সাতাশ
বেইজিঙের আকাশ গাঢ় ধূসর, ঝরঝর ঝরছে পেঁজা তুলোর মত ধবল তুষার। তিয়েনানমেন স্কয়্যার পার হয়ে হাঁটছে যেইন নিং। একটু দূরেই ফারের হ্যাট ও গাঢ় সবুজ আলখেল্লা পরে মাও সেতুঙের সমাধি পাহারা দিচ্ছে চিনা সৈনিকরা।
তাদের পাশ কাটাবার সময় পুরনো কৌতুক মনে পড়তেই হাসল যেইন নিং। ওই সমাধিতে সৈনিক আছে চোর-ডাকাত ঠেকাতে, নাকি আটকে রাখতে চেয়ারম্যান মাও-এর ভূতটাকে?
পরের কথাই ঠিক। আড়াই দশকেরও আগে হারিয়ে গেছে মাও-এর কমিউনিযম। চিন এখন দুনিয়া-সেরা উদ্যমে ভরা পুঁজিবাদী দেশ। নিং-এর দৃষ্টিতে আপাতত এ দেশ এমন হলেও ভবিষ্যতে জয় করে নেবে গোটা পৃথিবী।
নামকরা এক জায়গা পাশ কাটাল যেইন নিং। ওখানে নিঃসঙ্গ এক প্রতিবাদী রুখে দাঁড়িয়েছিল বলে তাকে পিষে দেয় মাও সেতুঙের সেনাবাহিনীর যুদ্ধ ট্যাঙ্ক। কোথাও নেই মানুষটার নামে কোন স্তম্ভ। কিন্তু পৃথিবীর সাধারণ শান্তিপ্রিয়, মুক্তিকামী মানুষের হৃদয়ে রয়ে গেছে সে চিরকালের জন্যে।
স্কয়্যারের পশ্চিমে যেইন নিঙের গন্তব্য। ওটা বিশাল দালান। তিন ধাপের সিঁড়ি বেয়ে আকাশ-ছোঁয়া মার্বেল কলামের মাঝ দিয়ে গ্রেট হল অভ দ্য পিপল-এ ঢুকল বৃদ্ধ।
চওড়ায় হাজার ফুটেরও বেশি এ দৈত্যাকার ভবন, সামনে থেকে শুরু করে পেছন দিক পর্যন্ত ছয় শত ফুট। মস্ত ছাত প্রায় দু’মিলিয়ন স্কয়্যার ফিটের— আমেরিকার ক্যাপিটল বিল্ডিং, ব্রিটেনের ওয়েস্টমিন্স্টার বা ওয়াশিংটন ডি.সি.-র মলের স্মিথসনিয়ান মিউযিয়ামের চেয়েও বড়।
গ্রেট হল অভ দ্য পিপল-এর বুকে আছে প্রমাণ আকারের কয়েকটি অডিটোরিয়াম, এক শ’র বেশি অফিস, কনফারেন্স রুম ও ওঅর্ক এরিয়া। চাইনি কমিউনিস্ট পার্টি থেকে দালানের দক্ষিণে যেইন নিংকে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে বিলাসবহুল অফিস। ক্ষমতাশালী মানুষ, তাকে দেখে আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়াল গার্ডরা। বিনা দ্বিধায় পেরোল সে চেকপয়েন্ট। করিডোর শেষে দেখল তার অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে আছে পুরনো এক বন্ধু।
‘হ্যাঁ, অ্যাডমিরাল, বহু দিন পর দেখা,’ অফিসের দরজায় থামল যেইন নিং।
‘একটা খবর দিতে এসেছি,’ বললেন অ্যাডমিরাল। ওটাকে সতর্কবাণীও বলতে পারেন।’
চাইনিয় কমিউনিস্ট পার্টির ভেতর প্রচণ্ড ক্ষমতা যেইন নিং- এর। তবে পার্টির কেউ কেউ মনে করেন, ভবিষ্যতেও চিনের অর্থনৈতিক গতি এমনই হবে। তাই দরকার নেই বাড়তি প্রচেষ্টার। অবশ্য, নিং মনে করে, ওসব লোকের ধারণা নেই মহাচিনের রাশ টেনে ধরেছে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা।
‘সতর্কবাণী?’ বলল নিং। ‘তা কি ব্যক্তিগত? নাকি অন্য কোনও বিষয়ে?’
‘দুটোই,’ বললেন অ্যাডমিরাল,
ভেতরে গিয়ে আলাপ করা উচিত।’
‘আমাদের বোধহয় দরজা খুলে অফিসে ঢুকল যেইন নিং। অ্যাডমিরালকে নিয়ে বাইরের অফিস পার হয়ে প্রবেশ করল ব্যক্তিগত কক্ষে। এ কামরার একপাশে হটহাউস। ঝুলন্ত টবে নানান গাছ ও লতা। অন্যপাশে প্রাচীন আসবাবপত্র। টেবিলে গাদি করে রাখা পুরনো সব বই।
নরম গদিওয়ালা চেয়ারে বসতে ইশারা করল নিং। অ্যাডমিরাল যেং বসতেই তাঁকে পাত্তা না দিয়ে দেখল প্রিয় গাছগুলোকে। দুঃখিত স্বরে বলল, ‘গরম ওদের জন্যে ভাল নয়। শুকিয়ে যায় পাতা। তবে ঠাণ্ডাও খারাপ।’
‘আমাদের মতই সমস্যা,’ বললেন অ্যাডমিরাল। একটু বিরতি নিয়ে জানতে চাইলেন, ‘আপনি কি কখনও অবসরে যাওয়ার কথা ভেবেছেন?’
টব থেকে শুকনো পাতা নিয়ে ওয়েস্ট বাস্কেটে ফেলল নিং। ‘আমার মত মানুষের অবসরে যাওয়ার সুযোগ থাকে না। দায়িত্ব পালন করতে করতেই একসময়ে বিদায় নেব। মারা যাব অথবা খুন হব।’
‘ঠিক, খুন হব বড় ভুল করলে,’ হাসলেন অ্যাডমিরাল।
পাল্টা হাসল নিং। ঠিকই বলেছে অ্যাডমিরাল। বড় ধরনের ভুল হলে দ্বিতীয়বার সুযোগ নেই চিনের রাজনৈতিক আঙিনায়। ‘আপনি বলছেন সেরকম কোনও ভুল করেছি?’
‘গুঞ্জন উঠেছে লো হুয়াং লিটন আর আপনাকে নি বললেন অ্যাডমিরাল, ‘আসলে সবার চোখ এখন আপনাদের পুব চিন সাগরের অপারেশনের ওপর।’
‘তো?’ মাথা নাড়ল নিং। ‘ওটা একটা এক্সপেরিমেন্ট। বন্ধ করে দেয়া হয়েছে এক বছর আগে।’
‘তা ঠিক,’ বললেন অ্যাডমিরাল, ‘এবং তারপর আপনার অনুরোধ পেয়ে এক বছর ধরে পাহারা দিচ্ছি ওই এলাকা। জানি না, আপনার লোক ওখানে কী করেছে, তবে অনেকের চোখ এখন ওদিকে। নানান প্রশ্ন তুলছে তারা।’
‘আসলে কী বলতে চান, অ্যাডমিরাল?’
‘প্রথমেই বলব ফিশারির কথা। বাঁচতে হলে এক শ’ পাঁচ কোটি লোকের চাই প্রচুর খাবার। আমাদের ফিশিং ফ্লিট পৃথিবীর সবচেয়ে বড়। দুনিয়ার প্রায় সব সাগরে মাছ ধরছে হাজার হাজার ট্রলার। আর চিনের পুব সাগর ছিল সবচেয়ে উর্বর এলাকা। এখন আর তা বলতে পারবে না কেউ। আপনার এক্সপেরিমেন্ট শুরু হওয়ার পর প্রতি মাসে কমেছে মাছ উত্তোলন। বন্ধ্যা হয়েছে ওই সাগর। ওখানে যারা ট্রলার নিয়ে মাছ ধরত, জোরেশোরে অভিযোগ তুলছে তারা।
‘জেলেদের কাছে কৈফিয়ত দিতে হয় না আমাকে,’ ঠাণ্ডা গলায় বলল নিং, ‘তা ছাড়া, আমাদের এক্সপেরিমেন্ট ছিল সাগরতলে। বলতে পারেন ডিপ-সি মাইনিং। আপনি এটা ভাল করেই জানেন। আমরা কোনওদিক থেকেই সাগরের ইকোসিস্টেমের ক্ষতি করিনি। তবে শাংহাই শহরের দশ হাজার ফ্যাক্টরির দূষণের ফলে এমন হতেই পারে। এক বছর আগের ছোট্ট এক অপারেশনের জন্যে নয়।’
এ জবাবই পাবেন ভেবেছেন অ্যাডমিরাল হ্যাং যেং। ‘আপনি কি বন্ধ করেছিলেন ওই অপারেশন?’
‘আমার তো তা-ই ধারণা।
‘তা হলে কেন আমাদের নিষিদ্ধ এলাকায় গোপনে ঢুকল আমেরিকান সাবমারসিবল?’
কথাটা শুনে হোঁচট খেল নিং। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘ওই একই প্রশ্ন আমিও তুলতে পারি, অ্যাডমিরাল আপনারই দায়িত্ব, যাতে ওদিকে কেউ ঘুরঘুর না করে। …কবে হয়েছে এমন?’
‘আজ সকালে,’ বললেন অ্যাডমিরাল। ‘আমাদের চেনা আমেরিকান এক ফ্রিকোয়েন্সি থেকে দেয়া হয়েছে কোডেড শর্ট রেঞ্জ ট্র্যান্সমিশন। তার ওপর আমাদের সোনার বয়া থেকে জানা গেছে, ওদিকে গোপনে গেছে কোনও ভেসেল। তবে ওটা কোথায় আছে বোঝার আগেই হারিয়ে যায়।’
রাগ ছাপিয়ে দুশ্চিন্তা আসতেই নিং বলল, ‘কী করে আপনাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেদ করে ওদিকে গেল আমেরিকান সাবমেরিন?
‘ওটা নেভাল ভেসেল ছিল না,’ বললেন অ্যাডমিরাল। ‘খুব ছোট সিগনেচার। দূর থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হয় সেই সাবমেরিন।’
‘তার মানে, কোনও জাহাজ থেকে নামিয়েছে, অথবা ফেলা হয়েছে বিমান থেকে,’ বলল নিং। ‘আমি আবারও জানতে চাইব, ওটাকে ঠেকানো গেল না কেন?’
ব্যর্থতার জন্যে অন্যায়ভাবে অভিযোগ হানা হচ্ছে, টের পেলেন অ্যাডমিরাল হ্যাং যেং। ‘আমি এটা বলতে পারি, কমরেড, আমাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় নাক গলাতে আসেনি কোনও আমেরিকান এয়ারক্রাফ্ট বা ভেসেল। তবে আমরা জানি, গোপনে ওখানে গেছে কোনও রোভ।’
বড় করে দম নিল নিং। এখনও বন্ধুই আছে অ্যাডমিরাল, নইলে নিজে এসে এসব বলত না। মিথ্যা বলার কারণ নেই। সিকিউরিটি ফোর্সের দোষে চিনা এলাকায় আমেরিকানরা ঢুকলে, নিজেদেরকে রক্ষা করতে এ ধরনের রিপোর্ট পুড়িয়ে ফেলত অ্যাডমিরাল। বা মুছে দিত সব ডেটা। ‘আপনি তা হলে বলছেন ওই এলাকায় আমেরিকান কোনও জাহাজ নেই?’
‘না, নেই।
জবাব পেয়েছে নিং। পুরনো বন্ধুর দিকে অভিযোগের আঙুল তাক করার আগে উচিত ছিল সতর্ক হওয়া। সূত্র দিয়েছে অ্যাডমিরাল। ওই সাবমারসিবল ছোট। অপারেট করা হয়েছে কোনও জাহাজ থেকে। আশপাশে ছিল না কোনও আমেরিকান জাহাজ বা সাবমেরিন। অর্থাৎ, ওই রোভ ছিল’ নুমার। গত দু’এক দিন আগে ওই সংস্থা থেকে জাপানে এক জিয়োলজিস্টের সঙ্গে দেখা করতে গেছে এক বাঙালি জিয়োলজিস্ট, তার স্ত্রী এবং আরও দু’জন। তবে তারা নুমা এজেণ্ট নয়। চারজনই ছিল বাংলাদেশি।
তাদেরকে পৃথিবী থেকে বিদায় করতে ব্যর্থ হয়েছে লো হুয়াং। অথচ বলেছিল, মারা গেছে তারা। এবার নিজেই ব্যবস্থা নেবে নিং।
উঠে হাতের ইশারা করল সে। আপাতত মিটিং শেষ। ‘খুবই খুশি হয়েছি নিজে থেকে এসে সতর্ক করেছেন, অ্যাডমিরাল। এটা বলতে পারি, সাগরের নিচে এমন কিছু নেই, যেটা দেখে বা পেয়ে সন্দেহ করবে নুমা। আমাদের পক্ষ থেকে আমেরিকান সরকারকে জানানো হবে, তাদের সংস্থা বেআইনীভাবে প্রবেশ করেছে চিনের এলাকায়।’
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন অ্যাডমিরাল হ্যাং যেং। ‘সতর্ক থাকবেন, নিং। এই দেশ আর আগের মত নেই। বিত্তের সঙ্গে এসেছে ক্ষমতা। আর ওই বিত্ত এসেছে গত পঁচিশ বছরে। বদলে গেছে চিনা কমিউনিস্ট পার্টি। এখন পার্টির ভেতর যথেষ্ট ক্ষমতাশালী ভিন্ন একটি গ্রুপ, আপনি জানেন। হয়তো আপনাদের চেয়েও বেশি ক্ষমতাশালী ওরা। অর্থনৈতিক সাফল্যের কারণেই দিতে হচ্ছে এই মূল্য।’
অ্যাডমিরাল সতর্ক করছে, পরিষ্কার বুঝল যেইন নিং। অর্থনৈতিক রেললাইনে তুমুল বেগে ছুটছে এ দেশ। হঠাৎ যেন ছিটকে পড়ে না যায়, সেজন্যে যে-কোনও ব্যবস্থা নেবে চিনের বর্তমান বিত্তশালী মোগলরা। অবশ্য দুশ্চিন্তার কারণ নেই তাদের। নিং-এর প্ল্যান সফল হলে যে শুধু তীব্র বেগে ছুটবে চিনের ট্রেন, তা-ই নয়, মাইলের পর মাইল উন্মুক্ত রেললাইন দেখবে সবাই।
সহস্রবারের মত আবারও ভাবল নিং: তা-ই হবে, তবে প্রথমে দমাতে হবে বড় সব হুমকিগুলোকে।