বারো
ক্লান্তিকর রাত পার করে, ভোরে হাসপাতালে পুলিশের কাছে জবানবন্দি দেয়ার পর ছেড়ে দেয়া হয়েছে রানা, সোহেল, আসিফ ও তানিয়াকে। আপাতত হোটেলে ফিরতে পারে।
আগেই বুক ছিল রুম, শিনজুকু প্রিন্স হোটেলে ফিরে যে যার ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে ওরা। পাঁচ ঘণ্টা পর অ্যালার্মের ঘণ্টি জাগিয়ে দিতেই জড় হয়েছে রানার ঘরে।
ফোনে আলাপ করতে হবে নুমা চিফ জর্জ হ্যামিলটনের সঙ্গে। গতরাতে কী হয়েছে, রানার কাছে শুনে চিন্তায় পড়ে গেলেন তিনি। চুপ করে আছেন।
রানা দিল নতুন তথ্য, ‘এবার চাইনিযদের জলসীমা পেরোতে হবে। জানতে চাই গোপনে কী করছে ওরা।
‘সেটা অসম্ভব,’ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন হ্যামিলটন। ‘তোমরা ধরা পড়লে নুমা আর আমেরিকান সরকারকে জালে জড়িয়ে নেবে চিন সরকার।
‘সাগরের উচ্চতা বাড়ছে, তদন্ত না করে উপায় নেই,’ টেবিলে রাখা ফোনের স্পিকারের দিকে চেয়ে বলল রানা।
‘কিন্তু তুমি যে লোকেশনের কথা বলছ, ওটা চাইনিয টেরিটোরিয়াল ওঅটার। ওরা বলে স্পেশাল অপারেশন্স যোন। টেস্ট করে নেভাল্ এক্সপেরিমেন্ট। সর্বক্ষণ বোট নিয়ে পাহারা দিচ্ছে এলাকা। চোখ রাখছে নেভির জাহাজ, সাবমেরিন ও এয়ারক্রাফ্ট। ওদিকে আছে চালু রাখা সোনার বয়া। কাছাকাছি কেউ গেলেই ধরা পড়বে।’
‘আপনি তা হলে নিষেধ করছেন।’ সোহেল, আসিফ ও তানিয়াকে দেখে নিল রানা। শিমেযুর অ্যানালগ মেশিনের রিডিং পাওয়ার পর প্রত্যেকে চাইছে সাগরের ওই এলাকা ঘুরে দেখতে।
‘স্যর, ডক্টর শিমেযুর থিয়োরি কিন্তু জিয়োলজিকালি ঠিক হতে পারে,’ বলল আসিফ, ‘নিশ্চয়ই কোনও উপায় আছে, যাতে চিনের পুব সাগরে যাওয়া যাবে?’
‘সম্ভব নয়,’ বললেন হ্যামিলটন। ‘কয়েক বছর আগে আমাদের একটা বিমান গুলি করে ফেলে দিয়েছে ওরা। অথচ, টেকনিকালি ওটা ছিল আন্তর্জাতিক এয়ারস্পেসে।’
‘শুনেছি কিছু দিন আগে প্রায় অদৃশ্য অ্যাটাক সাবমেরিন পেয়েছে আপনাদের নেভি,’ বলল রানা।
‘ওটা চেয়েছি আমরা,’ বললেন হ্যামিলটন। ‘তবে রাজি হয়নি নেভি। ওদিকের সাগর অগভীর। তা ছাড়া, সাগরের নিচে আছে, চিনাদের সফিসটিকেটেড লিসেনিং পোস্ট। আমেরিকান নেভিকে দোষ দিতে পারছি না।’
নেভির কাছে ওই অ্যাটাক সাবমেরিন চেয়েছেন নুমা চিফ, তথ্যটা হজম করে নরম সুরে বলল রানা, ‘তা হলে অন্য উপায় খুঁজতে হবে।’
নীরব হয়ে গেছে ঘর।
সামান্য বিরতির পর বললেন হ্যামিলটন, ‘গত দু’বছরে চিনের পুব সাগরের ওই এলাকায় পানির নিচে নানান শব্দ ধরেছে নেভি আর নুমা। আর ঠিক ওখান থেকেই শুরু হয়েছে ডক্টর শিমেযুর যি-ওয়েভ। দুই-এ দুই যোগ করলে বুঝতে দেরি হওয়ার কথা নয়, গোপনে ওখানে কিছু করছে চিনারা।’
‘কী ধরনের আওয়াজ, স্যর?’ জানতে চাইল আসিফ।
‘গভীর সাগরে ড্রিলের মত শব্দ,’ বললেন হ্যামিলটন, ‘আবার নেভির দেয়া তথ্য অনুযায়ী, মহাদেশীয় তাক থেকে বেরোচ্ছে কোনও তরল।’
‘তেল?’ জানতে চাইল তানিয়া।
‘হতে পারে,’ বললেন নুমা চিফ, ‘চিনের পুব আর দক্ষিণ সাগরে আছে হাইড্রোকার্বন ডিপোযিট। এ ব্যাপারে খুব কড়া নজর রেখেছে চিনা সরকার। বিশেষ করে চিনের দক্ষিণ সাগরে। তবে শিমের লোকেশন পুব সাগরে। ওই এলাকা যে চিনা নেভির, তাতে ভুল নেই।’
‘তাদের নিজ এলাকাতেই হোক, কিন্তু গোপনে কেন ড্রিল করবে?’ প্রশ্ন তুলল তানিয়া।
‘দু’বছর আগে একবার সাগরের নিচে খনি থেকে ‘ওর’ তুলতে চেয়েছিল একটা কোম্পানি,’ বলল আসিফ। ‘কিন্তু জিয়োলজি টিম মানা করে। সাধারণ রিগ বসাবার চেয়ে অন্তত এক শ’ গুণ বেশি খরচ ওতে।’
‘ঠিকই বলেছ,’ বললেন হ্যামিলটন। ‘তবে চিনের পুব সাগরের নিচে যে সোনার রেকর্ডিং আমরা পেয়েছি, ওটা সাধারণ ড্রিলিং মনে হয়নি। কিছু ডেটা থেকে মনে হয়েছে, সাগরতলে তীব্র বেগে বেরোচ্ছে হালকা কোনও তরল। সেটা ভারী ক্রুড অয়েল নয়। আবার আরেক জায়গায় পাওয়া গেছে ভারী, ধীর গতির কিছু। ওই আওয়াজ এসেছে মহাদেশীয় তাকের অনেক গভীর থেকে। কিন্তু অত গভীরে কখনও ড্রিল করা হয়নি।
‘হয়তো তৈরি হচ্ছে আগ্নেয়দ্বীপ,’ বলল আসিফ, ‘আমরা হয়তো ওটাই খুঁজছি।’
‘কিন্তু ঘুরে আসার উপায় নেই,’ বলল সোহেল।
‘আপনারা পুরুষালী সব চিন্তা করছেন,’ বলল তানিয়া। ‘এবার মেয়েলিভাবে ভাবুন। আমরা সহায়তা চাইতে পারি চিন সরকারের কাছে। ডেটা দেব। জানাব, সাগর ফুঁড়ে উঠে আসছে জমি ওপরে। সম্ভবত তৈরি হচ্ছে চিনের এলাকায় বড় কোনও দ্বীপ। আমরা চাইব ওটা পরীক্ষা করতে। হতেও তো পারে রাজি হবে চিনা সরকার?’
কথাটা কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে তারপর বলল রানা, ‘তাতে বাড়বে বিপদের সম্ভাবনা। গতরাতে খুন হয়েছে শিমের পাঁচজন শিষ্য। বিজ্ঞানী হাসপাতালে। বাঁচবেন কি না ঠিক নেই। এতবড় হামলা হয়েছে শুধু ডেটা গোপন করতে। সেগুলো চিনের পুব সাগরের। চিনা সরকার সরাসরি জড়িত না হলেও চাল দিচ্ছে শক্তিশালী কোনও পক্ষ।’
মাথা দোলাল তানিয়া, বুঝতে পেরেছে।
‘যারাই হোক, গোপন করছে কিছু,’ বলল রানা, ‘চাইছে না সব ফাঁস হোক। কাজেই খুঁজতে হবে অন্য পথ।’
‘বলতে পারো ওখানে যাওয়া প্রায় অসম্ভব,’ বললেন হ্যামিলটন। পরক্ষণে জানালেন, ‘রানা, তোমার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছি চাইনিয লিসেনিং পোস্টের ব্যাপারে সব ডেটা। সোনার বয়া, তাদের প্যাট্রল স্কেজুয়াল আর সার্ভেইল্যান্স কেপেবিলিটির তথ্য আছে ওসব ডেটার ভেতর। তবে আমরা চাই না আন্তর্জাতিক কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়তে। তোমরা ওখানে ধরা পড়লে, মেরে না ফেললেও, অন্তত বিশ বছর পচতে হবে চিনা জেলখানায়।’
সোহেলের দিকে তাকাল রানা।
কাগজ সরাবার আওয়াজ পেল ওরা ফোনে।
‘এবার বিদায় নেব,’ বললেন হ্যামিলটন, ‘প্রেসিডেন্টের সঙ্গে মিটিং আছে। কয়েক ঘণ্টা পর যোগাযোগ করব তোমাদের সঙ্গে। আশা করি এরই ভেতর দেখে নেবে জরুরি ডেটা।’
লাইন কেটে যেতেই উঠে দাঁড়াল রানা। অন্যরা হাই তুললেও পুরো সচেতন ও।
ঘুমে কাতর হলেও ওর দিকে মাথা দোলাল সোহেল। ‘এবার? ঢুকতে হবে চিনের সাগরে?’
কেউ কিছু বলার আগেই টোকার আওয়াজ হলো দরজায়। কবাট খুলে রানা দেখল, সামনে দাঁড়িয়ে আছে হোটেলের ডেস্ক ম্যানেজার। হাতে একটা মেসেজ।
কাগজটা নিয়ে চোখ বোলাল রানা।
‘কী ওটা?’ জানতে চাইল তানিয়া।
‘বলতে পারো সমন,’ বলল রানা, ‘বলেছে জাপানি ফেডারাল পুলিশের ডিসট্রিক্ট অফিসে যেতে।’
‘মনে হচ্ছে ভালুকের মত ছয়মাস ঘুমিয়ে থাকি, বলল সোহেল। ‘তুই বরং যা।’
মাথা নাড়ল রানা। ‘উপায় নেই। তোর জন্যেই এত আয়োজন। ওই যে, কমোডো ড্রাগনের ডিনার হতে আপত্তি তুলে পালিয়ে গেল যে লোক, তার ব্যাপারে কথা বলতে চেয়েছে তোর সঙ্গে। আমাদের মধ্যে তুই একমাত্র লোক, যে তাকে দেখেছে।’
আরেকবার হাই তুলল সোহেল। ‘ঠিক আছে, ওদেরকে খুলে বলব, কীভাবে বিপুল সাহসের সঙ্গে লড়াই করে, আস্ত শরীরটা নিয়ে বেরিয়ে এসেছি ভয়ঙ্কর চার ড্রাগনের কবল থেকে!’
মাথা দোলাল রানা, চোখে কৌতুক।
ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল তানিয়া। ‘ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিমানে চেপে এখন চোখ ভেঙে ঘুম পাচ্ছে।’
‘আমারও একই হাল,’ বলল আসিফ। ‘তোরা পুলিশের সঙ্গে কথা বলে আয়, আমরা একটু ঘুমিয়ে নিই।’
‘পারলে ঘুমিয়ে নে,’ বলল রানা। ‘তবে বোধহয় চিনের পুব সাগর থেকে ঘুরে আসার উপায় বেরোবে।’
ঘাড় কাত করে বন্ধুকে দেখল আসিফ।
ভুরু কুঁচকে গেছে তানিয়ার। ‘নুমা চিফ না বললেন উপায় নেই ওখানে যাওয়ার?’
‘উনি বলেছেন আমেরিকান সরকারকে জড়ানো চলবে না, ‘ বলল আসিফ।
‘কিন্তু তাঁর মুখ এসব বললেও চোখে ছিল নীরব সায়, ‘ বলল রানা।
আপত্তি তুলল তানিয়া, ‘কিন্তু আপনি তো আর তাঁর চোখ দেখেননি।’
‘কল্পনায় দেখে নিয়েছি,’ হাসল রানা। ‘নইলে এত ডেটা পাঠাচ্ছেন কেন? নেভাল প্যাট্রল আর সোনার বয়ার অত বয়ান এমনি এমনিই? তবে আমাদেরকেই খুঁজে নিতে হবে নিরাপদ পথ।’
বুকে দু’হাত ভাঁজ করল তানিয়া। ‘আমার তো মনে হয়নি তিনি চান আমরা গিয়ে বিপদে পড়ি।’
‘খোলা লাইনে আর কিছু বলার উপায় ছিল না তাঁর,’ বলল রানা, ‘কান পাততে পারে যে-কেউ। কয়েক মিনিট পর দেখো এনক্রিপটেড ই-মেইল লিঙ্ক। নতুন মেসেজ না পেলে ঘুমিয়ে পার করে দিয়ো বিকেলটা।’
‘রানার মত আমারও মনে হয় খাটুনির কাজ পেয়ে যাবি,’ আসিফকে বলল সোহেল। স্বামী-স্ত্রী ঘর ছেড়ে চলে যেতেই উঠে আড়মোড়া ভাঙল সে। ‘বাপরে! ঘুমের অভাবে বুড়ো তো হয়েইছি, তার ওপর হাড়-মুড়মুড়ে ব্যারামও ধরেছে!’
মুচকি হাসল রানা। ‘হে, মহাবীর, ড্রাগন পালোয়ান! আমি তো বিমানে ঘুমিয়ে চ্যাম্পিয়ন বদ্ধ-পাগল; তুই কী? তোর এত ঘুম-ঘুম কীসের?’
‘চোপ! ব্যাটা পার্মানেন্ট পাষণ্ড!’ বিড়বিড় করল সোহেল।