1 of 2

মহাপ্লাবন – ১৭

সতেরো

একটু আগে ধূসর দিগন্তের ওদিকে ডুবে গেছে লালচে সূর্য। টোকিওর মেট্রো এরিয়া পেরিয়ে হাইওয়ে থেকে নেমে পড়ল ঝাঁ-চকচকে রুপালি বেন্টলি মিউলস্যান। অপেক্ষাকৃত সরু পথে গ্রাম্য এলাকার মাঝ দিয়ে চলেছে।

যে-কেউ বলবে গাড়িটা আলট্রা-লাক্স সেডান। পাঁচ শ’ হর্সপাওয়ারের ইঞ্জিন। নামকরা ব্রিটিশ অটোমেকারের নতুন ফ্ল্যাগশিপ। জাপানি গাড়ির তুলনায় মিউলস্যান আকারে বড়। আদুরে শিশুর মতই সুন্দর, ফোলা ডিযাইন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ গাড়ির ডিএনএ এসেছে অ্যাব্রাস্‌ ব্যাটল ট্যাঙ্কের কাছ থেকে। যেমন বিলাসবহুল, শক্তিশালী, তেমনি দ্রুতগামী। দাম তিন লাখ ডলার। সাদা, দামি চামড়া ও মেহগনি কাঠের ইন্টেরিয়ার দারুণ নিখুঁত।

এখন পেছন সিটে বসে আছে বিসিআই-এর তুখোড় দুই এজেন্ট মাসুদ রানা ও সোহেল আহমেদ। যেন উড়ে চলেছে বিমানে চেপে। নেই সামান্যতম আওয়াজ। চারপাশ নীরব। যে-কেউ ভাববে, সে আছে আরামদায়ক দোলনায়। সিট হেলিয়ে দিতেই রানার পায়ের নিচে উঠে এল ফুটরেস্ট।

রানার দেখাদেখি সিট নামিয়ে হেলান দিল সোহেলও, মাথার পেছনে দু’হাত। ‘বুঝলি, কপাল খারাপ, বিপজ্জনক মিশনে যাচ্ছি, নইলে আরামসে ঘুরে বেড়াতাম এই গাড়িতে চেপে।’

টোকিও শহরের সামান্য দূরে বেআইনী এক ক্যাসিনোর দিকে চলেছে ওরা। ওখানে বিপুল অঙ্কের টাকা লেনদেন হবে, জেনেছেন পুলিশ সুপারইণ্টেণ্ডেণ্ট উরোন হিমুরা। তবে তাঁর ইনফর্মার নিশ্চিত হয়ে বলতে পারেনি, ওই টাকার জন্যে ওখানে যাবে কি না ওরে চিচিওয়া। অবশ্য লোকেশন ও টাইমিং মিলে যাচ্ছে।

ওই ক্যাসিনোয় জুয়া খেলতে যেতে চান বাংলাদেশের মস্ত বড়লোক ব্যবসায়ী মাসুদ রানা ও সোহেল আহমেদ, তাই সরকারি ঘুষখোর আমলা ধরে ব্যবস্থা করেছেন হিমুরা। কাজটা কঠিন হলেও অসম্ভব ছিল না। তবে পরের কাজটা প্ৰায় দুঃসাধ্য। ভূত বা ওরের পকেটে ফেলতে হবে ট্র্যাকিং ডিভাইস, সে দায়িত্ব রানা ও সোহেলের।

‘কেউ সন্দেহ করলে প্রাণ নিয়ে বেরোতে পারবেন না ওখান থেকে,’ বললেন হিমুরা। ‘কাজেই খুব সাবধান।’

‘লাশদুটো যারাই দেখবে, বলতে বাধ্য হবে, দুর্দান্ত সুপুরুষ ছিল দুই যুবক,’ হাসল সোহেল। ‘তবে আমরা মরলে ওই ক্যাসিনোর কর্তৃপক্ষ বা খুনিরাও প্রাণে বাঁচবে না।’

‘ওরা ভয়ঙ্কর,’ বললেন পুলিশ সুপার। ‘টোকাও পড়বে না ওদের গায়ে।’

রানা ও সোহেল জানে, ওদের মৃত্যু হলে ক’দিন পর ওই ক্যাসিনোয় ঢুকবে বাঙালি ক’জন যুবক। দায়ী লোকগুলোকে খুন করে হারিয়ে যাবে কোথাও। জাপানি পুলিশ বা অন্য কোনও সংগঠন জানবে না কোথা থেকে এসেছিল তারা, গেছে কোথায়।

সোহেলের দামি পোশাক দেখল রানা। দৌড়বিদের মত শরীরে খাপে খাপে বসে গেছে আরমানির সিল্ক সুট। সরু ল্যাপেল। ভেতরে মেরুন রঙের শার্ট। চকচক করছে ক্লিন শেভড্ মুখ। দুর্দান্ত সাহসী এক হাসিখুশি যুবক।

রানার পরনে ডাবল ব্রেস্টেড সাদা ডিনার জ্যাকেট। কলারটা সিল্কের। সাদা শার্টের গলায় ছোট্ট বাউ টাই। ও-ও ক্লিন শেভড্। ক্রু-কাট কালো চুল।

নরম সুরে জানতে চাইল রানা, ‘নিয়ন সাইন আর কত দূরে?’

পুলিশ সুপার হিমুরার পরনে বড়লোকের ড্রাইভারের পোশাক। ড্রাইভিং সিট থেকে ঘুরে দেখলেন রানাকে। ‘আর বড়জোর পাঁচ মিনিট। আবারও বলছি, মস্ত বিপদ হতে পারে। ঝুঁকিটা না-ও নিতে পারেন। আগেই বলেছি, রক্তারক্তি না করে ওখানে ঢুকতে পারবে না পুলিশবাহিনী। সরকারের হর্তাকর্তারা চাইবেন না তেমন কিছু হোক।’

‘আমরা ঝামেলায় জড়াব না,’ বলল রানা, ‘আপনি যা বলেছেন, তাতে মনে হয়েছে খুব কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয় ওই ক্লাব। ওরে নিজেও সশস্ত্র থাকবে না।

‘আগ্নেয়াস্ত্র বা ছোরা ছাড়াও হাজার পথে খুন করতে পারে ওই লোক,’ বললেন হিমুরা। ‘খুন-জখম তার কাছে শিল্প। মনে রাখবেন, ট্র্যাকিং ডিভাইস প্ল্যান্টের সময় ভুলেও যেন টের না পায়।’

মৃদু মাথা দোলাল রানা। ওর বুক পকেটে রয়েছে দুটো কয়েন। সফিসটিকেটেড বিকন। ওই একইরকম দুটো আছে সোহেলের কাছে। ওরা ঠিক করেছে, প্রথম সুযোগে প্রেতাত্মার পকেটে ফেলবে বিকন কয়েন। যে লোক টাকা দেবে, তার পকেটেও রাখবে কয়েন। এরপর ভূত আর টাকা সরবরাহকারী ক্লাব থেকে বেরোলেই অনুসরণ করবে ওরা। এবং প্রথম সুযোগে তাদেরকে গ্রেফতার করবেন উবোন হিমুরা। যেহেতু লড়াইয়ের সময় সোহেলকে মুখোমুখি দেখেছে ওরে, তাই রানা ভাবছে, চেষ্টা করবে আগেই লোকটার পকেটে কয়েন রাখতে।

‘আমরা সতর্ক থাকব,’ বলল রানা, ‘জরুরি আর কোনও তথ্য?’

‘ক্লাবে ঢুকলে মনে হবে খুব নিয়ম মেনে চলছে সব,’ বললেন হিমুরা। ‘আমার ইনফর্মার তাদের তালিকায় তুলে দিয়েছে আপনাদের নাম। মিস্টার সোহেলকে তারা চিনবে চিটাগাঙের মস্তবড় জাহাজ বহরের মালিক হিসেবে। আপনি বাংলাদেশের রিয়েল এস্টেট ব্যবসার উজ্জ্বলতম নক্ষত্র। এবং বলাবাহুল্য, দু’জনই ঋণখেলাপি। ওয়েব সাইট, ঠিকানা বা ব্যাকগ্রাউণ্ড তৈরি শেষ। কেউ চেক করলে খুঁত পাবে না। অতীত জেনে নেবে তারা, তাই মালিকপক্ষ চাইবে আপনারা বসুন জুয়ার টেবিলে। নানা দেশের ক্যাসিনোয় বড় অঙ্কের জুয়া খেলে হেরেও মন খারাপ করেন না আপনারা।

‘মন খারাপ করব কেন,’ মৃদু হাসল রানা। পকেট ভরা বড় নোটের বাণ্ডিল। একেকজনের কাছে এখন এক মিলিয়ন ইয়েনের চেয়েও বেশি। অর্থাৎ, ওদের প্রত্যেকের কাছে রয়েছে অন্তত দশ হাজার ডলারেরও বেশি। কিন্তু এটা মাত্র শুরু। একবার ওরা হারতে শুরু করলে নিয়ন সাইনের স্টাফরা ধরে নেবে, এই দুই জুয়াড়ি খরচ করবে এর দশ গুণ। সম্মানের চোখে দেখা হবে রানা ও সোহেলকে।

‘ক্লাবের কোথায় ওরেকে পাব ভাবছেন?’ জানতে চাইল রানা।

‘বলা কঠিন,’ বললেন হিমুরা, ‘তবে যেমন নিষ্ঠুর লোক, আমি হলে আগে তাকে খুঁজতাম কমব্যাট এরিনায়।’

‘বক্সিং?’ বলল সোহেল। ‘ওটা খুব নিষ্ঠুরতা নয়।

‘হবে মাত্র একটা বক্সিং ম্যাচ,’ বললেন সুপার, ‘পাঁচ রাউণ্ড। ওটা মূল খেলার আগে গা গরম করে নেয়ার জন্যে। এরপর শুরু হবে রক্তাক্ত লড়াই। ওখানে কাউকে খুন হতে দেখলে অবাক হবেন না। ভুলেও বাধা দেবেন না কাউকে, নইলে ফাঁস হবে আপনাদের কাভার।’

‘লড়াই হবে মৃত্যু পর্যন্ত?’ জানতে চাইল রানা।

‘মৃত্যু পর্যন্ত লড়তে হবে, এমন নয়,’ বললেন হিমুরা। ‘কিন্তু ব্যবহার করা হবে যেসব অস্ত্র, সেগুলো দিয়ে অনায়াসেই খুন করা যায় যে-কাউকে। ছুরি, তলোয়ার, চেইন ইত্যাদি। লড়াই চলবে মরণপণ। যারা অন্যায় করেছে ইয়াকুযা সংগঠনের বিরুদ্ধে, বেশিরভাগ সময় লড়তে নামানো হয় তাদেরকেই। সোজা কথা: প্রমাণ করো তোমার প্রয়োজন আছে, নইলে মরো! যারা হারবে, তাদের কাউকে হয়তো দেখবেন করুণভাবে মরতে।’

পরের দু’মিনিট পেরোল নীরবতার মাঝে।

সিকি মাইল যাওয়ার পর দু’ফুটি, চওড়া একটা ইঁটের দেয়ালের পাশ দিয়ে চলল ওরা। ওই দেয়াল থেকে ওপরে উঠেছে লোহার দণ্ড দিয়ে তৈরি বারো ফুটি বেড়া। ওরা পৌঁছে গেছে নিয়ন সাইন ক্লাবের বিশাল গেটের সামনে।

সুট পরা সশস্ত্র ক’জন এগিয়ে এল ওদের দিকে। রানা ও সোহেলের ক্রেডেনশিয়াল দেখল তারা। আয়না ব্যবহার করে সার্চ করল গাড়ির নিচে। দুটো কুকুর চারপাশ শুঁকে বুঝল, বিস্ফোরক নেই। এরপর ছেড়ে দেয়া হলো রুপালি বেন্টলি মিউলস্যান গাড়িটাকে।

কারুকাজ করা বাগানের মাঝ দিয়ে গেছে ড্রাইভওয়ে। দু’পাশে অলঙ্কৃত লণ্ঠন। গাছ ভরা চেরি ফুল। বিশাল ক্লাব হাউসের কাছে পৌঁছে দারুণ সুন্দর কাঠের এক সেতুর ওপর উঠল ওরা। নিচে শান্ত জলের কোই পণ্ড।

মেইন বিল্ডিঙের সামনে পৌছুতেই থাকল না চারপাশে জাপানি সংস্কৃতির ছাপ। টিন্টেড কাঁচের তৈরি ফ্যাসাডটা মডার্ন ডিযাইনের, উঠেছে ত্রিশ ফুট। মাঝে মসৃণ কংক্রিটের দুটোতলা। নানান বাঁক নিয়ে দালানের পেছনের দু’দিক গিয়ে মিশেছে ঘন ঘাসে ছাওয়া টিলার বুকে।

‘আধুনিক বম শেল্টার,’ মন্তব্য করল রানা।

‘আল্ট্রা-এফিশিয়েন্ট বিল্ডিং ডিযাইন,’ বলল সোহেল, ‘মাটি থেকে তাপ নিয়ে ঠিক রাখছে বাড়ির টেম্পারেচার।’

‘দেখছেন ক্লাবের ওপর অংশ,’ বললেন হিমুরা, ‘এটা তৈরি করা হয়েছে স্টেডিয়ামের মত করে। বৃত্তাকার। মাঝে ফাঁকা জায়গা বা খোঁড়লের মত এরিনা। ওটা মাটির নিচে।’

এরিয়াল ফোটো দেখেছে রানা ও সোহেল। তখনও পুরো তৈরি হয়নি এই ক্লাব। বৃত্তাকার দালান আর পেছনের টিলার মাঝে গভীর খাদ। স্টেডিয়ামের মত এরিনা তৈরিতে বিপুল টাকা খরচ করতে হয়নি এদেরকে।

যে-কেউ বলবে, নিয়ন সাইন ক্লাব বড়লোকদের হোটেল। তবে ওই কাজে ব্যবহার হচ্ছে শুধু ওপরতলা। নিচতলায় রয়েছে বেআইনী সব ব্যবস্থা: জুয়া, পতিতালয় ও ড্রাগসের আখড়া। একেবারে নিচে কমব্যাট এরিনা। ওটা সদস্যদের মূল আকর্ষণ। দালানের ভেতরের দিকে যে-কোনও কাঁচের জানালা দিয়ে দেখা যাবে মরণপণ লড়াই।

এন্ট্রি ডোর চলে আসতেই গতি কমালেন পুলিশ সুপার। এগিয়ে এল এক ভ্যালে। কিন্তু তাকে হাতের ইশারায় বিদায় করে দরজা পেরিয়ে গাড়ি রাখলেন হিমুরা। ‘আশা করি বিপদ হবে না। কয়েনের কাজ শেষ হলে বেরিয়ে যাবেন। আমি থাকব ক্লাবের বাইরে গাড়ি নিয়ে।’ নেমে ভাল শোফারের মত পেছন দুই দরজা খুলে দিলেন তিনি।

আগে গাড়ি থেকে নামল রানা, আটকে নিয়েছে কোটের বোতাম। অপেক্ষা করল সোহেলের জন্যে। বিসিআই চিফ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর বেরোল অলসভঙ্গিতে।

দু’দরজা আটকে ড্রাইভিং সিটে চাপলেন হিমুরা। রওনা হয়ে গেলেন প্রধান গেটের দিকে।

তিন ধাপ সিঁড়ি বেয়ে কাঁচের দরজা ঠেলে লবিতে ঢুকল রানা ও সোহেল। যে-কোনও ফাইভ স্টার হোটেলের লবির মতই চারপাশ। মেঝে সাদা মার্বেলের। ছাত থেকে ঝুলছে স্ফটিকের ঝাড়বাতি। বাঁক নিয়ে পেছনের দু’দিকে গেছে বিশাল লবি। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে দামি, আধুনিক সব আসবাবপত্র। লবির একপাশে পিয়ানো ও বেহালা বাজাচ্ছে দুই গম্ভীর বাদক। শ্যাম্পেনের গ্লাস ভরা রুপার ট্রে হাতে নানাদিকে চলেছে প্রায় উলঙ্গ, দীর্ঘাঙ্গিনী সুন্দরীরা।

‘জায়গা মন্দ নয়,’ মন্তব্য করল সোহেল, ‘কিন্তু জানিস, কপাল মন্দ। নইলে কোনও সুন্দরীর বদলে শালা তুই কেন আমার পাশে!’

‘তাও তো তুই পেলি মানুষের সঙ্গ,’ গম্ভীর হয়ে বলল রানা। ‘আমি তো পাচ্ছি বাঁদরের।’

‘শালা, বেঈমান! আমি মরলে ঠিকই হু-হু করে কাঁদবি!’

তোর মরে কাজ নেই, এই পৃথিবীটা স্বর্গের মত ভাল হয়ে গেলে খুশি হবে না কেউ।’

সিকিউরিটি এরিয়ার মাঝ দিয়ে যেতে হলো ওদেরকে। মোবাইল ফোন নিয়ে রাখা হলো ছোট্ট দুটো লকারে। দেয়া হলো লকারের চাবি। ফিরে যাওয়ার সময় মোবাইল ফোন সংগ্রহ করবে ওরা। এরপর এয়ারপোর্টে যেসব ব্যাটারি চালিত যন্ত্র দিয়ে বডি স্ক্যান করা হয়, সেগুলো দিয়ে ওদের আগাপাছতলা দেখা হলো। রানার পাশে বিপবিপ করে উঠেছে স্ক্যানার। পকেট থেকে কয়েন ট্র্যান্সমিটার বের করে সিকিউরিটি গার্ডের নাকের কাছে ধরল রানা।

মুচকি হাসল লোকটা।

ওই কয়েন পাঁচ ইয়েন-এর। হলদেটে। মাঝে ফুটো। জাপানের সব জায়গায় ওটাকে ধরে নেয়া হয় সৌভাগ্যের চাবিকাঠি। বহুবার দেখেছে গার্ড। পাঁড় জুয়াড়ীরা নিজেদের কাছে রাখে।

‘কপাল খুলবে,’ গার্ডের দিকে একটা কয়েন বাড়িয়ে দিল রানা।

লোকটা মাথা নাড়ল। নেবে না।

আবারও পকেটে ট্র্যান্সমিটার রাখল রানা। সিকিউরিটি চেক শেষ হতেই পৌছে গেল কাছের হোস্টেসের সামনে। ট্রে থেকে শ্যাম্পেনের গ্লাস নিয়ে মিষ্টি হাসল মেয়েটার উদ্দেশে। ঘুরে তাকাল চারপাশে।

ক’মুহূর্ত পর ওর পাশে পৌঁছুল সোহেল। ‘এবার বল্ তো কী করব? আলাদা হয়ে খুঁজব ড্রাগনের কামড় খাওয়া গাধাটাকে?’

মাথা দোলাল ‘রানা। বামদিক দেখাল। ‘আমি যাব ওদিকে। ঘুরে দেখব প্রতিটা তলা। একসিট কোথায় সেটা দেখে রাখবি। দরকার হলে যেন সটকে পড়তে পারি। একঘণ্টার ভেতর দেখা না হলে ফিরব পিয়ানোর সামনে। মন খুলে খরচ কর্। যত জলদি ডুবে যাবি ঋণে, দ্রুত আমাদেরকে দেবে লড়াইয়ের এরিনায় প্রথম সারির সিট।’

ভিড়ে চোখ বোলাল সোহেল। ‘ঠিক আছে, পয়সা ওড়ালেই ভিড়ে যাবে অনেকে।’

লবির চারপাশ দেখল রানা। ওরে ওরফে প্রেতাত্মাকে চেনে না। কোথাও কারও তাড়াহুড়ো নেই। শ্যাম্পেনের গ্লাস হাতে ধীর পায়ে বামে চলল রানা।

.

আঙটি আকৃতির প্রকাণ্ড দালানে ভবঘুরে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে সোহেল। দেয়ালে ঝুলন্ত নানান শিল্প দেখে মুগ্ধ, এমন ভঙ্গি করে গোপনে চোখ রাখছে চারপাশে। ও নিজে ছাড়া আর কেউ দেখেনি ওরে চিচিওয়াকে। রানাকে তার মুখের বর্ণনা দিয়েছে সোহেল। কিন্তু তাকে চট্ করে চিনে ফেলবে রানা, সে সম্ভাবনা ক্ষীণ।

ওপরতলা ঘুরে দেখল সোহেল। দালানের ভেতর দিকে মেঝে থেকে শুরু করে ছাত পর্যন্ত কাঁচের দেয়াল। ওখানে গিয়ে কাঁচে নাক ঠেকিয়ে তাকাল ও। অন্তত চারতলা নিচে বৃত্তাকার কমব্যাট এরিনা। ছাতে গেঁথে রাখা ধাতব রিগিং থেকে ঝুলছে অসংখ্য ফ্লাডলাইট। গাদাগাদা বৈদ্যুতিক তারের পাশে একটা ক্যাটও অক।

নিভিয়ে রাখা হয়েছে গুচ্ছ-গুচ্ছ ফ্লাডলাইট।

এরিনা ঘিরে সারি সারি আরামদায়ক সিট।

কেউ নেই আশপাশে।

অন্য কোথাও খুঁজতে হবে নরাধম প্রেতাত্মাকে।

.

একতলা নিচে ক্যাসিনোয় পৌছে দ্বিতীয় গ্লাস শ্যাম্পেন নিল রানা। কোথাও নেই জ্বরে আক্রান্ত কোনও লোক। এবার দু’হাতে ওড়াবে জাপানিস ফেডারেল পুলিশের দেয়া ইয়েন।

বড় দানের কয়েকটা ব্ল্যাক জ্যাক টেবিল পাশ কাটাল রানা। চোখ খুঁজছে ক্র্যাপ্স গেম। ওখানে থাকবে জুয়াড়ীদের ভিড়। কিছু দূর যেতেই একদিকে দেখল, পুরনো আমলের জুয়ার মেশিন। ঘুরছে রুপালি ভারী বল। শব্দ তুলছে ঠং-ঠং। কেউ জিতলে দপ-দপ করে জ্বলছে নিয়ন বাতি। যারা ওখানে আটকে গেছে, এমন দৃষ্টিতে মেশিন দেখছে, যেন ওখানেই আছে মহাবিশ্বের সমস্ত রহস্যের সমাধান। ওর দিকে কারও নজর নেই, সবার চেহারা দেখে নিল রানা।

‘প্যাচিনকো?’ পরামর্শের সুরে বলল কেউ।

ঘুরে তাকাল রানা।

খোলা একটা মেশিনের দিকে ইশারা করছে দুর্দান্ত এক সুন্দরী।

‘আরিগেটো,’ ধন্যবাদ দিল রানা, ‘তবে আপাতত নয়।’

প্যাচিনকো হল পেরিয়ে পাইগাউ পোকার টেবিলের পাশে চেয়ার টেনে বসল রানা। ডিলারের দিকে এক মিলিয়ন ইয়েন দিতেই পেল স্বচ্ছ একগাদা চিপ্‌স্‌। বেশিরভাগ ঠেলল ব্যাটের ডানে। ঝড়ের বেগে এল তাস।

‘নাইন,’ রানার দিকে তাকাল সুন্দরী ডিলার। কয়েকটা তাস বাটার পর ওর রাখা চিপসের পাশে জমল আরও বেশ কিছু চিপ্‌স্‌।

মৃদু হাসল রানা। টেবিল থেকে সরাল না চিপ্‌স্‌। অপেক্ষা করছে পরের তাসের জন্যে। এবার পেল ন্যাচারাল নাইন। এই খেলায় ওটা সেরা তাস। হারাতে পারবে না কেউ। ডিলারের হাতে একটা আট। এক কম বলে হেরে গেছে সে। রানার চিপসের পাহাড় হয়ে উঠল উঁচু।

হারতে বসে হুড়মুড় করে জিততে শুরু করেছে রানা। অন্যদিকে বেট সরিয়ে অনেকগুলো চিপ্ বাজি রাখল ডিলারের ওপর। আসলে প্রতিযোগিতা করছে নিজের সঙ্গেই। পেল একটা চার। ডিলারের হাতে সাত। টেকনিকালি জিতেছে ডিলার, কিন্তু তাতে চিপসের ভাগ পেল রানা।

দ্বিগুণ হয়েছে ওর চিপ্‌স্। ওগুলো ওর দিকে ঠেলে দিল ডিলার। ‘টেবিল লিমিট,’ বলল সে। তিন দানে রানা পেয়েছে বাড়তি আট মিলিয়ন ইয়েন।

চিপসের পাহাড়ের দিকে তাকাল রানা। বিরক্ত হয়ে ভাবল, কপাল কাকে বলে, যখন জিততে চাই, হাজির হয় বাজে তাস, আর এখন হারতে চাইছি প্রাণপণে!

ছোট-বড় দানে খেলতে লাগল রানা। ভাবছে, দেখা যাক ভাগ্য মন্দ করা যায় কি না। প্রতি দানে মোটা অঙ্কের ইয়েন উপহার দিতে লাগল ডিলারকে। পরের দানের তাস হাতে পেতেই রানা টের পেল, কাঁধে টোকা দিয়েছে কেউ। নখ ম্যানিকিয়োর করা। ঘুরে তাকাল রানা। প্যাচিনকো লাউঞ্জের সেই সুন্দরী। প্যাচিনকো হল থেকে চলে এসেছে পিছু নিয়ে।

‘আপনি খুব ভাগ্যবান,’ বলল ডিলার মেয়েটা।

মৃদু হাসল রানা। চারপাশে চাউর হয়েছে, দারুণ কপাল নিয়ে এসেছে এক লোক।

‘ভালই লাগছে খেলা,’ বলল রানা। সুন্দরীর জন্যে ওর দিকে মনোযোগ কম দেবে সবাই। কমবে বিপদ। তা ছাড়া, মিশে যেতে পারবে অন্যদের সঙ্গে। চোখ রাখতে পারবে সবার ওপর।

পরের দানে হারল রানা, খুশি। কিন্তু এরই ভেতর যা পেয়েছে, সেসব হেরে তারপর ধার নিতে সময় লাগবে।

নতুন বাজি ধরল রানা। চোখ ঘুরছে ঘরের চারপাশে। কোথাও নেই ওরে চিচিওয়া। কিছুক্ষণ পর একটু দূরের এক টেবিলে দেখল একজনকে। সে আছে পিট বসের সামান্য আড়ালে। তবে ওই মুখ ভুলবে না রানা। আরও নিশ্চিত হতে ধোঁয়ার মাঝ দিয়ে চোখ কুঁচকে মেয়েটাকে দেখল রানা।

‘স্যর, আপনি আবারও জিতেছেন,’ বলল ডিলার।

‘তাই?’ বিড়বিড় করল রানা। দেখছে পিট বসের পাশের মেয়েটাকে।

মাস্টার শিমের সেই তরুণী বডিগার্ড!

পরনে এখন অভিজাত পোশাক, হাতে সরু সিগার।

রানা বুঝে গেল, হাতের তাসের ওপর দিয়ে চারপাশে চোখ রেখেছে হিনা। ক্যাসিনোয় তার উপস্থিতির কারণে যে- কোনও সময়ে মহাবিপদে পড়বে সোহেল আর ও!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *