মহানিষ্ক্রমণ – ৬

॥ ৬ ॥

অল্প ক’দিন পরেই আমাদের যাত্রা ঠিক কি ধরনের হতে চলেছে সে সম্বন্ধে রাঙাকাকাবাবু আমাকে আর একটু খুলে বললেন। প্রথমত উনি ছদ্মবেশ গ্রহণ করবেন। দ্বিতীয়ত, সীমান্ত প্রদেশ থেকে তিনি সংকেতের প্রতীক্ষা করছেন, সংকেত পেলে যাবার দিন স্থির হবে। উনি যে দেশত্যাগ করতে চলেছেন সে কথা স্পষ্টই বুঝতে পারলাম।

এলগিন রোডের বাড়ি থেকে গোপনে কিভাবে নিষ্ক্রান্ত হওয়া যায়, তাই হল আমাদের পরিকল্পনার প্রথম ধাপ। এই নিষ্ক্রমণের গোপনতা ও সাফল্যের উপরই অন্তর্ধানের পরবর্তী পর্যায়ের সফলতা নির্ভর করছে। সফল হলে ওঁর উপর পুলিশী প্রহরার ব্যর্থতা একটা উপহাসের বিষয় হয়ে দাঁড়াবে এবং ব্রিটিশ ইন্‌টেলিজেন্স অন্তর্ধানের সূত্র বার করতে হিমসিম খেয়ে যাবে।

এলগিন রোডের বাড়ি থেকে বার হবার নানারকম প্ল্যান প্রস্তাবিত হল ও সেগুলি নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনাও হল। শেষ পর্যন্ত একটা ফাইনাল প্ল্যান দাঁড় করানো গেল।

প্রথমে কথা হল উনি বেশ খোলাখুলিভাবে ঘোষণা করবেন যে, শরীর সারানোর জন্য উনি কলকাতা থেকে ষোল মাইল দূরে গঙ্গার ধারে রিষড়াতে আমার বাবার যে বাগানবাড়ি আছে সেখানে গিয়ে থাকবেন। তারপর আমি একদিন রাত্রে গোপনে ওঁকে ওখান থেকে মোটরে করে নিয়ে বর্ধমান বা আসানসোল পৌঁছে দেবে, তা যদি নাও হয়, যদি সোজা কলকাতা থেকে বর্ধমান যাওয়া হয় তবুও আমার পক্ষে রিষড়ায় একটা রাত কাটানো বেশ সুবিধাজনক হবে। এই পরিকল্পনার পরিপ্রেক্ষিতে রাঙাকাকাবাবু আমাকে বললেন, রিষড়ার বাড়ির মালীকে আগে থেকে কিছু না জানিয়ে হঠাৎ একদিন গাড়ি চালিয়ে একটু রাত করে রিষড়ায় হাজির হয়ে রাতটা সেখানে কাটিয়ে আসতে। তা হলে অন্য কোন রাত্রে আমার হঠাৎ উপস্থিতিতে মালী আশ্চর্য হয়ে যাবে না, অভ্যস্ত থাকবে।

দ্বিতীয় পরিকল্পনা প্রথমটিরই অনুরূপ, একটু অন্যরকম। কথা হল ঐরকম একটা ঘোষণা করে উনি রিষড়ায় নয়, এক নম্বর উডবার্ন পার্কের বাড়িতে এসে উঠবেন আর তিনতলায় ছাদের দিকের একটা ঘরে থাকবেন। অজুহাত হবে এই যে, শরীর সারানোর জন্য ওঁর যথেষ্ট আলো-হাওয়া দরকার, এলগিন রোডের বাড়িতে তা উপযুক্ত পরিমাণে পাওয়া যাচ্ছে না। যদি উডবার্ন পার্কে থাকেন তা হলে নিশ্চিন্ত মনে সব পরিকল্পনা করার সুবিধা হবে। উপরন্তু এতজন আত্মীয়-পরিজনের ও তাঁর বৃদ্ধা মা’র চোখে ধুলো দেবার ব্যবস্থা করতে হবে না।

অবশ্য এই দুটো পরিকল্পনাই বাতিল করা হল, বাতিল করার কারণগুলো আমি উত্থাপন করেছিলাম বলে আমার ধারণা। প্রথম কারণ মনে হল—এতে করে পুলিশ জানতে পারবে, অন্তত এ-বাড়ি থেকে ও-বাড়ি যাবার মত স্বাস্থ্যের উন্নতি তাঁর হয়েছে, ফলে, তারা আগের চেয়ে সতর্ক হয়ে যাবে। জেল থেকে ছাড়া পাবার পর রাঙাকাকাবাবু আর ঘর থেকেই বার হচ্ছিলেন না। তার ফলে সকলের, বিশেষত পুলিশের ধারণা হয়ে গিয়েছিল যে, উনি বড় রকমের সক্রিয় কোন কাজে হাত লাগাতে পারবেন না। এর ফলে শত্রুপক্ষের চোখে ধুলো দেবার সুবর্ণ সুযোগ আমরা পেয়েছিলাম। উডবার্ন পার্কে যাওয়ার বিপক্ষে আর একটা কারণ আমি দেখালাম— আমার বাবার বাড়িতে সব ব্যাপারে একটা কড়াকড়ি ও শৃঙ্খলা ছিল —যেমন প্রত্যেক গেটে লোক ছিল, দারোয়ান ঠিক সময়ে গেট বন্ধ করত, ইত্যাদি। অপরদিকে, এলগিন রোডের বাড়িতে সব কিছু ছিল ঢিলেঢালা, সেখানে যা খুশি তাই করে পার পাওয়া যেত।

তৃতীয় একটি সম্ভাবনা বিবেচনা করা হল। আমার বড়দাদা ডাঃ অশোকনাথ বসু ধানবাদের কাছে কাজ করতেন। তিনি মাঝে মাঝে নিজের মোটর গাড়িতে কলকাতায় আসতেন। প্রস্তাবটা হল—একবার কলকাতা থেকে ধানবাদ ফিরে যাবার সময় আমি রাঙাকাকাবাবুকে ওঁর গাড়িতে লুকিয়ে চাপিয়ে দিতে পারি। এই প্ল্যানটা বেশী দূর এগোল না; কারণ, তখন বাড়ির অন্যান্যরা দাদার কাছে গিয়েছেন এবং তাঁর কলকাতা আসার কোন কথাই নেই।

রিষড়া ও উডবার্ন পার্ক থেকে অন্তর্ধানের প্ল্যান পরিত্যক্ত হওয়ার পর আমরা আবার কিভাবে এলগিন রোডের বাড়ি থেকেই উধাও হওয়া যায় সেই পরামর্শ করতে লাগলাম। খুব সহজভাবে বাড়ির সদর গেট দিয়ে চালিয়ে যে বের হয়ে চলে যাওয়া সম্ভব এমনটি আমার মাথায় অনেকদিন আসেনি। তাই আমি ক্রমাগত মাথা ঘামাতে লাগলাম কিভাবে উনি চুপিচুপি বাড়ি থেকে বার হয়ে কিছু দূরে গিয়ে আমার গাড়িতে উঠতে পারেন। আমি এমন ভাবলাম যে, রাঙাকাকাবাবু ছদ্মবেশে বাড়ির উত্তর-পশ্চিম দিকে জমাদারদের আসা-যাওয়ার জন্য যে ছোট গেট আছে তাই দিয়ে বার হবেন, আমি এলগিন রোড পোস্ট অফিসের কাছাকাছি গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করব, আর ওঁকে পথ থেকে তুলে নেব। বাড়ির পিছন দিকে একটা কারখানা থাকায় সেদিক দিয়ে বার হওয়া সম্ভব ছিল না। তা ছাড়া কোন পেছনের দরজাও ছিল না। আমরা এই ধরনের বিভিন্ন প্ল্যান নিয়ে অনেক অনেক আলোচনা করলাম। শেষ পর্যন্ত এই সিদ্ধান্তে এলাম যে, সব চাইতে নিশ্চিন্ত ও নিরাপদ প্ল্যান হল বাড়ির মধ্যেই উনি গাড়িতে উঠবেন। তারপর সেই অনুযায়ী অন্যান্য পরিকল্পনা করা স্থির হল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *