মহানিষ্ক্রমণ – ১৪

॥ ১৪ ॥

রাঙাকাকাবাবু তখন জামাকাপড় ছেড়ে সিল্কের ধুতি ও চাদর পরে নিচ্ছেন, নির্জন বাসের যে ব্ৰত তিনি গ্রহণ করবেন বলে ঘোষণা করেছেন, সেই ব্ৰত শুরু হবার আগে মা ও পরিবারের অন্যান্য সকলের সামনে উনি আনুষ্ঠানিকভাবে শেষবার আহার গ্রহণ করবেন। ইলা, দ্বিজেন আর অরবিন্দ ঘরে পর্দা লাগাবার ব্যবস্থা করছে। রাঙাকাকাবাবু পরে আমাকে বলেন, অরবিন্দকে ভাঁওতা চালিয়ে যাবার কাজে সাহায্য করতে বলা হয়েছে। ঘরের উত্তর প্রান্তে মাটিতে বসে রাঙাকাকাবাবু তাঁর সেই বিশেষ আহার গ্রহণ করলেন। ওঁকে ঘিরে বসেছিলেন ওঁর মা, বউদিদিরা আর ভাইপো-ভাইঝির দল—বলা বাহুল্য, আমিও তাদের অন্যতম। খাওয়া শেষ হলে মা-জননী ও অন্যান্যরা একে একে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। ওঁরা ঘুণাক্ষরেও জানলেন না যে, এই বিদায় দীর্ঘ বিদায় হতে চলেছে। রাঙাকাকাবাবুর মুখ থমথমে দেখাচ্ছিল, কিন্তু উনি নিজেকে সংযত রেখেছিলেন।

রাঙাকাকাবাবু তাঁর এই ব্রত পালনের সংকল্পের কথা পরিবারের সকলের কাছে বেশ বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে পেরেছিলেন। তবে এই স্বেচ্ছাকৃত নির্জনবাসের সময়, কিভাবে কি করতে হবে সকলকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। ঠাকুরকে কিভাবে পর্দার ওপার থেকে খাবার দিতে হবে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছিল। নিজের হাতে কিছু রেডিমেড জবাব লেখা চিরকুট তৈরি করে রেখে গিয়েছিলেন। যে-সব লোকজন দেখা করতে আসবে, তারা কি কাজে এসেছে আন্দাজ করে সেগুলো বিলি করতে হবে, এইসব চিরকুটের কোনটিতে লেখা—‘এ ব্যাপারে কংগ্রেস অফিসে খোঁজ করুন’; অথবা ‘এ সম্বন্ধে কর্পোরেশনে খোঁজ করবেন’। নয়তো ‘শরীর অসুস্থ, পরে এ বিষয়ে আলোচনা হবে’; অথবা ‘অমুকের সঙ্গে এ সম্বন্ধে কথা বলুন’ ইত্যাদি। এ ছাড়া জেলে যে-সব সহকর্মী ছিলেন, তাঁদের উদ্দেশে উনি কয়েকটা চিঠি লিখে রেখে যান। উনি চলে যাবার পরবর্তী কোন কোন দিবসের তারিখ দিয়ে সেগুলো যেন ডাকে ফেলা হয়। এইসব চিঠিরই অন্যতম হল শ্রীহরিবিষ্ণু কামাথকে লেখা ১৮ই জানুয়ারী তারিখে দেওয়া চিঠি।

ক্রমশ রাত্রি গভীর হলে বাড়ির সকলে তিনতলায় যে যার ঘরে শুতে গেলেন। মা-জননীও রাঙাকাকাবাবুর ঘরের পাশেই নিজের শোবার ঘরে চলে গেলেন। আমি জানি না, সেদিন তিনি কত রাত্রি অবধি জেগে ছিলেন। আমরা যখন রাত দেড়টার সময় বাড়ি থেকে বার হলাম, খনও তিনি জেগে ছিলেন কি? বড়দের আর কাউকে নিয়ে কোন সমস্যা হল না। কিন্তু দুই জ্যাঠতুতো ও খুড়তুতো দাদা কেবলই ঘুরঘুর করতে লাগলেন। তাঁদের একজনের সঙ্গে আমি পাশের ঘরে অর্থাৎ ইলার শোবার ঘরে বসে রেডিও শুনতে লাগলাম ও নানারকম গালগল্প করে তাঁকে ভুলিয়ে রাখার ও ক্লান্ত করে দেবার চেষ্টা করতে লাগলাম। শেষপর্যন্ত তিনি পরাজয় স্বীকার করে শুতে যাবার জন্য উঠে পড়লেন, আমিও বাড়ি যাবার ভান করে উঠে দাঁড়ালাম। অন্য দাদাটি কিন্তু এত সহজে ভোলবার পাত্র নন। তা ছাড়া স্পষ্টতই আমাদের কাজকর্ম ওঁর কাছে সন্দেহজনক মনে হয়েছিল। উনি একবার জিজ্ঞাসা করলেন, আমি কেন এত রাত অবধি বাড়ি যাচ্ছি না। আর একবার বললেন, আজ কেন আমি গাড়ি নিয়ে এসেছি। উনি উপরতলায় নিজের ঘরে চলে গিয়েও আবার একটু পরে ফিরে ফিরে আসছিলেন। একবার তো আমি ‘এবার বাড়ি যাওয়া যাক’ বলে বেশ জোরে পা ফেলে নীচে নেমে এসে আবার চুপিচুপি যখন ওপরে উঠে আসছি, ঠিক ওঁর সামনাসামনি পড়ে গেলাম।

অমূল্য সময় বয়ে যাচ্ছে। রাঙাকাকাবাবু চঞ্চল হয়ে উঠেছিলেন, শেষ পর্যন্ত দ্বিজেনকে ডেকে রাঙাকাকাবাবু বললেন, আমার এই সন্দেহগ্রস্ত দাদাটিকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে বিছানায় শুতে এবং যেমন করে পারে আমরা চলে না যাওয়া পর্যন্ত আটকে রাখতে।

বাইরে যাবার লম্বা টানা করিডর ও বাড়ির পিছন দিককার সিঁড়ি আর একবার দেখে নেওয়া হল, সব ঠিক আছে।

ঘরের সেই পর্দার ওপাশে দাঁড়িয়ে রাঙাকাকাবাবু মহম্মদ জিয়াউদ্দিনের পোষাক পরে নিলেন, ওঁর বেডিংটা গুটিয়ে ঠিক করে নেওয়া হল।

রাঙাকাকাবাবু ওঁর বাদামী রঙের গলাবন্ধ লম্বা কোটের সঙ্গে ঢোলা পায়জামা পরলেন আর মাথায় কালো ফেজ টুপি। ছদ্মবেশের ব্যাপারে শেষ মুহূর্তে উনি একটা পরিবর্তন করলেন। বললেন, আমি যে কাবুলী চপ্পল জোড়া ওঁর জন্য কিনেছিলাম, সেটা পরে হাঁটা-চলা করা ওঁর পক্ষে কষ্টকর। তাই পুরোনো ফিতে বাঁধা মজবুত যে জুতো য়ুরোপে ব্যবহার করতেন তাই পরে নিলেন। তাইতে উনি বেশী আরাম পেলেন বটে, কিন্তু এই জুতো বিভ্রাটের ফলে পরে আমাদের একটু বিপদে পড়তে হয়েছিল। যে চশমাটা উনি সে সময় পরতেন, সেটা ছেড়ে রেখে বছর দশেক আগের পুরোনো রোল্ডগোল্ডের ফ্রেম-ওয়ালা গোল কাঁচের চশমাটা সঙ্গে নিলেন, বলেছিলেন, যখন একলা থাকবেন বা অন্ধকারে, তখন চশমা ব্যবহার করবেন, নয়ত চশমা ছাড়াই চলবেন।

দ্বিজেনকে ভার দেওয়া হয়েছিল আমাদের সন্দিগ্ধ দাদাটিকে ধরে রাখবে, আর তা ছাড়া পথঘাটের দিকে নজর করে গেটের কাছে সি. আই. ডি-রা রয়েছে কিনা দেখে জোরে গলা-খাঁকারি দিয়ে আমাদের সংকেত দেবে।

রাস্তা ক্লিয়ার হবার জন্য বসে থেকে যে পুরো তিন ঘণ্টা সময় পার হয়ে গিয়েছে বুঝতেই পারিনি। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত ওপর থেকে সংকেত ভেসে এল আর আমরাও রওনা হলাম।

রাঙাকাকাবাবু পর্দার এপাশে এসে ইলার কাছ থেকে সস্নেহে বিদায় নিলেন, বললেন, ভগবান তোমার মঙ্গল করুন। ইলাকে বলা হল, আমরা চলে যাবার পরও অন্তত আরো এক ঘণ্টা রাঙা-কাকাবাবুর ঘরের আলো যেন জ্বলতে থাকে।

হোল্ড-অল হাতে অরবিন্দ আগে, তারপর রাঙাকাকাবাবু, পিছনে আমি। তিনজনে করিডরের দেওয়াল ঘেঁষে, পা টিপে টিপে চললাম। সেদিন আকাশে উজ্জ্বল জ্যোৎস্না, রাঙাকাকাবাবু সাবধান করে দিলেন দেওয়ালে যেন ছায়া না পড়ে।

একেবারে সাইলেন্ট মার্চ করে আমরা পিছনের সিঁড়ি দিয়ে নেমে গাড়ির কাছে এসে পড়লাম। হোল্ড-অলটা সামনের সীটে রাখা হল। রাঙাকাকাবাবু নিঃশব্দে গাড়িতে উঠে দরজাটা বন্ধ না করে ধরে রইলেন, যদি কেউ জেগে থাকে তো দুটো দরজা বন্ধ হবার আওয়াজ যেন শুনতে না পায়, তা হলে সন্দেহ হবে দু’জন লোক বেরিয়ে গেল।

রাঙাকাকাবাবু গিয়ে গাড়িতে বসার পর আমি বেশ আওয়াজ করে চটি জুতো ফটফট করে গাড়িতে উঠলাম ও দরজাও সশব্দে বন্ধ করলাম। আমার এত সব চেষ্টাকৃত গোলমালে দূরে কোথায় কয়েকটা কাক ডেকে উঠল। বাইরের গেটটা অরবিন্দ এগিয়ে গিয়ে খুলে দিল, আমি যেন তুমুল গর্জন করে গাড়ি চালিয়ে জোরে বেরিয়ে গেলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *