মহানিষ্ক্রমণ – ২

॥ ২ ॥

১৯৪০-এর জুলাই থেকে ডিসেম্বর মাসে রাঙাকাকাবাবু যখন শেষবারের মত জেলে ছিলেন, তখন আমি পরিবারের অন্যান্যদের সঙ্গে বেশ কয়েকবার ওঁর সঙ্গে দেখা করতে প্রেসিডেন্সি জেলে গিয়েছি। আমার মনে আছে, উনি আমাকে মেডিকেল কলেজে আমার পড়াশুনো কেমন হচ্ছে খোঁজখবর করতেন, আর আমাকে প্রায়ই মনে করিয়ে দিতেন যে, হাফ্‌-ডাক্তার হওয়ার চাইতে হাফ্‌-ইঞ্জিনিয়ার হওয়া ভাল। উনি অন্যান্যদের সম্বন্ধেও একইভাবে খোঁজখবর করতেন। জেলের কর্তাদের নিয়ে ওঁর যে সব রসিকতা ছিল তা আমরা খুব উপভোগ করতাম। “ব্রিটিশ সাম্রাজ্য আর কতদিন?” বার বার এই প্রশ্ন করে তিনি জেলের ভারতীয় কর্মচারীদের অপ্রস্তুত করে দিতেন। তারপর তিনি তাঁদের আশ্বাস দিয়ে বলতেন যে, তাঁদের চাকরি বহাল থাকবে। কেবল আজ যাঁরা সরকার চালাচ্ছেন আর যাঁরা বন্দী, তাঁদের মধ্যে স্থান বিনিময় হবে।

অক্টোবর মাসে সহবন্দীদের নিয়ে নেতাজী জেলের মধ্যে দুর্গাপূজার আয়োজন করলেন। তাতে আমাদের খুব উৎসাহ। বিসর্জনের দিন জেল-গেটের কাছে প্রতিমা নেবার জন্য যে দলটি গেল আমি তাদের সঙ্গে জুটে পড়লাম।

আমার বাবা তাঁর বন্দী ভ্রাতার কাছে প্রায়ই যেতেন। এই সময় আমি মা’র কাছে শুনি যে, তিনি বাবাকে খুব পীড়াপীড়ি করছেন যে, উনি যখন পূজার সময় উত্তর ভারতে বেড়াতে যাবেন, তখন যেন সীমান্ত প্রদেশের ফরোয়ার্ড ব্লক নেতা মিয়া আকবর শাহের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং মিয়াসাহেবকে সোভিয়েট রাশিয়া যেতে অনুরোধ করেন। আমি তখনই শুনেছিলাম যে, প্রথম জীবনে মিয়া আকবর শাহের এই ধরনের ভ্রমণের আরো অভিজ্ঞতা আছে।

২৯শে নভেম্বর থেকে রাঙাকাকাবাবু যখন জেলে অনশন শুরু করলেন, তখন সপ্তাহখানেক আমাদের সমস্ত পরিবারে একটা চরম দুশ্চিন্তা দেখা দিল। আমার বাবা তখন বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার বিরোধী দলের নেতা। আমার মা’র কাছে শুনলাম যে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন বাবাকে বলেছেন যে, ব্রিটিশ প্রভুরা এ ব্যাপারে খুব কঠোর মনোভাব অবলম্বন করবে। তাতে আমাদের দুশ্চিন্তা গভীরতর হল। কিন্তু ৫ই ডিসেম্বর বিকেলবেলা আমাদের দুশ্চিন্তার অবসান ঘটিয়ে এলগিন রোডের বাড়ি থেকে খবর এল যে, রাঙা-কাকাবাবু বিনাশর্তে মুক্তি পেয়েছেন ও তাঁকে একটি অ্যামবুলেন্স-এ করে বাড়িতে আনা হয়েছে।

আমরা যারা তখন বাড়িতে ছিলাম (উডবার্ন পার্ক) সকলে তাঁকে দেখতে এলগিন রোডের বাড়িতে ছুটলাম। রাঙাকাকাবাবু তাঁর ঘরে শুয়ে ছিলেন এবং তাঁকে খুব দুর্বল ও ক্লান্ত দেখাচ্ছিল।

এইখানে বলে রাখি যে, নেতাজীর ঘর বলে আজ যেটি সকলের পরিচিত, সেটি ছিল আসলে তাঁর বাবা জানকীনাথের ঘর। রাঙা-কাকাবাবু যখন ১৯৩৭ সালে এলগিন রোডের বাড়িতে বাস করতে আসেন, তার বছর দুয়েক আগে জানকীনাথের মৃত্যু হয়েছে। ঘরে দুটি খাট আছে—জানকীনাথের পুরানো সাবেকী ধরনের বড় খাট ও অন্যটি একটি মোটামুটি সাধারণ তাপোশ। রাঙাকাকাবাবু সাধারণ খাটটি ব্যবহার করতেন।

জেলে উনি গোঁফ রেখেছিলেন। তাতে যেন তাঁকে আরও অসুস্থ দেখাচ্ছিল। ঘরে কেউ ঢুকলেই তিনি তাঁর স্বভাবমত হেসে স্বাগত জানাচ্ছিলেন। আমি আমার স্বভাবমত সলজ্জভাবে ওঁর কাছে গেলাম, আমার হাতখানা ওঁর নিজের হাতের মধ্যে টেনে নিয়ে অস্বাভাবিক রকম দীর্ঘক্ষণ দৃঢ়ভাবে তিনি ধরে রাখলেন। আমি একটু অপ্রস্তুত রোধ করলাম। পরে আমার মনে হয়েছিল, সেই দীর্ঘ ও হৃদয়স্পর্শী হাতধরা থেকেই হয়ত আমার সঙ্গে ওঁর নতুন সম্পর্কের সূচনা। অবশ্য এ-সবই আমার কল্পনা হতে পারে।

ডাক্তারের নিষেধ সত্ত্বেও তার পরের ক’দিন বড় বেশী অতিথির ভিড় হতে লাগল। আমি দূরেই সরে রইলাম। আমার মা প্রতিদিন তাঁকে দেখতে যেতেন। মা এসে বলতেন, রাঙাকাকাবাবু আমার মেডিকেল কলেজের রুটিন সম্বন্ধে পুঙ্খানুপুঙ্খ খোঁজখবর করছিলেন। আমি কখন কলেজে যাই, কখন ফিরি, পড়াশুনার চাপ কেমন, ইত্যাদি। অবশ্য ওঁর যে আমার সঙ্গে বিশেষ কোন দরকার, এমন প্রত্যক্ষ ইঙ্গিত তার মধ্যে ছিল না। তিনি মাকে সোজাসুজি বলেনওনি যে, আমার সঙ্গে ওঁর বিশেষ কোন কাজ আছে বা আমার সঙ্গে কথা বলতে চান।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *