মহানির্মাতা
থর গিয়েছিল উত্তরে, ট্রোলদের সথে যুদ্ধ করতো। থরের অনুপস্থিতিতে এসগার্ড ছিল অনেকটাই শান্তিপূর্ণ কিন্তু একইসাথে ছিল অরক্ষিতও। সময়টা শুরুর দিকের, এসির আর ভানিরদের মধ্যে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, দেবতারা তাদের দুনিয়া সাজাচ্ছে। এসগার্ড ছিল অরক্ষিত।
“আমরা সমসময় থরের ওপর নির্ভর করে থাকতে পারি না”, বলল ওডিন, “আমাদের সুরক্ষার প্রয়োজন। দানবরা আসবে। ট্রোলরাও আমাদের আক্রমণ করবে”।
“আপনি কী প্রস্তাব করছেন?” দেবতাদের প্রহরী হাইমডেল জানতে চাইল।
“একটা প্রাচীর”, বলল ওডিন “এটা এত উঁচু হবে যে, তুষার দানবদের আটকাবে। এতটা চওড়া হবে যে, সবচেয়ে শক্তিশালী ট্রোলও সেটাকে ভাঙতে পারবে না”।
“এরকম একটা প্রাচীর”, বলল লোকি, “এত উঁচু আর এত চওড়া করে বানাতে অনেক বছর সময় লেগে যাবে”।
ওডিন সম্মতিসূচক মাথা নাড়াল, “কিন্তু তারপরও”, সে বলল, “আমাদের একটা প্রাচীর বানানো দরকার”।
পরদিন এসগার্ডে এক আগন্তুক এলো। লোকটা ছিল অনেক লম্বা আর মিস্ত্রির পোশাক পরা। তার সাথে ছিল বিশাল বড় বাদামি রঙের একটা মদ্দা ঘোড়া।
‘লোকজন বলছিল, তোমাদের নাকি একটা প্রাচীর বানাতে হবে”, বলল আগন্তুক।
“হ্যাঁ, ঠিক তাই”, বলল ওডিন।
“আমি তোমাদের একটা প্রাচীর বানিয়ে দিতে পারি। সবচেয়ে লম্বা দানব ও সেটা টপকাতে পারবে না। প্রাচীরটা এত চওড়া হবে যে, সবচেয়ে শক্তিশালী ট্রোলও সেটা ভেঙে ঢুকতে পারবে না। পাথরের ওপর পাথর বসিয়ে এমন নিখুঁত প্রাচীর বানাব যে, একটা পিঁপড়াও এর মধ্য দিয়ে ঢুকার জন্য ফাঁক খুঁজে পাবে না। আমি তোমাদের এমন প্রাচীর বানিয়ে দেব, যেটা হাজার হাজার বছর টিকে থাকবে”।
“এমন একটা প্রাচীর বানাতে অনেক সময় লেগে যাবে”, বলল লোকি।
“মোটেই না”, বলল আগন্তুক, “আমি এটা তিন মৌসুমের মধ্যে বানাতে পারব। আগামীকাল শীতের প্রথম দিন। আমি প্রাচীর তৈরির জন্য এই শীত, গ্রীষ্মকাল ও তার পরের শীত পর্যন্ত সময় নেব”।
“তুমি যদি এটা বানাতে পারো” বলল ওডিন, “বিনিময়ে তুমি কী চাও?”
“এই কাজের বিনিময়ে আমি খুব কমই চাই”, লোকটা বলল, “শুধুমাত্র তিনটা জিনিস চাই। আমি সুন্দরী দেবী ফ্রেয়াকে বিয়ে করতে চাই”।
“এটা ক্ষুদ্র কোনো বিষয় নয়”, বলল ওডিন, “আর এ বিষয়ে ফ্রেয়ার নিজস্ব কোনো মত থাকলেও আমি অবাক হব না। অন্য দুটি জিনিস কী?”
আগন্তুক আত্মবিশ্বাসের হাসি হাসল। “যদি আমি তোমাদের প্রাচীর বানিয়ে দিতে পারি, আমি ফ্রেয়াকে বিয়ে করতে চাই। আমি দিনে কিরণ দেওয়া সূর্য আর রাতে জ্যোৎস্না দেওয়া চন্দ্রটি চাই। এই তিনটি জিনিস দেবতারা আমাকে দিতে হবে, যদি আমি প্রাচীরটি বানাতে পারি”।
দেবতারা সবাই ফ্রেয়ার দিকে তাকাল। সে কিছুই বলছিল না, কিন্তু তার ঠোঁট দুটো শক্ত করে পরস্পর আঁটা ছিল আর তার মুখ রাগে সাদা হয়ে গিয়েছিল। “বাইরে গিয়ে অপেক্ষা করো”, ওডিন আগন্তুককে বলল। লোকটা বাইরে বেরিয়ে গেল। বেরিয়ে যাওয়ার আগে জিজ্ঞেস করল, কোথায় সে তার ঘোড়ার খাবার আর পানি পেতে পারে। ঘোড়াটি নাম ছিল সেভদিলফারি, অর্থাৎ যে দুর্ভাগা যাত্রায় বেরিয়েছে।
ওডিন নিজের কপালে হাত বুলাল। সে দেবতাদের দিকে ফিরল।
“এখন কী করণীয়?”
দেবতারা সবাই সমস্বরে কথা বলতে শুরু করল।
“চুপ করো”, চিৎকার করে বলল ওডিন, “একজন একজন করে বলো”। সকল দেব-দেবীদের মতামত ছিল আর সবার মত ছিল একইরকম। ফ্রেয়া, সূর্য আর চন্দ্র খুবই মূল্যবান আর গুরুত্বপূর্ণ। প্রাচীর বানানোর বিনিময়ে একজন আগন্তুককে এগুলো দিয়ে দেওয়া মোটেই উচিত হবে না।
ফ্রেয়ার আরও অতিরিক্ত মতামত ছিল। তার মত ছিল লোকটাকে তার ধৃষ্টতার জন্য আচ্ছামত উত্তম-মধ্যম দিয়ে এসগার্ড থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হোক।
“সুতরাং”, বলল বিশ্বপিতা ওডিন, “আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, আমরা লোকটাকে না করে দেব”।
দরবার কক্ষের এক কোনা থেকে শুকনো কাশির শব্দ শোনা গেল। এমন কাশি সাধারণত কারো মনোযোগ আকর্ষণের জন্য দেওয়া হয়। দেবতারা ফিরে তাকাল কে কাশল দেখার জন্য। তারা দেখল লোকি মুখে হাসি নিয়ে একটা হাত তুলে দাঁড়িয়ে আছে, যেন সে কিছু বলতে চায়।
“আমার জানানো উচিত”, বলল লোকি, “তোমরা গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় মিস করে যাচ্ছ”।
দেবতাদের অনিষ্ট সৃষ্টিকারী লোকি, আমার মনে হয় না আমরা কোনো বিষয় বাদ দিয়ে গেছি”, কর্কশভাবে বলে ওঠেন ফ্রেয়া।
“তোমরা সবাই বিষয়টি উপেক্ষা করে যাচ্ছ”, বলল লোকি। “আগন্তুক যে প্রস্তাব করেছে, সেটা এক কথায় অসম্ভব। দুনিয়ায় এমন কোনো লোক নেই যে তিন মৌসুমে এমন উঁচু আর চওড়া প্রাচীর বানাতে পারে। এটা কোনো দেবতা বা দানবের পক্ষেই সম্ভব নয়, কোনো মানুষের পক্ষে তো নয়ই। আমি আমার গায়ের চামড়া বাজি ধরে বলতে পারি”।
লোকির কথায় দেবতারা সবাই মাথা ঝাঁকাল, তাদের লোকির কথায় সম্মত বলে মনে হলো। শুধু ফ্রেয়াকে রাগান্বিত দেখাল।
“তোমরা সবাই বোকা”, বলল ফ্রেয়া, “বিশেষ করে তুমি, লোকি। তুমি নিজেকে খুব চালাক ভাব, না?”
“মিস্ত্রী লোকটা যা বলেছে, সে হয়তো করে দেখাতে পারবে”, বলল লোকি, “অসম্ভব মনে হলেও সে পারবে। তাই আমি প্রস্তাব করছি আমরা লোকটার প্রস্তাবে রাজি হব, কিন্তু তাকে আমরা কঠিন শর্ত দেব। সে প্রাচীর একাই বানাবে, অন্য কারো সাহায্য নিতে পারবে না আর তিন মৌসুমের পরিবর্তে যে প্রাচীর বানানোর জন্য মাত্র এক মৌসুম সময় পাবে। যদি গ্রীষ্মের প্রথম দিনে প্রাচীর অসমাপ্ত থাকে, এবং সেটাই আসলে হবে- আমরা তাকে কিছুই দেব না”।
“প্রাচীর না বানানোর চেয়ে এই প্রস্তাব দিয়ে আমাদের কী সুবিধা হবে?”
লোকির ধৈর্যচ্যুতি হলেও সে চেহারায় প্রকাশ করল না। ‘দেবতারা সবাই কি বোকা?’ সে ব্যাখ্যা করে বুঝাতে শুরু করল, যেমন করে বয়স্ক একজন লোক বাচ্চা ছেলেমেয়েদের বুঝায়।
“মিস্ত্রি লোকটা প্রাচীর বানাতে শুরু করবে। সে সেটা সময়মতো শেষ করতে পারবে না। সে বোকার মতো ছয় মাস বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করবে। ছয় মাস পর আমরা তাকে তাড়িয়ে দেব- আমরা তাকে তার স্পর্ধার জন্য উত্তম-মধ্যমও দিতে পারি। তার পর তার বানানো ভিত্তির ওপর আমরা সামনের বছরগুলোতে প্রাচীরটা সম্পূর্ণ করে ফেলব। আমাদের ফ্রেয়াকে হারানোরই ভয় নেই, চন্দ্র আর সূর্যের কথা বাদই দিলাম”।
“এক মৌসুমে দেওয়াল বানাতে লোকটা কেন রাজি হবে?” যুদ্ধ দেবতা টীর জানতে চাইল।
“সে হয়তো রাজি হবে না”, বলল লোকি, “তবে তাকে বেশ অহংকারী মনে হয়েছে, এবং আমার মনে হচ্ছে, চ্যালেঞ্জটা সে ফেলতে পারবে না”।
সকল দেবতারা গর্জন করল, লোকির পিঠ চাপড়াল আর লোকিকে বলল যে, সে খুবই চালাক। এটা খুবই আনন্দের বিষয় যে, সে তাদের দলে আছে। এখন তারা বিনা পারিশ্রামিকে একটা দেওয়ালের ভিত্তি পেয়ে যাচ্ছে। তারা নিজেদের বুদ্ধিমত্তা আর দরকষাকষি দক্ষতার জন্য একে অপরকে অভিনন্দন জানাল।
ফ্রেয়া কিছুই বলল না। সে তার জ্যোতির্ময় কণ্ঠহারে হাত রাখল। অনেক আগে একদিন যখন সে গোসল করছিল, এই হারটিই লোকি সীল মাছের রূপ ধরে চুরি করেছিল, সেটি উদ্ধার করার জন্য হাইমডেলকে সীল মাছের বেশে লোকির সাথে যুদ্ধ করতে হয়েছিল। সে লোকিকে মোটেই বিশ্বাস করে না। কথাবার্তা যেদিকে গড়াল, সে বিষয়টিকে পাত্তা দিল না।
দেবতারা নির্মাতাকে দরবার হলে ডাকল। সে চতুর্দিকে দেবতাদের দিকে তাকাল। তারা খোশমেজাজে একে অপরকে খোঁচা দিচ্ছিল আর হাসাহাসি করছিল। শুধু ফ্রেয়া হাসছিল না।
“কী সিদ্ধান্ত হলো?”, জানতে চাইল নির্মাতা।
“তুমি তিন মৌসুম সময় চেয়েছিলে”, বলল লোকি, “আমরা তোমাকে এক মৌসুম সময় দেব, শুধুমাত্র এক মৌসুম। আগামীকাল শীতের প্রথম দিন। তুমি যদি গ্রীষ্মের প্রথম দিনের মধ্যে কাজ শেষ না করতে পারো, তুমি কিছুই পাবে না। কিন্তু তুমি যদি প্রাচীর বানানোর কাজ শেষ করতে পারো- তুমি যেমন উঁচু আর চওড়া করে বানানোর কথা বলেছ, তাহলে তুমি যা চেয়েছ সবই পাবে, চন্দ্র, সূর্য আর সুন্দরী ফ্রেয়া, তবে তুমি অন্য কারো কাছ থেকে কোনো সাহায্য নিতে পারবে না, কাজটা তোমাকে একা করতে হবে”।
আগন্তুক কয়েক মুহূর্ত কিছুই বলল না। সে দূরে তাকাল আর লোকির শর্তগুলো নিয়ে ভাবল। তারপর সে দেবতাদের দিকে তাকাল আর কাঁধ ঝাঁকাল।
“তোমার বলেছ, আমি অন্য কারো সাহায্য নিতে পারব না। আমি শুধু আমার ঘোড়া সেভদিলফারিকে দিয়ে পাথর টানাতে চাই, যে পাথর ব্যবহার করে দেওয়ালটি বানাব। আমার মনে হয় এটা কোনো অযৌক্তিক অনুরোধ নয়”।
“এটা অযৌক্তিক নয়”, ওডিন রাজি হলো। অন্য দেবতারাও সম্মতি দিল আর বলাবলি করল, ভারী পাথর টানার জন্য ঘোড়া খুবই ভালো কাজে দেয়।
তারা শপথ নিল, দৃঢ় শপথ। দেবতারা আর আগন্তুক তাদের অস্ত্রের শপথ নিল। শপথ নিল ওডিনের সোনালি বাহুবন্ধনী ড্রপনিরের আর ওডিনের বর্শা গাংনিরের, গাংনিরের ওপর শপথ নিলে সেটা আর ভাঙা যায় না। তারা শপথ নিল তারা শর্ত পালন করবে, একে অপরের সাথে প্রতারণা করবে না।
পরদিন সকালে যখন সূর্য উদিত হলো, দেবতারা লোকটির কাজ দেখার জন্য জড়ো হলো। লোকটি তার হাতের তালুতে থুতু লাগিয়ে প্রাচীরের ভিত্তির জন্য গর্ত খুঁড়তে শুরু করল।
“সে অনেক গভীর করে খুঁড়ছে,” বলল হাইমডেল।
“সে অনেক দ্রুত খুঁড়ছে,” ফ্রেয়ার ভাই ফ্রে বলল।
“অবশ্যই সে ভালো গর্ত আর পরিখা খুঁড়তে পারে,” অনিচ্ছাসত্ত্বেও বলল লোকি। “কিন্তু ভেবে দেখো তাকে পাহাড় থেকে কত কত পাথর এখানে টেনে আনতে হবে। পরিখা খনন করা এক জিনিস আর এত এত পাথর এত মাইল দূর থেকে কারো সাহায্য ছাড়া টেনে এনে একটার ওপর একটা নিখুঁতভাবে বসানো যেটার ভিতর দিয়ে পিঁপড়াও গলে যেতে পারবে না, সবচেয়ে লম্বা দানবের চেয়েও উঁচু হবে, এমন প্রাচীর বানিয়ে ফেলা সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়।”
ফ্রেয়া বিরক্তির সাথে লোকির দিকে তাকাল, কিন্তু কিছুই বলল না।
সূর্য ডুবে গেলে লোকটি তার ঘোড়ায় চড়ে পাথর আনতে পাহাড়ের দিকে রওনা হয়ে গেল। ঘোড়ার পিছনে নরম মাটিতে টেনে নেওয়ার উপযোগী একটা নিচু স্লেড আটকানো ছিল। দেবতারা তাদের চলে যেতে দেখল। শীতের আকাশের চাঁদ তখন মাথার ওপর জ্যোৎস্না ছড়াচ্ছিল।
“সে এক সপ্তাহের মধ্যে ফিরে আসবে,” বলল লোকি। “দেখা যাক ঘোড়াটা একবারে কত পাথর টেনে আনতে পারে। এটাকে যথেষ্ট শক্তিশালী মনে হচ্ছে।” দেবতারা তাদের ভোজ কক্ষে গমন করল। সেখানে প্রচুর হাসিঠাট্টা হলো, কিন্তু ফ্ৰেয়া মোটেই সেসবে যোগ দিল না।
সকালের পূর্বে তুষারপাত হলো, তুষারের হালকা চাদরে চতুর্দিক ঢেকে গেল, শীত বাড়ার সাথে সাথে আরো ভারী তুষারপাত হবে, এটা তারই অগ্রিম বার্তা।
দেবতাদের প্রহরী হাইমডেল, এসগার্ডে কে আসে আর কে যায় সব দেখে আর নজরে রাখে, তার চোখে কোনোকিছুই এড়ায় না। সেই হাইমডেল অন্ধকার থাকতেই দেবতাদের ডেকে তুলল। আগের দিন আগন্তুকের খোঁড়া পরিখার কাছে সবাই গিয়ে জড়ো হলো। ভোরের আবছা আলোয় তারা দেখল নির্মাতা লোকটা তার ঘোড়াটিকে সাথে নিয়ে তাদের দিকে হেঁটে আসছে। ভালো ঘোড়াটি সাবলীলভাবে অনেকগুলো গ্রানাইট পাথরের খণ্ড টেনে নিয়ে আসছে। পাথরগুলো এতই ভারী যে, স্লেডটি মাটিতে গভীর দাগের সৃষ্টি করেছে।
লোকটি যখন দেবতাদের দেখতে পেল, সে তার হাত নেড়ে আনন্দিতভাবে সুপ্রভাত জানাল। সে উদীয়মান সূর্যের দিকে ইশারা করল আর দেবতাদের উদ্দেশে চোখ টিপল। সে স্লেড থেকে ঘোড়াটাকে ছুটিয়ে নিল আর তাকে ঘাস খাওয়ার জন্য ছেড়ে দিল। তারপর সে আগের দিন খুঁড়ে রাখা পরিখায় পাথরের খণ্ডগুলো অনায়াস দক্ষতায় বসাতে শুরু করল।
“ঘোড়াটা আসলেই খুব শক্তিশালী,” সবচেয়ে সুন্দর দেবতা বান্ডার বলল। “কোনো সাধারণ ঘোড়া এত ভারী পাথর টানতে পারার কথা নয়।”
এতটা শক্তিশালী ঘোড়ার কথা আমরা কল্পনাই করিনি,” বলল জ্ঞানী দেবতা ভাসির।
“আহ,” বলল লোকি, “ঘোড়াটা দ্রুতই ক্লান্ত হয়ে পড়বে। এটা তার প্রথম দিন। এটা প্রতিরাতে এত পাথর টানতে পারবে না। আর শীত আসছে। ভারী তুষার পড়বে, তুষারঝড়ে চতুর্দিক অন্ধকার হয়ে আসবে, পাহাড়ে যাতায়াত অনেক কঠিন হয়ে যাবে। চিন্তার কিছু নেই। সবই আমাদের পরিকল্পনামাফিক হবে।”
“আমি তোমাকে ঘৃণা করি,” শক্ত মুখ করে লোকির পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ফ্রেয়া বলল। সে ভোর হতেই এসগার্ডে ফিরে গেল, অন্যদের মতো প্রাচীরের ভিত্তি তৈরি হওয়া দেখার জন্য অপেক্ষা করল না।
প্রতি রাতে নির্মাতা আর তার ঘোড়া খালি স্লেড নিয়ে পাহাড়ের উদ্দেশে বেরিয়ে যেত। প্রতিদিন সকালে তারা ফিরে আসত, ঘোড়াটি প্রতিদিনই বিশটি করে গ্রানাইটের খণ্ড টেনে নিয়ে আসত, যার প্রতিটি খণ্ডের আকার ছিল সবচেয়ে লম্বা মানুষের চেয়েও বড়।
প্রতিদিন প্রাচীর উঠতে লাগল, প্রতিদিন বিকেলে সেটি পূর্বের দিনের চেয়ে আরো বৃহৎ হয়ে উঠতে লাগল।
ওডিন দেবতাদের ডেকে পাঠাল।
“প্রাচীরটি দ্রুত তৈরি হয়ে যাচ্ছে,” বলল সে। “আর আমরা একটি অলঙ্ঘনীয় শপথ, বাহুবন্ধনীর শপথ আর অস্ত্রের শপথ করেছি যে, যদি সে সময়মত প্রাচীর তৈরি করতে পারে, আমরা তাকে চন্দ্র আর সূর্য দেব আর সুন্দরী ফ্রেয়ার সাথে বিয়ে দেব।”
জ্ঞানী ভাসির বলল, “নির্মাতা লোকটি যে কাজ করছে, কোনো মানুষের পক্ষে তা করা সম্ভব নয়। আমার সন্দেহ হয়, সে কোনো মানুষ নয়।”
“একটা দানব সম্ভবত,” বলল ওডিন।
“যদি থর এখানে থাকত!”, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বান্ডার বলল।
“থর উত্তরে ট্রোলদের সাথে যুদ্ধ করছে,” বলল ওডিন। “সে যদি ফিরেও আসে, আমাদের শপথ অলঙ্ঘনীয়।”
লোকি তাদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করল। “আমরা সবাই বৃদ্ধ মহিলাদের মতো অকারণে উদ্বিগ্ন হচ্ছি। সে যদি সবচেয়ে শক্তিশালী দানবও হয়, লোকটা গ্রীষ্মের প্রথম দিনের আগে প্রাচীরের কাজ শেষ করতে পারবে না। এটা একেবারেই অসম্ভব।”
“থর যদি এখন থাকত,” বলল হাইমডেল, “কী করতে হবে, সে হয়তো বলতে পারত।”
তুষার পড়া শুরু হয়ে গেল, কিন্তু ভারী তুষারও প্রাচীর নির্মাতাকে থামাতে পারল না, পারল না সাভদিলফারির গতিও কমাতে। বাদামি মদ্দা ঘোড়াটি ভারী তুষার আর তুষার ঝড়ের ভিতর দিয়ে, উঁচু-নিচু পাহাড়ি রাস্তা আর সরু গিরিসংকটের মধ্য দিয়ে বড় বড় পাথরভরা স্লেড টেনে নিয়ে যেতে থাকল।
দিন বড় হতে থাকল। প্রতিদিন অনেক পূর্বেই সকাল হতে লাগল। বরফ গলতে শুরু করল, বরফগলা জলে ভারী কাদা জল তৈরি হলো, যেটা জুতোতে আটকে থাকে আর চলাচলের সময় পা আঁকড়ে থেকে চলার গতি কমিয়ে দেয়।
“ঘোড়াটা এই কাদার মধ্য দিয়ে পাথর টানতে পারবে না,” বলল লোকি। পাথর কাদাপানিতে ডুবে যাবে আর ঘোড়ার পা কাদায় আটকে যাবে।”
কিন্তু সভদেলফারিকে ভারী কাদাজল আটকাতে পারল না, সে একইভাবে পাথর টেনে এসগার্ডে আনতে লাগল, যদিও পাথরের স্লেড এত ভারী ছিল যে, সেটি পাহাড়ের পাদদেশে গভীর দাগ সৃষ্টি করেছিল। এখন নির্মাতা লোকটিকে শত শত ফুট ওপরে পাথর উঠাতে হচ্ছিল, আর সে অনায়াসে সেগুলো একটার ওপর একটা বসিয়ে প্রাচীর বানিয়ে যাচ্ছিল।
কাদা শুকিয়ে গেল, আর বসন্তের ফুল ফুটতে শুরু করল, আর এসগার্ডের চারদিকে উঠতে লাগল সুবৃহৎ এক প্রাচীর। এটি তৈরি সম্পন্ন হলে এটি হবে অলঙ্ঘনীয়, কোনো দানব, ট্রোল, বামন বা মানুষ এটা পেরিয়ে এসগার্ডে ঢুকতে পারবে না। আর আগন্তুক লোকটি একতালে প্রাচীর বানিয়ে যাচ্ছিল। বৃষ্টি হোক কিংবা তুষারপাত, লোকটি আর তার ঘোড়া কোনোকিছুই কেয়ার করছিল না। প্রতিদিন সকালে তারা পাহাড় থেকে পাথর টেনে আনত, প্রতিদিন নির্মাতা লোকটা পূর্বের দিনের কাজের ওপর গ্রানাইটের খণ্ড বসিয়ে প্রাচীরটি আরো উঁচু করত।
আর এখন শীতের শেষ দিন এসে গেছে, প্রাচীরের কাজ প্রায় শেষ।
এসগার্ডে দেবতারা তাদের সিংহাসনে বসেছে, তারা নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছে।
“সূর্যটা”, বলল বান্ডার, “আমরা সূর্যটা দিয়ে দিলাম!”
“রাত-দিন আর সপ্তাহ হিসাব করার জন্য আকাশে আমরা চন্দ্রকে স্থাপন করেছিলাম,” কাব্যের দেবতা ব্রাগি বলল হতাশভাবে, “আমরা আর চাঁদের দেখা পাব না।”
“আর ফ্রেয়া, ফ্রেয়াকে ছাড়া আমাদের কীভাবে চলবে?”, জানতে চাইল টীর।
“নির্মাতা লোকটি যদি আসলেই একটা দানব হয়,” বরফশীতল কণ্ঠে বলল ফ্রেয়া, “তাহলে আমি তাকে বিয়ে করব আর তার সাথে যতুনহাইমে চলে যাব। মজার বিষয় হলো, আমি কাকে বেশি ঘৃণা করব, দানবটিকে- যে আমাকে নিয়ে যাবে, নাকি তোমাদের সবাইকে- যারা আমাকে তার হাতে তুলে দেবে?”
“এভাবে বলো না”, লোকি কথা বলতে শুরু করল, কিন্তু ফ্রেয়া তাকে কথা না বলতে দিয়ে বলে উঠল, “যদি দানবটি আমাকে নিয়ে যায়, চন্দ্র আর সূর্য নিয়ে যায়, আমি এসগার্ডের দেবতাদের কাছ থেকে শুধু একটি জিনিস চাই।”
“কী চাও তুমি,” জানতে চাইল বিশ্বপিতা ওডিন, যে এতক্ষণ একটা কথাও বলেনি।
“যে এই দুর্যোগের জন্য দায়ী আমি যাওয়ার আগেই তার মৃত্যুদণ্ড দেখতে চাই,”, বলল ফ্রেয়া, “আমার মনে হয়, এতে উচিত বিচার হবে। যদি আমাকে তুষার দানবদের রাজ্যে যেতে হয়, আকাশ থেকে চন্দ্র আর সূর্যকে খুলে নেওয়া হয় আর পৃথিবী অনন্ত আঁধারে ঢাকা পড়ে, যে আমাদের এই অবস্থায় দাঁড় করিয়েছে, জীবন দিয়ে তাকে এর দায় চুকাতে হবে।”
“আহ”, বলে উঠল লোকি, “দায়ী ব্যক্তিকে খুঁজে বের করাটা খুবই কঠিন হবে। আমার যদ্দুর মনে পড়ে, সকল দেবতারাই এই দুর্ভাগ্যজনক ভুলের জন্য দায়ী। সবাই মিলেই বিষয়টি প্রস্তাব করেছিল, আর সবাই তাতে রাজি হয়েছিল
“তুমি এটা প্রস্তাব করেছিলে,” বলল ফ্রেয়া। “তুমি এই বেকুবদের কথার জালে ফাঁসিয়েছ। আমি এসগার্ড ত্যাগ করার পূর্বেই তোমাকে মৃত দেখতে চাই।”
“আমরা সবাই—”, বলতে শুরু করল লোকি, কিন্তু দেবতাদের সবার চেহারার ভাব দেখে সে চুপ মেরে গেল।
“লাউফির পুত্র লোকি”, বলল ওডিন, “এটা তোমার কু-পরামর্শের ফল”।
“এটা তোমার অন্য পরামর্শের মতোই খারাপ ছিল,” বলল বান্ডার। লোকি তার দিকে একটা ক্রুদ্ধ দৃষ্টি হানল।
“আমরা চাই, নির্মাতা লোকটা তার বাজিতে হেরে যাক”, বলল ওডিন, “শর্ত ভঙ্গ করা ছাড়াই। তাকে অবশ্যই ব্যর্থ হতে হবে।”
“আমি বুঝতে পারছি না, আপনি আমার কাছে কী আশা করেন,” বলল লোকি।
“আমি তোমার কাছে কিছু আশা করি না,” বলল ওডিন, “কিন্তু যদি নির্মাতা কাল বিকালের মধ্যে প্রাচীরের নির্মাণকাজ শেষ করতে সক্ষম হয়, তোমার মৃত্যু খুবই দীর্ঘ আর যন্ত্রণাদায়ক, খারাপ আর লজ্জাস্কর হবে।”
লোকি একে একে সকল দেবতাদের দিকে তাকাল, তাদের চেহারায় সে শুধু রাগ, ঘৃণা আর মৃত্যু দেখতে পেল। সে কোনো দয়া বা ক্ষমার লেশমাত্র দেখতে পেল না।
এটা আসলেই খুব খারাপ মৃত্যু হবে। কিন্তু এখন বিকল্প কী? সে কী করতে পারে? সে নির্মাতাকে আক্রমণ করতে পারে না। পরিবর্তে-
লোকি মাথা ঝাঁকাল। “এটা আমার ওপর ছেড়ে দিন।”
লোকি হল ছেড়ে বেরিয়ে গেল, কোনো দেবতাই তাকে থামানোর কোনো চেষ্টা করল না।
নির্মাতা প্রাচীরে পাথর বসানোর কাজ আজকের মতো শেষ করল। আগামীকাল, গ্রীষ্মের প্রথম দিনে, যখন সূর্য অস্ত যেতে থাকবে, সে তার প্রাচীর নির্মাণকাজ শেষ করবে এবং তার পারিশ্রামিক নিয়ে এসগার্ড ত্যাগ করবে। আর মাত্র বিশ খণ্ড পাথর বসানো বাকি। সে তার উঁচু কাঠের মাঁচা থেকে নামল আর শিস বাজিয়ে তার ঘোড়াটিকে ডাকল। সভদিলফারি বরাবরের মতোই প্রাচীর থেকে আধা মাইল দূরে বনের ধারে লম্বা ঘাসের তৃণভূমিতে ঘাস খাচ্ছিল। কিন্তু সে বরাবরই মালিকের শিস শুনে প্রাচীরের কাছে ফেরত আসত।
নির্মাতা তার পাথর টানা কাঠের স্লেডের দড়িটি ধরল আর সেটি ঘোড়ায় আটকানোর জন্য গিঁট পাকিয়ে তৈরি করল। সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে গেছে, কিন্তু সেটা আগামী কয়েক ঘণ্টায় অস্ত যাবে না, আকাশের উঁচুতে স্বর্গের কাছে বাঁকা চাঁদটাকে ধূসর দেখালেও ছিল স্বমহিমায় বর্তমান। শীঘ্রই এই দুটোই তার হবে, আর ফ্রেয়া, যে সূর্য আর চন্দ্রের চেয়েও সুন্দর। জয়ের ফলাফল তার হাতে আসার আগে নির্মাতা সেগুলো নিয়ে ব্যস্ত হতে রাজি নয়। সে অনেকগুলো দিন- সমগ্র শীতকাল কঠোর পরিশ্রম করেছে।
সে তার ঘোড়ার জন্য আবার শিস বাজাল। ব্যাপারটা অস্বাভাবিক, তাকে কখনোই দুবার শিস বাজাতে হয় না। সে এবার সভদেলফারিকে দেখতে পেল, তৃণভূমির বন্যফুলের মাঝে দাঁড়িয়ে মাথা ঝাঁকাতে, এক পা এগোয় তো এক পা পিছিয়ে যায়, যেন সে বসন্তের উষ্ণ বাতাসে মনোমুগ্ধকর কিছুর ঘ্রাণ পেয়েছে। “সভদিলফারি”, নির্মাতা ডাক দিল, আর ঘোড়াটি কান খাড়া করল আর তৃণভূমির মধ্য দিয়ে প্রাচীর পানে দ্রুতগতিতে ধাবিত হলো।
নির্মাতা ঘোড়াটিকে তার দিকে ছুটে আসতে দেখে সন্তুষ্ট হলো। তৃণভূমিতে ঘোড়ার খুরের শব্দ ধ্বনিত হচ্ছিল, সেই শব্দ উঁচু গ্রানাইটের দেওয়ালে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। একসময় নির্মাতার কাছে মনে হচ্ছিল, একপাল ঘোড়া বুঝি তার দিকে ছুটে আসছে।
না, একপাল ঘোড়া নয়, শুধু একটাই ঘোড়া, ভাবল নির্মাতা।
সে তার মাথা নাড়ল আর তার ভুল বুঝতে পারল। একটা ঘোড়া তো নয়! একটা ঘোড়ার খুরের শব্দ নয়, দুইটা ঘোড়ার শব্দ…….।
দ্বিতীয় ঘোড়াটি ছিল একটা পিঙ্গলবর্ণের মাদি ঘোড়া। নির্মাতা একনজর দেখেই বুঝল, সেটা একটা মাদি ঘোড়া। সভদেলফেয়ারি চরকির মতো ঘুরল আর তৃণভূমির ভিতর দিয়ে ছুটে গেল, গতি কমাল আর উচ্চস্বরে ডেকে উঠল।
পিঙ্গলবর্ণের মাদি ঘোড়াটা তাকে পাত্তাই দিল না। সে দৌড়ানো বন্ধ করল, যেন সে মদ্দা ঘোড়াটাকে দেখতেই পায়নি, সে মাথা নিচু করে ঘাস খাওয়ার ভান করল, কিন্তু সভদেলফারি তার ৮-১০ গজের কাছে যেতেই সে দৌড়াতে শুরু করল, প্রথমে আস্তে আস্তে, ক্রমেই দ্রুতগতিতে। বাদামি মদ্দা ঘোড়াটি তার পিছন পিছন ধাবিত হলো, দৌড়ে মাদি ঘোড়াটিকে ধরার চেষ্টা করতে লাগল, প্রায়ই খুব কাছে পৌঁছে যাচ্ছিল, আবার পিছনে পড়ে যাচ্ছিল।
গোধূলির সোনালি আলোয় ধূসর আর বাদামি রঙের ঘোড়া দুটো তৃণভূমিতে ছুটে বেড়াতে লাগল, যেন নৃত্যরত একটা জুটি নেচে চলেছে।
নির্মাতা জোরে তালি বাজাল, শিস দিল, সভদেলফেয়ারির নাম ধরে বারবার ডাকল, কিন্তু মদ্দা ঘোড়াটি তার দিকে ফিরেও তাকাল না।
ঘোড়াটিকে ধরার জন্য নির্মাতা তৃণভূমিতে দৌড়ে গেল, কিন্তু পিঙ্গলবর্ণের ঘোড়াটি যেন জানত তাকে কী করতে হবে। সে মদ্দা ঘোড়াটির মাথার পাশে তার কান আর নাক ঘষল, আর বনের দিকে দিকে দ্রুতগতিতে ছুটতে শুরু করল, এত দ্রুতগতিতে ছুটছিল, যেন তার পিছনে নেকড়ে আক্রমণ করেছে। সভদেলফারি তার পিছন পিছন ছুটল আর মুহূর্তের মধ্যে তারা বনের ছায়ায় অদৃশ্য হয়ে গেল।
নির্মাতা ঘোড়াটিকে অভিশাপ দিল আর ঘোড়াটির ফিরে আসার অপেক্ষা করল। ছায়ারা ক্রমে দীর্ঘায়িত হলো কিন্তু সভদেলফারি ফিরে এলো না।
নির্মাতা তার পাথর টানা স্লেডের কাছে ফিরে এলো। সে বনের দিকে তাকাল। হাতে থুথু ফেলে স্লেডের দড়ি তুলে নিল আর ঘাসের তৃণভূমি আর বসন্তের ফুলের রাজ্য পেরিয়ে পাহাড়ের খনির দিকে রওনা হয়ে গেল।
সে ভোরের মধ্যে ফিরে এলো না। নির্মাতা যখন পাথরের স্লেড নিয়ে এসগার্ডে ফিরে এলো, তখন সূর্য অনেক উপরে উঠে গেছে।
তার স্লেডে ছিল মাত্র দশটি পাথরের খণ্ড, এই কয়টি খণ্ডই সে কেটে টেনে আনতে সক্ষম হয়েছে, সে ভারী পাথরগুলোকে গালাগাল দিচ্ছিল আর পাথর টানা স্লেডটাকে টেনেহিঁচড়ে প্রাচীরের কাছে নিয়ে আসছিল।
তোরণের কাছে দাঁড়িয়ে সুন্দরী ফ্রেয়া তাকে দেখছিল।
তোমার কাছে মাত্র দশটি পাথর খণ্ড আছে”, ফ্রেয়া তাকে বলল, “দেওয়ালের কাজ শেষ করার জন্য তোমার এর দ্বিগুণ পাথর খণ্ড দরকার।”
নির্মাতা কিছুই বলল না। সে শক্ত মুখে তার পাথরগুলো টেনে অসমাপ্ত তোরণের কাছে আনল। তার চেহারায় হাসির লেশমাত্র ছিল না।
“থর ফিরে আসছে”, ফ্রেয়া বলল তাকে, “সে শীঘ্রই আমাদের সাথে যোগ দেবে।”
এসগার্ডের দেবতারা নির্মাতাকে পাথর নিয়ে আসতে দেখে এগিয়ে এলো। তারা রক্ষাব্যূহের মতো ফ্রেয়াকে ঘিরে দাড়াল।
তারা প্রথমে নিঃশব্দে দেখল, তারপর তাদের চেহারায় হাসি ফুটল, তারা উচ্চস্বরে হাসতে শুরু করল।
“হেই”, চিৎকার করল বান্ডার, “তুমি সূর্যটা পাবে যদি তুমি প্রাচীরটা শেষ করতে পারো। তোমার কী মনে হয়, তুমি সূর্যটা সাথে নিয়ে যেতে পারবে?”
“এবং চন্দ্রটা”, বলল ব্রাগি, “দুঃখের বিষয় হলো, তোমার ঘোড়াটা তোমার সাথে নেই। সে থাকলে তোমার সবগুলো পাথর টেনে আনতে পারত।”
দেবতারা সবাই উচ্চস্বরে হাসতে লাগল।
নির্মাতা তার স্লেডের দড়ি ছেড়ে দিয়ে দেবতাদের দিকে ফিরল। “তোমরা প্রতারণা করেছ!” বলল সে। তার মুখ রাগে কালো হয়ে গিয়েছিল।
“আমরা প্রতারণা করিনি,” বলল ওডিন। “তোমার চেয়ে বেশি নয়। তুমি কি মনে করো তুমি একটা দানব এটা জানার পর আমরা তোমাকে প্রাচীর বানাতে দিতাম?”
নির্মাতা এক হাতে একটা গ্রানাইটের খণ্ড তুলে নিয়ে আরেক হাত দিয়ে আঘাত করে সেটা দুই টুকরা করল। সে দুই হাতে দুই খণ্ড পাথর নিয়ে দেবতাদের দিকে ঘুরল। সে ক্রমে লম্বা হতে লাগল, লম্বা হতে হতে পঞ্চাশ ফুট ছাড়িয়ে গেল। তার চেহারা দুমড়ে গেল, তাকে আর এক মৌসুম আগে আসা শান্ত আর স্থিরচিত্তের আগন্তুকের মতো লাগছিল না। তার চেহারা রাগে ঘৃণায় মিশ্রিত পাথুরে গ্রানাইট মূর্তির মতো লাগছিল।
“আমি পাহাড়ি দানব,” বলল সে। “আর তোমরা দেবতারা সব প্রতারক আর নোংরা শপথ ভঙ্গকারী। যদি আমার ঘোড়াটা থাকত, আমি প্রাচীরের কাজ শেষ করে ফেলতে পারতাম। সুন্দরী ফ্রেয়া, চাঁদ আর সূর্যকে আমার পারিশ্রামিক হিসেবে নিয়ে যেতে পারতাম। আমি তোমাদের অনন্ত অন্ধকার আর ঠান্ডায় রেখে যেতাম।”
“কোনো শপথ ভঙ্গ করা হয়নি,” বলল ওডিন। “কিন্তু কোনো শপথই এবার তোমাকে আমাদের হাত থেকে রক্ষা করতে পারবে না।”
পাহাড়ি দানব রাগে গর্জন করে উঠল, আর দুই হাতে দুই পাথর খণ্ড নিয়ে দেবতাদের দিকে ধেয়ে এলো।
দেবতারা দুপাশে সরে গেল, শুধুমাত্র তখনই দানবটা দেখতে পেল তাদের পিছনে কে দাঁড়িয়ে আছে বর্ম পরা বিশালাকৃতির লাল দাড়ির এক দেবতা, হাতে একটা লোহার হাতুড়ি। সে হাতুড়িটা একবার মাত্র ঘুরাল, সেটা দানবের দিকে তাক হতেই হাত থেকে ছেড়ে দিল।
থরের হাত থেকে হাতুড়িটি ছুটি যেতেই আকাশে বিজলি চমকে উঠল আর বজ্রপাতের শব্দ হলো।
পাহাড়ি দানব তার দিকে হাতুড়িটি ছুটে আসতে দেখল, সেটি যতই কাছে আসছিল ততই বৃহৎ হচ্ছিল। হাতুড়ির আঘাতে দানবের ভবলীলা সাঙ্গ হলো।
দেবতারা তারপর নিজেরা প্রাচীরের বাকি কাজ শেষ করল। যদিও পাহাড়ের উঁচু খনি হতে পাথর কেটে সেগুলোকে টেনে এসগার্ডে এনে তোরণের ওপর সঠিক স্থানে বসাতে তাদের আরো অনেক সপ্তাহ লেগে গিয়েছিল। মহানির্মাতার কাটা আর বসানো পাথরের মতো সেগুলো এতটা নিখুঁতভাবে কাটা বা বসানো ছিল না। অনেক দেবতার মত ছিল দানবটাকে থর মেরে ফেলার আগে তাকে দিয়ে প্রাচীরের আরো কিছু কাজ করিয়ে নেওয়া যেত। পূর্বদিক থেকে ফিরে আসার পর মজাদার একটা কাজ তার জন্য তৈরি রাখার জন্য থর দেবতাদের প্রশংসা করল।
আশ্চর্যজনকভাবে, সভদেলফারিকে প্রলুব্ধ করে সরিয়ে নেওয়ার জন্য প্রশংসার বন্যায় ভাসার জন্য লোকিকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। সে কোথায় আছে, কেউ জানত না। যদিও এসগার্ডের তৃণভূমিতে চরে বেড়ানো একটা চমৎকার পিঙ্গলবর্ণের মাদি ঘোড়ার কথা লোকমুখে প্রায়ই শোনা যেত। বছরের একটা বড় সময় লোকি নিরুদ্দেশ থাকল, তারপর হঠাৎই একদিন উদয় হলো, একটা ধূসর অশ্বশাবক সাথে নিয়ে।
এটা ছিল একটা খুবই সুন্দর অশ্বশাবক কিন্তু তার চার পায়ের পরিবর্তে আটটি পা ছিল। অশ্বশাবকটি লোকি যেখানে যেত, তার পিছন পিছন যেত, তার গায়ে নাক ঘষত আর এমন আচরণ করত যেন লোকি তার মা।
অশ্বশাবকটি বড় হয়ে ‘স্লিপনির নামে এক বিশাল ধূসর মদ্দা ঘোড়ায় পরিণত হয়, সবচেয়ে শক্তিশালী আর সবচেয়ে দ্রুতগামী, এত দ্রুতগামী আর শক্তিশালী অশ্ব কেউ কখনো দেখেনি, যে বাতাসের চেয়েও দ্রুত ছুটতে পারত।
মানুষ আর দেবতাদের দুনিয়ার সবচেয়ে ভালো ঘোড়া স্লিপনিরকে লোকি ওডিনকে উপহারস্বরূপ প্রদান করে।
অনেকেই ওডিনের ঘোড়ার প্রশংসা করে কিন্তু খুব কম লোকই লোকির উপস্থিতিতে ঘোড়াটির জন্মবৃত্তান্ত নিয়ে কথা বলার সাহস রাখে। লোকি কীভাবে সভদেলফেয়ারিকে প্রলুব্ধ করে তার মালিকের কাছ থেকে সরিয়ে নিয়েছিল আর তার নিজের মন্দ পরামর্শের প্রভাব থেকে দেবতাদের রক্ষা করেছিল, এই বিষয়ে তোমাকে কোনো কথা বলতে শুনলে লোকি তোমার জীবনে অশান্তি সৃষ্টি করতেও পিছপা হবে না। লোকি কিন্তু তার অসন্তোষ পুষে রাখে।
এবং এই ছিল দেবতাদের প্রাচীর তৈরি হওয়ার গল্প।