মহানিষ্ক্রমণ – ৩

॥ ৩ ॥

সেদিন ছিল ছুটির দিন। দুপুরে খাওয়ার সময় নেতাজীর নিজস্ব ভৃত্য উডবার্ন পার্কে আমার কাছে এসে খবর দিল, রাঙাকাকাবাবু ডেকে পাঠিয়েছেন, সেদিনই যেন ওঁর সঙ্গে দেখা করি। কিছুক্ষণ পরে আমি এলগিন রোডের বাড়িতে উপস্থিত হলাম ও বুঝতে পারলাম রাঙাকাকাবাবু আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। আমি ঢুকতে ঘরটা খালি করিয়ে নিলেন। ওঁকে বেশ স্নিগ্ধ দেখাচ্ছিল, যদিও তখনও বেশ ফ্যাকাশে ও রোগা। শুধু অল্প একটু আগাছার মত গজানো দাড়িটা কেমন অদ্ভুত ঠেকছিল। খাটের উপর বালিশে হেলান দিয়ে তিনি বসে ছিলেন। ওঁর শান্ত ও স্বাভাবিক চেহারা দেখে আমার একবারও মনে হয়নি যে, কোন গুরুতর কথার তিনি অবতারণা করবেন। আমার অভ্যাসমত একটু দূরত্ব বজায় রাখার জন্য আমি ওঁর বাবার যে খাটটি ছিল তার উপর বসতে গেলাম। আমাকে ইশারা করে ঘুরে এসে ওঁর নিজের বিছানার উপর ডান দিকে বসতে বললেন, তাই বসলাম। এই কাছে ডাকাতেই আমি যে একটু নার্ভাস হয়ে পড়লাম তা বলাই বাহুল্য।

কয়েক মুহূর্ত আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে তারপর— ‘আমার একটা কাজ করতে পারবে?’ এই বলে তিনি শুরু করলেন। আমার যেমন স্বভাব, একটু দুর্বল ও দ্বিধান্বিতভাবে মাথা নাড়লাম। ‘তুমি কেমন গাড়ি চালাতে পারো?’ ‘এই একরকম মোটামুটি ভালই পারি।’ —বললাম। রাঙাকাকাবাবু আর একটু বিশদ হলেন— ‘কখনো লঙ ডিসট্যান্স গাড়ি চালিয়েছ?’ আমি বললাম—‘না’। ‘দেখ, একদিন রাত্রে তোমাকে গাড়ি করে আমাকে বেশ কিছু দূরে পৌঁছে দিতে হবে। কেউ কিন্তু জানবে না।’ আমি নির্লিপ্ত মুখে শুনে যাচ্ছিলাম। ‘পারবে?’

আমি আবার মাথা নাড়লাম। এই মাথা নাড়ার মানে ‘হ্যাঁ’-ও হতে পারে আবার অনিশ্চিতও হতে পারে। উনি যেন ‘হ্যাঁ’ বলে ধরে নিলেন এবং আরও বলে চললেন। সমস্ত ব্যাপারটা এমনভাবে প্ল্যান করতে হবে যে, সব কিছু যেন ফুল-প্রুফ হয়। অবশ্যই আমি এ সম্বন্ধে একটি প্রাণীকেও কিছু বলতে পারব না।

রাঙাকাকাবাবু বললেন যে, তিনি গোপনে, গৃহত্যাগ করে অজানা পথে পাড়ি দিয়েছেন—এলগিন রোডের বাড়িতে সে কথা জানবে একমাত্র ইলা। ইলা আমার খুড়তুতো বোন, আমার চাইতে বছর দুয়েকের ছোট। রাঙাকাকাবাবু বললেন যে, ইলাকে পরীক্ষা করে দেখেছেন, আর তাঁর বিশ্বাস যে, সে পারবে।

এই প্রথম সাক্ষাৎকার শেষ হলে তিনি বললেন বাড়ি গিয়ে এই পরিকল্পনার সব দিক ভাল করে খতিয়ে দেখতে এবং পরদিন সন্ধ্যায় এসে এ সম্বন্ধে সুচিন্তিত মতামত দিতে। বারবার উনি বললেন, এই প্ল্যান ফুল-প্রুফ হওয়া চাই। কোন ঝুঁকি নেওয়া চলবে না।

কিছু বিস্ময় ও চাপা উত্তেজনা মনের মধ্যে নিয়ে আমি ১নং উডবার্ন পার্কে হেঁটে ফিরলাম। ব্যাপারটি কী? আমার প্রথম মনে হয়েছিল, উনি হয়ত গোপনে কারও সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন, আমায় তাঁকে সেখানে পৌঁছে দিতে সাহায্য করতে হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *