1 of 2

মহাপ্লাবন – ১০

দশ

ঝনঝন শব্দে কাঁচ ভাঙতেই ভারী ডেস্ক টপকে ইয়োশিরো শিমেযুকে নিয়ে দূরের মেঝেতে ঝাঁপ দিয়েছে রানা। চোখের কোণে দেখেছে কাভার নিতে অন্যদিকে ঝাঁপ দিয়েছে আসিফ ও তানিয়া। সোহেলের পায়ের কাছেই ছিল গ্রেনেড।

দক্ষ উইকেট কিপারের মত বোমা তুলেই পরক্ষণে ফিরতি পথে ছুঁড়ে দিয়েছে সোহেল। জানালার কাঁচে গর্ত তৈরি করে কিছুটা গিয়েই বিস্ফোরিত হয়েছে গ্রেনেড। আগুনে বোমা, নানাদিকে ছিটকে দিয়েছে জেলি করা গ্যাসোলিন। কাছাকাছি কেউ থাকলে বেঘোরে পুড়ে মরত। বিস্ফোরিত গ্রেনেড জ্বলে উঠেছে আস্ত সূর্যের মত। মুহূর্তে ঘরের প্রতিটি জানালা চুরমার করে চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে জ্বলন্ত গ্যাসোলিন ও কাঁচের টুকরো। ঝনঝন আওয়াজ থামতে না থামতেই ওরা শুনল লেকে মোটরবোটের কর্কশ গর্জন। পরের মুহূর্তে শুরু হলো দুর্গের ভেতর পশলা পশলা গুলির আওয়াজ।

জাপানি বিজ্ঞানীকে মেঝেতে উঠে বসতে সাহায্য করল রানা। ‘শত্রুরা হামলা করেছে আপনার দুর্গে।’

‘কিন্তু কেন?’ অবাক হয়ে বললেন শিমেযু। ‘এ কাজ করবে কে?’

‘আমিও তা-ই জানতে চাই,’ বলল রানা।

‘আমার শিষ্যরা রক্ষা করবে দুর্গ,’ গর্বের সঙ্গে বললেন বিজ্ঞানী।

গুলির শব্দ বহু কিছু বুঝিয়ে দিল রানাকে। শুকনো গলায় বলল ও, ‘তলোয়ার বা ড্যাগার দিয়ে? কীভাবে?’

‘এটা কাজে আসতে পারে,’ পুরনো গ্যাটলিং গানের পাশ থেকে বলল সোহেল, ‘আপনার কাছে অ্যামিউনিশন আছে?’

‘গুলি আছে কয়েক বাক্স,’ বললেন শিমেযু।

ব্রেক খুলে ফ্রেমের ভেতর কাঁধ রাখল সোহেল। চাকা খোলা জানালার কাছে নিয়ে গেল পুরনো অস্ত্রটা।

‘আর কোনও অস্ত্র?’ জানতে চাইল রানা।

‘টাওয়ারে একটা কামান আছে,’ বললেন বিজ্ঞানী।

‘স্পিডবোটের বিরুদ্ধে কাজে আসবে না,’ বলল রানা। চোখ বোলাল দেয়ালে ঝুলন্ত অস্ত্রগুলোর ওপর। তাকে আছে ক্রসবো আর তূণ ভরা লোহার চোখা ফলাওয়ালা তীর। বিজ্ঞানীকে বলল রানা, ‘আপনি সোহেলকে গুলি এনে দিন। নিচু রাখবেন মাথা।’

নিজেও কুঁজো হয়ে দেয়ালের কাছে গেল রানা, সুইচ টিপে নিভিয়ে দিল ঘরের বাতি। তাক থেকে নিল ক্রসবো ও তীর ভরা তৃণ। আবছা আলোয় আসিফ ও তানিয়াকে দেখল। আসিফের হাতে একটা বর্শা। তানিয়ার হাতে মোটা লাঠি। কী যেন পেঁচিয়ে রেখেছে হ্যাণ্ডেলের কাছে। নিচু গলায় বলল রানা, ‘তোরা এখানে থাক্। আমরা সব নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারলে সোজা যাবি গ্যারাজে। কিন্তু বাধ্য না হলে ভুলেও নিচু করবি না ড্র-ব্রিজ।’

‘আপনি কোথায় চলেছেন?’ জানতে চাইল তানিয়া।

কাঁধে ঝুলন্ত তূণ থেকে তীর নিল রানা। ‘টাওয়ারে। পাল্টা হামলা করব ওপর থেকে।’

রানা ঘর ছেড়ে চলে যেতেই সোহেলের পাশে গেলেন বিজ্ঞানী শিমেষু, হাতে দুই বাক্স অ্যামিউনিশন। নিচু হয়ে বসে আছে সবাই। চারপাশের দেয়ালে বিধছে রাশ রাশ গুলি। শিমের কাছ থেকে নিয়ে গুলির বাক্স খুলে খুশি হয়ে উঠল সোহেল। অস্ত্র প্রাচীন হলেও বুলেট আধুনিক।

এই জিনিস কোত্থেকে পেলেন?’

‘আমাদের সঙ্গে আছেন বয়স্ক এক গানস্মিথ।’

‘আশা করি ভাল জিনিসই তৈরি করেছেন।’ বাক্স থেকে শেল নিয়ে হপারে রাখল সোহেল। ক্র্যাঙ্ক ধরে নিচু করে নিল গ্যাটলিং গানের নল। মসৃণভাবে ঘুরছে ক্র্যাঙ্ক, ঘুরিয়ে নিল ছয় ব্যারেল। চেম্বারে ঢুকেছে বুলেট। ব্যারেলগুলো খানিকটা ঘুরতেই রাতের আঁধার লক্ষ্য করে গেল এক রাশ বুলেট। ঠিকভাবে ঘুরছে অস্ত্রের নল। তবে চট্ করে বেশি, অ্যামিউনিশন খরচ করা হবে অনুচিত।

‘নল আরও নিচু করুন,’ বললেন শিমে।

অস্ত্রের নল নিচে নামিয়ে নিল সোহেল। জানালা দিয়ে আবারও পাঠাল গুলি। তাতে নীলচে ধোঁয়ায় ভরে গেল পুরো ঘর।

.

ছুটতে ছুটতে প্যারাপিটের মাঝামাঝি জায়গায় পৌঁছে গেছে রানা, এমনসময় পেছনের ঘর থেকে শুনল গ্যাটলিং গানের গুলির আওয়াজ। কাঁধের ওপর দিয়ে তাকাল ও। জানালা দিয়ে ভকভক করে বেরোচ্ছে নীলচে ধোঁয়া। নিচের লেকে একটা স্পিডবোটের বো-র কাছে পানিতে নাক গুঁজছে সারি সারি বুলেট।

বোট ঘুরিয়ে আঁধারে পালিয়ে গেল ড্রাইভার। একইসময়ে আঁধার থেকে এল আরেক স্পিডবোট। ওটার বো-তে বসে আছে এক লোক। কাঁচওয়ালা ছাতের ঘর লক্ষ্য করে গুলি পাঠাল সে। গ্রেনেড ছুঁড়ে দেয়ার জন্যে তৈরি হচ্ছে তার সঙ্গী

দুর্গের ঘরে এক পশলা গুলি ঢুকতেই থামল গ্যাটলিং গান। নিশ্চয়ই বাধ্য হয়ে কাভার নিয়েছে সোহেল। এদিকে সুযোগ পেয়ে উঠে দেয়ালের ওপর দিয়ে ক্রসবো তাক করে ট্রিগার টিপে দিল রানা।

পুরনো অস্ত্রের দুই ডানা ঝটকা খেতেই সাঁই করে বেরোল তীর। তবে বয়স হয়েছে বলে মুচড়ে গেছে ওটার পেছনের পালক। লক্ষ্য থেকে সরে গেল তীর। লোকটার বুকে না লেগে বিধল ঊরুর মাংসে।

হাত থেকে গ্রেনেড ফেলে হাউমাউ করে উঠল লোকটা। নিচু হলো বোমা তুলে নিতে। কিন্তু তার ঊরু আর বোটের ফাইবারগ্লাস দুটোকেই গেঁথে ফেলেছে তীর। করুণ সুরে কী যেন বলতে শুরু করেও থেমে গেল লোকটা। তখনই বিস্ফোরিত হলো বোট। চারদিকে ছিটকে গেল কমলা আগুনের হলকা।

কিন্তু অন্য বোটের লোক দেখে ফেলেছে রানাকে। ওর দিকে এল গুলি। পুরু দেয়ালের এদিকে বসে পড়ল রানা। মাথার ওপর দিয়ে পেছনের দেয়ালে লেগে নানাদিকে যাচ্ছে বুলেট। ‘একটা বোট গেল, আরও তিনটা, বিড়বিড় করল রানা।

.

বাধ্য হয়ে মেঝেতে শুয়ে কাভার নিয়েছে সোহেল। হঠাৎ শুনল বাইরে বিস্ফোরণের আওয়াজ। ক্রল করে জানালার পাশে পৌছে উঁকি দিল বাইরে।

তুমুল বেগে আসছে-যাচ্ছে কয়েকটা স্পিডবোট। সুযোগ পেলেই গুলি করছে দুর্গ লক্ষ্য করে।

লক্ষ্যভেদ করতে গ্যাটলিং গানের কাছে ফিরল সোহেল। কিন্তু পুরনো অস্ত্র এতই ভারী, দ্রুতগামী বোট অনুসরণ করা কঠিন। কয়েক পশলা গুলি পাঠিয়ে কাঁধ দিয়ে ঠেলে আরেকদিকে অস্ত্রটা সরাল ও। নতুন করে গুলি পাঠাল শত্রু বোট লক্ষ্য করে। গুলি ফুরাতেই দ্বিতীয় অ্যামিউনিশনের বাক্সের দিকে হাত বাড়াল, আর তখনই দেখল শেষ শত্রু স্পিডবোট।

‘ওরা কি চলে যাচ্ছে?’ জানতে চাইলেন শিমেযু।

‘না, যাচ্ছে দ্বীপের অন্যদিকে,’ জানাল সোহেল।

ক’সেকেণ্ড পর আবারও এল গুলির আওয়াজ। এবারে হামলা হয়েছে দুর্গের আরেক দিকে।

‘ভাল হয় পুলিশে ফোন করলে,’ বলল সোহেল।

‘কিন্তু আমাদের তো ফোন নেই,’ বললেন শিমেযু।

‘তা হলে রেডিয়ো ব্যবহার করুন।’

হামাগুড়ি দিয়ে পুরনো এক শর্টওয়েভ রেডিয়োর কাছে গেলেন জাপানি বিজ্ঞানী। টোকা দিলেন মাইক্রোফোনে, তারপর সুইচ টিপে চ্যানেল বদলে রেডিয়ো করলেন জাপানি ইমার্জেন্সি সার্ভিস এজেন্সিতে।

‘সিক্স বলছি… কবুতর… থ্রি… এক্সরে… এক্সরে… ওয়ান,’ তাঁর রেডিয়োর লাইসেন্স কোড বলছেন শিমেযু। ‘আমাদের সাহায্য দরকার। দয়া করে পুলিশ ফোর্স পাঠান। সশস্ত্র লোক হামলা করেছে। আবারও বলছি, একদল সশস্ত্র লোক হামলা করেছে আমাদের ওপর…’

ওদিক থেকে জবাব দিল না কেউ

স্ট্যাটিকের আওয়াজও নেই।

‘যাহ্, ভেঙে পড়েছে অ্যান্টেনা,’ বললেন শিমে। আঙুল তাক করলেন ভাঙা জানালার দিকে। ওটা ওদিকে।’

‘যোগাযোগের চেষ্টা করুন, বলল সোহেল। ‘আমরা বেশিক্ষণ ওদেরকে ঠেকাতে পারব না।’

ওর কথা ঠিক তা প্রমাণ করতেই বাইরের দেয়ালের এদিকে খটাং শব্দে পড়ল একটা গ্র্যাপলিং হুক। গ্যাটলিং গানের নল ঘুরিয়ে অপেক্ষা করল সোহেল। নড়ছে চকচকে হুক। কয়েক সেকেণ্ড পর দেয়ালে উঠে এল এক লোক। কুঁজো হয়ে বসে পড়ল হুকের পাশে। উঠে এল দ্বিতীয় লোকটাও। নল সামান্য ওপরে তুলে সামনে ক্র্যাঙ্ক ঠেলল সোহেল। কিন্তু আধ ইঞ্চি নড়েই জ্যাম হয়ে গেল অস্ত্রটা।

ক্র্যাঙ্ক সামনে ও পেছনে নেয়ার চেষ্টায় কোনও লাভ হলো না। প্রাচীন অস্ত্রের জ্যাম কীভাবে সারাতে হয়, জানা নেই সোহেলের।

এদিকে দেয়ালে উঠেছে আরও দুই আততায়ী।

‘এবার সরে যেতে হবে,’ বলল সোহেল, ‘যে-কোনও সময়ে তেড়ে আসবে ওরা।’

.

শুকনো পরিখা পেরিয়ে দুর্গের মূল ইমারতে ঢুকে পড়েছে রানা। একটু দূরে পেল সিঁড়ি। দৌড় শুরু করে একেকবারে তিনটে করে ধাপ টপকে উঠে এল প্যাগোডার তিনতলায়। গাঢ় ছায়া থেকে বেরোতেই, ঝিলিক তুলে ওর মাথা লক্ষ্য করে নামল তলোয়ার। একেবারে শেষসময়ে বসে পড়ল রানা। খটাং শব্দে ওর পেছনের দেয়ালে লেগে কাঠের চাপড়া উপড়ে নিল ধারালো ফলা। পরের সেকেণ্ডে উঠেই সামনে বাড়ল রানা। শত্রুর ওপর চালাল ব্যাটারিং র‍্যামের মত করে ক্রসবোটা। নিজেও মুখোমুখি ধাক্কা খেল লোকটার সঙ্গে। চট্‌ করে চিনল, লোক নয়, হামলা করেছে হিনা। ল্যাং মেরে মেয়েটাকে মেঝেতে ফেলল রানা। শক্ত হাতে ধরেছে দুই কবজি।

‘মিস্টার রানা…’ বিস্মিত সুরে বলল হিনা।

‘কোন পক্ষের লোক আসছে জেনে তারপর তলোয়ার চালাবে,’ বিরক্ত হয়ে বলল রানা।

‘সরি,’ লজ্জা পেল মেয়েটা। ‘ভেবেছি আপনি শত্রুদের লোক।’

রানা ছেড়ে দিতেই উঠে পিছিয়ে গেল মেয়েটা। মেঝে থেকে নিয়ে দু’হাতে ধরেছে তলোয়ার। এখন পরনে ঝুলন্ত ধাতব প্লেটের তৈরি বর্ম

‘লড়াইয়ের জন্যে পাল্টে নিয়েছ পোশাক,’ মন্তব্য করল রানা।

‘আমিই তৈরি করি দুর্গের সব অস্ত্র, মেরামতও করি, বলল হিনা। ‘আমার দায়িত্ব প্রভু শিমেযুকে রক্ষা করা।’

মেয়েটা পাশ কাটাতে গেল, কিন্তু ডানবাহু ধরে ফেলল রানা। ‘শিমেযুর সঙ্গে আছে আমার বন্ধুরা। ওরাই সরিয়ে নেবে ওঁকে। তুমি আমাকে নিয়ে চলো টাওয়ারে। ওপর থেকে পাহারা না দিলে লেকের দিকের দেয়াল টপকে উঠবে শত্রুরা।

‘চলুন। ঘুরেই রওনা হলো হিনা। ডানদিকের এক দরজা খুলে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল। পিছু নিল রানা। অবাক হয়েছে ভারী বর্ম নিয়ে মেয়েটাকে অনায়াসে চলতে দেখে।

সিঁড়ি শেষে ওরা বেরিয়ে এল একটা প্ল্যাটফর্মে। ওটাই টাওয়ারের সবচেয়ে উঁচু জায়গা। মেঝেতে বসে আছে ছোট একটা কামান। পাশেই ব্যাগ ভরা বারুদ আর লোহার ছোট গোলা দিয়ে তৈরি পিরামিড। গোলা ছুঁড়তে চাইলেও সুবিধা হবে না, বুঝে গেল রানা। ওটা অনেক বেশি ভারী। সরিয়ে তাক করা প্রায় অসম্ভব। কামান বাদ দিয়ে ক্রসবো হাতে রেলিঙের কাছে গিয়ে দাঁড়াল ও।

এত ওপর থেকে পরিষ্কার দেখল দুর্গের আশপাশের বেশিরভাগ জমি। নিচের পরিস্থিতি সুবিধের নয়। ‘ওরা দেয়াল টপকে ঢুকে পড়েছে,’ বলল রানা। ‘তিন দিকে তিনটা দল। সরাসরি দুর্গের দিকে আসছে একটা দল।’

তীর মেরে দলনেতার ঊরু গেঁথে ফেলল রানা। হোঁচট খেয়ে পড়ল লোকটা। ক্রসবো মেঝেতে রেখে ওটা রিলোড করল রানা। এদিকে সাধারণ এক তীরধনুক জোগাড় করেছে হিনা। তীর ছুঁড়ল সে। বুকে তীক্ষ্ণ ফলা গাঁথতেই মেঝেতে পড়ল দলের দ্বিতীয় লোকটা। মেয়েটার দ্বিতীয় তীর ফুটো করল এক শত্রুর বাহু। হাত থেকে পড়ে গেছে তার অস্ত্র, গাছের আড়ালে কাভার নিল সে। চতুর্থ লোকটা পিছিয়ে গেল দেয়ালের আরেক পাশে। হিনার তৃতীয় তীর লাগল দেয়ালে। খটাং শব্দে ছিটকে পড়ল বাগানে। আপাতত এগোবার সাহস হারিয়ে ফেলেছে শত্রুরা।

‘আমার জন্যেও কয়েকটা তীর রেখো, ঠাট্টার সুরে বলল রানা।

হাসল না হিনা। ‘শত্রু এখনও সংখ্যায় বেশি।’

ওর কথা ঠিক তা প্রমাণ করতেই যেন গর্জে উঠল অ্যাসল্ট রাইফেল। রানা ও হিনার মাথার ওপরের কাঠের তক্তায় লাগল একরাশ গুলি। নানাদিকে ছিটকে গেল কাঠের কুচি। ঠক্ঠক্ করে লাগছে লোহার গোলার গায়ে। মেঝেতে শুয়ে কাভার নিল রানা ও হিনা। যেদিক থেকে গুলি এসেছে, তার উল্টো দিকে সরল ওরা।

রেলিঙের দিকে ক্রল করল রানা। ‘আমরা আটকা পড়েছি ক্রস ফায়ারে।’ কয়েক সেকেণ্ড পর খুব সাবধানে উঁকি দিল রেলিঙের ওদিকে। ‘লেকের দেয়ালের ওদিকে কাভার নিয়েছে ওরা। হয়তো কাজে আসবে তোমার গুরুর কামান।’

কিছু করা বা বলার আগেই ওরা শুনল চাপা বিস্ফোরণের আওয়াজ। ছাতের দূরে ভুস করে আকাশে উঠল লালচে আগুন আর কালো ধোঁয়া।

‘মলোটভ ককটেল,’ বলল হিনা।

‘অয়েস্টার আর ক্যাভিয়ার ছাড়াই,’ বলল রানা, ‘অসভ্য লোক এরা।’

নিচে আগুনের কমলা জিভ লকলক করে চাটছে প্রাচীন কাঠের দুর্গের শুকনো দেয়াল। সাপের মত হিসহিস শব্দে টাওয়ারের দিকে উঠছে অসংখ্য শিখা। ভুস ভুস করে চারপাশ ঢেকে দিল কালো ধোঁয়া। এবার পিছু নিয়ে আসবে লেলিহান আগুন।

‘এখান থেকে সরে যেতে হবে,’ বলল রানা।

‘আপনি না বলেছিলেন ওপর থেকে হামলা করবেন?’ জানতে চাইল হিনা।

‘তখন এই টাওয়ার জ্বলন্ত চুলা ছিল না।’ মেয়েটার হাত ধরে সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগল রানা। কিন্তু শেষ ধাপ পেরিয়ে টের পেল, সামনের দরজা এখন বন্ধ। কাঁধ দিয়ে ঠেলল রানা, কিন্তু নড়ল না পুরু কাঠের কবাট।

দরজার ওপরে ছোট্ট জানালা দিয়ে তাকাল হিনা। ‘ভারী কিছু দিয়ে আটকে রেখেছে।

পিছিয়ে গেল রানা, এবার দৌড়ে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে দরজার ওপর, এমনসময় তক্তা ফুটো করে ওদিক থেকে এল এক পশলা গুলি!

সিঁড়ির পাশে সেঁটে গেল রানা। কিন্তু বুকে দুটো গুলি নিয়ে পিছিয়ে মেঝেতে ছিটকে পড়ল হিনা।

ছুটে গিয়ে ছোট জানালা দিয়ে ক্রসবো বের করল রানা। তাক করেই টিপে দিল ট্রিগার।

দরজার দশ ফুট দূরে বাচ্চা কুকুরের মত কেঁউ করে উঠল কেউ। ঝনঝন শব্দে ভাঙল কাঁচের কিছু। পরক্ষণে বিস্ফোরিত হলো মলোটভ ককটেল। জানালা দিয়ে রানা দেখল, আগুন ধরেছে বাইরের ঘরে। পুড়ছে প্রাচীন আমলের সুন্দর ট্যাপেস্ট্রি আর পুরনো আসবাবপত্র।

আবারও গুলিবর্ষণ হবে ভেবে ক্রল করে হিনার পাশে গেল রানা। কাত হয়ে পড়ে আছে মেয়েটা। দু’হাতে চেপে ধরেছে বুক ও পেট। রানা খেয়াল করল, কোথাও নেই রক্ত। হিনার প্রাচীন ধাতব প্লেটিঙের নিচে কেভলার ভেস্ট!

‘কেভলার ভেস্ট পরেও ওই লোহা-লক্কড় কেন?’ জানতে চাইল রানা। ‘নিচের টেকনোলজি তো মন্দ নয়।

ব্যথা চেপে ফিক করে হেসে ফেলল হিনা। ‘এখান থেকে বেরোতে হবে। কেভলার ভেস্ট তো আর ধোঁয়া থেকে বাঁচাবে না।’

‘উঠে দাঁড়াতে পারবে?’

‘বোধহয়,’ উঠেই ব্যথায় প্রায় দু’ভাঁজ হয়ে গেল হিনা। কাশতে লাগল খকখক করে।

ফুসফুস জ্বলছে রানার। বাঁচতে চাইলে বেরোতে হবে এখান থেকে। আবারও সিঁড়ির দিকে তাকাল। তারপর বড় করে দম নিয়ে ছুট দিল ভারী ধোঁয়ার মাঝে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *