1 of 2

মহাপ্লাবন – ১১

এগারো

‘জলদি আসুন,’ তাড়া দিলেন জাপানি বিজ্ঞানী শিমেযু। ‘চলুন!’ খুব নার্ভাস হয়ে গেছেন তিনি।

দুর্গের অচেনা অংশে পৌছে বলল সোহেল, ‘আমরা এদিক দিয়ে আসিনি।’

ওর পেছনে ছুটছে আসিফ ও তানিয়া।

‘এটা শর্টকাট, বললেন শিমেষু, ‘লুকিয়ে পড়ব। চাইলেও আমাদেরকে খুঁজে পাবে না।’

কাঠের এক দরজার সামনে থামলেন তিনি। কোমর হাতড়ে পুরনো আমলের তামার চাবি নিয়ে খুললেন তালা। বাইরে দরজা মেলতে যাওয়ায় বুঝলেন, ওদিকের মেঝেতে আছে ভারী কিছু। কবাটের সরু ফাঁক পেরিয়ে ওরা দেখল, এটা বৃত্তাকার বড় একটা ঘর। দরজার কাছে পড়ে আছে লাশ। মৃতদেহের পাশে বসলেন শিমেযু। বিড়বিড় করে বললেন, ‘মাসাকাজু। প্রিয় অনুসারী। বাপ-মার অত্যাচারে আমার কাছে চলে এসেছিল।’

ঝুঁকে পাল্স্ দেখল সোহেল। নেই। কাছ থেকে গুলি করে ঝাঁঝরা করা হয়েছে মাসাকাজুকে। নিচু গলায় বলল ও, ‘মারা গেছে। তার মানে, দুর্গে ঢুকে পড়েছে শত্রুরা।’

মাথা দোলালেন শিমেযু। ‘প্রশ্ন হচ্ছে: তারা কতজন আর কোথায় আছে।’

রক্তের ফোঁটা গেছে দূরের দরজার কাছে।

‘ওদিকে না যাওয়াই ভাল,’ বলল তানিয়া।

বাইরে বাড়ল গুলির আওয়াজ। নাকে এল পোড়া কাঠের কড়া গন্ধ।

‘যে-পথে এসেছি, সেদিকে ফিরতে পারব না,’ বলল আসিফ।

বৃত্তাকার ঘরের তৃতীয় দরজাটা সরাসরি সামনে। ওদিক দিয়ে না বেরোলে পেঁচানো এক সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হবে ছোট এক দরজার কাছে।

দৌড়ে গিয়ে তৃতীয় দরজার হ্যাণ্ডেলে মোচড় মেরে নিজের দিকে টান দিলেন শিমেযু।

‘একমিনিট!’ মানা করতে চাইল সোহেল।

কিন্তু দেরি হয়ে গেছে।

টান দিয়ে দরজা খুলেছেন জাপানি বিজ্ঞানী। তাজা অক্সিজেন পেয়ে ওদিকের ঘর থেকে ছিটকে এল গনগনে আগুনের হলদে হলকা ও কুচকুচে কালো ধোঁয়া— ঘিরে ফেলল মানুষটাকে। শকওয়েভের ধাক্কায় ছিটকে পড়লেন তিনি বৃত্তাকার ঘরের মাঝে। ভাঙা পুতুলের মত পড়ে রইলেন। আগুনে পুড়ছে কাপড়চোপড়।

দৌড়ে তাঁর পাশে গেল সোহেল। খুলেছে নিজের কোট। ওটা দিয়ে চাপড়ে নেভাতে চাইল ধিকিধিকি আগুন। ওকে সাহায্য করতে চাইছে তানিয়া। সামনে বেড়ে ওদিকের দরজাটা দড়াম করে বন্ধ করল আসিফ। তাতে ওদিকের ঘরে আটকা পড়ল আগুন ও ধোঁয়া।

‘পুড়ে গেছে মুখটা,’ বলল তানিয়া, ‘দু’হাতের অবস্থাও খুব খারাপ। তবে মনে হয় বেশিরভাগ শিখা গেছে পোশাকের ওপর দিয়ে।’

একবার গুঙিয়ে উঠে নীরব হয়ে গেলেন শিমেযু।

‘মেঝেতে পড়ার সময় জোরে ঠুকে গেছে মাথা,’ বলল সোহেল, ‘জ্ঞান নেই, মেডিকেল সাহায্য দরকার।’ রোবটিক হাত ও ডানহাত ব্যবহার করে শিমেযুকে কাঁধে তুলল ও। দ্বিতীয়তলার দরজা দেখাল। ‘ওখানে উঠলে হয়তো বেরোবার পথ পাব।

‘বাইরে শত্রুরা,’ পুরু লাঠি শক্ত হাতে ধরল তানিয়া।

‘বেরোবার চেষ্টা না করে উপায় নেই,’ বলল সোহেল, ‘আগুন ভরা দুর্গে আটকা পড়েছি অসহায় ইঁদুরের মত। আমাদের মধ্যে একমাত্র শিমেযু জানতেন কোথায় যাওয়া উচিত।’ তাড়া দিল ও, ‘আসিফ, তানিয়া, সামনে যা। আমি পেছনে থাকব বিজ্ঞানীকে নিয়ে।

প্রথমে সিঁড়ি বেয়ে উঠল আসিফ। ওর পেছনে তানিয়া। দরজা খোলার আগে ওরা দেখল, ওদিক থেকে আগুনের তাপ আসছে কি না। কবাট খুলে ঢুকে পড়ল পরের ঘরে। শিমেযুকে কাঁধে নিয়ে অনুসরণ করল সোহেল। দরজা পেরোবার সময় খুব সতর্ক থাকল, যাতে চোট না পান অচেতন মানুষটা।

ওদিকের দরজা খুলে হতবাক হয়েছে আসিফ ও তানিয়া। কমলা আগুনে দাউদাউ জ্বলছে পুরো চারতলা কারুকার্যময় প্যাগোডা দুর্গ।

‘আশা করি মাসুদ ভাই টাওয়ারে এখন নেই,’ শুকনো গলায় বলল তানিয়া।

‘নিশ্চয়ই সরে গেছে,’ বলল আসিফ।

‘এগোতে শুরু কর, লেকের তীরে যাব,’ তাড়া দিল সোহেল।

ছোট্ট সেতু পেরিয়ে বাইরের দেয়াল লক্ষ্য করে চলল ওরা। কিছুটা যেতেই পেছনে খুলে গেল দুর্গের এক দরজা। ওখান থেকে দৌড়ে এল দুই লোক।

‘এদিকেই আসছে,’ বলল আসিফ। ‘যদি দেখে ফেলে, খুন হব।’

‘না দেখে ওদের উপায় নেই,’ বলল সোহেল, ‘শিমেযুকে কাঁধে নে। লুকিয়ে পড় কোথাও। ওদেরকে ব্যস্ত রাখব আমি।’

বর্শা ফেলে দেয়ালে শরীর ঠেকিয়ে নিচু হলো আসিফ। সোহেলের কাছ থেকে নিজ কাঁধে নিল আহত বিজ্ঞানীকে। তানিয়ার পিছু নিয়ে লেকের দিকে নামতে লাগল আসিফ।

ওরা চোখের আড়াল হতেই বর্শাটা নিল সোহেল। ঘুরে দাঁড়িয়ে মিশে গেল অন্ধকারে। আয়, শালারা!

ধোঁয়ার মাঝ দিয়ে সেতুর দিকে ছুটে আসছে দুই আততায়ী। আগুন থেকে বাঁচতে হবে! তবে সোহেল, আসিফ, তানিয়া বা শিমেযুকে দেখলে দ্বিধা করবে না গুলি করতে। মরতে আপত্তি আছে সোহেলের। ঘাপটি মেরে অপেক্ষা করছে অন্ধকারে। লোকদুটো নাকের কাছে পৌছে যেতেই উঠে দাঁড়াল ও, বর্শা ঘুরিয়ে লাঠির মত করে সাঁই করে মারল প্রথম লোকটার পেটে। মারাত্মক ব্যথায় দু’ভাজ হলো আততায়ী। এদিকে দ্বিতীয় লোকটা পিস্তল তুলেই তাক করল সোহেলের বুকে। কিন্তু বর্শার ডগা ঠাস করে নামল তার কবজির ওপর।

পাথরে পড়ে কোথায় যেন হারিয়ে গেল পিস্তল। নিক ‘বুম্!’ শব্দে গুলি বেরোলেও লাগল না কারও গায়ে। দ্বি লোকটাকে ল্যাং মেরে ফেলতে চাইল সোহেল। কিন্তু ওকে জড়িয়ে ধরল আততায়ী। সোজা পাশের নিচু দেয়াল টপকে শুকনো, গভীর পরিখায় গিয়ে পড়ল ওরা।

ওই খাদেই পেটে রাজ্যের খিদে নিয়ে অপেক্ষা করছে বেশ ক’টা কমোডো ড্রাগন!

.

বিজ্ঞানী শিমের ছোট্ট কামান দু’হাতে তুলে সাবধানে সিঁদি বেয়ে নামছে রানা। কালো ধোঁয়ায় জ্বলছে চোখ, দেখছে প্রায় কিছুই। মেঝেতে নেমে আরেকটু হলে হিনার শরীরে পা বেধে আছাড় খেত। পড়ে আছে মেয়েটা। দরজার নিচের ফাঁক ও জানালা দিয়ে ঢুকছে তাজা হাওয়া, বেরিয়ে যাচ্ছে সিঁড়িঘরের দরজা দিয়ে। এ কারণেই এখনও বেঁচে আছে ওরা।

মেঝেতে কামান রেখে বসল রানা। ওর দিকে ক্রল করে এল হিনা। রানাকে সাহায্য করল কামান ঠিক দিকে তাক করতে। দ্রুত হাতে আট পাউণ্ডের নিরেট স্টিলের ভারী কামানে বারুদ ও গোলা ভরল ওরা। কামানে নেই লিন্সটক বা লাইটার। আগেই সিঁড়িতে এক টুকরো কাগজ পেয়েছে রানা, ওপর থেকে নেমে আসা আগুনে ওটা ধরিয়ে নিল। কাগজ দিয়ে জ্বেলে দিল ফিউয। পেরোল কয়েক সেকেণ্ড, ঘটল না কিছুই। তারপর চিড়বিড় শব্দে জ্বলল ফিউয, পরের সেকেণ্ডে দরজা ফাটিয়ে বেরিয়ে গেল আট পাউণ্ডের গোলা।

‘কাজের জিনিস এই কামান,’ বিড়বিড় করল রানা। এবড়োখেবড়ো কাঠের টুকরো সরিয়ে ক্রল করে বেরোল পরের ঘরে। টপকে গেল একগাদা আসবাবপত্র। ওগুলো দিয়ে আটকে রাখা হয়েছিল দরজা। ‘কোন্ দিকে গ্যারাজ?’

‘চলুন,’ পথ দেখাল হিনা। পাঁজরের ব্যথা সহ্য করে হাঁটছে। পৌঁছে গেল গ্যারাজে। ওখানে ওরা পেল শিমের সাতজন শিষ্যকে। তবে আশপাশে নেই শিমেষু, সোহেল, আসিফ বা তানিয়া।

‘গুরু আর অন্যরা এখানে নেই?’ জানতে চাইল হিনা।

মাথা নাড়ল এক শিষ্য।

‘তা হলে আবারও ফিরব,’ বলল হিনা। ঘুরে দাঁড়াতেই ওর বাহু ধরল রানা। গ্যারাজের ভেতর ভকভক করে ঢুকছে কালো ধোঁয়া।

‘ওপরতলায় আর যেতে পারবে না,’ বলল রানা, ‘চিন্তা কোরো না। মাস্টার শিমের সঙ্গে সোহেল আছে। ও সরিয়ে নেবে তাঁকে।’

হাত ছাড়িয়ে দলের অন্যদের দিকে ঘুরল হিনা।

‘ওদের বলো গাড়িতে উঠতে,’ বলল রানা। ‘দুর্গ ধসে পড়ার আগেই বেরোতে হবে।’

আঞ্চলিক জাপানি ভাষায় নির্দেশ দিল হিনা। সে-ই দলের নেত্রী। এবার বলল, ‘নামিয়ে দেব ড্র-ব্রিজ।’ ছুটে দেয়ালের কাছে গেল সে। একপাশে সরাল একটা লিভার, তারপর নিচু করল ওটা।

নেমে গেল ড্র-ব্রিজ। ধুম্ করে আটকে গেল জায়গায়। আগুন ধরেছে গ্যারাজে, একটু পর জায়গাটা হবে নরক।

.

আট ফুট ওপর থেকে পরিখার বালিতে পড়ে আলাদা হয়েছে সোহেল ও আততায়ী। কারও দেরি হলো না উঠে দাঁড়াতে। প্রাণের ভয়ে ভুলে গেছে লড়াইয়ের কথা। দু’জনেরই চোখ খুঁজছে কমোডো ড্রাগন।

একদিক থেকে এল অপেক্ষাকৃত ছোট দুটো সরীসৃপ। তৃতীয়টা অপেক্ষা করছে আগের জায়গায়। আর সবচেয়ে বড়টা ধীর পা ফেলে আসছে উল্টোদিক থেকে।

আগে যেসব কমোডো ড্রাগন দেখেছে, সেগুলোর চেয়ে এগুলোকে অনেক বেশি বিরক্ত ও আক্রমণাত্মক বলে মনে হলো সোহেলের। আগুন, ধোঁয়া, ছাই আর তার ওপর প্রায় ঘাড়ের ওপর বাজে দুটো প্রাণী নামতেই মনের শান্তি নষ্ট হয়েছে তাদের।

ছোটদুটোর একটা সরাসরি এল সোহেলের দিকে। ওটাকে ভয় দেখাতে পুরো সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে, দেবতার স্টাইলে দু’হাত আকাশে তুলল সোহেল।

বিচ্ছিরি জন্তুটা হঠাৎ করে নড়েছে বলে চিন্তায় পড়েছে কমোডো ড্রাগন। বেঁটে পাগুলো ভাঁজ করে প্রায় শুয়ে পড়ল। কয়েক সেকেণ্ড পর আবারও এগোল। এখন আর মোটেও ভয় পাচ্ছে না সোহেলকে।

একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে আততায়ী, ধমকের সুরে তার কাছে জানতে চাইল সোহেল, ‘কী রে, শালার শালা, তোর পিস্তল কই?’

কড়া চোখে ওকে দেখল জাপানি লোকটা। বাংলা ভাষা না বুঝলেও বক্তব্য ভালই বুঝেছে, যেভাবে হোক বাঁচতে হবে। তার দিকে না চেয়ে বালি থেকে একমুঠো নুড়িপাথর তুলে ড্রাগনের নাক-মুখে ছুঁড়ল সোহেল। একটু দূরে বর্শাটা দেখে দৌড়ে গিয়ে কুড়িয়ে নিল ওটা। ঘুরেই দু’হাতে বর্ণা বাগিয়ে খোঁচা দিতে চাইল ছোটমিয়ার নাকে।

ভয় পেয়ে হিসহিস শব্দে সরে গেল কুমিরের সম্মুন্ধি।

এদিকে হঠাৎ খরগোসের গতি তুলে কাছের দেয়াল লক্ষ্য করে ছুট দিল সোহেলের সঙ্গের লোকটা। বিড়বিড় করে বলে চলেছে, ‘ওউস্‌, ওয়াতাশিনোচিচি!’ অর্থাৎ: ওরে, বাপরে বাপ!

তাকে দৌড়াতে দেখে আচমকা খেপে গেল পরিখার বড় মিয়াসাহেব। দৈর্ঘ্য দশ কি বারো ফুট, ওজন কমপক্ষে তিন শ’ পাউণ্ড। অবিশ্বাস্য গতি তুলে তেড়ে গেল লোকটার দিকে।

একবারও ঘুরে তাকাল না আততায়ী, দৌড়ে গিয়ে লাফ দিয়ে ধরল দেয়ালের ওপরের কিনারা। পেছন পেছন ছুটে গেল কমোডো ড্রাগন। পেছন পায়ে ভর দিতেই পেয়ে গেল শিকারকে নাগালে। লোকটার কাঁধ ও বাহুতে বসাল বড় বড় হলুদ দাঁত। ছিঁড়ে গেল শার্ট, সঙ্গে এল ছোট এক চাকা মাংস। ছেঁড়া কাপড় ও মাংস নিয়ে ধপ করে পরিখার মেঝেতে পড়ল কমোডো ড্রাগন। খুবই হতাশ। আরেকটু হলে পেতে যাচ্ছিল দারুণ ডিনার।

হাঁচড়েপাছড়ে দেয়ালে উঠল আততায়ী।

তার কাঁধে রঙিন উল্কি দেখল সোহেল। এভাবে লাফিয়ে দেয়ালে লোকটাকে উঠতে দেখে রীতিমত শ্রদ্ধা জন্মেছে ওর মনে। তখনই চিন্তা এল মনে: এবার? দুনিয়ার সবচেয়ে হিংস্র চারটে জন্তুর সঙ্গে রয়ে গেছি খাদের ভেতর!

ফিসফিস করল সোহেল, ‘কোন্ কুক্ষণে বলেছি: ওগুলো কীভাবে খায় দেখতে পেলে বেশ হতো!’

ওর দিকেই আসছে চার কমোডো ড্রাগন।

হয়তো বর্শা দিয়ে অন্যগুলোকে ঠেকাতে পারবে, কিন্তু বড়টা কামড়ে ভাঙবে বর্শা। বা দাঁত খিঁচিয়ে কেড়ে নেবে। আর তারপর ওকে খাওয়ার পর টুথপিকের মত ব্যবহার করবে দাঁত পরিষ্কার করতে!

না, এ হতে দেয়া যায় না!

দানবটাকে পাশ কাটিয়ে ঝেড়ে দৌড় দেবে, ভাবল সোহেল। কিন্তু ওকে সরতে দেখে পথ আটকে দিল বড়মিয়া।

তখনই বজ্রপাতের মত বিকট এক আওয়াজে চমকে গেল সোহেল ও চার ড্রাগন। পরিখায় হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল জ্বলন্ত প্যাগোডার একাংশ। চারদিকে ছিটকে গেল আগুনের ফুলকি। ভয় পেয়ে সরসর করে ক’ গজ পিছিয়ে গেছে চার কমোডো ড্রাগন।

‘আগুন অপছন্দ,’ বিড়বিড় করে আগুনের দিকে এগোল সোহেল। গা থেকে কোট খুলে ওটা দিয়ে সাবধানে ধরল লম্বা একটা জ্বলন্ত কাঠ। এখন একহাতে বর্শা, আরেক হাতে জ্বলন্ত মশাল। জন্তুগুলোর দিকে এগোতে শুরু করে কাছের ড্রাগনটার দিকে আগুনে কাঠ ঠেলে ধমকে উঠল সোহেল, ‘পিছিয়ে যা বলছি!’

মোটা, বেঁটে পা দিয়ে চাপড় মেরে জ্বলন্ত কাঠ সরাতে চাইল জন্তুটা। তবে চামড়ায় তাপ লাগতেই সরে গেল। ওটার মতই পিছু হঠল অন্য দুই ছোট ড্রাগন। কিন্তু জায়গা ছাড়তে আপত্তি আছে বড়মিয়ার।

‘হয় এখন, নইলে কখনও নয়,’ বিড়বিড় করল সোহেল। পরক্ষণে ঝেড়ে দৌড় দিল জন্তুটার দিকে। ওটার মুখ লক্ষ্য করে তাক করেছে জ্বলন্ত কাঠ।

অনায়াসেই নাক দিয়ে ঠেলে আগুন ধরা কাঠ সরিয়ে দিল জন্তুটা। ক্ষণিকের জন্যে সরে গেছে মনোযোগ, এটাই চেয়েছে সোহেল। দৌড়ের মধ্যেই সামনের বালিতে বর্শা গাঁথল ও, পোল ভল্টের ভঙ্গিতে শূন্যে ভেসে পেরোল বড় ড্রাগনটাকে। পা বালিতে পড়তেই উড়ে চলল ও দেয়াল লক্ষ্য করে।

ওপরে ছোঁ দিয়েও উড়ন্ত খাবার মুখে পায়নি বড়মিয়া। চার পা নিয়ে ধপ্ করে বালিতে পড়ল ওটা। ঝট্ করে ঘুরে গেল টিকটিকির মত। ধাওয়া করবে কি না বুঝছে না।

ততক্ষণে লাফিয়ে সিমেন্টের দেয়ালের কিনারা দু’হাতে ধরেছে সোহেল। শরীর টেনে উঠে পড়ল ওপরে। ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাকাল পরিখার ভেতর।

নিচে অর্ধবৃত্ত তৈরি করে রাগী চোখে ওকে দেখছে চার কমোডো ড্রাগন। একবার হাত নেড়ে টাটা দিয়েই লেকের দিকে ছুট দিল সোহেল। ওদিকেই পাথরের স্তূপের আড়ালে বিজ্ঞানী শিমেযুকে নিয়ে লুকিয়ে আছে আসিফ। আশপাশে দেখা গেল না আহত আততায়ীকে। লেকে তুমুল গতি তুলে আঁধারে হারিয়ে গেল কয়েকটা স্পিডবোট।

সোহেল বাইরের দেয়ালের কাছে যেতেই পাথর স্তূপের পেছন থেকে বেরিয়ে এল আসিফ। ‘চলে যাচ্ছে।’

‘জানা দরকার এরা কারা, এবং কেন এসেছিল,’ বলল তানিয়া।

‘যে কাজে এসেছে, শেষ করে গেছে,’ বলল সোহেল। ‘পুড়িয়ে আহত করেছে বিজ্ঞানীকে। নষ্ট হয়েছে তাঁর যন্ত্র- পাতি। ছাই হচ্ছে দুর্গ। কোনও রেকর্ড বা ডেটা পাব না। সব ছিল কাগজে।’

‘সব নষ্ট হয়নি,’ বলল তানিয়া।

ঘুরে ওকে দেখল সোহেল।

লাঠিতে মুড়িয়ে রাখা একটা কাগজ খুলল তানিয়া। ওটা নীল ওই বড় মানচিত্রের অংশ। ছিঁড়ে এনেছে ফ্রেম থেকে। পরিষ্কার দেখা গেল লাল রঙের সব রেখা।

‘বিশেষ কেউ চাইছে আমরা যেন জানতে না পারি কোথা থেকে শুরু হচ্ছে যি-ওয়েভ,’ বলল তানিয়া। ‘তাই মনে হলো এসব তথ্য আমাদের কাজে লাগবে।’

‘মানুষ খুন করবে, এতই জরুরি তথ্য?’ বিড়বিড় করল আসিফ।

‘খুন করেছে, নিজ চোখেই দেখলি,’ বলল সোহেল। একবার দেখল অচেতন বিজ্ঞানীকে। ‘এঁর কী হাল?’

‘কাশির সঙ্গে রক্ত উঠছে,’ বলল তানিয়া, ‘বোধহয় পুড়ে গেছে ফুসফুস। শ্বাস নেয়ায় বুকে ঢুকেছে আগুন।’

চুপ করে থাকল সোহেল ও আসিফ। শিমেযুকে বাঁচানো যাৱে কি না, জানা নেই। মানুষটাকে নিতে হবে কোনও হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে।

‘একটা গাড়ি পেলে হতো,’ বলল আসিফ। ‘পুড়ে গেছে গ্যারাজ?’

কাঁধের ওপর দিয়ে পেছনে তাকাল সোহেল। জবাব দিতে হলো না ওকে। পুরো কাঠের দুর্গ এখন অঙ্গার। লাল-হলদে আগুনের পাহাড়ের চূড়া যেন। ‘বেশিক্ষণ লাগবে না, আগুন দেখে পৌঁছে যাবে সবাই।’

একমিনিট পর ওরা শুনল ইঞ্জিনের আওয়াজ। আঁধার চিরে আসছে বোট। তীরের কাছে গেল ওরা।

অন্ধকারে চোখ চালাল সোহেল। কয়েক সেকেণ্ড পর দেখল, জল কেটে আসছে বোঁচা, থ্যাবড়া নাকের ভারী এক গাড়ি, শব্দটা ফোক্সভাগেনের এয়ার কুল্ড ইঞ্জিনের মত।

‘দ্য ডাক,’ জানাল সোহেল। ‘শিমের কালেকশনে ছিল। অ্যামফিবিয়াস কার।’

হুইলে রানা। পাশে হিনা। পেছনে বিজ্ঞানীর ক’জন স্যাঙাৎ।

রানার মনোযোগ কাড়তে প্রাণপণে হাত নাড়তে লাগল সোহেল।

ধীরে ধীরে তীরের দিকে এল মন্থর গতি উভচর গাড়ি।

খুশি হয়ে হেসে ফেলল সোহেল, আসিফ ও তানিয়া।

এবার হাসপাতালে নিতে পারবে আহত বিজ্ঞানীকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *