এক
ঘোড়ায় চেপে তুমুল বেগে দুই সেনাবাহিনী মুখোমুখি হতেই চারপাশ ভরে উঠল তলোয়ারের ঝনঝনাৎ আওয়াজে।
সময়টা পনেরো শ’ চৌষট্টি সাল।
মধ্য জাপানের পাহাড়ি এলাকা।
স্যাডলে ঝুঁকে নৈপুণ্যের সঙ্গে লড়ছে পাখোয়াজ যোদ্ধা ইউসেই হায়াশি। আক্রমণ এলে ঠেকিয়ে দিচ্ছে শত্রুর তলোয়ার বা বর্শা, দেরি হচ্ছে না পাল্টা হামলা করতে। বিশ্ববিজয়ী সম্রাট অ্যালেক্যাণ্ডারের মতই নিখুঁত তার তলোয়ারবাজি। ঘোড়া নিয়ন্ত্রণের জন্যে স্পার নেই, কারণ ওগুলো ব্যবহার করে না সামুরাই যোদ্ধারা।
রঙচঙে আর্মার পরনে ইউসেই হায়াশির দু’কাঁধে কাঠের বোর্ড, হাতে ভারী গ্লাভ, মাথায় স্ট্যাগ হরিণের শিংওয়ালা শিরস্ত্রাণ। হাতের চকচকে কাতানা থেকে ছিটকে উঠছে সূর্যের সোনালি আলো।
কবজির মোচড়ে কাছের আক্রমণকারীকে নিরস্ত্র করল হায়াশি, পরক্ষণে উল্টো দিকে গেল তলোয়ারের ফলা। তাতে দু’টুকরো হলো আরেক শত্রুর অস্ত্র। লোকটা ঘোড়া নিয়ে পালিয়ে যেতেই বর্শা হাতে হায়াশির ওপর হামলে পড়ল তৃতীয় শত্রু। ধারালো ফলা হায়াশির পাঁজরে গাঁথতে চাইলেও সেটা ঠেকাল ভারী ধাতুর বর্ম, অক্ষত রয়ে গেল সামুরাই যোদ্ধা। পরক্ষণে ঘুরেই প্রচণ্ড বেগে শত্রুর মাথায় কোপ বসাল সে। মাথা থেকে শুরু করে বুক পর্যন্ত দু’ভাগ হলো শত্রুর দেহ।
শত্রুমুক্ত হয়েই আর্মার পরা ঘোড়া চরকির মত ঘুরিয়ে নিল হায়াশি। আকাশে দু’পা ছুঁড়ে তীরবেগে ছুটল রণ-প্রশিক্ষিত জানোয়ার। সামনের দুই লোহার নাল নামল দুই শত্রুর মুখে। ক্ষত-বিক্ষত লাশ লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। তৃতীয় যোদ্ধার ওপর হুমড়ি খেল হায়াশির ঘোড়া। এদিকে চারপাশ থেকে হায়াশিকে ঘিরে ফেলেছে একদল সৈনিক।
ডানে ঘুরে তাকাল হায়াশি, পরক্ষণে বামে। এসেছিল শোগানের বিরুদ্ধে লড়তে, অথচ সংখ্যায় তার সৈনিক বহু গুণ বেশি। ফলাফল যা হওয়ার তা-ই হয়েছে, ফুরিয়ে এসেছে ওর জীবনের শেষ ক’টি মুহূর্ত।
মৃত্যু নিশ্চিত, তবে খুন হওয়ার আগে খতম করবে আরও শত্রু, তাই ভেবে কাছের সৈনিকদের দিকে উন্মত্তের মত ঘোড়া ছোটাল হায়াশি। কিন্তু ও আক্রমণ করবে দেখে আত্মরক্ষামূলক ব্যূহ তৈরি করল শত্রুরা। বাড়িয়ে ধরেছে ঢাল ও বর্ণা। ওদিকে সুবিধা হবে না বুঝে অন্য আরেকদল সৈনিকের দিকে চলল হায়াশি। কিন্তু তারাও হুঁশিয়ার, থমকে দাঁড়িয়ে বাড়িয়ে দিয়েছে অসংখ্য বর্শার তীক্ষ্ণ ফলা।
তাতে দুশ্চিন্তা আরও বাড়ল হায়াশির। এরা বোধহয় বন্দি করতে চায় ওকে। সেক্ষেত্রে তাদের নেতা শোগান চাইবে, যেন সবার সামনে তলোয়ার দিয়ে নিজের পেট চিরে আত্মহত্যা করে ও। কিন্তু লড়াই না করে কাপুরুষের মত জীবন দেবে না হায়াশি!
ঘোড়া নিয়ে নানাদিকে যেতে চাইল সে। কিন্তু প্রতিবার পদাতিক সৈনিকরা বর্শা বা তলোয়ার তুলে আটকে দিল পথ। বাধ্য হয়ে ঘোড়া থামাল হায়াশি। ওটার জন্যেই বাড়তি সুবিধা পাচ্ছে, নইলে বহু আগেই খুন হতো।
‘মায়ের দুধ খেয়ে থাকলে লড়ো!’ শত্রুদের উদ্দেশে হাঁক ছাড়ল হায়াশি, ‘সম্মান বলে কিছু থাকলে লড়ো!’ ডানে তাকাল জান্তব, চাপা গর্জন শুনে। তীরের মত উড়ে এল দীর্ঘ বর্শা। কিন্তু অবিশ্বাস্য বেগে এক কোপে ওটার কাঠের দণ্ড কাটল হায়াশি। একইসময়ে সরাল লোহার ছুটন্ত ডগা। দু’টুকরো হয়ে মাটিতে পড়ল শত্রুর অস্ত্র।
‘ওকে খুন করবে না!’ সৈনিকদের পেছন থেকে বলে উঠল কেউ। ‘ওর মাথা শুধু আমার!’
ওই নির্দেশ শুনে থমকে গেছে সৈনিকরা।
ঘিরে রাখা একদল সৈনিকের মাঝ থেকে বেরোল এক অশ্বারোহী। পরনে সিল্কের রঙিন পোশাক। চট করে তাকে চিনল ইউসেই হায়াশি। ওই লোকের বুকে সোনালি বর্ম, মাথায় ডানাওয়ালা শিরস্ত্রাণ।
আজ সত্যিই লড়তে এসেছে স্বয়ং শোগান!
‘সোসুকে সেইটো!’ উঁচু গলায় বলল হায়াশি। ‘ভাবিনি আমার সঙ্গে লড়তে সাহস পাবে!’
‘তুমি নির্লজ্জ বেঈমান, তাই খতম করতে আসতেই হলো,’ খাপ থেকে সড়াৎ শব্দে তলোয়ার বের করল সোসুকে সেইটো। হায়াশির তরবারির মত হলেও তার কাতানার ফলা পুরু এবং কালচে। ‘সামন্ত রাজা হিসেবে তুমি ছিলে আমার অনুগত, অথচ যোগ দিলে বিদ্রোহী দলে!’
‘তুমিও কথা দিয়েছিলে শান্তিতে থাকতে দেবে সাধারণ মানুষকে, অথচ নির্বিচারে খুন করছ, সব লুঠপাট করে নিয়ে যাচ্ছ!’
‘ভুল, জমি সব আমার!’ কর্কশ কণ্ঠে ধমক দিল শোগান। ‘জমি বা তোমাদের প্রভু আমি! যা আগেই আমার, তা আবার চুরি করে কেউ! তবে তুমি মাফ চাইলে পারে প্রাণভিক্ষা।’
শিস বাজাল শোগান।
ওই ইঙ্গিত পেয়ে ঠেলে আনা হলো ক’টা বাচ্চাকে। দুই ছেলে ও দুই মেয়ে। শোগানের ভৃত্যদের পায়ের সামনে হাঁটু গেড়ে বসিয়ে দেয়া হলো তাদেরকে। ওই চারজনের পেছনে গিয়ে ছোরা বের করল শোগান। কঠিন কণ্ঠে বলল, ‘আমার হাতে হাজারেরও বেশি বন্দি। হেরে গেছে তোমার বিদ্রোহীরা। এবার কে বাঁচাবে তোমাদের গ্রাম? তবে তুমি আত্মহত্যা করলে প্রাণে বাঁচবে অন্যরা। আর যদি লড়তে চাও আমার সঙ্গে, তুমি খুন হওয়ার পর বাঁচতে দেব না কাউকে। বৃদ্ধ, বৃদ্ধা, মহিলা, শিশু বা পুরুষ— রক্ষা নেই কারও! পুড়িয়ে ছাই করে দেব তোমাদের গ্রাম!’
এমনই হবে, জানত হায়াশি। তবে আশার কথা: শোগানের অনর্থক নিষ্ঠুর অত্যাচারে বিরক্ত হয়ে উঠেছে তার সেনাবাহিনীর অফিসার থেকে শুরু করে সাধারণ সৈনিকরা। আজ হোক বা কাল, ঠিকই টনক নড়বে তাদের। এ কথা ভেবেই হায়াশির বুকে জাগল ক্ষীণ আশা। শোগানকে খুন করলে হয়তো তার দলের লোক ভাববে, বন্ধ করা উচিত এই অকথ্য নির্যাতন। তাতে ফিরবে এই এলাকায় শান্তি।
কীভাবে দলের সবাইকে বাঁচাবে, ভাবছে হায়াশি। শক্তিশালী, দক্ষ এবং সুচতুর যোদ্ধা শোগান। লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা কম নয় তার। কিন্তু দেখা যাচ্ছে ঘোড়ার গায়ে নেই রক্ত, ঘাম বা মাটির চিহ্ন। বহু দিন নিজের প্রাণরক্ষা করতে লড়তে হয়নি শোগানকে।
‘কী হলো? জবাব দিচ্ছ না কেন?’
পা দিয়ে প্রিয় ঘোড়ার পেট স্পর্শ করল হায়াশি, পরক্ষণে তেড়ে গেল শোগানের দিকে। হাতের তলোয়ার তুলেছে মাথার ওপর।
ধীর প্রতিক্রিয়া দেখাল শোগান। শেষসময়ে হামলা ঠেকাতে সামনে বাড়াল ঘোড়া। হায়াশির বাম পাশ কাটিয়ে গেল সে।
ঘোড়া চরকির মত ঘুরিয়ে নিয়ে আবারও পরস্পরের দিকে ছুটল দুই যোদ্ধা। এবার সৈনিকদের তৈরি বৃত্তের ঠিক মাঝে মুখোমুখি সংঘর্ষ হলো দুই ঘোড়ার। সামনের দুই পা আকাশে তুলল জানোয়ার দুটো। স্যাডল থেকে ছিটকে মাটিতে পড়ল দুই যোদ্ধা। আগে মাটি ছাড়ল হায়াশি, লাফ দিয়ে সামনে বেড়ে তলোয়ার চালাল শোগানের বুক লক্ষ্য করে।
নিজ তলোয়ার দিয়ে আড়াআড়িভাবে হায়াশির তলোয়ার সরিয়ে দিল শোগান। তবে ঝট করে ঘুরেই ওপর থেকে তার মাথার ওপর তলোয়ার নামাল হায়াশি। হামলাটা ঠেকিয়ে দিল শোগান।
দুই তলোয়ারের প্রচণ্ড সংঘর্ষে চারদিকে ছিটকে গেল আগুনের ফুলকি। উঠে দাঁড়িয়ে একপাশ থেকে হায়াশির মাথা লক্ষ্য করে তলোয়ার চালাল শোগান। ছিটকে পড়ল সামুরাই যোদ্ধার শিরস্ত্রাণ। কেটে গেছে গাল। হায়াশির ধারালো তলোয়ার উড়িয়ে দিল শোগানের কাঁধের কাঠের বোর্ড।
ব্যথা পেয়ে রেগে গেছে শোগান। পাশ থেকে চালাল তলোয়ার। পরক্ষণে সরেই সামনে বেড়ে চিরে দিতে চাইল সামুরাই যোদ্ধার বুক-পেট। খোঁচা মেরে ফুটো করতে চাইল হৃৎপিণ্ড। মাথা লক্ষ্য করে নামাল তলোয়ারের ফলা। এমন প্রচণ্ড আক্রমণ আগে দেখেনি কোনও জাপানি সৈনিক।
তীব্র হামলার মুখে টলতে টলতে পিছিয়ে গেল হায়াশি। মাটিতে পড়তে পড়তেও সামলে নিল নিজেকে। ওর গলা কাটতে পাশ থেকে সাঁই করে তলোয়ার চালাল শোগান। মাথা কাটা পড়ত হায়াশির, তবে তলোয়ারের চ্যাপ্টা পাত দিয়ে ঠেকিয়ে দিল সে শোগানের তলোয়ার।
শোগানের আঘাত এতই প্রচণ্ড, কয়েক টুকরো হতো সাধারণ তলোয়ার, কিন্তু বেঁকে গিয়েও আবার সিধে হলো হায়াশির অস্ত্রটা। রক্ষা করল মালিককে।
পাল্টা হামলায় একপাশ থেকে শোগান সেইটোর পেট লক্ষ্য করে তলোয়ার চালাল হায়াশি। তার তলোয়ারের ফলা এতই ধারালো, রঙ করা লোহার পাত ও শক্ত চামড়ার ভেস্ট কেটে শোগানের পাঁজর থেকে ফিনকি দিয়ে বের করল রক্ত।
ভূস্বামী আহত দেখে হাঁ হয়ে গেছে সৈনিকরা।
টলমল করে পেছাল শোগান সেইটো। বামহাতে চেপে ধরেছে ক্ষত। বিস্মিত চোখে দেখল হায়াশিকে। ‘তোমার তলোয়ার আস্ত রয়ে গেল, অথচ চিনা বাদামের মত ভেঙে গেছে আমার বর্ম! এখন বুঝলাম, গুজব সঠিক। তোমার কাছে আছে কিংবদন্তীর তলোয়ার-নির্মাতা মাসামিউনের অস্ত্র।’
গর্বের সঙ্গে ঝকঝকে তলোয়ার ওপরে তুলল হায়াশি। ‘এটা পেয়েছি বাবার কাছ থেকে। তার আগে তিনি পেয়েছেন তাঁর বাবার কাছ থেকে। আমার দাদা পান তাঁর বাবার কাছ থেকে। মাসামিউনের তৈরি সেরা তলোয়ার এটা। আর এ দিয়েই তোমার নোংরা জীবনটা খতম করব।’
দম নিতে এবং ভালভাবে দেখার জন্যে শিরস্ত্রাণ খুলল শোগান। মাথা দুলিয়ে বলল, ‘সত্যিই ভয়ঙ্কর অস্ত্র। তবে তোমার লাশের হাত থেকে নেব, কারণ আমার তলোয়ারটা আরও ভাল। রক্তের জন্যে তৃষ্ণার্ত এটার পাত।’
শোগানের হাতের কাতানা চিনল হায়াশি। ওটা তৈরি করেছে জাপানী উপকথার আরেক তলোয়ার প্রস্তুতকারী মিউরামাসা। সে ছিল তলোয়ার জাদুকর মাসামিউনের সাক্ষাৎ শিষ্য।
কিংবদন্তী অনুযায়ী: তিক্ত হয়েছিল দুই তলোয়ার কর্মকারের মন। গুরু মাসামিউনের প্রতি মিউরামাসার অন্তরে জমেছিল প্রবল হিংসা ও ঘৃণা। তাই কালো জাদু দিয়ে নিজ অস্ত্রের ভেতর মনের সবটুকু তিক্ততা ঢেলে দিয়েছিল সে। এসব তলোয়ার দখল, ধ্বংস ও মৃত্যুর বাহক। অন্যদিকে, মাসামিউনের অস্ত্র সবসময় ন্যায়ের পক্ষে থাকে। কাজে লাগে শান্তি নিশ্চিত করতে।
শ্রুতি যেমনই হোক, কখনও কখনও রয়ে যায় তাতে কিছু সত্য।
‘কালো পাতের ওই তলোয়ারকে বিশ্বাস করলে নিজেই শেষ হবে তুমি,’ সাবধান করার সুরে বলল হায়াশি।
‘হয়তো, তবে তার আগে কেটে নেব তোমার মাথা!’
বৃত্তের মাঝে মুখোমুখি হয়ে ঘুরছে দু’যোদ্ধা। স্বাভাবিক করতে চাইছে শ্বাস। তৈরি হচ্ছে শেষ হামলার জন্যে। ঘোড়া থেকে পড়ে পায়ে ব্যথা পেয়েছে হায়াশি, খুঁড়িয়ে হাঁটছে। শোগান সেইটোর পাঁজরের ক্ষত থেকে ঝরছে রক্ত। একটু পর খুন, হবে দু’জনের যে-কোনও জন।
খুব সতর্ক হয়ে হামলা করতে হবে, ভাবছে ইউসেই হায়াশি। নইলে ওকে খুন করবে শোগান সোসুকে সেইটো। ভূস্বামী মারাত্মকভাবে আহত হলেও প্রাণের ভয়ে লোকদের বলবে, ওর ওপর হামলা করতে। তা যদি ঘটে, হায়াশির হাতের এই অপূর্ব সুন্দর তলোয়ার বাঁচাতে পারবে না ওকে।
কাজেই এমন হামলা করতে হবে, যাতে এক আঘাতে খুন হয় শোগান।
খোঁড়াতে খোঁড়াতে হঠাৎ থমকে গেল হায়াশি। দাঁড়াল চিরকালীন সামুরাই যোদ্ধার ভঙ্গিতে— এক পা পেছনে, অন্য পা সামনে। উরুর কাছে কোমরের পাশে দু’হাতে ধরেছে তলোয়ারের বাঁট।
‘তোমাকে কিন্তু ক্লান্ত লাগছে,’ টিটকারির সুরে বলল শোগান।
‘লড়ে দেখো ক্লান্ত কি না,’ দর্পের সঙ্গে জানাল হায়াশি। জবাবে নিজেও আত্মরক্ষামূলক ভঙ্গিমা করল শোগান। পা দেবে না ফাঁদে।
হামলা বাধ্যতামূলক বুঝে ঝড়ের বেগে এগোল হায়াশি, কয়েক স্তরের লোহার পাত বা বর্ম দু’পাশে প্রসারিত হলো পাখির ডানার মত। কাছাকাছি পৌঁছে শোগানের গলা লক্ষ্য করে তলোয়ার চালাল হায়াশি। কিন্তু লোহার পাতভরা গ্লাভ বাড়িয়ে আক্রমণ ঠেকাল শোগান। নিজের তলোয়ারের ধারালো ফলা সরাসরি নামাল হায়াশির বাহুর ওপর।
চিরচির করে কাটল হায়াশির বাহুর ত্বক ও মাংস। কিন্তু প্রচণ্ড ব্যথা সয়েও ঘুরেই নতুন হামলা চালাল সে শোগানের ওপর। হায়াশির প্রবল আক্রমণের মুখে টলতে টলতে পিছিয়ে গেল শোগান। প্রথমে বামে তারপর আবারও ডানে সরল। তাল সামলাতে গিয়ে থরথর করে কাঁপছে দুই পা। ফোঁস- ফোঁস করে পড়ছে শ্বাস। হায়াশির তুমুল হামলা সামলাতে না পেরে কাত হয়ে বাচ্চা এক বন্দির পাশে বসে পড়ল সে। এবার এক কোপে কল্লা কাটবে সামুরাই যোদ্ধা হায়াশি। কিন্তু প্রাণের ভয়ে নিজের সামনে বাচ্চাটাকে টেনে নিল শোগান সোসুকে সেইটো।
এদিকে শত্রুর মাথা লক্ষ্য করে বিদ্যুদ্বেগে অস্ত্র নামিয়ে এনেছে হায়াশি। তবে একেবারে শেষসময়ে অন্যদিকে সরাল ফলা। তাতে শোগান বা বাচ্চাটা রক্ষা পেলেও হায়াশির ক্ষুরধার তলোয়ারের ফলা শোগানের গোড়ালিতে লেগে গাঁথল পদদলিত কাঁচা মাটিতে।
হ্যাঁচকা টানে মাটি থেকে তলোয়ার উপড়ে নিতে চাইল হায়াশি, কিন্তু ওই একমুহূর্তই প্রয়োজন ছিল শোগানের। বাচ্চাটাকে ছুঁড়ে ফেলে দু’হাতের জোরে হায়াশির ঘাড়ে তলোয়ারের কোপ বসাল সে। চোখের পলকে খুন হলো সামুরাই যোদ্ধা। ধপ্ করে মাটিতে পড়ল কবন্ধ। পরের সেকেণ্ডে একটু দূরের মাটিতে পড়ে বলের মত গড়িয়ে থামল মুণ্ডুটা।
কিন্তু হঠাৎ বসা থেকে উঠে সামনে বাড়তে গিয়ে মচকে গেছে শোগানের রক্তাক্ত, আহত গোড়ালি। মাটিতে আছড়ে পড়ছে বুঝে হাত বাড়িয়ে পতন ঠেকাতে চাইল সে। তাতে নিজের বুকের দিকেই তাক হলো তলোয়ারের ডগা।
হায়াশির ভেদ করা বর্মের জায়গা দিয়ে পড়পড় করে তলোয়ারটা ঢুকল সোসুকে সেইটোর হৃৎপিণ্ডে। পাণ্ডবদের দাদু তীরবিদ্ধ ভীষ্মের মতই মাটি থেকে ওপরে রয়ে গেল শোগান। প্রাণের ভয়ে আর্তচিৎকার দিতে চাইল, কিন্তু মুখ থেকে বেরোল না টু শব্দ। গেঁথে রইল নিজের তলোয়ারে। কারুকাজ করা কালচে পাত বেয়ে নামল তাজা লাল রক্ত।
লড়াই সত্যিই শেষ!
লড়তে লড়তে ক্লান্ত শোগানের সৈনিকরা। তা ছাড়া, এখন নেতৃত্ব দেয়ার কেউ নেই। বহু সপ্তাহের পথ দূরে তাদের বাড়ি। কাজেই আরও গ্রাম না পুড়িয়ে নিজেদের মৃত যোদ্ধাদের নিয়ে ফিরতি পথ ধরল তারা। তাদের কাছে রয়ে গেল মাসামিউনের চকচকে তলোয়ার ও তাঁর স্যাঙাতের রক্তে ভেজা কালচে অস্ত্র।
দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ল শোগান সোসুকে সেইটো ও ‘সামন্ত রাজা ইউসেই হায়াশির লড়াইয়ের কাহিনী। চিরকালের মতই বাস্তব ঘটনায় সাধারণ মানুষ যোগ করল তাদের অলীক কল্পনা।
হায়াশির কাতানার স্রষ্টা জাপানের সর্বকালের সেরা তরবারি-কর্মকার মাসামিউনে, তাই তাঁর নামেই ওই তলোয়ারের নাম হলো: হঞ্জো মাসামিউনে। প্রচলিত কথা অনুযায়ী: পাতলা চাবুকের মত বাতাস কাটলেও, প্রায় দু’ভাঁজ হলেও ভাঙত না ওটা। ওই তলোয়ার থেকে ছিটকে বেরোত আলো, তাই অন্ধ হতো প্রতিপক্ষ। ওই তলোয়ারের পাত এতই নিখুঁত, হায়াশি চোখের কাছে ধরতেই দেখেছিল রামধনুর সাত রঙ ছড়িয়ে অদৃশ্য হয়েছে ওটা।
বিখ্যাত হয়েছে হঞ্জো মাসামিউনে, আর কুখ্যাত হয়েছে শোগানের কালচে তলোয়ার। সবাই বলত: শোগানের রক্ত পান করে আরও কালচে হয়েছে ওটা। নাম দেয়া হলো: খয়েরি তলোয়ার। বহু বছর ধরে ও-দুটোকে নিয়ে উপকথার বোঝা জমল মানুষের মনে। যারা পেয়েছে ওই দুই তলোয়ার, হাতে এসেছে প্রচুর সম্পদ ও ক্ষমতা। কিন্তু শেষে নিজেরাই খুন হয়েছে করুণভাবে।
শত শত বছর ধরে দুই তরবারি ঘুরল সামুরাই যোদ্ধা বা বিদ্রোহী নেতাদের হাতে হাতে। পরে হয়ে উঠল জাপানের জাতীয় সম্পদ। আমজনতা সম্মানের দৃষ্টিতে দেখত, ক্ষমতাশালী পরিবারে রয়েছে বিখ্যাত ও কুখ্যাত দুই তরবারি। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে হঠাৎ করেই হারিয়ে গেল ও-দুটো।