মহানিষ্ক্রমণ – ১৮

॥ ১৮ ॥

আমরা যখন বারারিতে এসে পৌঁছলাম রাত তখন তিনটে। আমরা শুয়ে পড়লাম।

দাদা আমাকে বলছিলেন যে, মনে হয় রাঙাকাকাবাবু যেন পুরোনো ভারতীয় বিপ্লবীদের ঐতিহ্য ও পথ অনুসরণ করছেন, বোধ করি উনি রাশিয়া চলেছেন। আমি দাদার সঙ্গে একমত হলাম যে, রাঙাকাকাবাবু বিপ্লবীদের পথে চলেছেন। কিন্তু আমি বললাম যে, আমি এ বিষয়ে নিঃসন্দেহ যে ওঁর বর্তমান গন্তব্যস্থল জার্মানী।

পরদিন শনিবার ১৮ই জানুয়ারী সকাল ৯টা নাগাত আমি কলকাতার পথে রওনা হলাম। এবারকার ড্রাইভ সম্পূর্ণ অন্য ধরনের। আমার জীবনে আমি এত নিশ্চিন্ত ও হালকা বোধ করিনি। সারা পথ আমি গান গাইতে গাইতে এলাম। স্বদেশী গান যত জানতাম সব গেয়ে ফেললাম। গাড়িতে খাবার ছিল। পথে দাঁড়িয়ে খেয়ে নিলাম। স্টেশন বা লোকজনের সান্নিধ্য যতটা পারি এড়িয়ে চললাম। একেবারে চুঁচুড়ার কাছাকাছি এসে দূর থেকে একটা পুলিশের সমাবেশ চোখে পড়ল। হঠাৎ বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল—আমার জন্য অপেক্ষা করছে না তো?

বিকেল চারটা নাগাদ আমি ১নং উডবার্ন পার্কে গাড়ি নিয়ে এসে ঢুকলাম। বড় গাড়ির ড্রাইভার এগিয়ে এসে গাড়ির ভার নিল। আমি গাড়ি-বারান্দায় গাড়ি ছেড়ে দিয়ে দৌড়ে ওপরে উঠে গেলাম। দোতলার হলঘরে মা’র সঙ্গে দেখা। মা বললেন, বাবা এখনই নীচে নামবেন। আমি সিঁড়ির পাশে আমাদের ড্রইংরুমে অপেক্ষা করতে লাগলাম। একটু পরেই বাবা সে-ঘরে এলেন।

আমি খুব সংক্ষেপে বাবাকে আমাদের যাত্রা বর্ণনা করে গেলাম। বাবা কতকগুলি প্রশ্ন করলেন। সবগুলির জবাবই তাঁর সন্তোষজনক বলে মনে হল। আমি একটু আশ্চর্য হয়ে গেলাম যখন বাবা বললেন যে, বারারি থেকে আমার যে টেলিগ্রাম করার কথা ছিল সেটা উনি আর আশা করছিলেন না। কারণ, আমরা চলে যাবার পর ওঁর মনে হয়েছিল যে, এই টেলিগ্রাম করাটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। উনি বুঝতে পেরেছিলেন, রাঙাকাকাবাবুও সে কথা ঠিক বুঝবেন।

সেদিন আমাদের সমস্ত পরিবারের বিয়ের নেমন্তন্ন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের নাতনী মিনুর সেদিন বিয়ে। আমি অত্যন্ত ক্লান্ত বোধ করছিলাম। গত আটচল্লিশ ঘণ্টায় প্রায় পাঁচশ’ মাইল গাড়ি ড্রাইভ করেছি। কিন্তু বাবা বললেন যে, আমাকে বিয়ে-বাড়ি যেতেই হবে। সব কিছু স্বাভাবিক দেখাতে হবে। বিয়ে-বাড়িতে অনুপস্থিত থাকা চলবে না। আমাকে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে নিতে বললেন। বাড়ির সকলে আগে চলে গেলেন। আমি বাবার সঙ্গে একটু দেরি করে পরে গেলাম। কিন্তু যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই রাত হয়। বিয়ে-বাড়িতে আবার আমাকেই বিশেষ করে ধরে কেউ কেউ জিজ্ঞাসা করলেন—কি, সুভাষবাবুর কি খবর? আমিও সরলভাবে বললাম— শরীরটা তো তেমন ভাল নেই।

মা’র কাছে শুনে আমি আশ্বস্ত হলাম যে, বাড়িতে আমার অনুপস্থিতি বিশেষ তেমন নজরে পড়েনি। অন্তর্ধানের পরের দিন সন্ধ্যায় আমার বোন গীতা কলেজ থেকে আমি তখনও ফিরছি না কেন জিজ্ঞাসা করেছিল। মা তাকে বলেছিলেন যে, রাঙাকাকাবাবুর কোন কাজে আমি বাইরে গিয়েছি। ছোটবেলা থেকে আমাদের সকলেরই বেশী কিছু প্রশ্ন না করার ট্রেনিং ছিল। আমার এক জ্যাঠতুতো ও আর এক মাসতুতো দাদা, যাঁরা প্রতিদিন সন্ধ্যায় আমাদের বাড়ি আসতেন, কি জানি কেন ঠিক সেই দু’দিনই তাঁরা আসেননি।

এলগিন রোডের বাড়িতে গিয়ে পরদিন সন্ধ্যায় আমি ইলা ও অন্য দুই ভাইকে খবর দিয়ে এলাম যে, সব ঠিক আছে। কেবল ভাঁওতাটা চালিয়ে যেতে হবে এবং we must keep our mouth shut। এর পর আমি প্রতিদিন সন্ধ্যায় আমার পুরোনো অভ্যাসমত এলগিন রোডের বাড়িতে যেতাম। ইলা কায়দা করে আমাকে রাঙাকাকা-বাবুর ঘরে ঢুঁকিয়ে দিত এবং রাঙাকাকাবাবুর জন্য রাখা উপাদেয় খাবারগুলি—ফল, মিষ্টি, ছানা ইত্যাদি আমি আত্মসাৎ করতাম। রাঙাকাকাবাবু ঘরের মধ্যে নির্জনবাস করছেন, এই ভাঁওতাটা পুরো দশ দিন চালিয়ে যাওয়া হল।

২০ জানুয়ারী সোমবার রাঙাকাকাবাবুর একটা মামলা আলিপুর কোর্টে উঠবার কথা। এই শুনানির জন্য মুলতুবি প্রার্থনা করা দরকার। পুরোনো মেডিকেল সার্টিফিকেটের ওপর জজ যদি মুলতুবি মঞ্জুর না করেন, তবে তো মুশকিল। দ্বিজেন আর আমি মেডিকেল কলেজে ডাঃ পঞ্চানন চ্যাটার্জীর খোঁজে গেলাম। সেখানে তাঁকে না পেয়ে তাঁর বাড়িতে ধাওয়া করলাম। সেখানেও তিনি নেই। ইতিমধ্যে কোর্ট বসার সময় হয়ে যাচ্ছে। দ্বিজেন আর আমি তখন রাঙাকাকাবাবুর কৌঁসুলীর বাড়ি এলাম, আমি গাড়িতেই বসে রইলাম। দ্বিজেন গিয়ে কৌঁসুলীকে বলল—রাঙাকাকাবাবুর সায়েটিকার ব্যথা খুব বেড়েছে। সকালের মধ্যে ডাক্তারের সার্টিফিকেট হয়ত হবে না। কৌঁসুলী যেন রাঙাকাকাবাবুর নাম করে এই শেষবারের মত মুলতুবি চেয়ে নেন। যাই হোক, জজ সাহেব শুনানি মুলতুবি রেখেছিলেন।

সেইদিনই কলেজে ফিরে আবার অ্যানাটমি ডিপার্টমেন্টে মৃতদেহ ডিসেক্‌শনের কাজে লাগলাম। আমার পার্টনার ছিল নিতান্তই ভালমানুষ, তাকে নিয়ে কোন সমস্যা হল না। আমাদের demons-trator মহাশয় যখন পার্সেণ্টেজ দিতে এবং পরীক্ষা নিয়ে আমার কার্ড সই করতে এলেন, তখন স্বীকার করতেই হল যে, পারিবারিক কারণে আমাকে দু’দিনের জন্য কলকাতার বাইরে যেতে হয়েছিল। তিনি খুবই খোলা মনে বললেন, কলকাতার বাইরে যে গিয়েছিলে তার পুলিশ রেকর্ড তো আর নেই! তিনি সেই দু’দিনেরও পার্সেন্টেজ দিয়ে দিলেন ও কার্ড সই করে দিলেন। তাঁর এই ঠাট্টা করে বলা মন্তব্যে আমি এমন চমকে উঠলাম যে, আজ পর্যন্ত আমার সেই ঘটনাটা মনে আছে।

আবার শুনানির তারিখ ধার্য হল ২৭ জানুয়ারী। বাবা বললেন, রাঙাকাকাবাবু সেদিন যখন কোর্টে হাজিরা দিতে উপস্থিত হবেন না, তখন পুলিশ এসে দেখবে উনি নেই, সেটা ভাল হবে না। তার চাইতে পুলিশ জানবার আগেই আমাদের তরফ থেকেই রাঙাকাকা-বাবুর অন্তর্ধানের খবর প্রকাশ হওয়া উচিত। রাঙাকাকাবাবু যে নেই সে কথা যেন আমরা হঠাৎ জানতে পারলাম, সমস্ত ঘটনাটা এভাবে কি করে সাজানো যায় সে বিষয়ে আলোচনার জন্য ২৫ জানুয়ারী দুপুরে উডবার্ন পার্কে বাবার শোবার ঘরে একটা ছোটখাট বৈঠক হল। সেখানে আমি, দ্বিজেন ও অরবিন্দ ছিলাম। বাবা বললেন, বাবা যেমন সাধারণত শনি-রবিবার ছুটি কাটাতে রিষড়ার বাগানবাড়িতে যেতেন, তেমনি সেদিন সন্ধ্যায় রিষড়া চলে যাবেন। শনিবার সন্ধ্যায় রাঙাকাকাবাবুর জন্য যে খাবার রাখা হবে সেটা কেউ খাবে না। তা হলেই পরদিন সকালে ঠাকুর যখন দেখবে যে, কেউ খাবার স্পর্শ করেনি তখন সে আপনা থেকেই একটা হইচই সৃষ্টি করবে এবং বাড়িসুদ্ধ জানাজানি হবে। তা হলে সমস্ত ব্যাপারটাই খুব স্বাভাবিক হবে এবং তখন আমার ভাইয়েরা চারদিকে রাঙাকাকাবাবুর খোঁজে লোক পাঠাবেন। বাবাকে রিষড়ায় খবর দিতেও একদল ছুটবে। আমি বাবার সঙ্গে রিষড়াতে থাকব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *