মহাপ্রয়াণ
ছয়টা বাজিয়া গেল তবু কেউ আসিতেছে না। অথচ সাড়ে ছয়টায় মিটিং। উদ্যোক্তারা অধীর হইয়া উঠিল, শেষে স্থির করিল, এমন কান্ড তাহারা জীবনেও দেখে নাই, শোকসভার অনুষ্ঠান করিতে গিয়া যে এমন বেকুব বনিয়া যাইবে, ইহা তাহারা স্বপ্নেও ভাবিতে পারে নাই। একজন একটা অত্যন্ত কঠিন মন্তব্য করিয়া ফেলিল, আজ যাহারা শোকসভার এই আড়ম্বরহীন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে দ্বিধা করিতেছে, কাল যে তাহারাই আবার শ্রাদ্ধবাসরে উপস্থিত হইতে কুকুরের মতো ঠেলাঠেলি করিয়া মরিবে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই! সুবোধ ঘোর জাতীয়তাবাদী, এমনকি বাঙলাকেও ভারতবর্ষ হইতে পৃথক করিয়া দেখে, কিন্তু আধুনিক সব কান্ড-কারখানা দেখিয়া সে বাঙালির ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে ভীষণ সন্দিহান হইয়া পড়িয়াছিল, অত্যন্ত বিরক্তিভরা সুরে সে বলিল, বাঙালির আবার টাইম!
মৃত মধুসূদন দাস মহাশয়ের মোটরের ড্রাইভারটি খাটিতে খাটিতে হয়রান হইয়া গেল। তবুও সে তাহার ভবিষ্যৎ ভাগ্যনিয়ন্তা চাকরিটাকে দাস মহাশয়ের অন্যান্য ছেলেদের মতোই উত্তরাধিকারসূত্রে অক্ষুন্ন রাখিতে পারিবে কিনা কে জানে! সভামন্ডপটাকে চমৎকার সাজানো হইয়াছে, আরামদায়ক চেয়ারে, ইলেকট্রিক লাইট ইত্যাদিতে চমৎকার। প্রেসিডেন্টের টেবিলের উপর রাশি রাশি ফুল, ফুলের মালা, মাথার উপর ঝালর দেওয়া দামি সামিয়ানা। সেই ঝালরগুলি বাতাসে মৃদু কাঁপিতেছে।
মধুসূদন এত টাকা রাখিয়া গিয়াছেন যে, তা রূপকথার মতোই শোনায়। অথচ তাঁহার জীবনের কোথাও আড়ম্বরের চিহ্নমাত্র নাই। এক পয়সা দিয়া একটা সিগারেটও কিনিয়া খান নাই কখনো। নিজের স্ত্রী ছাড়া দ্বিতীয় স্ত্রীলোকের মুখ দেখেন নাই জীবনে। একটা মোটর কিনিয়াছিলেন তাও লোকের কথায় নিতান্ত ঠেকিয়া, কিন্তু সেই মোটরে একটি দিনের জন্যও কখনো চড়েন নাই। এমন সরল অনাড়ম্বর জীবন যাঁহার ছিল, প্রাচুর্যের ভিতর বাস করিয়াও যিনি অপ্রাচুর্যের রূপকে চিরকাল ভক্তিভরে প্রণাম করিয়াছেন, তাঁহার স্বৰ্গত আত্মার সদগতি কামনার উদ্দেশ্যেই আজ সকলে এখানে সমবেত হইবে।
উদ্যোক্তারা ভুল করিয়াছিল, যতটা হীন মন্তব্য তাহারা মানুষের সম্বন্ধে করিয়াছিল, ততটা হীন হইবার যোগ্য তাহারা নয়। সাতটা বাজিবার আগেই সকলে একে একে আসিয়া হাজির হইল। স্থানীয় ইস্পিরিয়েল ব্যাঙ্কের এজেন্ট নিজে আসিলেন না কিন্তু তাঁহার কর্মচারীদের পাঠাইয়া দিলেন। অন্যান্য ব্যাঙ্কের কর্মচারীরাও আসিল। প্রেসিডেন্ট যিনি নির্বাচিত হইয়াছিলেন তিনি মধুসূদনের মতো কোনো রূপকথারই নায়ক। সকলে তাঁহার জন্যই কাতর হইয়া অপেক্ষা করিতেছিল। সকলের শেষে যখন তাঁহার ভারী মোটরখানা সভামন্ডপের কাছে আসিয়া থামিল, উদ্যোক্তাদের পক্ষ হইতে উকিল অনাদিবাবু দৌড়াইয়া গেলেন তাঁহাকে অভ্যর্থনা করিতে, প্রেসিডেন্টের হাতের লাঠিখানা তাড়াতাড়ি নিজের হাতে লইয়া বলিলেন, আসুন আসুন।
প্রেসিডেন্ট বুদ্ধিমান, অত্যন্ত সাবধানে একটু হাসিলেন এবং তাঁহার এই হাসির স্বপক্ষে মুখ জনতা হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিত সন্দেহ নাই, কিন্তু এতদূর মূর্খ তাহারা এখনও অর্জন করে নাই যে শোকসভার কথা শুনিয়াও হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিবে।
প্রেসিডেন্ট সভামন্ডপে প্রবেশ করিলেন। একটা চমৎকার সেন্টের গন্ধে চারিদিক ভরিয়া গেল। প্রেসিডেন্ট বুড়া হইয়াছেন সত্য কিন্তু প্রসাধনের শখ এখনও যায় নাই। এবং তাঁহার শাস্ত্রে টাকাকড়ি সদব্যবহারের কথাটা উল্লেখ যেখানে আছে সেখানকার কিছুটা যে একেবারেই পড়েন নাই, এমন নয়। তাঁহাকে দেখিয়া একটা অস্পষ্ট গুঞ্জনে সভাস্থল ছাইয়া গেল। প্রেসিডেন্ট এবং অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিদের গলায় মাল্যদানের পর সভার কাজ আরম্ভ হইল। একটা ভীষণ স্তব্ধতায় সভা ভরিয়া গেল। এমন নিস্তব্ধতার মধ্যে অস্পষ্ট স্বরে প্রেসিডেন্ট কী বলিলেন তাহা মোটেই বোঝা গেল না। এ কথা কে না জানে, এই দরিদ্র দেশে টাকা-পয়সা সঞ্চয় করিবার প্রবল উৎসাহেই তিনি গা ভাসাইয়া দিয়াছিলেন, পড়াশুনা করিবার সময় পান নাই। তাঁহার বক্তৃতা শেষে এক মিনিট নিঃশব্দে দাঁড়াইয়া থাকিয়া পরলোকগত আত্মার প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবদেন করা হইল। ইহার পর ওরিয়েন্টাল ব্যাঙ্কের ম্যানেজার জীবানন্দ চক্রবর্তী স্বর্গীয় মধুসূদন দাস মহাশয় যে বিখ্যাত দানবীর ছিলেন, এ কথার উল্লেখ করিলেন। কংগ্রেসের অনেক নিরাপদ সভায় বক্তৃতা দিয়া তিনি হাত পাকাইয়া ফেলিয়াছেন। তাঁহার বক্তৃতায় সকলেই চমৎকৃত হইল।
এমন সময় ব্যস্ত হইয়া প্রবেশ করিলেন শ্রীপতি। এত করিয়াও তিনি যে সকালে আসিতে পারিলেন না, তার জন্য আফশোষের অন্ত নাই। বাহিরের অফিসকে কোনরকমে কাটাইয়া আসিতে পারিলেও আবার যে ভিতরের একটা মস্ত বড় অফিসের সম্মুখীন হইতে হয়, এই নিদারুণ অভিজ্ঞতা তাঁহার মতো অন্যান্য অনেক অফিসওয়ালাদের তহবিলেও আছে। বাড়ি ঢুকিয়াই শ্রীপতি দেখিয়াছিলেন, এক রক্তবর্ণ শাড়ি পরিয়া দুই মেয়ে তাঁহার দিকে রক্তনেত্রে চাহিয়া আছে, আরও শাড়ি চাই। যে পয়সা তিনি দিবেন বলিয়াছিলেন, সেই কবে, সেই পয়সার জন্য আর একবার শাসাইয়া গেল তাঁহার ছেলেমেয়েরা, আর এই গোলমালে গৃহকত্রীর কণ্ঠের স্বর তো শোনাই যায় না। কিন্তু আজ সকল চাওয়াকে উপেক্ষা করিবার সুযোগ পাইয়াছেন শ্রীপতি, তিনি ছুটিয়া চলিয়া আসিয়াছেন। তবু তো দেরি হইয়া গেল। এমনি সংসার যে এক মিনিট নিশ্বাস ফেলিবার সময় তো নাই-ই, দৈবাৎ এমন একটা সভাতেও যোগ দেওয়ার সময় তাঁহার নাই!
বিশিষ্ট ব্যক্তিদের পাশে শ্রীপতি তাড়াতাড়ি একখানা আসনগ্রহণ করিলেন। উকিল অনাদিবাবু এখনও অভ্যর্থনায় ব্যস্ত, কিন্তু শ্রীপতির অভ্যর্থনায় তাঁহার ভুল হইয়া গেল। তিনি তাঁহাকে দেখিয়াও দেখিলেন না। শ্রীপতি গভীর মনোযোগে, অভিভূত হইয়া বক্তার বক্তৃতা শুনিতে লাগিলেন। বক্তৃতা করিতেছিলেন এক সুবিখ্যাত ব্যাঙ্কার এবং জমিদার। তিনি ব্যবসায়ে মারোয়াড়ীর সাফল্য আর বাঙালির অসাফল্যের কথা বিশ্লেষণ করিয়া এক নতুন তথ্য পরিবেশন করিলেন। এ ছাড়া মধুসূদনের মৃত্যুতে তাঁহাদের মহলে তথা সমগ্র ভারতের জনসাধারণের যে সমূহ ক্ষতি হইয়াছে, তার উল্লেখ করিলেন। শ্রীপতি বসিয়া বসিয়া সেই সমূহ ক্ষতির কথাই কেবল ভাবিতে লাগিলেন। ভাবিতে ভাবিতে একসময় চোখের দৃষ্টি আচ্ছন্ন হইয়া আসিল, তিনি দাঁড়াইয়া গেলেন, গভীরস্বরে বলিলেন, মাননীয় সভাপতি মহাশয় এবং সমবেত বন্ধুগণ! আজ যাঁর মৃত্যুতে আমাদের মনের সব বেদনা জানাতে আমরা সকলে এখানে সমবেত হয়েছি, তিনি তো দুদিন আগেও আমাদের মধ্যে ছিলেন। অথচ তিনি আজ নেই, আমাদের শোকসাগরে ফেলে চলে গেছেন, আমরা হাবুডুবু খাচ্ছি। এটা যে কতবড়ো ব্যথার, কত কষ্টের, আমাদের পক্ষে কত শোচনীয়, তা আশাকরি আপনাদের বলতে হবে না। তিনি যে নেই, একথা ভাবতেও আজ আমাদের কণ্ঠ রোধ হয়ে আসে।…
শ্রীপতির সত্যই কণ্ঠরোধ হইয়া আসিল, তিনি ঝরঝর করিয়া কাঁদিয়া ফেলিলেন।
মূর্খ জনতা বিস্তর মূর্খতা অর্জন করিয়াছে সন্দেহ নাই; এটা যে শোকসভা, একথা আর কিছুতেই মনে রাখিতে পারিল না, দারুণ করতালি দিতে লাগিল।