মহানিষ্ক্রমণ – ১১

॥ ১১ ॥

বারারি-ধানবাদ এলাকা পর্যবেক্ষণ করে আমার ফেরার সঙ্গে সঙ্গে অন্তর্ধান-পর্বের চূড়ান্ত প্রস্তুতি শুরু হল। রাঙাকাকাবাবু একটু অধৈর্য হয়ে পড়ছিলেন। কারণ, সীমান্ত প্রদেশ থেকে সবুজ সংকেত এসে পৌঁছতে দেরি হচ্ছিল। প্রথম যখন রাঙাকাকাবাবু এ-ব্যাপারে আমার সঙ্গে কথাবার্তা বলেন তখন বলেছিলেন, ডিসেম্বরের শেষেই রওনা হয়ে পড়বেন। তা যদি হত তা হলে কিন্তু যাবার আগে বাবার সঙ্গে তার দেখা হত না। বাবা কালিম্পং থেকে ফিরলেন জানুয়ারিতে।

এলগিন রোডের বাড়ি থেকে কিভাবে নিষ্ক্রান্ত হবেন সব স্থির হয়ে গেল। উনি পশ্চিমা মুসলমান ভদ্রলোকের পরিচ্ছদ পরে থাকবেন। একদিন রাত্রে উনি পোষাক পরে ঘরের বিরাট আয়নায় নিজেকে কেমন দেখাচ্ছে দেখে নিলেন।

পরদিন আমি আসতেই বিশেষ উৎসাহের সঙ্গে বললেন যে, ছদ্মবেশ খুব ভাল হয়েছে, ভিড়ের মধ্যেও কেউ ওঁকে চিনতে পারবে না। শুনে আমি হাসলাম এবং সাহস করে বলেও ফেললাম যে, সুভাষচন্দ্র বোসের চেহারা ও ব্যক্তিত্ব যত ছদ্মবেশেই থাকুক না কেন, লুকনো সম্ভব নয়। শুনে উনি কিঞ্চিৎ হতাশ হলেন।

এরপর তিনি সকলের চোখে ধূলো দেবার যে পরিকল্পনা করেছেন সেকথা প্রকাশ করলেন। রাঙাকাকাবাবু ঘোষণা করবেন যে, উনি কিছুদিনের জন্য লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যাচ্ছেন। এই স্বেচ্ছাকৃত অবসর-ব্ৰত যাপনের সময় উনি কারুর সঙ্গে দেখা করবেন না বা কথাও বলবেন না। ওঁর ঘরের মধ্য দিয়ে দু’টি পর্দা দুই দিক থেকে ঝুলিয়ে দেওয়া হবে, যাতে করে ঘরের উত্তর দিকটা সম্পূর্ণভাবে আলাদা হয়ে যাবে। রাঙাকাকাবাবু ঘরের সেই দিকটায় থাকবেন এবং তাঁর ব্রত উদ্‌যাপন করবেন। যে ঠাকুর ওঁর মা’র রান্না করে, তার উপর ভার থাকবে ওঁর খাবারটা সময়মত পর্দার তলা দিয়ে ঠেলে দেওয়ার। আহার্য হবে নিরামিষ, তরকারি, দুধ, ছানা, মিষ্টি আর ফল। উনি চলে যাওয়ার পর ইলাকে এই ভাঁওতাটা চালিয়ে যেতে হবে। খাবারগুলো খেয়ে নিতে হবে ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সব কাজ করতে হবে।

একটা মস্ত সুবিধা ছিল এই যে, একমাত্র মা-জননী ও ইলা ছাড়া বিরাট বসু পরিবারের আর সকলেই তিনতলায় শুতেন, রাঙাকাকা-বাবুর শোবার ঘর দোতলায়। আরও একটা সুবিধা ছিল এই যে, মা-জননী সে সময় বাড়ির বা রাঙাকাকাবাবুর দৈনন্দিন জীবনযাত্রার খুটিনাটি নিয়ে মাথা ঘামাতেন না। তা ছাড়া রাঙাকাকাবাবুর এই ধরনের ব্রত উদ্‌যাপনের প্রস্তাবে কারুরই খুব আশ্চর্য হবার কথা নয়—বিরোধিতার তো কোন প্রশ্নই ওঠেনি। রাত্রের খাওয়ার পর বাড়ির চাকর-বাকররাও শুতে চলে যেত। একমাত্র রাঙাকাকাবাবুর যে ব্যক্তিগত ভৃত্য, তাকে একটু সামলে নিতে হবে। তার ওপরেই একতলার সদর দরজা বন্ধ করার ভার। বাইরের গেটে তো তালা পড়তই না, শুধু ভেজানো থাকত। ঠিক হল—সে রোজ যেমন করে সেদিনও তাই করবে। তারপর তাকে ছুটি দিয়ে শুতে যেতে বলা হবে। সৌভাগ্যবশত তার ঘুম ছিল গভীর।

আমরা ঠিক করলাম যে, সদর দরজা ব্যবহার না করে আমরা বাড়ির পিছনে রান্নাবাড়ির যে ছোট সিঁড়ি আছে তাই দিয়ে নীচে নামব। আমাদের ডাক্তার-কাকাবাবুর যে অ্যালসেশিয়ান কুকুরটি আছে সেটা আবার রাত্রে ছাড়া থাকে, তাকে নিয়ে একটা সমস্যা হতে পারে। এর মধ্যে একদিন একজন বিশিষ্ট অতিথি রাঙাকাকা-বাবুর সঙ্গে দেখা করে যখন একটু রাত করে বাড়ি ফিরছেন, তখন সেই অ্যালসেশিয়ানটি তাঁর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।

ইলা এই ঘটনার সুযোগ নিয়ে রাঙাকাকাবাবুর তরফ থেকে ডাক্তার-কাকাবাবুকে গিয়ে বলল যে, রাত্রের দিকে কুকুরটা বেঁধে রাখলে ভাল হয়, কারণ অনেকেই রাত করে রাঙাকাকাবাবুর কাছে যাওয়া-আসা করেন। বাড়ির বাইরে কোন আলো রাত্রে জ্বালানো থাকত না। রাঙাকাকাবাবুকে অবশ্য একটা দীর্ঘ করিডর পার হয়ে যেতে হবে। আশেপাশের বাড়ি থেকে কেউ উঁকি মেরে দেখে ফেলার ভয় থাকবে। বাড়ির বাইরে সাদা পোষাকে যেসব পুলিশ বিভাগের লোক থাকত, দিনকতক তাদের হাবভাব নজর করলাম। আমি রাঙাকাকাবাবুকে জানালাম যে, তারা যেন বেশ নিশ্চিন্ত বোধ করছে। মনে হয় একটু রাত হলেই বেশ কাজে ঢিলে দেয়। শুধু দেখতে হবে যে, গাড়ি করে যখন বার হব তখন গেটের খুব কাছাকাছি তারা কেউ না থাকে।

অন্তর্ধানের দিন দশ-বারো আগে আমার বাবা কলকাতায় ফিরলেন। রাঙাকাকাবাবু আমাকে বললেন বাবাকে গিয়ে বলতে যে, যত শীঘ্র সম্ভব উনি বাবার সঙ্গে কথা বলতে চান। আমি গিয়ে মাকে খবরটা পৌঁছে দিলাম। পরদিন সন্ধ্যায় দুই ভাই মিলিত হলেন। দিন দুয়েক বাদে মা আমাকে বললেন যে, বাবা ঠাট্টা করে জিজ্ঞেস করছিলেন—‘তোমার ছেলে কি বাবা-মাকে না বলেই কাকার সঙ্গে অ্যাডভেঞ্চারে চলেছে?’ আমি চুপ করে শুনলাম। আমার বাবা-মা যে এখন সব কিছু শুনেছেন এবং এত ভালভাবে গ্রহণ করেছেন, এটা জেনে কিন্তু আমার মনে একটা আত্ম-বিশ্বাস ও তৃপ্তির ভাব এসে গেল। আমি লক্ষ্য করতে লাগলাম যে, ইদানীং রাঙাকাকাবাবু আমার সঙ্গে দীর্ঘ নৈশ আলোচনার সেসন্‌গুলি ছোট করে দিয়ে বাবার সঙ্গে কথা বলছেন। ঠিক এই সময় রাঙাকাকাবাবু আমাকে বারবার জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন, যাবার আয়োজন সম্পূর্ণ কিনা এবং আমি নিজে শেষ সংগ্রামের জন্য ‘প্রস্তুত’ কিনা। বাবা আমার সঙ্গে একেবারে যাত্রার দিনে ছাড়া এ নিয়ে কোন সোজাসুজি কথা বললেন না। কিন্তু মা’র কাছ থেকে আমি জানতে পারছিলাম যে, দুই ভাইয়ে মিলে সমস্ত পরিকল্পনাটা আগাগোড়া খতিয়ে দেখছেন।

ঐতিহাসিক সেই দিনটি ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। রাঙা-কাকাবাবু আমাকে ডেকে বললেন, বাবা আমাদের পরিকল্পনার কিছু কিছু পরিবর্তন করেছেন। একটা পরিবর্তন হলঃ বাবা চান এই যে, রাঙাকাকাবাবু চলে যাওয়ার পর উনি লোকচক্ষুর আড়ালে নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করছেন বলে ভাঁওতা দিতে হবে এবং শেষ পর্যন্ত পুলিশকে বলতে হবে, এ ব্যাপারে এলগিন রোডের বাড়ির কোন একটি ছেলেকে ভার দেওয়া হোক। আমি তো এলগিন রোডে থাকি না, সুতরাং আমার দ্বারা এ কাজ সম্ভব ছিল না। পরে পুলিশের যে অবশ্যম্ভাবী জুলুম হবে, ইলার মত অল্পবয়সী মেয়ে তার মুখোমুখি হোক এটা বাবা একেবারেই চান না। রাঙাকাকাবাবু বাবার কথা মেনে নিয়েছেন মনে হল। বললেন, ‘তুমি একটু ভেবে বল কাকে নেওয়া যায়।’ আমি আমাদের জ্যাঠতুতো দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথের নাম করলাম। খানিক আলাপ-আলোচনার পর স্থির হল, ইলাকে একটু আড়ালে রেখে ওর উপরই ভাঁওতা বজায় রাখার কাজ দেওয়া হবে। ইলা অবশ্য সব বিষয়ে সাহায্য করবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *