॥ ৪ ॥
সেদিন অনেক রাত পর্যন্ত বিছানায় শুয়ে ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা করতে করতে আমার মনের মধ্যে এই উপলব্ধি হলো যে, আমার এতদিনকার নিস্তরঙ্গ জীবনে একটা অসাধারণ ও চ্যালেঞ্জিং কিছু ঘটতে চলেছে। এও বুঝলাম যে, আমার দিক থেকে যে সংকোচ এতদিন আমার ও রাঙাকাকাবাবুর সম্পর্কের মধ্যে আড়াল সৃষ্টি করে এসেছে, তা আমাকে এবার কাটিয়ে উঠতে হবে।
দ্বিতীয় সাক্ষাৎকারের সময়ে রাঙাকাকাবাবুর আহ্বানে শয্যা-পার্শ্বে গিয়ে বসতে আমি আর ইতস্ততঃ করলাম না। সেদিন থেকে শুরু করে প্রতি দিন ওঁর বিছানার বাঁ দিকে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা প্ল্যান নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলতে লাগল। আলোচনা যত অগ্রসর হল, পরিকল্পনা যখন দানা বাঁধতে শুরু করল, তখন আমি উঠে বারান্দার দিকের দরজাটা প্রায়ই বন্ধ করে দিয়ে আসতাম, যাতে চট করে কোন আত্মীয়-পরিজন ঢুকে না পড়ে। মা-জননীর ঘরের দিকের অন্য দরজাটি অবশ্য বরাবরই বন্ধ থাকত।
পরদিন সন্ধ্যায় আমি যখন তাঁর কাছে ফিরে গেলাম, তখনও আমার মনে কোন সুচিন্তিত মতামত গড়ে ওঠেনি। তার কারণ, প্রথম দিন প্ল্যান সম্বন্ধে উনি যেটুকু বলেছিলেন তা যথেষ্ট ছিল না। সাহস সঞ্চয় করে ওঁর মুখখামুখি হলাম। এবার থেকে শুরু হল প্রতি দিনের দেখা-সাক্ষাৎ। এই সাক্ষাৎগুলো খুব সহজ ও স্বাভাবিক দেখানো দরকার। অনেক সময় আমাকে ঘোরাফেরা করে বেড়াতে হত যতক্ষণ না বাইরের অতিথিরা উঠে যান। ঘরে যদি আত্মীয়স্বজন বা ভৃত্যরা কেউ থাকত তা হলে অপেক্ষা করে থাকতে হত, রেডিওটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতাম কিংবা আর কোন তুচ্ছ কাজ। অসুস্থ কাকাকে ভাইপো দেখতে আসবে এতে অবশ্য অস্বাভাবিক কিছু ছিল না, তবুও রাঙাকাকাবাবু ভেবেচিন্তে একটা অজুহাত বার করলেন, কেউ প্রশ্ন করলে বলা হবে যে, আমি রেডিওটা ভাল চালাতে পারি তাই ওঁকে ফরেন ব্রডকাস্টগুলো শুনতে সাহায্য করি। অবশ্য উনি সত্যিই যুদ্ধের গতি-প্রকৃতি খুটিয়ে দিনের পর দিন পর্যবেক্ষণ করছিলেন, এবং বার্লিন, রোম ও লণ্ডনের সংবাদ প্রচার ও ভাষ্য ঘণ্টায় ঘণ্টায় শুনতেন।
আমরা ওঁর পরিস্থিতির মূল্যায়ন মন দিয়ে শুনতাম, যুদ্ধে অথবা কূটনীতিতে ইংরেজ কোন বেকায়দায় পড়েছে শুনলে উনি সত্যিকারের আনন্দ পেতেন, আমরাও সেই আনন্দের ভাগী হতাম।
আমাদের আলোচনা যত অগ্রসর হতে লাগল, আমার আত্ম-বিশ্বাসও ততই বাড়তে লাগল। আমার এই নবলব্ধ সাহসের ফলে আমি আশ্চর্য হয়ে দেখলাম যে, আমি রাঙাকাকাবাবুর কোন কোন প্রস্তাবের সমালোচনা বা বিরোধিতা করছি। ধীরে ধীরে তাঁর সম্বন্ধে আমার সংকোচের প্রাচীর একেবারে ভেঙে গেল।
১৯৪১ সালের গোপন যাত্রার পরিকল্পনার সময় রাঙাকাকাবাবুর আর এক বিদেশ যাত্রার কথা আমার প্রায়ই মনে হত। ১৯৩৩ সালের গোড়ার কথা। জব্বলপুর সেন্ট্রাল জেলে দুই ভাই তখন তা একসঙ্গে বন্দী। রাঙাকাকাবাবু রোগে শয্যাশায়ী—চিকিৎসার জন্য সরকার তাঁকে ইউরোপ যেতে অনুমতি দিয়েছেন। আমরা কয়েকজন মা ও আমাদের ঠাকুমা’র ( বাসন্তী দেবী) সঙ্গে তাঁকে বিদায় দিতে গিয়েছি। সে আর এক ধরনের যাত্রা। জেল থেকে কড়া পুলিশ পাহারায় অ্যাম্বুলেন্স করে তাঁকে ষ্টেশনে নিয়ে গেল, সেখানে স্ট্রেচারে করেই তাঁকে ট্রেনের কামরায় তুলে দিল। জেলের মধ্যে বাবার কাছে বিদায় নেবার সময় রাঙাকাকাবাবু ভেঙে পড়লেন—বাবার কঁধে মাথা রেখে কাঁদলেন। বোম্বাই থেকে তাঁকে জাহাজে তুলে দেবে এবং জাহাজ ভারতের কূল ছেড়ে যাবার পর তিনি মুক্ত হবেন। অনুশাসনের আর শেষ নেই ! ১৯৩৩ থেকে ১৯৪১! ব্রিটিশ সরকারের সব বাধা-নিষেধ তুচ্ছ করে ও সব অনুশাসন অগ্রাহ্য করে কি প্রতিশোধই না ১৯৪১-এ নেওয়া গেল! কেবল ১৯৪১ সালের গোপন যাত্রার আগে বাবার কাছ থেকে রাঙাকাকাবাবু কি ভাবে বিদায় নিয়েছিলেন সেটা জানতে পারলাম না।
রাতের পর রাত রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে আলোচনা করবার সময় আর একবার ১৯৩৬ সালে কারসিয়ং-এ তাঁর ঘনিষ্ঠ সাহচর্যে যে দিনগুলি কাটিয়েছিলাম তার কথাও আমার মনে পড়ত। সে-সময় খুব কাছ থেকে তাঁর অনেক কথাবার্তা শোনবার একটা সুযোগ পেয়েছিলাম। চার বছর ইউরোপে নির্বাসনের পর তিনি দেশে ফেরামাত্র সরকার তাঁকে গ্রেপ্তার করল এবং বাবার কারসিয়ং-এর বাড়িতে বন্দী করে রাখল। সেই সময় আমার দাদা অমিয়নাথ ও আমি গরমের ছুটিটা রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে কারসিয়ং-এ কাটাবার অনুমতি পেলাম। আমি সবে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছি এবং বোধকরি খানিকটা ভাবতে ও বুঝতে শিখেছি। কথাবার্ত অবশ্য প্রায় সবই হত রাঙাকাকাবাবু ও আমার দাদা অমিয়নাথের মধ্যে এবং আমি ছিলাম নীরব শ্রোতা। সকাল থেকে আরম্ভ করে বেশ রাত পর্যন্ত, এমন কি ঘোর বর্ষার মধ্যে বেড়াতে বেড়াতে রাঙাকাকাবাবু কথাবার্তা চালাতেন। বিষয়ের কোন সীমা ছিল না। পারিবারিক খুঁটিনাটি ব্যাপার, নিজের জীবনের সুখ-দুঃখের কাহিনী থেকে আরম্ভ করে দেশ-বিদেশের রাজনীতি, interpretation of dreams পর্যন্ত। তাঁর ছেলেবেলার স্মৃতিচারণে আমার আগ্রহ ছিল বেশী, কারণ সেই বয়সে নিজের অভিজ্ঞতার সঙ্গে সেগুলি মিলিয়ে নিতে পারতাম। আমাদের দিকে একটু চেয়ে খানিকটা দুঃখের সুরে হয়ত বললেন, জানো, আমি যখন তোমাদের বয়সী বা আরও ছোট, বাড়িতে আমাকে বিশেষ কেউই গ্রাহের মধ্যে আনতেন না—প্রায় সকলেই বলতেন যে ওটা একটা বদ্ধ পাগল। জীবনে ওর কিছুই হবে না। একটু পরেই হয়ত বিষয়টা সম্পূর্ণ বদলে নিয়ে যেন ভবিষ্যতের একটু আভাস দিয়ে বললেন—লেনিনের একটা গল্প শোন। এই যেমন আমরা বেড়াচ্ছি, লেনিন তাঁর সাথীদের নিয়ে লণ্ডনের রাস্তায় যখন বেড়াতে বের হতেন, লণ্ডনের “ববি”রা (পুলিশ কনষ্টেবল) তাঁকে দেখিয়ে পরিহাস করে বলত—দেখ দেখ, ঐ লোকটির নাম হল লেনিন, ওরা আমাদের দেশে ইঁদুরের গর্তের মধ্যে লুকিয়ে বাস করে, আবার কিনা ওরা প্রবল পরাক্রান্ত জারকে উচ্ছেদ করার স্বপ্ন দেখে। বলে রাঙাকাকাবাবু হাসলেন। অনেক পরে বুঝলাম যে, তাঁর বিরাট স্বপ্নের ইঙ্গিত তিনি ঐ গল্পের মধ্যে দিয়েছিলেন।