1 of 2

মহাপ্লাবন – ১৫

পনেরো

‘পুরুষ, দৈর্ঘ্য ছয় ফুট,’ রোবটের মত আড়ষ্ট কণ্ঠে বলল চিনা টেকনিশিয়ান। পরনে সাদা ল্যাব কোট। চোখে চশমা। ন্যাড়া মাথা চকচক করছে কাঁচের সাদা বলের মত। নাম লোকটার সাবা সাবেলা, বিলিয়নেয়ার লো হুয়াং লিটনের ইঞ্জিনিয়ার দলের নেতা। ‘স্যর, আপনার কথা মত রাখা হয়েছে ত্বক। তবে এখনও মুখ বা চুল দিইনি আমরা।’

নাগাসাকি উপকূলে হাশিমা দ্বীপে নীরব, শীতল এক গোপন ফ্যাসিলিটির মাঝে চৌকো এক ঘরে দাঁড়িয়ে আছে বিলিয়নেয়ার। ছাতে জ্বলছে অত্যুজ্জ্বল সাদা বাতি। ঘরের মাঝে ধাতব টেবিলে পড়ে আছে মস্তক ছেদ করা একটা দেহ। গভীর মনোযোগে ওটাকে দেখল লো হুয়াং লিটন। মুণ্ডহীন ধড়ের ত্বক থেকে আসছে প্লাস্টিক পোড়া গন্ধ। একটু বেশি চকচক করছে। ‘না, নতুন করে কাজে নামুন। এখনও রয়ে গেছে অনেক বেশি খুঁত। বাজে ধরনের খুঁত।’

তর্ক করতে গেল না ইঞ্জিনিয়ার সাবা সাবেলা। অবশ্য চেহারায় প্রকাশ পেল অসন্তুষ্টি। নরম সুরে বলল, ‘বডি প্যানেল নিখুঁত করা জটিল কাজ। গায়ের পেশি আর ত্বক সত্যিকারের মানুষের মত নড়াচড়া করতে হবে। যতই থ্রি-ডি প্রিন্টিং প্রসেস ব্যবহার করা হোক, পলিমার দিয়ে সত্যিকারের মানুষের মত মাংস বা ত্বক তৈরি প্রায় অসম্ভব।’

‘আবারও বলছি, নিখুঁত হতে হবে কাজে,’ বলল লো হুয়াং, ‘অন্ধ লোকও বলবে এর ত্বক নকল। আর গা থেকে বেরোচ্ছে পোড়া প্লাস্টিকের দুর্গন্ধ। তা ছাড়া, কেউ স্পর্শ করলেই বুঝবে, এর হাত, পা বা শরীরে কোনও রোম নেই। নেই জন্মদাগ বা পুরনো ক্ষত। মানুষ এমন হয় না।’

‘এ কথা আমরা ভাবিইনি,’ অপরাধী সুরে বলল টেকনিশিয়ান।

‘এবার ভাবুন,’ নির্দেশের সুরে বলল বিলিয়নেয়ার। ‘নতুন করে ডিযাইন করুন ত্বক। নিজেকে ভাবুন শিল্পী। নিখুঁত কিছু তৈরি করতে হবে না। নিখুঁত কোনও মানুষকে খুঁজে পাবেন না। যে-কারও কনুইয়ের কাছে থাকবে চামড়ায় ভাঁজ, এখানে ওখানে পুরনো ক্ষতের চিহ্ন। আঁচিলও থাকতে পারে।’

মাথা দোলাল সাবা সাবেলা। নোটবুকে তুলে নিল তথ্যগুলো। ‘এবার বুঝতে পেরেছি, স্যর। এরপর…

‘পোড়া প্লাস্টিকের গন্ধটাও দূর করবেন। আমার তো মনে হচ্ছে ঢুকে পড়েছি পুরনো টায়ারের দোকানে।’

লজ্জায় লাল হলো টেকনিশিয়ানের দু’গাল। ‘জী, স্যর। দেরি না করে কাজে নামছি আমরা।’

‘গুড,’ বলল লো হুয়াং। ‘এবার বলুন আকার-আকৃতির কথা। আগেই বলেছি, নানান ধরনের হতে হবে দেহ।’

‘ভেতরের ফ্রেমে নানাধরনের ত্বক ও মাংসপেশি জুড়ে দিতে পারব,’ বলল সাবেলা। ‘ফ্যাক্টরির মডেলের মত নয় এগুলো। লম্বা বা বেঁটে করে দেয়া সমস্যা নয়। ওজন ও কমবেশি করতে পারব। চার ফুট আট ইঞ্চি থেকে শুরু করে সাত ফুটি দানবও তৈরি সম্ভব। একবার ফ্রেম তৈরি হলে থ্রি-ডি প্রিন্টিং করে তৈরি হবে বডি প্যানেল। চাইলে একই চেসিস বেশ ক’বার ব্যবহার করতে পারব। কঠিন নয় বডি প্যানেল অ্যাডজাস্ট করা। ছোট-বড় করে নেয়া যাবে মাথা, হাত-পা আর মাঝের অংশ।

‘ভেরি গুড,’ মাথা দোলাল লো হুয়াং, ‘তো কাজে নেমে পড়ন। আগামীকাল এসে দেখব কাজ কতটা এগোল।’

ইঞ্জিনিয়ারের নতুন উদ্যম দেখে খুশি মনে দরজার দিকে চলল হুয়াং লিটন। উজ্জ্বল আলোকিত ল্যাবোরেটরি থেকে বেরিয়ে এল বাইরের সুড়ঙ্গে। দেখে নিল চারদিকের পাথুরে নোংরা দেয়াল। তিরিশ ফুট দূরে দূরে একটা করে এলইডি বার্। ওই আলোয় দূর হয়নি অন্ধকার।

সুড়ঙ্গ ধরে হেঁটে চলল লো হুয়াং। জায়গায় জায়গায় ছাত নেমে এসেছে, মাথা নিচু করতে হচ্ছে তাকে। অবশ্য, আরও কিছু দূর যাওয়ার পর শুরু হলো মানুষের তৈরি করিডোর। শেষমাথার দরজা খুলতেই এল প্রাকৃতিক আলো।

ঢুকে পড়েছে লিটন বিশাল এক ফাঁকা ওয়্যারহাউসে। ওপর দিকের কাঁচ ভাঙা জানালা দিয়ে আসছে আলো। বহু ওপরে উঠেছে করোগেটেড ধাতব দেয়াল। একপাশে স্তূপ হয়েছে ভাঙা কাঠের বাক্স। পাশেই বাচ্চাদের জং ধরা একটা ট্রাই সাইকেল। লো হুয়াং লিটন ওয়্যারহাউসে ঢুকে চমকে দিয়েছে দুটো কবুতরকে। ডানার ফটফট আওয়াজ তুলে ক’বার ঘুরে ভাঙা এক জানালার চৌকাঠে গিয়ে উঠল ওরা।

ওদিকে চেয়ে রইল বিলিয়নেয়ার। টেকনিশিয়ানরা বলেছে, কয়েক দিন আগে ভুল করে ভাঙা জানালা দিয়ে ঢুকে পড়েছে দুই কবুতর, এরপর আর বেরোতে পারেনি। নিজেকে ওদের মতই বন্দি মনে হলো লো হুয়াং লিটনের। এই মিশন হাতে নেয়ার পর থেকে ক্রমেই জড়িয়ে গেছে নিজের তৈরি ফাঁদে।

যেইন নিং প্রস্তাব দিতেই লাফিয়ে তার কোলে গিয়ে উঠেছে সে। অথচ, উচিত ছিল সতর্ক হওয়া। অনেক জটিল হয়ে গেছে পরিস্থিতি।

ওয়্যারহাউস থেকে বেরোবার দরজার দিকে পা বাড়াল লো হুয়াং। তখনই বেজে উঠল ফোন। কোটের পকেট থেকে কালো, চিকন ডিভাইসটা বের করল সে। স্ক্রিনে কোনও নম্বর নেই। শুধুমাত্র একটা কোড বুঝিয়ে দিল, পার্সোনাল নেটওঅর্ক থেকে করা হয়েছে এনক্রিপটেড কল।

সবুজ বাটন টিপে কল রিসিভ করল লো হুয়াং লিটন।

‘কোথায় ছিলে?’ ওদিক থেকে কড়া সুরে, জানতে চাইল কেউ। ‘অন্তত দশবার ফোন করেছি সকাল থেকে।’

আপাতত নিজের ভেতর নেই প্রেতাত্মা, ভাবল লিটন। ‘কোথায় আছি তোমার জানার দরকার নেই। বলো কেন ফোন করেছ।’

‘বাকি প্রাপ্য বুঝে নেয়ার জন্যে।’

‘চুক্তির কথা নিশ্চয়ই মনে আছে?’ বলল বিলিয়নেয়ার। ‘প্রথমে আমার জানতে হবে সফল হয়েছ কি না। তার আগে…’

‘একটা লিঙ্ক পাঠিয়ে দিচ্ছি তোমার কাছে,’ বলল ওরে। ‘তাতে বুঝবে, আমার কাজ শেষ করেছি।’

মৃদু আওয়াজে হাজির হলো লিঙ্ক। কান থেকে সরিয়ে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকাল লো হুয়াং। ওখানে আছে একটা জাপানিয নিউজ রিপোর্ট। লেখা আছে পুড়ে গেছে দুর্গ। মারা গেছে এগারোজন। তাদের ভেতর রয়েছেন দুর্গের মালিক বিজ্ঞানী ইয়োশিরো শিমেযু। খুন হয়েছে তিনজন বাঙালি অতিথি। আরও কয়েকজনের চিকিৎসা চলছে। তবে বাঁচার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।

একটা হাসপাতালের বাইরে দাঁড়িয়ে বর্ণনা দিচ্ছে এক জাপানি রিপোর্টার। কী কারণে দুর্গে আগুন ধরেছিল, সেটা নিয়ে এখনও তদন্ত করছে ফায়ার ব্রিগেড ও পুলিশবাহিনী। তবে কোনও ধরনের তথ্য নেই বললেই চলে।

‘ওই কাজের জন্যে বাড়তি টাকা দেয়া উচিত তোমার,’ বলেই পর পর দু’বার হ্যাঁচ্চো-হ্যাঁচ্চো করে হেঁচে নিল প্রেতাত্মা। পরক্ষণে শুরু হলো বিচ্ছিরি খক খক কাশি।

‘অসুস্থ নাকি?’ জানতে চাইল লো হুয়াং।

‘আহত,’ বলল ওরে। ‘কিন্তু নিজের কাজ ঠিকই শেষ করেছি। এবার তোমার পালা। টাকার ব্যবস্থা করো।’

কতটা খারাপভাবে প্রেতাত্মা আহত, জানতে পারলে ভাল হতো, ভাবল লো হুয়াং। জাপানি বিজ্ঞানীর মত ওই ব্যাটাও ফুসফুস পুড়ে মরলে আর টাকা দিতে হতো না। ‘কথামতই টাকা পেয়ে যাবে। তবে কাজ ঠিকভাবে শেষ হয়েছে, সেটা নিশ্চিত হয়ে নেব।’

‘যা খুশি করো, তবে বাড়তি সময় দেব না,’ বলল ওরে, ‘এখনও বেঁচে আছে কেউ কেউ। বেরিয়ে আসতে পারে সত্য ঘটনা। তার আগেই ডুব দিতে হবে আমাকে। কাজেই টাকা দেবে তুমি আজ রাতেই।’

‘আমার আজ অন্য কাজ আছে,’ বলল লো হুয়াং।

‘ভুলেও চিটিংবাজি করতে যেয়ো না,’ ধমকের সুরে বলল প্রেতাত্মা, ‘তোমার চেয়ে অনেক ক্ষমতাশালী লোকও ওই কাজ করতে গিয়ে খুন হয়েছে আমার হাতে।’

ঘাড়ের কাছে ভীষণ রাগী প্রেতাত্মা খুনি চাই না, ভাবল লো হুয়াং। টাকা বড় কথা নয়, তবে নিয়মের বাইরে যাবে না সে। ‘ঠিক আছে, আজ রাতেই টাকা পাবে। পেয়ে যেতে পারো আরেকটা ভাল কাজও। যদি উপযুক্ত হও আর কী।’

চুপ থাকল ওরে। কিছুক্ষণ কেশে নিয়ে বলল, ‘আগের টাকা দিয়ে নাও। পরের কাজ পরেই শুনব।

‘ঠিক আছে,’ বলল বিলিয়নেয়ার, ‘তবে যেখানে দেখা হবে, সেখানে আনুষ্ঠানিক পোশাক পরতে হবে তোমাকে।’

তোমার সঙ্গে দেখা করতে কোত্থাও যাচ্ছি না আমি।’

‘দু’জনই চিনি এমন জায়গায় বসব,’ বলল লো হুয়াং লিটন। ‘নিয়ন সাইন। বিশ্বাস করো, ওখানে গেলে পুরনো অনেক দোস্তের সঙ্গে দেখা হবে তোমার।’

ওই বেআইনী নাইটক্লাব ও গ্যাম্বলিং প্যালেস ভাল করেই চেনে ওরে। জাপানে ক্যাসিনো নিষিদ্ধ হলেও দাপটের সঙ্গেই বড় সব শহরে ব্যবসা করছে অমন দু’চারটা সংগঠন।

‘ঠিক আছে,’ বলল ওরে, ‘দেখা হবে। ভুলেও চালাকি করতে যেয়ো না।’

শহরতলীতে নিয়ন সাইন ক্লাব চালায় টোকিওর শক্তিশালী ইয়াকুয়া কার্টেল। ক্যাসিনো, রুমে চলে কোটি কোটি টাকার জুয়া। নিশ্চিন্তে যা খুশি করে ধনীদের তরুণ-তরুণী ছেলে- মেয়েরা। নিয়মিত হাজির হন রাজনৈতিক নেতা, খেলাপি ঋণকারী বড় মাপের অপরাধী ব্যবসায়ীরা।

ওরেকে ভালভাবে চিনলেও কিছুই বলবে না কার্টেলের কর্মচারী বা সশস্ত্র গার্ডরা। কোনও কৌশলের বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই লো হুয়াং লিটনের। তবে ক্লাবে ঢুকতে গেলে অস্ত্র বা কোনও গুবরে পোকা আছে কি না, আগেই সার্চ করা হবে। কাজেই তার মনে হয়েছে, পুরো দ্বীপে সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা হচ্ছে নিয়ন সাইন ক্লাব। চাইলেও যা খুশি করতে পারবে না ভূত বা প্রেতাত্মা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *