উনিশ
পুরো একঘণ্টা ঘুরে ক্লাবের চারপাশ বুঝে নিয়েছে সোহেল, এখন ফিরছে পিয়ানোর অ্যালকোভের দিকে। আপাতত কোথায় যেন গেছে পিয়ানিস্ট। একাই সবাইকে মুগ্ধ করতে চাইছে বেহালাবাদক।
আশপাশে কোথাও রানাকে দেখল না সোহেল। সুন্দরী এক ওয়েট্রেসের কাছ থেকে শ্যাম্পেনের গ্লাস নিয়ে বসল লাউঞ্জ চেয়ারে। ভিড়ের দিকে পিঠ, কিন্তু পিয়ানোর চকচকে গা থেকে আসছে পেছনের প্রতিবিম্ব। ওদিকে না চেয়েও সবই দেখছে ও।
কেউ পাশ কাটাবার সময় দেখে নিচ্ছে মুখ। আশা করছে যে-কোনও সময়ে পৌঁছুবে রানা। কিন্তু একমিনিট পর অন্য কাউকে দেখল সোহেল। প্রায় ছুটতে ছুটতে ওর দিকেই আসছে লোকটা। হাতে কী যেন!
ধরা পড়েছে, বুঝল সোহেল। চেয়ার ছেড়ে না উঠে শান্ত রাখল নিজেকে। কাছে পৌছে গেছে খোদ শয়তানের মত দেখতে জাপানি। একেবারে শেষসময়ে চেয়ারে কাত হয়েই ওরে চিচিওয়ার মুখে গ্লাসের শ্যাম্পেন ছুঁড়ল সোহেল। অন্ধ হয়েছে জাপানি আততায়ী। ভাঙা গ্লাস সাঁই করে নামাল সোহেলের ঘাড় লক্ষ্য করে। কিন্তু একপাশে সরে চেয়ারের পুরু ফোমে গেঁথে গেল ও। তাতে রক্ষা নেই, ডানহাতে ওর ঘাড় পেঁচিয়ে ধরে হেডলক করল ওরে। সোহেলের উন্মুক্ত গলা লক্ষ্য করে নামল গ্লাস।
কাণ্ড দেখে হাঁ হয়ে গেছে সবাই।
কেউ কেউ পিছিয়ে গেছে কয়েক পা।
পেছন থেকে হামলা করেছে লোকটা। বিপদে পড়েছে সোহেল, দু’হাতে সরাবে ওরেকে, সে উপায় নেই। কিন্তু ওর প্রতিক্রিয়া নিখুঁত। বাম বাহু তুলে ঠেকিয়ে দিল ভাঙা গ্লাসের কাঁচের ছোরা। টাইটেনিয়াম বাহুতে লেগে আরও ঘুঁটো হলো ওটা। একইসময়ে ওরের কবজি ধরে অন্যহাতে ঘাতকের মাথার তালুর ওপর নামাল শ্যাম্পেনের গ্লাস।
কাঁচ ভাঙতেই ওরের কালো চুলের অরণ্য থেকে দরদর করে নামল রক্ত। প্রচণ্ড রাগে চিৎকার ছাড়ল আততায়ী। সোহেলের হাত থেকে ঝটকা দিয়ে ছুটিয়ে নিল হাত। এবার কণ্ঠনালীতে গাঁথবে অর্ধেক ভাঙা গ্লাস। কিন্তু তার চেয়ে অনেক দ্রুত সোহেল। ওরেকে নিজের দিকে টান না দিয়ে গ্র্যাণ্ড পিয়ানোতে পা বাধিয়ে নিজেই ছিটকে গেল পেছনে।
চেয়ারের ওপরের অংশ গুঁতো দিল ওরের পেটে। টলমল করে পেছাতে গিয়ে চিত হয়ে আছাড় খেল লোকটা। খটাং শব্দে মেঝেতে পড়েছে চেয়ার। কিন্তু পরের সেকেণ্ডে ছেড়ে দেয়া বাঁকা স্প্রিঙের মত উঠে দাঁড়াল সোহেল। ওর বাম পায়ের লাথি লাগল ওরের চোয়ালে। প্রেতাত্মার হাঁ করা মুখ থেকে ছিটকে বেরোল রক্ত ও লালা।
কয়েক গড়ান দিয়ে উঠে দাঁড়াল জাপানি ঘাতক। জিভ দিয়ে চাটতে শুরু করেছে রক্তাক্ত ঠোঁট।
চোখে চোখ রেখে হাতের ইশারায় কুকুরকে ডাকছে এমন সুরে বলল সোহেল, ‘আ-আ চু-চু!’
ষাঁড়ের মত তেড়ে এল চিচিওয়া। সোহেল ভেবেছিল ল্যাং মেরে মেঝেতে ফেলবে তাকে। কিন্তু গরিলার মত ওকে জড়িয়ে ধরল ঘাতক। মেঝেতে হুড়মুড় করে পড়ল দু’জন। ওপরে পড়েছে আততায়ী। কিন্তু গড়ান দিয়ে তার বুকে উঠে এল সোহেল। ডানহাতি ঘুষি মারল শত্রুর বাম গালে।
স্লিপার হোল্ডে ধরতে চাইল ওরে, কিন্তু তার পেটে ঠাস্ করে নামল সোহেলের কনুই। মুক্ত হয়ে ভাবতে শুরু করেছে এবার কী করবে, এমনসময় ওকে জাপ্টে ধরল বেশ ক’জন। তুলে নিল চ্যাংদোলা করে। চারপাশ থেকে ছুটে এসেছে ক্যাসিনোর সিকিউরিটি টিম। একই অবস্থা ওরে চিচিওয়ার।
হাত-পায়ের জঙ্গলের মাঝ থেকে নিজেকে ছুটিয়ে নিতে চাইল সোহেল। কিন্তু তখনই ওর পেটে লাগল শক্তিশালী বিদ্যুতের টেইয়ার। হঠাৎ নিজেকে হালকা মনে হলো ওর।
লবি থেকে সরিয়ে নিচ্ছে ওরে আর সোহেলকে। অবাক হয়ে ওদেরকে দেখছে দর্শকরা। একটু দূরে মস্ত এক হাঁ মেলে দাঁড়িয়ে আছে বেহালাবাদক।
ঝুলতে ঝুলতে যেতে যেতে ধমক দিল সোহেল, ‘আরে, হাঁদা, মুখে গুয়ের নীলমাছি ঢুকবে, মুখটা বন্ধ কর্!’
হুঁশ ফিরল বাদকের। সবাইকে শান্ত করতে হাতে তুলে নিল বেহালা।
পেছনের এক করিডোরে এনে বামের ঘরের মেঝেতে ধুপ্ করে ফেলা হলো সোহেলকে। কংক্রিটের চারদেয়ালে কোনও জানালা নেই। দরজা লোহার তৈরি।
‘ওই শালা কই?’ তিক্ত সুরে জানতে চাইল সোহেল, ‘এটা কোনও বিচার হলো?’
জবাব না দিয়ে ধুম্ শব্দে দরজা বন্ধ করে চলে গেল সিকিউরিটি টিমের লোকগুলো।
.
সোহেলের মতই চ্যাংদোলা করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ওরে চিচিওয়াকে। যারা বন্দি করেছে, জানেও না কাকে ধরেছে। প্রথম সুযোগে এক পা ছুটিয়ে নিয়ে হাঁটু দিয়ে জব্বর এক গুঁতো দিল সে এক গার্ডের পেটে। মেঝেতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে ককাতে লাগল লোকটা। তাতে ওরের পিঠে টেইয়ার ছোঁয়াল আরেক গার্ড। অবশ হয়ে গেল ঘাতক। একটা ঘরে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলা হলো মেঝেতে। এতে আরও রেগে গেল প্রেতাত্মা। পড়ে থাকল চুপ করে। ভাবছে: দাঁড়া, শালারা, এমন টাইট দেব না… মরার আগে বাপ ডাকবি আমাকে!
কিছুক্ষণ পড়ে থাকার পর উঠে বসল ওরে। ওর চোখ খুঁজছে অস্ত্র, কিন্তু ঘরে তেমন কিছুই নেই। রয়ে গেছে শুধু সোনালি চাকতি। ক্যাসিনোর নামকরা ও সম্মানিত গ্রাহকদের দেয়া হয় এই চিপ।
ওরে চিচিওয়া জাপানি বলেই বোধহয় দরজা বন্ধ করে চলে যায়নি সিকিউরিটির লোক। তার ওপর খুনিটার হাতে এখন সোনালি চিপ দেখে বিস্মিত চোখে পরস্পরের দিকে তাকাল তারা। নরম হাতে ওরেকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করল দু’জন মিলে। বসিয়ে দেয়া হলো একটা চেয়ারে।
সিকিউরিটির লোক কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই ঘরে ঢুকল দু’জন। প্রথমজন গোখারো নাগিনো। ইয়াকুযার মাঝারি পর্যায়ের নেতা, নিয়ন লাইট ক্যাসিনো ঠিকভাবে পরিচালনা করা তার কাজ। দ্বিতীয়জন বিলিয়নেয়ার লো হুয়াঙ লিটন।