মহানিষ্ক্রমণ – ২০

॥ ২০ ॥

ভগৎরাম রাঙাকাকাবাবুর নিরাপদে দেশত্যাগের যে সংবাদ বহন করে আনলেন, সেখানেই এই কাহিনীর পরিসমাপ্তি হতে পারত, কিন্তু এর পরবর্তী দু-একটি ঘটনার বিবরণ না দিলে এই মহানিষ্ক্রমণের কথা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।

এর পরের সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হল কলকাতার জাপানী কনস্যুলেটের মাধ্যমে রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ। ভগৎরাম আসবার মাস দুয়েক বাদে বাবা আমাকে এক সন্ধ্যায় নীচে ডেকে পাঠালেন, গিয়ে দেখি কালো টুপি মাথায় এক বাঙালী ভদ্রলোক বারান্দায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন। বাবা আমাদের পরস্পরকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে আমাকে বললেন যে, কলকাতার জাপানী কনসাল জেনারেল তাঁর সঙ্গে গোপনে দেখা করতে চান। রিষড়ার বাগানবাড়িতে দেখা করার ব্যবস্থা হয়েছে। ঐ বাঙালী ভদ্রলোক কনসাল জেনারেল ওকাজাকিকে নিয়ে সন্ধ্যার পর নিদিষ্ট সময়ে গঙ্গার ধারে এক নির্দিষ্ট জায়গায় আসবেন। আমি গাড়ি নিয়ে সেই সময় সেই জায়গা থেকে ওকাজাকিকে তুলে নিয়ে রিষড়ায় যাব। বাবা প্রথমে বলেছিলেন যে ড্রাইভার গাড়ি চালাবে। কিন্তু আমি এই ধরনের বিপজ্জনক কাজে ড্রাইভারকে সাক্ষী রাখা পছন্দ করলাম না। তাই নির্দিষ্ট সময়ে আমি নিজেই ওয়ানডারার গাড়ি চালিয়ে গঙ্গার ধারে প্রিন্সেপ ঘাটের কাছে হাজির হলাম। মস্ত একখানা গাড়ি থেকে নেমে ওকাজাকি আমার পাশের সীটে বসলেন। আমি সোজা রিষড়ার দিকে রওনা দিলাম।

রাঙাকাকাবাবু জার্মানী থেকে জাপানে সংবাদ পাঠিয়েছেন— সেই সংবাদ কলকাতার জাপানী কনস্যুলেটে এসে পৌঁচেছে, ওরা কোডের অর্থ উদ্ধার করে সংবাদ আমাদের দিতে এসেছেন।

ওকাজাকির হাতে বাবা রাঙাকাকাবাবুর বার্তার একটা উত্তরও দিলেন, আমাকে বললেন, ‘তোমার কথাও লিখে দিলাম।’ বললেন, ‘লিখেছি যে, দি মেডিকেল স্টুডেন্ট ইজ অল রাইট।’

জাপানী কনস্যুলেটের মাধ্যমে রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে বাবার নিয়মিত যোগাযোগ স্থাপিত হল। ওকাজাকির পর সংবাদ আনা-নেওয়ার কাজের ভার নিলেন কনসাল ওতা। এই ওতাও ও তাঁর স্ত্রী রিষড়ার বাড়িতে কয়েকবার এসেছেন। শ্ৰমতী ও সঙ্গে আসতেন যাতে ব্যাপারটা নিছক সামাজিকতা অর্থাৎ সোশ্যাল কল্‌ বলে মনে হয়। শ্ৰীমতী ওতা আবার শাড়ি পরে আসতেন।

সম্প্রতি এই গোপন যোগাযোগ সম্বন্ধে বিশেষ কৌতূহলোদ্দীপক তথ্য আমেরিকান ঐতিহাসিক শ্ৰীমতী জয়েস লেব্রা নেতাজী ভবনে অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল নেতাজী সেমিনারে দিয়েছেন। শ্ৰীমতী লেব্রা জাপানী সরকারের পুরোনো নথিপত্রের মধ্যে ১৯৪১ সালের এপ্রিল মাসে কলকাতা থেকে পাঠানো ওকাজাকির তারবার্তা দেখেছেন। সেই বার্তায় ওকাজাকি জাপানী গভর্নমেন্টকে বার্লিনে সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলছেন। আরও বলছেন যে, ভারতের স্বাধীনতার জন্য জাপানের উচিত সুভাষপন্থী চরমপন্থী সংগ্রামী দলকে অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সাহায্য করা।

বলাই বাহুল্য, নিয়মিত রেডিও শোনা ও রাঙাকাকাবাবুর কার্যকলাপ সম্বন্ধে যে কোন রকম ইঙ্গিত পাবার চেষ্টা করা আমার দিন ও রাতের প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়াল। বছরের মাঝামাঝি হঠাৎ একদিন টোকিও রেডিও থেকে বলল যে ভারতের জাতীয়তাবাদী নেতা সুভাষচন্দ্র বসু বার্লিনে রয়েছেন এবং ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য একটি সৈন্যবাহিনী গঠনের উদ্দেশ্যে জার্মানীর নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে কথাবার্তা বলছেন। খবরটা শুনে আমিও বেশ বিচলিত হলাম। মনে হল যেন অসময়ে অতি গোপনীয় খবরটি ফাঁস হয়ে গেল। রাতে বাবাকে জানালাম। ঐ সময়ে জাপান থেকে ঐ ধরনের খবর প্রচারের তাৎপর্য বুঝলাম না। শ্রীমতী লেব্রার গবেষণা থেকে অবশ্য আমরা এখন জানতে পেরেছি যে, ঐ সময়েই রাঙাকাকাবাবু সম্বন্ধে জাপানের কর্তৃপক্ষ সক্রিয় “অনুসন্ধান” আরম্ভ করেন এবং আরও কিছুদিন পরে বালিনে মিলিটারি অ্যাটাচে ইয়ামামোটো ও রাষ্ট্রদূত ওশিমার মারফত—তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা শুরু করেন।

পূজার ছুটিতে কারসিয়ং-এ বাবা জাপানী কনস্যুলেটের মারফত রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে বার্তা আদান-প্রদানের বিষয়ে নিভৃতে আমাকে কিছু কিছু বললেন। জার্মানী সেভিয়েট রাশিয়া আক্রমণ করায় পশ্চিম থেকে বড় কিছু করা সম্বন্ধে আমি তখন ব্যক্তিগতভাবে খুবই সন্দিহান ও নিরাশ হয়ে পড়েছি। বাবার কাছ থেকে শুনলাম যে জার্মানরা রাঙাকাকাবাবুকে বলছে যে, রাশিয়ার যুদ্ধ চূড়ান্ত পর্যায়ে যেতে দেরী নেই—ব্যাপারটা “a matter of weeks”. অন্যদিকে রাঙাকাকাবাবু জানিয়েছেন যে তাঁর প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী রিবেনট্রপ ও তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গোদের ভারতবর্ষ ও এশিয়া সম্বন্ধে educate করা। এসব বিষয়ে অনেক পুরোনো কাগজপত্র অবশ্য এখন নেতাজী রিসার্চ ব্যুরোতে আমরা পড়ছি।

১৯৪১-এর ১১ই ডিসেম্বর বাবা গ্রেপ্তার হলেন। গভর্নমেন্ট একটি ইস্তাহারে বললেন যে, জাপানীদের সঙ্গে বাবার এমন ধরনের যোগাযোগ হয়েছে যে তাঁকে বন্দী করা প্রয়োজন। আসলে কিন্তু জাপানীরা ছিল উপলক্ষ্য, যোগাযোগ হয়েছিল রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে দেশের স্বাধীনতার জন্য চূড়ান্ত লড়াই-এর প্রস্তুতির ব্যাপারে। সাথে সাথে বাবা ফজলুল হক সাহেবের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক বিরাট পরিবর্তন আনলেন। নাজিমুদ্দীন সাহেবের নেতৃত্বে মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভার পতন হল এবং বাবা নিজে স্বরাষ্ট্র দপ্তরের মন্ত্রিত্বের দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত হলেন। দুইদিক থেকে—ভিতর থেকে ও বাইরে থেকে—ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে অবস্থাটা যে খুবই বিপজ্জনক হয়ে উঠল সেটা অনস্বীকার্য। বাবাকে সুদূর দক্ষিণ ভারতে পাঠিয়ে দেবার পর ভাইস্‌রয় লর্ড লিনলিথগো বিলাতে ভারতের সেক্রেটারী অফ্‌ ষ্টেট লিওপোল্ড এমেরীকে এক গোপন চিঠিতে লিখলেনঃ

“It is obvious that it was well to have got Sarat Bose away from here……………in fact one individual went so far as to suggest that it was almost the case that Cabinet meetings were held in his quarters in the Jail: ……………his contacts with the Japanese were an additional reason for exercising the greatest care in his case.”

“এ কথা পরিষ্কার যে শরৎ বোসকে এখান (কলকাতা) থেকে সরিয়ে দিতে পারাটা খুবই ভাল হয়েছে। বাস্তবিক একজন তো এমন কথাও বললেন যে, ব্যাপারটা যা দাঁড়িয়েছিল তাতে জেলে ওঁর ঘরের মধ্যেই মন্ত্রীসভার বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছিল বলা যায়!⋯ওঁর সঙ্গে জাপানীদের যোগাযোগও আরও একটি কারণ যার জন্য ওঁর সম্বন্ধে বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করা দরকার।”

বাবার গ্রেপ্তারের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের পরিবারের ঘোর দুঃসময় শুরু হল। ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের শ্যেনদৃষ্টি তো আছেই—জনকয়েক ছাড়া আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধব আমাদের সঙ্গে স্বাভাবিক যোগাযোগ রাখাও বিপজ্জনক মনে করে আমাদের যথাসম্ভব এড়িয়ে চলতে লাগলেন। আমার মা তাঁর জীবনের কঠিনতম পরীক্ষার সম্মুখীন হলেন। সংসার তো চালানোই দায়, তার উপর আবার সরকারী জুলুম এবং আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের শীতল আচরণ। বাবা বন্দী হবার পর নিজে ধরা পড়া পর্যন্ত সত্যরঞ্জন বক্সী মহাশয় মাঝে মাঝে এসে মাকে রাঙাকাকাবাবুর খবরাখবর জানিয়ে যেতেন। আমি আড়াল থেকে কিছু কিছু শুনে ফেলতাম। রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে কাবুল মারফত যোগাযোগ রাখবার জন্য সীমান্ত প্রদেশ, পাঞ্জাব ও বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের নিয়ে এক গোপন বিপ্লবী কেন্দ্র গঠন করা হয়েছিল—তার বাঙালী প্রতিনিধি মারফত সত্যবাবু রাঙাকাকাবাবুর খবর পেতেন।

অন্যদিকে জাপানীদের ইংরাজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা এক নতুন সম্ভাবনা এনে দিল এবং যুদ্ধে জাপানীদের অভূতপূর্ব সাফল্য আমাদের মনে—সাধারণ ভাবে দেশের স্বাধীনতাকামী জনগণের মনে—নতুন আশার সঞ্চার করল।

১৯৪২-এর ফেব্রুয়ারী মাসের শেষাশেষি কানাঘুষো শোনা গেল যে আজাদ হিন্দ্‌ রেডিও নামে একটি গোপন রেডিও ষ্টেশন চালু হয়েছে এবং তারা প্রচার করেছে যে, শীঘ্রই সুভাষচন্দ্র বসু ঐ বেতারে বক্তৃতা করবেন। অনেক চেষ্টা করেও প্রথম প্রথম আজাদ হিন্দ্‌ রেডিও ধরতে পারলাম না। সৌভাগ্যবশতঃ বার্লিন রেডিও রাঙা-কাকাবাবুর প্রথম বেতার বক্তৃতা পুনঃপ্রচার করল এবং আমরা শুনলাম। তারপর থেকে রাতের পর রাত রেডিওর কাঁটা ধরে বসে থাকাই আমার প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়াল। এখনও শুনতে পাই আজাদ হিন্দ্‌ রেডিওর বাংলা প্রোগ্রামের শুরুতে সেই গর্জনঃ

“বল্‌ রে বন্য হিংস্র বীর,

দুঃশাসনের চাই রুধির⋯”

১৯৪২-এর মার্চের শেষ সপ্তাহে নাইট ডিউটি সেরে একদিন ভোরে মেডিকেল কলেজ থেকে বাড়ি ফিরছি। বাসে একজন সহযাত্রীর হাতে Statesman কাগজের প্রথম পাতায় রাঙাকাকাবাবুর ছবি চোখে পড়ল। খুবই আশ্চর্য লাগল, কারণ ঐ কাগজে তাঁর ছবি বেরোন সেকালে খুব স্বাভাবিক ছিল না। যাত্রীটির পাশ ঘেষে ফলাও করে ছবি ছাপার কারণটি পড়লাম—২৪শে মার্চ নাকি জাপানের উপকূলে এক বিমান দুর্ঘটনায় রাঙাকাকাবাবুর মৃত্যু হয়েছে। খবরটি যে ভুল এ বিষয়ে আমার মনে কোন সন্দেহ জাগেনি। বাড়ি ফিরে দেখি মা স্থির হয়ে যেন আমারই অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছেন—চোখে জল। আমি তো বেশ জোর গলায় ও ও স্থির বিশ্বাসে খবরটি উড়িয়ে দিলাম। বললাম, আপনি তো জানেন রাঙাকাকাবাবু ইউরোপে আছেন এবং এখন সেখান থেকে প্রায় রোজই রেডিওতে বক্তৃতা করছেন। আরও বললাম যে তখন যুদ্ধের যে ভৌগোলিক পরিস্থিতি তাতে রাঙাকাকাবাবুর পক্ষে হঠাৎ বিমানে জাপানে আসা একেবারেই অসম্ভব। মাকে শান্ত করে বেরিয়েই দেখি শ্ৰীমতী লীলা রায় উপরে উঠছেন। তাঁরও একই অবস্থা—একই কথা বলে শ্ৰীমতী রায়কে বোঝালাম যে খবরটি সত্য হতে পারে না। সিঁড়ি দিয়ে নামবার সময় শ্ৰীমতী রায় বার বার থম্‌কে দাঁড়ালেন এবং প্রত্যেক বারই আমাকে একই কথা বলতে হল।

১৯৪২-এর মার্চ মাসে সুভাষচন্দ্রের মৃত্যুসংবাদ ঘোষণার পর আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদকীয়

১৯৪২-এর মার্চ মাসে সুভাষচন্দ্রের মৃত্যুসংবাদ প্রচারের পর হিন্দুস্থান স্ট্যাণ্ডার্ড পত্রিকার সম্পাদকীয়

মা-জননী তো প্রথম থেকেই খবরটা বিশ্বাস করেননি বলে শুনলাম। তবুও তাঁকে সন্ধ্যায় উডবার্ন পার্কের বাড়িতে নিয়ে এলাম। মা-জননী ও মাকে বসিয়ে রাঙাকাকাবাবুর বেতার বক্তৃতা শোনালাম। কিন্তু দেশের, বিশেষ করে সুভাষপ্রেমী আপামর জনসাধারণকে বোঝাবে কে? তাদের মনের কথা প্রতিধ্বনিত হল আনন্দবাজার পত্রিকা ও হিন্দুস্থান স্ট্যাণ্ডার্ডের সম্পাদকীয়র কয়েকটি ছত্রে।

সুরেশচন্দ্র মজুমদার মহাশয়ের কাছে শুনেছি যে ঐ সম্পাদকীয় ছাপাবার পর বাংলাদেশের তদানীন্তন ইংরাজ হোম সেক্রেটারী তাঁকে খুব চোখ রাঙিয়েছিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *