মহানিষ্ক্রমণ – ১০

॥ ১০ ॥

রাঙাকাকাবাবুর মালপত্র চুপিচুপি উডবার্ন পার্কে আমার তিনতলার ঘরে জমা করছিলাম। সে-সময় আমার বাবা, মা ও বাড়ির অন্যান্যরা কলকাতার বাইরে থাকায় গোপনে জিনিসপত্র ওপরে তোলা নিয়ে আমাকে বিশেষ বেগ পেতে হয়নি। ভৃত্যেরা যাতে কোন সন্দেহ না করে সেজন্য সাধারণত আমি জিনিসপত্র দুপুরবেলার দিকে যখন ওরা বিশ্রাম করত তখন নিয়ে আসতাম। বেডিংটা গুটিয়ে আমি নিজের আলমারীর ভিতরে রাখলাম। স্যুটকেসটা রাখলাম আরও দু-একটা ঐকম বাক্সর সঙ্গে আমার খাটের তলায়। জামা-কাপড় ও ছোটখাট জিনিস লুকিয়ে ফেলা সহজ ছিল। আমার ঘরে আমি একাই শুতাম, অন্য লোকজন বড় একটা আসত না।

কোন্ মোটর গাড়িটা নেওয়া হবে, তাও আমরা বেশ কিছু দিন ধরে আলোচনা করলাম। সে-সময় আমার বাবার দু’খানা গাড়ি ছিল, একটা খুব বড় স্টুডিবেকার প্রেসিডেন্ট, অন্যটি একটু কম চেনা জার্মান গাড়ি—ওয়ানডারার। স্টুডিবেকার গাড়িটা আমার মায়ের নামে রেজিস্ট্রি করা ছিল আর ওয়ানডারারটা ছিল আমার নামে। ছোটাবেলা থেকেই গাড়ি সম্বন্ধে আমার দুর্বলতার কথা বাবা জানতেন। একটা গাড়ি আমার নামে থাকার হয়ত সেটা একটা কারণ। যদিও ছোট ওয়ানডারার গাড়িটা আমি বেশী ব্যবহার করতাম, বাবা কিন্তু আমাকে দুটো গাড়িই ইচ্ছামত ব্যবহার করতে দিতেন। আমি গাড়ি চালিয়ে যথেষ্ট ঘুরে বেড়াতাম, অবশ্য বাবার সুবিধা-অসুবিধা বুঝে। গাড়ি চালানোর দিক থেকে বলতে গেলে দুটো গাড়িতেই আমার সমান দখল ছিল। প্রথম দিকে আমরা স্টুডিবেকার গাড়িটা নেওয়া ঠিক করেছিলাম; কারণ, ও গাড়িটা সহজে খারাপ হয় না আর স্পীডেও যায়। পরে অন্যান্য কতকগুলি কারণে ওয়ানডারার গাড়িটাই বেছে নেওয়া হল। প্রথমত, বাবা যখন কলকাতায় রয়েছেন, তখন স্টুডিবেকার গাড়িটা নিয়ে আমার দু’দিনের জন্য উধাও হয়ে যাওয়াটাই কেমন যেন দেখাবে। তা ছাড়া গাড়িটার একটা বেশ সম্ভ্রান্ত চেহারা, আর বাবার গাড়ি হিসাবে চারিদিকে পরিচিত। অন্যদিকে ওয়ানডারার গাড়িটা আমারই নামে রয়েছে; আমি যদি ক’দিন গাড়িটি চালিয়ে এদিক-সেদিক যাই, কেউ কিছু ভাববে না। যে মুহূর্তে ঠিক হল ওয়ানডারার গাড়িটাই যাবে, অমনি আমি লেগে পড়লাম গাড়ির এঞ্জিন ও সব কিছু পার্ট চেক-আপ করাতে। একটা বাড়তি টায়ার কিনলাম, নতুন ব্যাটারি লাগালাম, নিজের আত্ম-বিশ্বাস বাড়াবার জন্য একদিন গাড়ি চালিয়ে পার্ক সার্কাস এলাকার একটি নির্জন জায়গায় গিয়ে টায়ার বদল করা অভ্যাস করে নিলাম। ইতিমধ্যে স্টুডিবেকার গাড়িটি চড়ে আমাদের একদল আত্মীয়স্বজন ধানবাদের কাছে আমার দাদার বাড়িতে ছুটি কাটাতে চলে গেলেন।

আমার মনে হল দাদার ওখানে ধানবাদে একবার ঘুরে আসাটা প্রস্তুতি হিসাবে আমার খুব কাজে লাগবে। তাই এমনভাবে আমি ব্যবস্থা করলাম যাতে আমার মাকে কলকাতা ফিরিয়ে আনার জন্য আমাকে সেখানে ডেকে পাঠানো হয়। বোম্বাই থেকে আগত অতিথিরা জানুয়ারির প্রথমে ফিরে গেলেন। আমি তাদের সঙ্গেই ট্রেনে চেপে ধানবাদ পর্যন্ত চলে গেলাম। দিন দুয়েক দাদার ওখানে বারারিতে থাকার ফলে জায়গাটা ঘুরে-ফিরে দেখে নেবার ও মনে মনে কতকগুলি পথের নিশানা ঠিক করে নেবার বেশ অপূর্ব সুযোগ পেয়ে গেলাম। আমার পরবর্তী যাত্রায় এ সবই খুব কাজে লেগেছিল। তখনও পর্যন্ত অন্তর্ধান পর্বের খুঁটিনাটি প্ল্যানিং একেবারে ঠিক হয়ে যায়নি। কিন্তু মোটামুটি ঠিক হয়েছিল যে, আমি অন্ততঃ এক রাত্রি দাদার বারারির বাড়িতে বিশ্রাম নেব। তা ছাড়া আমি যেন কোন কাজে দাদার ওখানে গিয়েছি, এইভাবে ব্যাপারটা সাজালে বাড়িতে আমার অনুপস্থিতি কারুর মনে সন্দেহের উদ্রেক করবে না। রাঙা-কাকাবাবু আমাকে যেমন শিখিয়ে দিয়েছিলেন, সেইমত আমি দাদাকে বারারিতে শুধু বললাম—‘রাঙাকাকাবাবুর কোন কাজে আমাকে শীগগিরই এদিকে আসতে হবে, সে সময়ে আমি আবার আসব।’

আমাদের পারিবারিক যে দলটি স্টুডিবেকার গাড়ি করে কলকাতা ফিরছিল, আমি সেই দলের সঙ্গে সেই গাড়িতে উঠলাম। আমি বারারি থেকে ধানবাদ রাস্তাটি ও পরে কলকাতা পর্যন্ত গ্র্যাণ্ড ট্রাঙ্ক রোড খুব মনোযোগ দিয়ে দেখতে দেখতে এলাম। আর কয়েক দিনের মধ্যেই রাঙাকাকাবাবুকে নিয়ে এই পথেই আমাকে আসতে হবে।

আসানসোল ও বর্ধমানের মাঝখানে একটা বড় রকম যান্ত্রিক গোলযোগ হয়ে গাড়ি অচল হয়ে গেল। অবস্থা এমনি হল যে, কলকাতা থেকে একটা বিশেষ যন্ত্রাংশ না আনলে গাড়ি চলবে না। আমরা সেখানে গাড়ি রেখে রাস্তা থেকে একটা ঝরঝরে ট্যাক্সি চড়ে কলকাতা ফিরলাম। এই ঘটনা দেখে আমার তো হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে এল। আমি মনে মনে প্রার্থনা করতে লাগলাম, যখন সময় আসবে ওয়ানডারার গাড়ি যেন এরকম ব্যবহার না করে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *