তেরো
সুপারইণ্টেণ্ডেণ্ট উবোন হিমুরার মেসেজ পেয়ে ট্রেনে চেপে কয়েক স্টেশন যাওয়ার পর অন্য আরেক ট্রেনে উঠেছে রানা ও সোহেল। আরও চার স্টেশন পেরোবার পর নিয়েছে ট্যাক্সি। একটু পর ওটা ছেড়ে নানান গলি ঘুরে পৌঁছে গেছে মেট্রো পুলিশ দপ্তরের সামনে।
‘দেখে তো মনে হচ্ছে না বদ পুলিশের আখড়া,’ মন্তব্য করল সোহেল।
বাড়ির চারদিকের দেয়ালে রামধনুর সাত রঙ। প্রধান ফটকের সামনে অ্যাটেনশন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে পুরো ইউনিফর্ম পরা এক অফিসার। হাতে সাদা গ্লাভস। ডানহাতে চকচকে পলিশ করা লাঠি। লোকজন পাশ দিয়ে গেলেও নড়ছে না সে, চোখের পাতাও ফেলছে না।
‘রিতসুবান,’ বলল রানা, ‘অতন্দ্র প্রহরী। সাধারণ মানুষ যেন বুঝতে পারে, সবসময় তাদের ওপর চোখ রেখেছে পুলিশ বাহিনী।’
‘শুনে জ্ঞান লাভ করলাম,’ বলল সোহেল। ‘কিন্তু কথা হচ্ছে, মাস্টার শিমেযুকে নিরাপদে রাখতে পারেনি।’
দালানে প্রবেশ করে হীরক আকৃতির এক রুমে ঢুকল ওরা। দুটো দরজা দালানের গভীরে যাওয়ার জন্যে, আবার রাস্তায় যাওয়ার জন্যে দুটো দরজা। ডিউটি অফিসারের সঙ্গে কথা বলতে হবে ভেবেছিল রানা ও সোহেল, কিন্তু কয়েকটা ডেস্কে বসে আছে জাপানি ভাষা বলা কয়েকটা কমপিউটার। সোহেলের সুবিধার জন্যে একটার সামনে থামল রানা। স্ক্রিনে টোকা দিতেই জাপানি ভাষা ভুলে ইংরেজির বোল ফোটাল যন্ত্রটা। জানতে চাইল, ‘আপনি আমেরিকান ইংরেজিতে কথা বলতে চান, নাকি ব্রিটিশ ইংরেজি?’
বিরক্ত হয়ে স্ক্রিনের অপশন থেকে ব্রিটিশ ইংরেজি বেছে নিল সোহেল।
ওয়েলকাম টু দ্য ইয়ামানা পোলিস স্টেশন,’ অভ্যর্থনার সুরে বলল কমপিউটার, ‘প্লিয স্টেট ইয়োর রিযন ফর অ্যারাইভাল।’
‘সুপারইণ্টেণ্ডেণ্ট উবোন হিমুরার সঙ্গে দুপুর দুটোয় আমাদের মিটিং আছে,’ বলল রানা।
‘দয়া করে নিজের নাম ও কোন্ দেশের মানুষ তা টাইপ করে দাঁড়ান ক্যামেরার সামনে।’
‘মাসুদ রানা, জাতে বাঙালি, বাংলাদেশের নাগরিক।’
আউড়াল সোহেল, ‘সোহেল আহমেদ, জাতে বাঙালি, বাংলাদেশের নাগরিক।’
চুপ থাকল কমপিউটার।
‘ল্যারি কিঙের সুন্দরী ভেনাস সুযোগ পেলে এত চুপচাপ স্বামী হাতছাড়া করত না,’ মন্তব্য করল সোহেল।
ল্যারি কিং নুমার রেসিডেন্ট কমপিউটার জিনিয়াস। তৈরি করেছে অত্যাধুনিক কমপিউটার সিস্টেম। তাক লেগে যাবে যে কারও। ওর কমপিউটার ভাবতে পারে নিজে থেকে। আছে সবচেয়ে দ্রুত প্রোসেসর। ফলে ভেনাস পৃথিবীর সেরা আর্টিফিশাল ইন্টেলিজেন্সের অধিকারী। এমন কী, তার আছে সূক্ষ্ম কৌতুকবোধও।
মৃদু শব্দে খুলে গেল ডানদিকের দরজা। ‘আপনাদের জন্যে অপেক্ষা করছেন সুপারইন্টেণ্ডেণ্ট হিমুরা। ওদিকের দরজা পেরিয়ে এগিয়ে যান।’
তিন ধাপ সিঁড়ি বেয়ে দ্বিতীয় ঘরে ঢুকল রানা ও সোহেল। চারপাশে দেখল শ’খানেক কমপিউটার স্ক্রিন সামনে নিয়ে বসে আছে একদল পুরুষ ও নারী। টিপে চলেছে কি-বোর্ড। ঘরের মাঝে কোনও দেয়াল নেই। আধুনিক ডিযাইন। ছাতে নির্দিষ্ট জায়গায় বাতি। একতিল ধুলো নেই ঘরে। চকচক করছে চারপাশ। কোনও অপরাধীকে দেখল না রানা ও সোহেল। তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। জাপানের ক্রাইম রেট পৃথিবীর সবচেয়ে নিচে। এর বড় কারণ, দেশটি অত্যন্ত ধনী। আরেকটি কারণ, জাপানিরা ছোটবেলা থেকেই শেখে নিয়ম- কানুন।
দু’একজন চেয়ে দেখলেও বেশিরভাগ অপারেটর ঘুরেও তাকাল না ওদের দিকে।
কালো প্যান্ট, সাদা শার্ট ও ধূসর টাই পরনে এক মাঝবয়সী ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন রানা ও সোহেলের দিকে। তাঁকে অ্যাথলেট বলেই মনে হলো ওদের। চিবুকে গভীর খাদ। খাটো করে ছাঁটা কালো চুল।
‘আমিই সুপারইণ্টেণ্ডেণ্ট উবোন হিমুরা,’ বললেন তিনি।
মৃদু বাউ করল রানা, তবে ওর সঙ্গে হ্যাণ্ডশেক করলেন তিনি। ‘খুশি হলাম আপনাদের সঙ্গে দেখা হওয়ায়। দয়া করে আমার সঙ্গে আসুন।’
নিখুঁত, ছোট এক অফিসে ওদেরকে নিলেন উবোন হিমুরা। ডেস্কের সামনের চেয়ারে বসতে বললেন।
‘আমার দেখা পৃথিবীর সেরা পুলিশ স্টেশন এটা,’ মন্তব্য করল সোহেল।
‘তা বোধহয় নয়,’ বললেন উবোন হিমুরা। ‘আমরা অন্যদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে চাই, এটুকু বলতে পারি।’
চারপাশে তাকাল সোহেল। ওর চোখ খুঁজছে খুঁত। নেই কোথাও। তারপর ওর মনে পড়ল রানার কথা, জাপানিরা সবসময় প্রশংসাকে নিন্দনীয় বলে ধরে নেয়। তাই চেষ্টা করে আরও নিখুঁত হতে। বাঙালিদের অতি তাড়াহুড়োর কথা ভেবে লজ্জা পেল সোহেল। মনে পড়েছে বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিক পত্রিকার হেডিং: রকেট বেগে চলেছে বাঙালি শিশু। আর্টিকেলে লেখা হয়েছে: কত কম বয়সে স্কুলে গুঁজে দেয়া হচ্ছে বাচ্চাগুলোকে। তাতেই খুশিতে কুর্দন করছে বা লম্ফ দিচ্ছে বাবা-মারা। দেখিয়ে দিলাম দুনিয়াকে। অথচ, জাপানে বেশিরভাগ শিশুকে দশ বছর হওয়ার আগে স্কুলে ভর্তিই করা হয় না। আগে বাবা-মা ও আত্মীস্বজনকে সময় দেয়া হয়, যাতে তাঁরা বাচ্চাটাকে মানুষ হওয়ার পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন।
এই দালান সত্যিকারের শিল্প। দেখার মত। কোথাও কোনও খুঁত পাবে না কেউ। এখানে আসার সময় ওরা দেখেছে র্যাকে রাখা অস্ত্র। যে-কেউ বলবে জাদুঘরে পা রেখেছে সে। ধুলোর কণাও নেই কোথাও।
‘আপনাদের ফয়েতে দেখলাম, রিসেপশনিস্ট বা ডিউটি অফিসার নেই,’ বলল সোহেল।
‘কেউ থাকলে সময় নষ্ট হতো,’ বললেন সুপারইণ্টেণ্ডেণ্ট হিমুরা, ‘আপনারা তো জানেন, ক্রমেই কমছে জাপানিদের জনসংখ্যা। আরও জরুরি কাজ দেয়া হচ্ছে পুলিশ অফিসারদেরকে।’
‘কিন্তু ওই যে রিতসুবান?’ প্রশ্ন তুলল সোহেল।
কাঁধ ঝাঁকালেন সুপারইন্টেণ্ডেণ্ট হিমুরা। ‘অপরাধ থেকে সবাইকে দূরে রাখতে এ ব্যবস্থা। তবে জীবন্ত গার্ড না রেখে ব্যধহার করা হয় ম্যানিকিন।’
ওটা এতই নিখুঁত, বোঝার উপায় ছিল না যে নকল পুলিশ।
‘ভাল… আপনাদের মেশিন রিসেপশনিস্ট অনেক ভাষা জানে, এটা বলতেই হবে,’ প্রশংসার সুরে বলল সোহেল।
‘এ ছাড়া উপায়ও ছিল না,’ বললেন হিমুরা। ‘আমরা জানি, জাপানের বেশিরভাগ অপরাধ করে বিদেশিরা।’
সুপারইণ্টেণ্ডেন্টের মুখে মৃদু হাসি দেখল রানা। কথাটা বলে তৃপ্তি পেয়েছেন তিনি।
‘এবার বলুন কেন ডেকেছেন?’ জানতে চাইল সোহেল।
‘আমরা চাই, আপনারা যেন যত দ্রুত সম্ভব এ দেশ ছেড়ে চলে যান,’ হঠাৎ করেই বোমা ফাটালেন হিমুরা।
‘জী?’ চেয়ারের পিঠে হেলান দিল রানা।
‘আমরা চাই আপনারা যেন দেরি না করে ফিরে যান, ‘ আবারও বললেন হিমুরা, ‘আপনাদেরকে এস্কোর্ট করে বিমানবন্দরে পৌছে দেব আমরা।’
‘আপনারা কি জোর করে আমাদেরকে এ দেশ থেকে বের করে দিতে চাইছেন?’ জানতে চাইল রানা।
‘আপনাদের নিরাপত্তার স্বার্থেই,’ বললেন পুলিশ সুপার, ‘গতরাতে যারা হামলা করেছিল, তাদের পরিচয় কী, তা জানতে পেরেছি আমরা। আগে তারা ছিল ইয়াকুয়া দলের কুখ্যাত খুনি।’
ড্রাগনের খপ্পরে পড়ে আহত হলো যে লোক, তার বর্ণনা সোহেল দেয়ার পর, রানাও ধারণা করেছিল, সে হবে ইয়াকুযা দলের কেউ। নানান উল্কি ব্যবহার করে তারা। প্রথম যে প্রশ্নটা ওর মনে এল, সেটা জিজ্ঞেস করল, ‘কিন্তু কেন আধপাগল এক বিজ্ঞানীকে খুন করতে চাইবে ইয়াকুয়া দলের কেউ?’
‘প্রাক্তন ইয়াকুযা,’ শুধরে দিলেন হিমুরা। ‘দল থেকে বেরিয়ে গেছে।’
‘তার মানে, বলতে চাইছেন, সে বা তারা এখন ভাড়াটে খুনি,’ মন্তব্য করল রানা।
মাথা দোলালেন পুলিশ সুপার। ‘আগে ইয়াকুযারা ছিল রোনিন। মানে, সামুরাই যোদ্ধা। মাথার ওপরে ছিল না প্রভু বা মালিক। যাযাবর বলতে পারেন। বা ভাড়াটে যোদ্ধা। এ যুগেও তা-ই রয়ে গেছে। কেউ উপযুক্ত টাকায় ভাড়া করলে তার হয়ে খুন করে খুশি মনে। মিস্টার সোহেল যাকে দেখেছেন, সে একসময় ছিল ইয়াকুয়া দলের পাণ্ডা। তবে কয়েক বছর আগে ইয়াকুয়া দলের সিণ্ডিকেট ভেঙে দিই আমরা। বড় নেতাদের ভরা হয় জেলখানায়। নিচে যারা ছিল, গোপনে অপরাধ করছে তারা। কারও নির্দেশে কাজ করে না। ফলে আরও অনেক বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে এরা।
‘আপনারা কি জেনেছেন, কার হয়ে কাজ করছে ওরা?’ জানতে চাইল রানা।
মাথা নাড়লেন হিমুরা। ‘বড় অঙ্কের টাকা নিয়ে মানুষ খুন করে। একেকজনের আলাদা আলাদা স্টাইল। জানার উপায় নেই, ওদেরকে ভাড়া করেছে কে বা কারা।’
শিমেযুর দুর্গে হামলার পেছনে রয়েছে চিনের পুব সাগর থেকে পাওয়া ডেটা। অথচ, আর কোনও তথ্য নেই। পুলিশ সুপার কী বলেন জানতে তাঁর দিকে তাকাল রানা।
‘মূল কথা হচ্ছে, হামলা ঠেকিয়ে দিয়েছেন আপনারা, বললেন হিমুরা। ‘এবার ধরে নিতে পারেন, আপনাদেরকে বাঁচতে দেবে না তারা। নইলে অপরাধী সমাজে ছোট হতে হবে। তাই এই অপমান সহ্য করবে না তারা কিছুতেই।’
‘অথচ, একটু আগে বলেছেন, জাপানের বেশিরভাগ অপরাধ করে বিদেশিরা,’ মন্তব্য করল রানা।
‘তাই করে, অত্যন্ত দুঃখজনক,’ মাথা নাড়লেন হিমুরা। সোহেলের দিকে ঠেলে দিলেন একটা ফাইল। ‘শুধু আপনি দেখেছেন তাদের একজনকে। তাই ওই লোককে সনাক্ত করলে, উপকৃত হব আমরা।’
ফাইল টেনে নিয়ে খুলল সোহেল। ভেতরে মানুষের ছবি নেই, বদলে রঙিন সব ডিযাইন। সবই পিঠ ও কাঁধের উল্কি।
‘ইয়াকুযারা সারাশরীরে এঁকে নেয় উল্কি,’ বললেন হিমুরা, একেক দল ব্যবহার করে একেক ডিযাইন। দেখুন ওই লোকের ডিযাইনের সঙ্গে এদের কারও মিল আছে কি না।’
সোহেলের পাশ থেকে দেখছে রানা। অত্যন্ত জটিল সব ডিযাইন। একেবারেই আলাদা। কোনও কোনওটার ভেতর রয়েছে ডানা বা ড্রাগন। এ ছাড়া, আছে আগুন ও করোটি। একটা ক্যালাইডোস্কোপে অসংখ্য রঙ ও ধারালো তলোয়ার।
‘এখানে নেই,’ প্রথম পাতা ওল্টাল সোহেল। পরের পৃষ্ঠা দেখে মাথা নাড়ল। ‘এখানেও নেই।’ আরও কয়েক পৃষ্ঠা দেখার পর হঠাৎ মুখ তুলল। ‘এই যে প্যাটার্ন, এটাই ছিল ওই লোকের ঘাড়ে। তবে খানিকটা মাংস আর চামড়া নিয়ে গেছে কমোডো ড্রাগন। ‘
কাগজটা দেখলেন হিমুরা। ‘যা ভেবেছি। কুখ্যাতির কারণে এর নাম দেয়া হয়েছে: ‘ওরে’। অর্থাৎ প্রেতাত্মা বা ভূত। পুরো নাম: ‘ওরে চিচিওয়া’।
‘তা হলে এই লোকই প্রেতাত্মা?’ মৃদু হাসল সোহেল। ‘কী সৌভাগ্য, প্রথমবারের মত দেখা পেলাম।’
‘আসল নাম কেউ জানে না,’ বললেন পুলিশ সুপার। ‘প্রথমে যখন সিণ্ডিকেটের হয়ে খুন করতে লাগল, তার কিছু দিনের ভেতর ছড়িয়ে পড়ল কুখ্যাতি। বেশিরভাগ খুনি মজা পায় না খুন করতে। কিন্তু এর কথা আলাদা। খুব খুশি হয় ভয়ঙ্করভাবে মানুষ হত্যা করতে পারলে। তা ছাড়া, হুড়মুড় করে এসেছে লাখ লাখ টাকা। আর কী চাই!’
‘জানলেন কে খুন করেছে দুর্গে, এবার ধরে ফেলুন,’ বলল রানা। ‘সেক্ষেত্রে আর এ দেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে না আমাদেরকে।’
‘ব্যাপারটা অত সহজ নয়,’ ডিযাইনটা সরিয়ে রাখলেন হিমুরা। ‘এদেরকে বাগে পাওয়া কঠিন। বছরের পর বছর ধরে তাকে খুঁজছি আমরা।’
‘কমোডো ড্রাগন বিষাক্ত,’ বলল সোহেল। ‘যে লোকটা কামড় খেয়েছে, তাকে অবশ্যই যেতে হয়েছে হাসপাতালে বা মর্গে।’
‘সত্যিই খুব বিষাক্ত হয় কমোডো ড্রাগন,’ সায় দিলেন পুলিশ সুপার। ‘তবে আজ সকালে এক এক্সপার্টের সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি বলেছেন, প্রতিটা কামড়ে বিষ ঝাড়ে না এসব গিরগিটি। মিস্টার সোহেল, আপনি যে কামড় খেতে দেখেছেন, ওটা মারাত্মক হামলা না-ও হতে পারে।’
‘ড্রাগনের মুখের ভেতরের অবস্থা ভাল থাকার কথা নয়, বলল রানা। ‘যতটা মনে পড়ে, ওগুলোর দাঁতে থাকে হাজার রকমের ব্যাকটেরিয়া।’
‘কথা ঠিক,’ সায় দিলেন হিমুরা, ‘ওরে বোধহয় এখন জ্বরের ঘোরে কোঁ-কোঁ করছে। নিশ্চিতভাবেই ইনফেকশন হয়েছে। নিচ্ছে হাই-ডোযের অ্যান্টিবায়োটিক। তবে ধরে নিতে পারেন বাঁচবে সে। আর এজন্যেই আপনাদের বোঝার কথা, আপনারা আছেন মস্ত বিপদে। প্রথমে এ কথাই বলেছি।’
চেয়ারে হেলান দিল রানা। বুঝে গেছে সহজ সমাধানে পৌঁচেছেন হিমুরা। তাই ওদেরকে ডেকে এনেছেন পুলিশ স্টেশনে। নিজ মুখে বলছেন না কিছু।
কয়েক সেকেণ্ড পর বলল রানা, ‘আমরা যদি সহায়তা করি, আপনি হয়তো উৎরে দিতে পারবেন আমাদেরকে এই বিপদ থেকে।’
চুপ করে থাকলেন হিমুরা।
‘এসব ভেবেই বহু পথ ঘুরে আপনাদের স্টেশনে এসেছি আমরা,’ বলল রানা। ‘আমাদের পিছু নেয়নি কেউ।’
মৃদু মাথা দোলালেন পুলিশ অফিসার। ‘আপনারা খুব বিচক্ষণ মানুষ। জেদিও। আবার এ কথাও ঠিক, জেদি হলেও ততটা বিচক্ষণ নন আপনারা।’
‘আমরা চাই আপনাদের পাশে থাকতে,’ বলল রানা।
‘তা হলে কী করতে বলেন?’ ভুরু নাচালেন হিমুরা।
‘আপনি তো জানেন, হামলাটা ছিল বড় ধরনের। ব্যবহার করা হয়েছে কয়েকটা স্পিডবোট। ছিল ডযনখানেক লোক। সঙ্গে প্রচুর আগ্নেয়াস্ত্র। ব্যবহার করেছে গ্রেনেড। এসব সংগ্রহ করতে গিয়ে ব্যয় করেছে বহু টাকা। যে যা-ই বলুক, চোর, ডাকাত বা অপরাধীদের ভেতর সম্মান বলে কিছু থাকে না। একজন আরেকজনকে বিশ্বাস করে না। তার মানে, কাজটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত পয়সা পাবে না এরা। অন্তত পুরো টাকা পায়নি।’
গম্ভীর হলেন হিমুরা। ‘বোধহয় বোঝাতে চাইছেন, বিশেষ কোথাও বসে টাকা লেনদেন হবে।’
‘সেটা আপনি আগেই জানেন, বলল রানা।
মাথা দোলালেন পুলিশ সুপার। ক’সেকেণ্ড ভেবে নিয়ে বললেন, ‘কিন্তু আপনারা কোন্ দিক থেকে কাজে আসবেন আমাদের?’
‘বিজ্ঞানী শিমেযু আর তাঁর লোকদেরকে পাঠিয়ে দিন কোনও সেফহাউসে,’ বলল রানা, ‘মিডিয়ায় ছড়িয়ে দিন, হামলায় মারা গেছে ক’জন বাঙালি। একজন এখনও মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে। নাম প্রকাশ করবেন না কারও। সংখ্যা বলাই যথেষ্ট।’
‘আচ্ছা? তারপর?’
‘ওরে প্রাক্তন ইয়াকুযা খুনি, কমোডো ড্রাগনের কামড়ে প্রতি চারঘণ্টায় নিচ্ছে হাই-পাওয়ারের অ্যান্টিবায়োটিক। স্বাভাবিকভাবেই তার মনে হবে, এখনই উচিত নিযুক্তকারীর কাছে বাকি টাকা চেয়ে নেয়া।’
রানা থেমে যেতেই ওর মনের কথা বললেন হিমুরা, ‘প্রাপ্য টাকা নিতে গোপন আস্তানা থেকে বেরোবে ওরে চিচিওয়া।’
‘আমার তা-ই ধারণা,’ বলল রানা।
‘যদি চেক-এ পরিশোধ করে,’ বলল সোহেল, ‘বা ইলেকট্রনিকালি?’
‘অনেক বড় অঙ্কের টাকা,’ বললেন হিমুরা। ‘ঝামেলা করতে পারে সরকারী ক্লিয়ারিং হাউস। কাজেই টাকা হারাবার ঝুঁকি নেবে না ওরে। সাধারণত এসব লেনদেন হয় খোলামেলা জায়গায় মুখোমুখি বসে। কোনও পক্ষ যেন বিশ্বাসঘাতকতা করতে না পারে।’
‘আপনি যদি বের করতে পারেন কোথায় লেনদেন হবে, ওখানে হাজির হব আমরা,’ বলল রানা। ‘দেখিয়ে দিতে পারব কে ওরে চিচিওয়া। এরপর যা করার আপনারা করবেন।’
সোহেলের দিকে তাকালেন পুলিশ সুপার। ভাবছেন, অনেক বেশি ঝুঁকি নিতে হবে বাঙালি লোকটাকে।
ওরেকে চিনিয়ে দিতে আমার কোনও আপত্তি নেই,’ বলল সোহেল
নীরবে কী যেন ভাবতে লাগলেন হিমুরা। কিছুক্ষণ পর মাথা দুলিয়ে বললেন, ‘আপনারা অত্যন্ত সাহসী মানুষ তা আগেই বুঝেছি, নইলে গতকাল রাতে ওভাবে লড়তেন না।’
‘আমরা অতি সাহসী লোক নই, তবে প্রয়োজনে দায়িত্ব পালন করতে পিছিয়ে যাই না,’ বলল রানা।
‘আমাদের মতই আপনারাও প্রশংসাকে পাত্তা দেন না, বললেন হিমুরা। ‘তবে বুঝতে পারছি না, কী কারণে এত বড় বিপদের ঝুঁকি নেবেন।
‘কেউ হামলা করলে ঠিক পছন্দ করি না আমরা,’ বলল রানা। ‘তা ছাড়া, দায়িত্বও এড়িয়ে যাই না। আমাদের কারণেই হামলা হয়েছে দুর্গে মানুষগুলোর ওপর। আপনি চান ওরে চিচিওয়াকে। আর আমরা জানতে চাই তাকে টাকা দিয়েছে কে বা কারা এবং তা কী কারণে।’
‘তার মানে, নুমা বা আমেরিকান সরকার জানতে চায়?’
মাথা নাড়ল রানা। ‘কোনও পক্ষ জানতে চাইলে, সেটা বাংলাদেশ সরকার।’
পুলিশ সুপার হিমুরা বুঝে গেলেন সাধারণ সিভিলিয়ান নয় মাসুদ রানা ও সোহেল আহমেদ। সিধে করে নিলেন ডেস্কে পড়ে থাকা কয়েকটা কাগজ। বললেন, ‘ঠিক আছে। তবে জানিয়ে রাখি, সব তথ্য মিথ্যা দেব না আমরা। দুঃখজনকভাবে সকালে অচেতন অবস্থাতেই মারা গেছেন বিজ্ঞানী ইয়োশিরো শিমে। বেশি পুড়ে গিয়েছিল তাঁর ফুসফুস।’
কথাটা শুনে চোয়াল শক্ত হয়ে গেল রানার। ভাবছিল এমনই কিছু হবে।
গম্ভীর হয়ে গেছে সোহেলও।
একবার ওকে দেখে নিয়ে পুলিশ সুপারের দিকে তাকাল রানা। ‘আশা করি তাঁর শিষ্যদেরকে নিরাপদ কোথাও সরিয়ে দেবেন? নিজের কাজ শেষ করতে চাইতে পারে ওরে।’
‘এরই ভেতর সরিয়ে ফেলেছি,’ বললেন হিমুরা, ‘তবে দুধে একটা মাছি ছিল।’
‘সে কে?’
‘শিমের মহিলা বডিগার্ড।’
‘হিনা,’ বিড়বিড় করল সোহেল।
‘হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে,’ বললেন হিমুরা। ‘বিজ্ঞানী মারা যাওয়ার সময় ওঁর বেডের পাশেই ছিল। মনে হয়েছিল প্রচণ্ড মানসিক আঘাত পেয়েছে। কিন্তু পরে যখন জবানবন্দি নিতে চাইলাম, তাকে আর খুঁজে পেলাম না। ব্যাপারটা সন্দেহজনক মনে হওয়ায় মেয়েটার অস্ত্র থেকে আঙুলের ছাপ নিয়েছি। তাতে জানলাম, দীর্ঘ অপরাধী রেকর্ড আছে হিনার। টোকিওর ইয়াকুয়া দলের হয়ে ডাকাতিও করেছে।’
রানার দিকে তাকাল সোহেল। এত কম বয়সেই? তোর কি মনে হয় ওই হামলার সঙ্গে হিনা জড়িত?’
‘নিশ্চিত নই,’ বলল রানা, ‘তবে শিমেযুর হয়ে প্রাণপণে লড়েছে। দুটো গুলি লেগেছিল বুক ও পেটে। কেভলার ভেস্ট না থাকলে মারা পড়ত।’
‘অতীত রেকর্ড ভাল নয়,’ বললেন হিমুরা। ‘ওকেও প্রায় ভূতের মতই ভয় পায় পাবলিক। ছোটবেলা থেকেই এতিম। লড়েছে রাস্তায় রাস্তায়। পরে অপরাধী জগতে ঠাঁই করে নিয়েছে।’
‘হয়তো উপায় ছিল না,’ বলল সোহেল।
কঠিন সুরে বললেন হিমুরা, ‘হয়তো। আপনাদের সঙ্গে হিনা যোগাযোগ করলে, সঙ্গে সঙ্গে আমাকে জানাবেন।’
‘মনে করি না যোগাযোগ করবে,’ বলল রানা। ‘নইলে চলে যেত না। তবে সে ফোন দিলে বা দেখা করলে, আমরা আপনাকে জানাব।’
‘ঠিক আছে,’ বললেন পুলিশ সুপার, ‘আমরা খবর ছড়িয়ে দিচ্ছি ইনফর্মারদের মাধ্যমে। কপাল ভাল হলে জানর কোথায় হবে টাকার লেনদেন। সেক্ষেত্রে ওখানে যাব আমরা।’