মহানিষ্ক্রমণ – ১৬

॥ ১৬ ॥

আমি বেশ সহজভাবে এবং আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে গাড়ি ড্রাইভ করে দাদার বাড়িতে ঢুকলাম। বাড়ির সামনেই দু’জন লোক কাজ করছিল। তার মধ্যে একজন দাদার ড্রাইভার। অন্তত দু’জন লোক দেখল যে, আমি একা গাড়ি করে এসে ঢুকলাম, এতে আমি খুব নিশ্চিন্ত বোধ করলাম। আমার ছোট স্যুটকেসটা হাতে নিয়ে আমি একরকম দৌড়ে বাড়ির মধ্যে চলে গেলাম। হাতে মাত্র মিনিট দশেক সময় আছে। তার মধ্যে দাদাকে সব কথা বুঝিয়ে বলতে হবে। রাঙাকাকাবাবুর দুটো বাক্স গাড়ির পেছনের লাগেজ বুথে ছিল, সেখানেই রইল। হোল্ড-অলটি সীটের উপর ছেড়ে এলাম। গাড়ি গ্যারাজে ঢোকাবার আগে ড্রাইভার সেটা আমার মনে করে ভিতরে দিয়ে গেল। দাদা শোবার ঘরে ছিলেন। আমি দরজায় নক্‌ করছি, বেশ জোরে নক্‌ করছি, আমার মনে হল বহুক্ষণ যেন কোন সাড়া নেই। মনে হল সব কথা বুঝিয়ে বলার আগেই রাঙাকাকাবাবু হয়ত এসে পৌঁছে যাবেন। আমি অধৈর্য হয়ে উঠছিলাম। এমন সময় দরজা খুলে দাদা আমাকে দেখে রীতিমত আশ্চর্য হয়ে গেলেন—যদিও আমি যে আসতে পারি তার ইঙ্গিত ওঁকে আগের বার দিয়ে গিয়েছিলাম। আমি কোনমতে দাদাকে রাঙাকাকাবাবু যা বলতে বলেছিলেন, বলে গেলাম। বললাম, রাঙাকাকাবাবুকে আমি সঙ্গে নিয়ে এসেছি। উনি একটা বিশেষ গোপন মিশনে যাচ্ছেন, ছদ্মবেশে এসেছেন। আমি ওঁকে রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে এসেছি যাতে আমরা একসঙ্গে এসেছি তা কেউ জানতে না পারে। আর কয়েক মিনিটের মধ্যেই রাঙাকাকাবাবু এসে পড়বেন। উনি বলবেন যে, উনি একজন ইন্সিওরেন্স এজেট এবং দাদার সঙ্গে ব্যবসায়িক কথা বলতে চান। দাদাকে বলতে হবে যে, এখন ওঁর কাজে বার হবার সময় হয়ে গিয়েছে, তাই কথাবার্তা বলার সুবিধা হবে না। তখন রাঙাকাকাবাবু বলবেন, অনেক দূর থেকে আসছেন। কাছাকাছি থাকবার জায়গা নেই এবং ফেরবার ট্রেনও রাত্রের আগে নেই, অতএব তার চাইতে উনি না-হয় অপেক্ষা করবেন, পরে কথাবার্তা হবে। আজকের দিনের মত উনি দাদার আতিথ্য ভিক্ষা করবেন। এই সব কথাবার্তা ইংরেজিতে হবে এবং এমন করে হবে যাতে ভৃত্যরা সব শুনতে পায়। রাত্রির প্ল্যান নিয়ে আমরা পরে কথা বলব।

আমার বক্তব্য শেষ হতে না হতেই ভৃত্য এসে খবর দিল একজন অপরিচিত পরদেশী লোক দাদার সঙ্গে দেখা করতে চাইছেন। আমি এমন ভাব দেখালাম যেন এতে আমার কোনও উৎসাহ নেই। আমি বউদিদির খোঁজে বাড়ির মধ্যে ঢুকে গেলাম।

দাদা বাবান্দায় বেরিয়ে ‘অপরিচিত’ আগন্তুকের সঙ্গে যথাবিহিত কথাবার্তা বললেন। তারপর অতিথিকে সঙ্গে নিয়ে বসবার ঘরে এলেন। ভৃত্যকে ডেকে দাদা বলে দিলেন যে, ইনি আজকের দিনটা থাকবেন, বাড়তি শোবার ঘরটায় ব্যবস্থা করে দিতে হবে। এঁর খাওয়া-দাওয়া ওঁর ঘরেই পাঠিয়ে দিলে হবে।

সেই ১৭ই জানুয়ারি ১৯৪১-এর সারা দিন ধরে আমরা যে স্টেজ অ্যাক্‌টিং করে গেলাম, সে একটা আলাদা করে বলার মত গল্প। দাদা যখন ভৃত্যকে নানারকম নির্দেশ দিচ্ছেন, আমি খুব নিরাসক্ত ভঙ্গিতে ঘরে এসে ঢুকলাম। দাদা অমনি অপরিচিত আগন্তুকের সঙ্গে আমার ‘পরিচয়’ করিয়ে দিয়ে বললেন—এটি আমার ভাই শিশির বোস।

অতিথিকে বসবার ঘরেই চা খেতে দেওয়া হল। আমি দাদা ও বউদিদির সঙ্গে ভেতরে খাবার ঘরে খেতে বসলাম। দাদা তারপরেই কাজে বেরিয়ে গেলেন। আমি বউদিদির সঙ্গে গল্পগুজব করে খানিক সময় কাটালাম। তারপর বিশ্রাম করলাম। রাঙাকাকাবাবু তাঁর ঘরেই ছিলেন।

দুপুরে খেতে দাদা বাড়ি এলেন। বাইরের লোককে যেমন দেওয়া হয়ে থাকে—রাঙাকাকাবাবুর খাবার ওঁর ঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হল। আমরা সকলে মিলে খেলাম। দাদা অতিথির সঙ্গে আর দেখা করলেন না। তখনই কাজে চলে গেলেন। আমি গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গিয়ে পেট্রল ভরে নিলাম।

বাইরে থেকে বুঝতে পারলাম, রাঙাকাকাবাবু দুপুরবেলা বেশ খানিকটা ঘুমিয়ে নিলেন। বিকেলের আগে ঘর থেকে বার হলেন না।

দাদা কাজ থেকে ফিরলে বেয়ারার মারফত উনি খবর পাঠালেন যে, এবার একটু কথা বলতে চান। দাদা ও রাঙাকাকাবাবু বাইরে বারান্দায় কথাবার্তা বললেন। আমি বসবার ঘরে বসে নির্লিপ্তভাবে ম্যাগাজিনের পাতা ওলটাতে লাগলাম। রাঙাকাকাবাবু সিদ্ধান্ত নিলেন যে, আসানসোল নয়, উনি গোমো থেকে ট্রেন ধরবেন। আমি যখন এ কথা শুনলাম, আমি বললাম যে, এখান থেকে গোমোর রাস্তা আমার অচেনা, তায় রাত্রে গাড়ি ড্রাইভ করব— আরও অসুবিধা হবে। দাদা সঙ্গে এলে ভাল হয়। রাঙাকাকাবাবু রাজী হলেন, কিন্তু দাদা বললেন, এসব জায়গায় রাত্রে বউদিদিকে একা ফেলে যাওয়া নিরাপদ নয়। রাঙাকাকাবাবু বললেন—ঠিক আছে, উনিও সঙ্গে যাবেন। কেবল ভৃত্যদের ডেকে বলে দেওয়া হল বাইরের ভদ্রলোককে তাড়াতাড়ি খাবার দিতে, কারণ, ওঁকে ট্রেন ধরতে হবে। আমরাও একটু আগে আগে খাওয়া সেরে নিলাম। লোকজনদের বলা হল আমাকে নিয়ে দাদা-বউদিদি বেড়াতে বার হবেন।

শীতের সন্ধ্যা যখন গাঢ় হয়ে এল, রাঙাকাকাবাবু সব ভৃত্যদের সামনে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বেশ লোক দেখানোভাবে আমাদের কাছে বিদায় নিলেন। বলা বাহুল্য, ইংরেজীতে বিদায় সম্ভাষণ হল। কথা ছিল—উনি যে পথে এসেছেন সে-পথে কিছু দূর গিয়ে অপেক্ষা করবেন। আমরা তিনজন একটু পরে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। পথে মোটেই আলো নেই। রাঙাকাকাবাবু টর্চের সাহায্যে এগোচ্ছিলেন। কিছু দূর গিয়েই অস্পষ্টভাবে তাঁর ছদ্মবেশী চেহারা চোখে পড়ল। তাঁকে আমরা গাড়িতে তুলে নিলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *