বাইশ
ভিড়ের মাঝ দিয়ে এগোচ্ছে হিনা আর রানা, এমনসময় দপ্ করে জ্বলে উঠল এরিনার ফ্লাডলাইট।
‘লড়াই হবে কতক্ষণ পর?’ জানতে চাইল রানা।
‘আর বিশ মিনিট,’ বলল হিনা।
ক্যাসিনোয় ব্যস্ত হয়ে উঠল প্রায় সবাই, যে যার চিপ্ গুছিয়ে নিয়ে চলেছে লড়াই দেখতে।
ভিড়ের ভেতর দিয়ে চলেছে রানা। হিনা একটু পিছিয়ে পড়তেই বলল, ‘আমার পাশে থাকো।’
‘এরিনায় গেলে বিপদে পড়বেন,’ বলল হিনা, ‘ওরা চাইছে আপনি ওখানে যান।’
‘না গিয়ে উপায়ও নেই,’ বলল রানা। ‘তবে ওরা অত সহজে ধরতে পারবে না। আমাদের প্রথম কাজ হবে চোখের আড়ালে সরে যাওয়া।’
দূরে গোপন এক দরজা খুলতেই ওদিক থেকে বেরিয়ে এল এক ককটেল ওয়েট্রেস, হাতে ড্রিঙ্ক ভরা ট্রে।
‘বাড়ির পেছনদিক,’ বলল রানা, ‘সব হোটেলে থাকে।’
হিনাকে নিয়ে ওদিকে চলল ও। দরজা থেকে কিছুটা দূরে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়াল ওরা। অপেক্ষা করছে। একটু পর আবারও খুলে গেল দরজা। বেরোল আরেক ওয়েট্রেস। রানা বা হিনার দিকে না চেয়ে যাচ্ছে একটা টেবিলের দিকে দরজাটা বন্ধ হওয়ার আগেই ওদিকের করিডোরে ঢুকল রানা ও হিনা।
সার্ভিস করিডোর। দেয়ালে রঙের পোচ নেই। একটু দূরের দরজার ওদিকে ড্রিঙ্ক স্টেশন। আগের ঘরটা লকার রুম। করিডোরের বাঁক থেকে এল পায়ের আওয়াজ। দ্রুত পায়ে লকার রুমে ঢুকল রানা ও হিনা। পেছনে আটকে নিল দরজা।
হাই-হিলের খট-খট তুলে করিডোরের দূরে মিলিয়ে গেল পদশব্দ। নিচু গলায় হিনাকে বলল রানা, ‘তুমি এসেছিলে প্রতিশোধ নিতে। কী করবে ভেবেছিলে?’
অভিজাত ড্রেসের ছোট্ট এক পকেট থেকে চামড়ার পাউচ বের করল হিনা। ওটা থেকে নিল প্লাস্টিকের ভায়াল। ঢাকনি খুলতেই দেখা গেল কয়েকটা সাদা বড়ি।
‘বিষ,’ বড়ি বের করে বলল হিনা। ‘ধীরে ধীরে মরবে। তার আগেই ক্লাব ছেড়ে বেরিয়ে যেতাম। কেউ জানত না কে করেছে কাজটা।’
‘দাও, জরুরি কাজে লাগবে,’ বলল রানা।
ভায়ালের ভেতর বড়ি রেখে ওটা ওর হাতে দিল হিনা। ‘ভাবছেন কাজে লাগবে?’
‘একে-৪৭ তো পাব না, এগুলোই ভরসা,’ বলল রানা। ‘এবার লাগবে ওয়েট্রেসের পোশাক।’
‘আপনাকে বেশ আত্মবিশ্বাসী মনে হচ্ছে,’ বলল হিনা। -’আত্মবিশ্বাস না থাকলে সফল হওয়া কঠিন,’ বলল রানা, ‘গিয়ে দেখা করব ক্লাব ম্যানেজারের সঙ্গে। আশা করি আমাদের দিকটা দেখবে সে। তবে তার সঙ্গে দেখা করার আগে লকার থেকে নিয়ে পরো ককটেইল সার্ভার ইউনিফর্ম।’
কয়েকটা লকার খোলার পর বামেরটায় ওয়েট্রেসদের পোশাক পেল হিনা। যাতে পোশাক পাল্টাতে গিয়ে লজ্জা পেতে না হয় মেয়েটাকে, তাই ঘুরে দাঁড়াল রানা। ঘাঁটতে লাগল একের পর এক লকার। কয়েকটা দেখার পর পেল দরকারি বোতল। পকেটে রেখে দিল। পোশাক পাল্টে ঘুরে দাঁড়িয়ে জানতে চাইল হিনা, ‘আপনি পোশাক পাল্টে নেবেন না?’
‘আপাতত না, বলল রানা।
‘কিন্তু আপনার সাদা কোট তো ধরিয়ে দেবে,’ বলল মেয়েটা। ‘দেখলেই ছুটে আসবে…
‘আমিও তো তা-ই চাই,’ বলল গম্ভীর রানা।
.
এরিনার নিচে লকার রুমে আনা হয়েছে সোহেলকে। পরতে হবে মার্শাল আর্ট প্রতিযোগিতার পাতলা আলখেল্লা। দেখানো হলো অ্যাথলেটিক কয়েকটি গিয়ার।
হাতির মত এক লোকের কাছে জিজ্ঞেস করল সোহেল, ‘বর্মটম নেই? মধ্যযুগীয়?’
আরও গম্ভীর হলো প্রহরীরা। ক্লাব ম্যানেজার গোখারো নাগিনো বলেছে, পোশাক পরা শেষ হলে এরিনায় নেবে লোকটাকে। তেড়িবেড়ি করলে চ্যাংদোলা করে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলবে ওখানে।
উপায় নেই দেখে দুই পিসের মার্শাল আর্ট ইউনিফর্ম পরল সোহেল। ঊর্ধ্বাঙ্গের পোশাকে ভি আকৃতির নেক-কলার। প্যান্টের কোমরে ইলাস্টিক ব্যাণ্ড। হামলা করতে বা তা ঠেকাতে ওকে দেখানো হলো কয়েকটা অস্ত্র। একটা নানচাক্কু নিয়ে সাঁই-সাঁই করে ডানে ও বামে ঘুরিয়ে নিল সোহেল। প্র্যাকটিস করেছিল ছোটবেলায়। ভাল করেই জানে, ঠিকভাবে ব্যবহার না করলে শত্রুর বদলে ওরই বারোটা বাজাবে জিনিসটা। ঠিক করল, নেবে না নানচাক্কু।
বদ্ধ দরজার ওদিক থেকে এল উত্তেজিত দর্শকের চিৎকার। আওয়াজ একবার বাড়ছে, আবার কমছে। জাপানি ভাষায় লাউড স্পিকারে বলা হচ্ছে: একটু পর শুরু হচ্ছে প্রথম বাউট।
‘অ্যাই, সময় হয়েছে,’ ধমকে উঠল এক গার্ড।
সোহেলকে ঠেলে নিয়ে চলল তারা। একজন খুলল দরজা। প্রতিযোগীকে দেখে বিকট শব্দে গর্জে উঠল দর্শকরা। ওপর থেকে আলো পড়ল সোহেলের ওপর।
পেছন থেকে ঠেলে র্যাম্পে তোলা হলো ওকে। উঠে এসে বৃত্তাকার এরিনা দেখল সোহেল। চারপাশে ছয় ফুট উঁচু দেয়াল। বুলফাইটের রিঙের মতই, তবে কাঠের তক্তার তৈরি মেঝে। জায়গায় জায়গায় শুকনো রক্তের দাগ।
‘খয়েরি দাগ দেখে অনেক বাড়ল সাহস,’ বিড়বিড় করল সোহেল। ওর দিকের প্রহরীকে বলল, ‘আমার ওপরেই বাজি ধরো। জিতলে অনেক টাকা পাবে। আমাকে অর্ধেক দিলেই হবে।’
জবাব না দিয়ে অন্যদিকে চেয়ে আছে লোকটা।
ওদিকে চেয়ে গলা শুকিয়ে গেল সোহেলের। দেয়ালের সরু ফাটল দিয়ে বেরিয়ে এসেছে মস্তবড় এক দানব!
লোকটা দৈর্ঘ্যে হবে ছয় ফুট দশ ইঞ্চি। ঘাড় থেকে শুরু করে গোড়ালি পর্যন্ত থোকা থোকা পেশি! বাইসনের মত শক্তিশালী কাঁধ ও ঘাড়! মুচড়ে রাখা দড়ির মত পেট! কোমরের পর গাছের গুঁড়ির মত দুই পা!
‘ওরেব্বাপ্স্!’ বিড়বিড় করল সোহেল। ‘তোমাকে দোষ দেব না। আরে, শালা, আমি নিজেই তো নিজের ওপর বাজি ধরব না!’
খল-খল করে হেসে উঠল পেছনের গার্ড। গলা শুকিয়ে গেছে সোহেলের, চট্ করে দেখল চারপাশ। বুকের ভেতর কে যেন বলল, ‘ভয় নেই, কাছেই থাকবে রানা। তুই শুধু যতক্ষণ পারিস টিকে থাক্।’
দানবের দিকে আবার তাকাল সোহেল। লোকটা ভারী। নড়াচড়ায় ধীর হবে। চট্ করে ধরতে পারবে না ওকে। এটাই বোধহয় ভাল হলো, মার্শাল আর্ট এক্সপার্ট প্রতিযোগী হলে প্রজাপতির মত এসে হামলা করত।
পেছন থেকে পিঠে ঠেলা দিয়ে রিঙের মাঝে পাঠানো হলো ওকে। বলা হলো অস্ত্র বেছে নিতে। একটা পোক্ত চেহারার লাঠি নিল ও। এমনই একটা দিয়ে কমোডো ড্রাগনের ওপর দিয়ে পার হয়ে গিয়েছিল। খাটো দুটো লাঠি নিল জাপানি হারকিউলিস।
একটা বেসুরো ট্রাম্পেট বাজতেই শুরু হলো বাউট।
দু’হাতে লাঠি বাগিয়ে তৈরি হলো সোহেল। বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে ওর দিকে আসছে দানব। কয়েকবার পেটে খোঁচা মেরে তার গতি কমিয়ে দিল সোহেল।
প্রথম দুটো গুঁতো পাঁজরে খেয়েও পাত্তা দিল না দানব। ভাব দেখে মনে হলো ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেবে সোহেল নামের মাছিটাকে। তৃতীয় খোঁচার সময় পাল্টা হামলা করল সে। গতি তার রকেটের মত। অত বিশাল লোক এভাবে তুমুল বেগে হামলা করবে, ভাবা যায়নি। বামহাতের লাঠি সাঁই করে নামল সোহেলের লাঠির ওপর। গতি এতই, খটাং শব্দে মেঝেতে লাগল ওর লাঠি। একইসময়ে সামনে বেড়ে সোজা সোহেলের মাথার তালু লক্ষ্য করে ডানহাতের লাঠি নামাল দানব।
ঝট্ করে নিচু হয়ে সরে মাথার ওপরে বাতাস কাটার সাঁইই শব্দ শুনল সোহেল। হৈ-হৈ করে উঠল দর্শকরা। মুখে হাত চাপা দিয়েছে মেয়েরা। পিছিয়ে গিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল সোহেল। নিচু গলায় বলল, ‘এত তাড়া কীসের? মাথা চুরমার করার আগে ওদেরকে একটু খেলা দেখতে দাও!’
নিরেট পাথরের মত চেহারা দানবের। মুখে নেই সামান্য হাসি। ভুরুও কোঁচকাল না। তেড়ে এল মেইল ট্রেনের মত।
মেঝেতে শুয়েই দানবের দু’পায়ের মাঝে লাঠি ভরে বেমক্কা মোচড় দিল সোহেল। অপ্রত্যাশিত হামলায় হাঁটু ভাঁজ হয়ে যাওয়ায় মেঝেতে পড়ল লোকটা।
শত্রুকে আহত না করেই তার অস্ত্র সরাতে চাইল সোহেল। ওর লাঠির বাড়ি খেয়ে দানবের ডানহাত থেকে ছিটকে গেল খাটো লাঠি। ওটা মিসাইলের মত তৃতীয় সারির সিটের দিকে আসছে দেখে প্রাণের ভয়ে সরে গেল কয়েকজন দর্শক।
এদিকে বাড়তি সময় পেয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে দানব। বুঝে গেছে, চাইলে তার মাথা ফাটাতে পারত অর্ধেক সাইযের লোকটা।
আবারও মুখোমুখি হওয়ার আগেই বাজল বেসুরো ট্রাম্পেট।
প্রথম রাউণ্ড শেষ।
সিটে গিয়ে বসল দানব। নিজের কোণে ফিরল সোহেল। অবাক চোখে ওকে দেখছে গার্ডরা। এক বোতল পানি নিয়ে ছিপি খুলে চুমুক দিল সোহেল। দু’ঢোক খাওয়ার পর অবশিষ্ট ঢালল মাথা ও বুকে। যতটা পারা যায় বিশ্রাম নিতে হবে। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসল।
প্রথমবারের মত দর্শকদের ভালভাবে দেখছে। খুব কাছেই তারা। বৃত্তাকার এরিনা ঘিরে ওপরে গেছে সারি সারি সিট। ওকে দেখছে অন্তত এক হাজার নিষ্ঠুর পুরুষ ও নারী। খালি নেই একটা সিট।
চোখে পড়ল না রানার পরিচিত মুখটা। প্রতিটি দরজায় একাধিক সশস্ত্র গার্ড। সিটগুলোর মাঝেও রয়েছে তারা। ফাইটিং এরিনায় ঢোকার উপায় নেই ওর প্রাণের বন্ধুর। গলা আরও শুকিয়ে গেল সোহেলের। বোধহয় এরইমধ্যে ধরা পড়েছে রানা। সেক্ষেত্রে বাঁচবে না ওরা। তবুও বুকের মাঝে কে যেন বলল, ‘দেখিস, রানা ঠিকই আসবে। মরতে দেবে না তোকে।’
যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষণ আশ! লড়াইয়ের জন্যে নতুন করে মানসিক প্রস্তুতি নিল সোহেল।
কয়েক মুহূর্ত পর বাজল ট্রাম্পেট।
শুরু হচ্ছে দুই নম্বর রাউণ্ড।
সিট ছেড়ে বিড়বিড় করল সোহেল, ‘রানা, দোস্ত, যা করার তাড়াতাড়ি! লড়ে বেশিক্ষণ টিকব না কিংকঙের সঙ্গে!’