরিতে ওঠে না পার্টি অফিশিয়ালরা। প্রথম প্যাট্রলে বের হওয়া ক্যাডেটের মত অ্যাটেনশন হয়ে দাঁড়ালেন ক্যাপ্টেন। মাথার চুল বেয়ে সরসর করে কপালে নামছে ঘাম। ‘আমার সৌভাগ্য যে এ ফেরিতে পা রেখেছেন, মন্ত্রী মহাদয়। আপনার যে-কোনও নির্দেশের জন্যে আমি তৈরি। আজ কী করতে পারি পার্টির জন্যে?’
দয়ালু হাসল নিং। ‘দুশ্চিন্তা করবেন না, ক্যাপ্টেন। শুধু দেখুন, যাতে ফেরি থেকে কেউ নেমে যেতে না পারে। আপনার দুই যাত্রীকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে আমার লোক।’
কোটের পকেট থেকে ভাঁজ করা কাগজ নিয়ে ওটা ক্যাপ্টেনের হাতে দিল মন্ত্রী যেইন নিং। ওখানে হলদে রঙে হাইলাইট করা দুটো নাম। ক্যাপ্টেন আগে কখনও এসব নাম শোনেননি। পার্সারকে ডাক দিলেন তিনি। জানা গেল ওই দু’যাত্রীর কেবিনের নম্বর। ‘আমি নিজে আপনাকে ওখানে নিয়ে যাচ্ছি,’ মন্ত্রীকে বললেন ক্যাপ্টেন।
তিন ডেক ওপরে উঠে এল সবাই। হাঁটছে মেইন করিডোর ধরে। গটগট করে হাঁটছেন ক্যাপ্টেন। পেছনেই সৈনিক ও অফিসাররা। বিস্মিত চোখে তাদেরকে দেখছে সাধারণ যাত্রীরা। ভয় পেয়ে সরে যাচ্ছে পথ ছেড়ে।
একবার কাঁধের ওপর দিয়ে দেখলেন ক্যাপ্টেন। পেছনে এখন তিনভাগের একভাগ সৈনিক। অন্যরা বোধহয় আটকে দিয়েছে জাহাজ থেকে নামার সব পথ।
দু’পাশের কেবিনের দরজায় সাঁটা নম্বর দেখতে দেখতে চলেছেন ক্যাপ্টেন। একটু পর থামলেন নির্দিষ্ট কেবিনের সামনে। ‘এই যে, এটাই,’ সরে দাঁড়ালেন তিনি।
এক অফিসারের দিকে ইশারা করল যেইন নিং। তাতে দরজার আরেকপাশে থামল সৈনিকরা। হাতে উদ্যত সাবমেশিন গান ও ব্যাটন। পিছিয়ে গেল মোষের মত এক সৈনিক, তারপর দৌড়ে গিয়ে প্রচণ্ড লাথি মারল দরজার হ্যাণ্ডেলের ওপর। মড়াৎ করে ভাঙল তালা। দৌড়ে ব্যাটন হাতে ভেতরে ঢুকল দুই সৈনিক।
এল না কোনও প্রতিরোধ।
কেবিন সার্চ করতে লাগল সৈনিকরা। খুঁজে দেখল ছোট্ট বাথরুম আর ক্লসিট।
একটু পর কেবিন থেকে বেরোল এক সৈনিক। ‘কেউ নেই, স্যর।’
এবার ছোট্ট কেবিনে পা রাখল যেইন নিং। পিছু নিলেন ক্যাপ্টেন। তচনচ হয়েছে কেবিন। উল্টে পড়ে আছে আসবাবপত্র, মেঝেতে দু’জনের বুটজুতো, পোশাক ও দুটো ব্যাকপ্যাক। তাড়াহুড়া করে পালিয়ে গেছে যাত্রীরা।
খাটের পায়ার সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে কালো একটা সরু কেবল। সোজা গেছে কেবিনের জানালার পর্দার ওদিকে। ‘কেবলে হাত রেখে জানালার কাছে গিয়ে পর্দা সরাল নিং। মুচড়ে ভাঙা হয়েছে হালকা অ্যালিউমিনিয়ামের ফ্রেম। নিচের সাগরে উঁকি দিল ক্ষমতাশালী মন্ত্রী।
ক্ষয়-ক্ষতি দেখলেন ক্যাপ্টেন। ‘জানালা খুলত মাত্র আট ইঞ্চি।’
‘ঠিক। বেরোবার তুলনায় বেশ ছোট ছিল,’ বলল যেইন নিং।
বাইরে তাকালেন ক্যাপ্টেন। জাহাজ থেকে বন্দরের কালচে সাগরে নেমেছে কেবল। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে কী হয়েছে। অফিসারদের উদ্দেশে বলল নিং, ‘ওরা পানিতে নেমেছে। বোট নিয়ে সার্চ করবে। পালাতে যেন না পারে।’
‘তীর এক মাইল দূরে,’ জবাবে বলল এক অফিসার। স্রোত খুব জোরালো। তার ওপর বছরের এ সময়ে পানি বরফের মত ঠাণ্ডা। সাঁতরে তীরে উঠতে গেলে ডুবে মরবে।’
মাথা নাড়ল যেইন নিং। ‘এরা নুমার লোক। প্রশিক্ষিত ডাইভার। মাইলের পর মাইল সাঁতরাতে পারে। তা ছাড়া, তাদের সঙ্গে হয়তো থাকবে দরকারি ইকুইপমেন্ট, যেমন কম্প্যাক্ট রিব্রিদার বা অক্সিজেন বটল। এদেরকে ছোট চোখে দেখতে যাওয়া মস্তবড় ভুল হবে। আমি চাই তীরে টহল দেবে পুলিশের লোক। প্রয়োজনে সার্চ করার জন্যে যে-কোনও পরিমাণের বোট রেকুইযিশন করতে পারো।’
মন্ত্রীর কথায় বেল্ট থেকে রেডিয়ো নিয়ে নির্দেশ দিতে লাগল এক অফিসার। আরেকবার কেবিন দেখল যেইন নিং, তারপর ব্যাকপ্যাক দ্বিতীয়বার সার্চ করিয়ে বেরিয়ে গেল কেবিন ছেড়ে। পিছু নিল সৈনিকরা। কেবিনে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন ফেরির ক্যাপ্টেন। জানালা দিয়ে আবারও দেখলেন সাগর। কোথাও নেই কোনও সাঁতারু। শুনলেন ফেরির ওদিক থেকে এদিকে আসছে নেভির বোট।
আমেরিকার এজেন্ট… নুমার লোক… প্রশিক্ষিত ডুবুরি… পার্টির বড় মাপের কর্মকর্তা ফেরিতে… বহু বছরের পর এত উত্তেজনার ছোঁয়া লেগেছে ক্যাপ্টেনের মনে। ভাবতে লাগলেন এবার কী করবেন। তবে দ্বিতীয়বার চিন্তা করতেই বুঝলেন, মুখ বন্ধ রাখা ভাল। তিনি আসলে কিছুই জানেন না, এমন ভাব করাই বুদ্ধিমানের কাজ।