মহানিষ্ক্রমণ – ১২

॥ ১২ ॥

রাঙাকাকাবাবুর নির্দেশমত এক সন্ধ্যায় ইলাকে আমার গাড়িতে করে দক্ষিণেশ্বর নিয়ে গেলাম। আমি কালীমন্দিরের দরজায় অপেক্ষা করলাম, ইলা একটি ছোট তাম্রপাত্র নিয়ে মন্দিরে প্রবেশ করল। পূজার ফুল ও চরণামৃত হাতে করে সে বাড়ি ফিরে এল।

যখন আমাদের যাত্রার চূড়ান্ত প্ল্যান হয়েছিল তখন কথা হয়েছিল, আমি ধানবাদের কাছে কোন ডাকবাংলোতে রাঙাকাকাবাবুকে নামিয়ে দিয়ে সোজা বারারিতে দাদার বাড়িতে চলে যাব। সেখানে দিনটা কাটিয়ে সন্ধ্যাবেলা আবার ডাকবাংলো থেকে ওঁকে তুলে নিয়ে যে রেল-স্টেশনে উনি যেতে চাইবেন সেখানে পৌঁছে দেব। কিন্তু একেবারে শেষের দিকে উনি আমাকে বললেন যে, অন্য জায়গায় যাওয়ার চাইতে উনি বরঞ্চ ছদ্মবেশে দাদার বাড়িতেই দিনটা কাটাবেন। বললেন—‘দেখ, অজানা লোকের সঙ্গে থাকার ঝুকি নেওয়ার চাইতে নিজের লোককে যতটা দরকার ততটা বলে দিয়ে নির্ভর করা ভাল।’ সে-সময় হয়ত আমার মামার বাড়ির কিছু লোক বারারিতে থাকতে পারেন এমন সম্ভাবনা ছিল। উনি বললেন, তা হলেও ডাকবাংলোর চাইতে দাদার বাড়িতে থাকাই শ্রেয় মনে করেন।

আমরা ক’দিন ধরে কেবলই ভাবছিলাম, কি করে ওয়ানডারার গাড়ির ড্রাইভারটিকে দু-তিন দিনের জন্য সরিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু কোন উপায় ভেবে পাচ্ছিলাম না। যাত্রার ঠিক ক’দিন আগে প্রায় দৈব আশীর্বাদের মত একটা ব্যাপার ঘটল। ড্রাইভারের দেশ থেকে চিঠি এল, তার মা গুরুতর অসুস্থ, তাকে এখুনি দেশে যেতে হবে। খবর শুনে আমার মন থেকে একটা ভার নেমে গেল, দৌড়ে গিয়ে রাঙাকাকাবাবুকে বললাম, আজ একটা সুখবর আছে। ড্রাইভারকে টাকা-পয়সা দিয়ে যতদিন প্রয়োজন তার মা’র কাছে থাকতে ছুটি দেওয়া হল।

আমি কেন হঠাৎ দাদার কাছে যাব, তার একটা জুতসই কারণ থাকা দরকার। ঠিক হল—বলা হবে বউদিদি অসুস্থ হয়েছেন, তাই বাবা আমাকে নিজে গিয়ে খোঁজ নিয়ে আসতে বলেছিলেন—ব্যাপারটা কি। কথা হল যে, আমি সেখানে পৌঁছে বাবাকে টেলিগ্রাম করব যে, বউদিদি ভাল আছেন, চিন্তার কোন কারণ নেই।

যদি পথে কেউ আমাদের গাড়ি থামায় ও চ্যালেঞ্জ করে, তাহলে কি করা হবে? আমি এমন ভাব করব যেন আমিই গাড়ির মালিক, যেন এখন শখ করে গাড়ি চালাচ্ছি। আর সুভাষচন্দ্র বসু হলেন আমার ড্রাইভার, ড্রাইভার সঙ্গে রয়েছে। আমি হেসে বললাম, ‘গাড়ির মালিক আর ড্রাইভারের চেহারার দিকে তাকালে গল্পটা খুব বিশ্বাসযোগ্য মনে হবে কি?’ রাঙাকাকাবাবু বললেন, ‘হ্যাঁ, ঠিক হবে, তুমি কোন কথা বলবে না। গম্ভীর হয়ে মালিকের মত বসে থাকবে, আমি তাড়াতাড়ি নেমে দরজা খুলে সেলাম ঠুকে দাঁড়িয়ে যাব। অভিনয় যা করবার তা আমিই চালিয়ে নেব।’ যদি কেউ জিজ্ঞাসা করে কোথায় যাচ্ছি, পরবর্তী স্টেশনের নামটা করতে হবে, এত রাত্রে কেন চলেছি জিজ্ঞাসা করলে বলতে হবে, রাস্তায় গাড়ি খারাপ হয়ে গিয়েছিল তাই আটকে পড়েছিলাম।

যাত্রার পূর্বে রাঙাকাকাবাবু আমাকে ঠিক দু’দিনের নোটিস দিলেন। ১৬ই জানুয়ারী, বৃহস্পতিবার, ১৯৪১ সন্ধ্যাবেলা যাত্রা শুরু। আমি তখুনি আবার ওয়ানডারার গাড়ির তদারকে লাগলাম। সার্ভিস করতে দিতে গিয়ে দেখলাম বৃহস্পতিবারের আগে বুকিং নেই, তাতেই অগত্যা রাজী হলাম।

আমি তখন মেডিকেল কলেজের তৃতীয় বার্ষিক শ্রেণীর ছাত্র, মৃতদেহ কাটা-ছেঁড়ার কাজে নিযুক্ত, কলেজ থেকে ছুটি নেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না, সেদিন সকালেও কলেজ করলাম। শুধু কি একটা অজুহাতে একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরলাম, কেন ক’দিন আসতে পারলাম না, এসব কথা কলেজে পরে বললে চলবে, আগে তো ঘুরে আসি। আমার কোন ছদ্মবেশের প্রশ্ন নেই। সেকালে আমরা সাধারণত যেরকম পোষাক পরতাম তাই পরলাম—ধুতি, শার্ট, তারপর গরম কোট আর জুতো। রওনা হবার আগে রাঙাকাকাবাবু তার নিজের কাশ্মীরী কাজ-করা গরম টুপিটা আমাকে দিলেন। বললেন, দিনের আলোয় গাড়ি চালাবার সময় অথবা কোন লোকজনের সঙ্গে কথা-বার্তার প্রয়োজন হলে টুপিটা পরে নিতে। এতে চেহারায় একটা অন্যরকম ভাব আসবে। এই টুপিটা রাঙাকাকাবাবু তাঁর ত্রিশ সালের য়ুরোপ ভ্রমণের সময় খুব পরতেন। এই টুপি পরে ওঁর অনেক ছবিও আছে। এই কাশ্মীরী টুপিটা আমি আজও যত্ন করে রেখে দিয়েছি।

ঠিক যাত্রার আগের রাত্রে আমার হঠাৎ সন্দেহ হল, আমি রাঙাকাকাবাবুর জন্যে যে স্যুটকেস কিনেছি ও জামাকাপড় গুছিয়ে রেখেছি, সেটা ওয়ানডারার-এর লাগেজ রাখার জায়গার পক্ষে বেশী বড় হবে না তো? স্যুটকেসটা মেপে নিয়ে গিয়ে লাগেজ বুথও মাপলাম। কি সর্বনাশ! যা ভেবেছিলাম তাই। তখন তাড়াতাড়ি করে বাবার একটা স্যুটকেস বার করলাম। একটা স্যুটকেসে M.Z. (মহম্মদ জিয়াউদ্দিনের নামের আদ্যক্ষর), অন্যটিতে S.C.B. লেখা ছিল। বাক্স বদল করলাম, M.Z. ও S.C.B. লেখা দুটো মুছে দিলাম, তাড়াহুড়া করে একটু চাইনিজ ইংক দিয়ে আবার M.Z. লিখে ফেললাম। লেখাটি খুব বাজে হল—কিন্তু কি আর করা! ব্যাপারটা গাড়ি চালাতে চালাতে পরে রাঙাকাকাবাবুর কাছে স্বীকার করলাম। তিনি একটু বিরক্তি প্রকাশ করলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *