মহাদেবী : দুর্গা ও কালীর উত্থান
মানচিত্রের দিকে তাকালে দেখা যায় উপমহাদেশের পশ্চিমাঞ্চলের সিন্ধু ও বেলুচিস্থানে শিবকে দিয়ে হিন্দুর যাত্রা শুরু এবং পূর্বাঞ্চলে দুর্গা ও কালীকে দিয়ে তার শেষ। পূর্বাঞ্চল অর্থাৎ আসাম, ত্রিপুরা, বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে দুর্গা ও কালী হচ্ছেন বাঙালি হিন্দুর মহাদেবী। যেমন হিন্দুর কাছে শিব ‘মহাদেব’। ‘মহাদেবীর’ দুই রূপের মধ্যে দুর্গারূপ আজ বাঙালির দুর্গোৎসব। বাৎসরিক দুর্গাপূজা উপলক্ষে তাই তার সীমাহীন আনন্দ। একটু লক্ষ করলেই বোঝা যায় দুর্গা পূজায় পূজিত হন দুর্গার পরিবার। মনে হয় এ যেন বাঙালি হিন্দুর পারিবারিক একটি ছবি। এ ছবিতে হিন্দুর ঐক্যেরও একটা আভাস পাওয়া যায়। কারণ দুর্গার সাথে পূজিত তাঁর পুত্র-কন্যা গণেশ, কার্তিক, লক্ষ্মী ও সরস্বতী উপমহাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম ও উত্তরাঞ্চলের প্রধান প্রধান দেব-দেবী। সবার ওপরে রয়েছেন সর্বভারতীয় মহাদেব। সব মিলে মহাদেবের পরিবার এবং বাঙালির পরিবার মিলে মিশে একাকার।
অপরদিকে মন্দিরে মন্দিরে মহাদেবী কালী পূজিতা হন প্রতিদিন। অধিকন্তু বছরে একবার জাঁকজমকের সাথে কালী পূজিতা হন এককভাবে। সঙ্গে থাকেন স্বয়ম্ভু মহাদেব। দু’য়ের তুলনা করলে বলা যায় একটি যদি হয় বাঙালি পরিবারের ছবি, অন্যটি তাহলে তার মনের ছবি। একটি যদি হয় শুক্লপক্ষের করণীয় তাহলে অন্যটি কৃষ্ণপক্ষের। আবার দুর্গা যদি হন উৎসবের দেবী, কালী হচ্ছেন সাধনার দেবী। উৎসবে প্রয়োজন হয় সকলের সাহায্য ও সহযোগিতা। তাই দুর্গা পূজায় যেমন লাগে পুরোহিত তেমনি লাগে কুমার, নট্ট, মালাকার, ভুঁইমালী, ধোপা ও নাপিতসহ নানা শ্রেণির লোকের সহযোগিতা। অপরদিকে সাধনা নিত্য-দিনের ব্যাপার। কৃষকের সাধনায় দরকার নিষ্ঠা, একাগ্রতা ও ধৈর্য্য। কারণ কৃষকের জীবন একটি অনিশ্চিত জীবন। বন্যা, খরা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ কেড়ে নিতে পারে তার ফসল। তাই বীজ লাগানোর পর আরম্ভ হয় তার অপেক্ষার পালা। ধৈর্য্যের চরম পরীক্ষা! এই ধৈর্য্যের লক্ষ্য শক্তি। শক্তি বাঁচার জন্য, আত্মরক্ষার জন্য এবং ঈশ্বরের সাথে মিলনের জন্য। বাঙালি হিন্দু এই শক্তিরই সাধনা করে। যেমন করে সে ফসলের পরিচর্যা। তাই যেখানেই বাঙালি হিন্দু সেখানেই কালী মন্দির অর্থাৎ শক্তি সাধনার কেন্দ্র।
উৎসব ও সাধনার দুই মহাদেবী অর্থাৎ দুর্গা ও কালীর ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে আছে বাঙালি হিন্দুর জটিল এক সামাজিক ইতিহাস। কারণ দুর্গা ও কালীতে বিলীন হয়েছে বহু লোকায়ত দেবী যাদেরকে আত্মস্থ করে তারা হয়েছেন মহাদেবী। আত্মস্থ করতে গিয়ে তাদেরকেও রূপ বদলাতে হয়েছে। তাই আজকে যে রূপে তাদেরকে আমরা পাই পূর্বাপর তারা এমন ছিলেন না। কারণ প্রাচীন রূপ হয়েছে বিবর্তিত ও পরিবর্তিত। দু’য়ের মধ্যে অবশ্য দুর্গাপূজা প্রাচীনতর। কালীপূজার বর্তমান রীতি পরের ঘটনা। বিষয়টি বোঝার জন্য নিচে দুর্গা ও কালীর সংক্ষিপ্ত পরিচয়সহ এই দুই পূজার সর্বজনীন বৈশিষ্ট্যের দিকগুলো তুলে ধরা হল:
১. মহাদেবী দুর্গা : অনেক হিন্দুর বিশ্বাস আজকের দিনে যে রূপে দুর্গাদেবী পূজিতা হন তা প্রাচীনকাল থেকেই চালু। এই ধারণাটির কোনো ভিত্তি আছে বলে মনে হয় না! কারণ দুর্গা পূজার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় পূজাটি সম্ভবত দ্বাদশ- ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে চালু। পূজার বিধান রচিত হয়েছে আরও অনেক পরে। এই পূজার বিধান সম্বলিত ‘দেবী পুরাণ’, ‘দেবী ভাগবত’, ‘কালিকা পুরাণ’ ও ‘ভবিষ্য পুরাণ’ ইত্যাদি রচিত হয় খ্রিস্টাব্দ চতুর্দশ থেকে ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যে। দুর্গা পূজার বিধান সম্বলিত রঘুনন্দনের (১৫০০-১৫৭৫) ‘দুর্গাপূজাতত্ত্ব’ গ্রন্থটি রচিত হয় ষোড়শ শতাব্দীতে। এর থেকে প্রতীয়মান হয় যে, দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে চালু হলেও বর্তমান রূপে দুর্গাপূজাকে পাওয়া যায় সম্ভবতঃ ষোড়শ শতাব্দী থেকে। কথিত আছে যে, আকবর বাদশাহর আমলে (ষোড়শ শতাব্দী) কুলুক ভট্টের পুত্র রাজা কংসনারায়ণ নয় লক্ষ টাকা ব্যয়ে দুর্গা পূজা করেন।
এদিকে রজনীকান্ত চক্রবর্তীর তথ্যও একই ইঙ্গিত দেয়। তাঁর মতে (গৌড়ের ইতিহাস: দে’জ পাবলিশিং : কলকাতা, ১৯৯৯) চুচুংফা বা প্রতাপ সিংহ রাজা হয়ে ১৬১১ খ্রিস্টাব্দে দুর্গোৎসব চালু করেন। এই তথ্য প্রমাণের পরেও সব কিছুতেই প্রাচীনতা দেওয়ার ক্ষমতা গুণে দুর্গাপূজাকে একটি প্রাচীন পূজা হিসেবে হিন্দুরা গণ্য করে। এটি করতে গিয়ে রামচন্দ্রকেও টেনে আনা হয়। বলা হয় রামচন্দ্রও দুর্গাপূজা করেছিলেন। এমনকি দশমীর দিনটিকে বলা হয় বিজয় উৎসবের দিন। রাবণের বিরুদ্ধে রামের বিজয়। তাই শুভ বিজয়া। বলা বাহুল্য এই ধারণাটিও অমূলক। রাম আর্য প্রতিনিধি। আর্যরা পূজায় বিশ্বাস করত না। রামচন্দ্রকে দুর্গাপূজায় টেনে আনা পুরাণ লেখকদের কাণ্ড। এটি অনেক পরের ঘটনা। সম্ভবত ভূমিপুত্র ও আর্যদের মধ্যে সুসম্পর্ক স্থাপনই এর উদ্দেশ্য।
‘দেবী’ পূজার রীতি প্রাচীন সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রাচীন অর্থ অপরিবর্তিত ও স্থায়ী কিছু নয়। যুগে যুগে দেবীর রূপ পরিবর্তিত হয়েছে। যোগ হয়েছে নানা উপাদান। দেবীর নামেও হয়েছে পরিবর্তন। এই সূত্র ধরে কেউ কেউ বলতে চান প্রাচীন এক ‘মহাদেবী’ থেকে ধীরে ধীরে বহু দেবীর উৎপত্তি হয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ঘটনাটি ঠিক বিপরীত। আমরা জানি স্থান-কাল ভেদে এ অঞ্চলে বহু দেবীপূজার প্রচলন ছিল। অর্থাৎ দেবীপূজার ছিল বহু ধারা। এর মধ্যে কোনো কোনোটি ছিল প্রধান ধারা, কোনোটি ছিল গৌণ ধারা। প্রধান ধারার সাথে অন্যান্য ছোট ছোট ধারা যুগে যুগে মিশ্রিত হয়েছে। এতে প্রধান ধারা আরও পরিপুষ্ট হয়েছে (শশিভূষণ দাশগুপ্ত : ভারতের শক্তি সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য : সাহিত্য সংসদ : কলকাতা, ১৩৭২)।
লক্ষণীয় ছোট-বড় ধারা বা দেবীদের মিশ্রণকে গ্রহণযোগ্য ও যুক্তিপূর্ণ করার জন্য একসময় দরকার হয় দার্শনিক তত্ত্বের। কারণ দেখা গেল যে, অসংখ্য দেব-দেবীর মূলে একটি শক্তিই কাজ করছে। অর্থাৎ সব দেবীই শক্তিরূপিনী এক মহাদেবীর অংশ বা রূপভেদ মাত্র। তাই বিভক্তি দূর করা দরকার। কারণ ঐক্যেই শক্তি, বিভক্তিতে পতন। কাজেই বহু দেবীকে এক করা দরকার। তা করতে হলে পুরোনোকে করতে হয় বর্জন, নতুনকে করতে হয় গ্রহণ। এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি কাজ। কারণ ভিন্ন ভিন্ন গোষ্ঠীর ভিন্ন ভিন্ন দেবীকে একত্রিত করা খুবই কঠিন। এতে সময় লাগে। তাই দীর্ঘদিন ধরে ক্রমবিকাশের মাধ্যমে এই প্রক্রিয়ার কাজ শেষ হয়। বর্তমান কালের দুর্গাদেবী এই ক্রমবিকাশেরই ফল। পুরাণগুলোতে গ্রন্থিত নানা কাহিনীই এই ক্রমবিকাশের সাক্ষ্য।
শশিভূষণ দাশগুপ্তের মতে মাতৃদেবী বা শক্তিদেবী হিসেবে দুর্গাপূজায় দুটো প্ৰধান ধারাসহ অনেক ছোট ছোট ধারার সংমিশ্রণ ঘটেছে। এই দুটো প্রধান ধারা হচ্ছে: ক. পৃথিবী ও শস্যপ্রজননীর ধারা এবং খ. পর্বতবাসিনী ও সিংহবাহিনী দেবী পার্বতী-উমার ধারা। পৃথিবীর ধারায় পৃথিবী হচ্ছে শস্যোৎপাদিনী মাতৃদেবী। তিনি (পৃথিবী) প্রাণশক্তি ও প্রজনন শক্তির প্রতীক হিসেবে প্রাচীনকাল থেকেই পূজিতা। এই ‘পৃথিবীদেবীর’ পূজা থেকেই পরবর্তীকালে ‘শস্যদেবী’ ও শস্যপূজার উৎপত্তি হয়েছে। তাই শস্য (পৃথিবীর দান) দুর্গাপূজার একটি বড় দিক। দুর্গা পূজায় দেবীর বোধন হয় ষষ্ঠীর দিন। বোধনের প্রতীক বিল্বশাখা। পরে দেবীর স্নান, প্রতিষ্ঠা ও পূজা হয় নবপত্রিকায়। ‘নবপত্রিকা’ হচ্ছে ‘শস্যবধূ’। একটি কলাগাছের সাথে কচু, হরিদ্রা, জয়ন্তী, বিল্ব, ডালিম, মানকচু, অশোক ও ধান একত্রে বেধে এই শস্যবধূ তৈরি করা হয়। এই নবপত্রিকা বা শস্যবধূকেই ‘দেবীর’ প্রতীক হিসেবে প্রথম পূজা করতে হয়। এই উদাহরণ থেকে বোঝা যায় দুর্গাপূজা মূলত ছিল ‘শস্যপূজা’।
কালে কালে ‘শস্যপূজার’ (পৃথিবীর ধারা) সাথে ভিন্ন আর একটি ধারা অর্থাৎ পার্বতী-উমার ধারা মিশ্রিত হয়েছে। কবে হয়েছে তা বলা কঠিন। ভিন্ন একটি ব্যাখ্যা থাকলেও আমরা জানি ‘উমাকে’ বলা হয় হিমালয় দুহিতা। আবার আমরা জানি হিমালয় দুহিতার মূল নাম ‘পার্বতী’ ও ‘গিরিজা’ প্রভৃতি। এর থেকে বোঝা যায় যে, উমা ও পার্বতীর সম্পর্ক পর্বতের সাথে। তাঁর বাহন সিংহ। সিংহবাহিনী পর্বতকন্যা উমা-পার্বতীই ভারতের শক্তি দেবীর প্রাচীন রূপ। শশিভূষণ দাশগুপ্তের মতে, এই ক. সিংহবাহিনী উমা-পার্বতীর সাথে খ. পৃথিবী ও শস্য প্রজননী দেবী এবং গ. আরও অনেক দেবী একত্রিত হয়ে এক ‘মহাদেবীর’ সৃষ্টি হয়েছে। এই মহাদেবীই দুর্গা।
পৃথিবী এবং পার্বতী-উমা এ দুটো ধারার সাথে পরবর্তীকালে যোগ হয়েছে আরও একটি ধারা। এই তৃতীয় ধারাটি হচ্ছে অসুরনাশিনী ধারা। ‘দুর্গা’ নামের বিভিন্ন ব্যাখ্যা থেকে তার আভাস পাওয়া যায়। দুর্গা নামের অনেক ব্যাখ্যার কথা আমরা জানি। এই ব্যাখ্যাগুলো হচ্ছে: ক. যিনি দুর্গতিনাশিনী তিনিই দুর্গা; খ. দুর্গানামক দৈত্য, মহাবিঘ্ন, কুকর্ম, শোক, দুঃখ, নরক, যমদণ্ড, মহাভয় ও অতিরোগ ইত্যাদি যিনি হত্যা করেন তিনি দুর্গা; গ. যিনি দুর্গম ভবসাগরে নৌকাস্বরূপ তিনিই দুর্গা; ঘ. যিনি ‘দুর্গম’ নামীয় মহাসুর বধকারিনী তিনি দুর্গা এবং ঙ. দুর্গরক্ষাকারিনী দুর্গের অধিষ্ঠাত্রী দেবীই হলেন দুর্গা। উপরোক্ত ব্যাখ্যাগুলো থেকে বোঝা যায় এই ধারাটি অসুরনাশিনী (দুর্গতিনাশিনী ধারা। এই ধারাটিও আজকে দুর্গার অঙ্গীভূত।
পরিশেষে বলা দরকার যে, বিভিন্ন ধারা একত্রিত হওয়ার ফলে দুর্গার রূপ ও চরিত্র বহুমুখী হয়েছে। এর একদিকে আছে তাঁর কল্যাণরূপী, স্ত্রীরূপী ও মাধুর্যমণ্ডিত রূপ এবং অন্যদিকে আছে ব্রাহ্মণ্য সংযোজন অসুরনাশিনী রূপ। কিন্তু লক্ষণীয় অসুরনাশিনী (চণ্ডী) এবং ‘যুদ্ধং দেহি’ দুর্গারূপ বাঙালি হিন্দু কর্তৃক গৃহীত হয় নি। বাঙালি গ্রহণ করেছে তাঁর কোমল-স্নিগ্ধ মাতৃরূপকে। শরৎকালে দুর্গা তাঁর পুত্র-কন্যা নিয়ে ফসল ওঠার পূর্বে স্বামীর গৃহ কৈলাস থেকে পিতৃগৃহে আসেন। এই রূপটিতে বাঙালি হিন্দুর দৈনন্দিন জীবনের একটি প্রতিফলন ঘটেছে। এই রূপের জয়গানই করেছেন বাঙালি কবি ও গায়করা। সাধারণ হিন্দুও এই রূপেই দুর্গাকে আপন করে নিয়েছে। প্রতিমাতে অবশ্য ‘চণ্ডী’ রূপ বিদ্যমান। আমরা জানি এই চণ্ডীরূপ ব্রাহ্মণ্য সংযোজন। কেন এই সংযোজন তার গ্রহণযোগ্য কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। মনে হয় সামাজিক ও ধর্মীয়ভাবে পর্যুদস্ত ও রাজনৈতিকভাবে পরাস্ত মধ্যযুগীয় বাঙালি হিন্দুকে মুক্তির জন্য শাস্ত্রকাররা দৈবশক্তির ওপর নির্ভরশীল করাতে চেয়েছিলেন। আমরা জানি মধ্যযুগে সামাজিক অনৈক্য (জাতিভেদ), ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের কঠোরতা, ব্রাহ্মণ্য অনুশাসনের নিষ্ঠুরতা এবং সর্বোপরি বৌদ্ধ নির্মূলের আয়োজন ইত্যাদির প্রেক্ষাপটে ধর্মীয়-সামাজিক উত্থান-পতন শুরু হয়। এ প্রেক্ষাপটে শাসকের ধর্ম ইসলামে গেলে শাসক করবে রক্ষা, কিন্তু ব্রাহ্মণ্যধর্মে আশ্রয় নিলে? ব্রাহ্মণ্যধর্মে হিন্দুকে রক্ষা করবে দৈবশক্তি। এই বিশ্বাস স্থাপনের জন্যই মনে হয় শাস্ত্রকাররা মাতৃদেবীর হাতে অস্ত্র তুলে দেন। কিন্তু এতদ্সত্ত্বেও লক্ষণীয় বাঙালি হিন্দু দুর্গাদেবীকে মাতৃরূপেই গ্রহণ করে নিয়েছে, অস্ত্রধারিনী রূপে নয়। কারণ এই রূপ তার ঐতিহ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
২. মহাদেবী কালী : দুর্গার মতই মহাদেবী হিসেবে কালীর উত্থানও একদিনে হয় নি। দেবীপূজার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় বহু বিবর্তনের মাধ্যমে কালী মোটা-মুটিভাবে মধ্যযুগে তাঁর অবস্থান দৃঢ় করে নেন। বর্তমানে যে পদ্ধতিতে কালীপূজা করা হয় তার একটা রূপ ও ভিত্তি পাওয়া যায় ‘তন্ত্রসার’ গ্রন্থে। এই গ্রন্থটির রচয়িতা কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ। শশিভূষণ দাশগুপ্তের মতে, তিনি চৈতন্যদেবের (১৪৮৫-১৫৩৩) সমসাময়িক ছিলেন। পরবর্তীকালে এই কালীপূজার ব্যাপক প্রচলনের ব্যবস্থা করেন নবদ্বীপের মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র (১৭১০-১৭৮২)। কথিত আছে যে, তিনি তাঁর রাজ্যের অধিবাসীদের কালী পূজা করতে উদ্বুদ্ধ করেন। এইসময়ে বাংলার জমিদার ও সামন্ত শ্রেণি কালী সাধনায় উৎসাহ ও মদত যোগায়। এতে অবদান রাখেন বাঙালি কবি গায়ক ও সাধকরা। শাক্ত সঙ্গীতের প্রথম কবি রামপ্রসাদ (১৭২০-১৭৮১) কালীর জনপ্রিয়তার একটা শক্ত ভিত্তি রচনা করেন। তিনি বৈষ্ণব পদাবলীতে অভ্যস্ত বাঙালিকে শাক্ত পদাবলীর রসে স্নাত করান।
আমরা জানি দ্বাদশ শতাব্দীর দিকে বাঙালি হিন্দু ভক্তির দিকে মনোযোগ দেয়। শ্রীচৈতন্য (১৪৮৫-১৫৩৩) বৈষ্ণব আন্দোলনের মাধ্যমে ভক্তির আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করেন। সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত বৈষ্ণব আন্দোলন ছিল খুবই প্রভাবশালী। এ প্রেক্ষাপটেই শাক্ত পদাবলী বাঙালিকে ভিন্ন একটি স্বাদ দেয়। এই স্বাদটি যৌথভাবে মাতৃভক্তি ও শক্তির। শুধু ভক্তিতে বাঙালি বোধ হয় সন্তুষ্ট ছিল না। বিদেশি শাসনের প্রেক্ষাপটে তার দরকার হয়ে পড়ে শক্তির। তাই বৈষ্ণব ‘রাধা-কৃষ্ণের বদলে ধীরে ধীরে সামনে চলে আসে কালী ও তাঁর সাধনা। তিনি মানবী, মঙ্গলময়ী ও আনন্দময়ী, আবার সকল শক্তির আধার। প্রেমধর্মের দেশে শক্তির আদলে কল্পিত হয় মাতৃভক্তি। এই সূত্রেই জন্ম নেয় ‘শাক্ত সম্প্রদায়’। তাই আমরা বিদ্যাপতি (চতুর্দশ শতাব্দী) ও চণ্ডীদাসের (১৪১৭-১৪৭৭) পরে পাই রামপ্রসাদকে। রাম প্রসাদের শক্ত ভিত্তিকে কাজে লাগিয়ে সামনে আসেন শক্তিসাধক রামকৃষ্ণ (১৮৩৬-১৮৮৬)। রামকৃষ্ণের সমসাময়িককালে আমরা আরও বহু শক্তিসাধককে পাই। ধর্মীয় শক্তিসাধকদের এই অবস্থানকে কাজে লাগান জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। শক্তিসাধনায় বঙ্কিমের (১৮৩৮-১৮৯৪) ‘আনন্দ মঠ’ সাহিত্যিক একটা ভিত্তি দেয়। এই প্রেক্ষাপটে ‘অনুশীলন’ ও ‘যুগান্তর’ নামীয় রাজনৈতিক গ্রুপগুলো কালীকে শক্তির উৎস ও প্রেরণা হিসেবে গ্রহণ করে। এর লক্ষ্য অবশ্যই বিদেশি শাসক ব্রিটিশকে তাড়ানো।
ধর্মীয়, সাহিত্যিক ও রাজনৈতিক সমর্থনে এবং জমিদারদের মদতে কালী এক সময়ে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠেন। এতে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখে অর্থ-বিত্ত ও শিক্ষায় অগ্রসর হিন্দুর শাক্ত সম্প্রদায়। ঘটনাক্রমে বাংলার তথাকথিত উঁচুজাতির হিন্দুরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শাক্ত। অপরদিকে অধিকাংশ হিন্দু হয় বৈষ্ণব নয় তো শৈব। এই দুই ধারার লোকেরা হিন্দুর ভেদাভেদ বিশ্বাস করে না। কিন্তু ‘শাক্তরা সাধারণভাবে বৈষম্যের অনুসারী। তারা সুকৌশলে কালীকে ব্যবহার করে বৈষ্ণবদের আধিপত্য বিনষ্ট করে। সুচতুরভাবে কালীকে শিবের আড়াল করে শৈবদেরও (শিবানুসারী) দুর্বল করে। পদক্ষেপ হিসেবে তারা প্রথম পর্যায়ে কালীকে পার্বতী দেবীর (উমা-দুর্গা-গৌরী-চণ্ডী ) সাথে অভিন্ন হিসেবে দেখায়। কিন্তু কালী যখন ‘মহাদেবীর’ পর্যায়ে ওঠেন তখন শাক্তরা বলেন: কালীই মূল দেবী, বাকি দেবীগণ তাঁর থেকে উদ্ভূতা। বলাবাহুল্য শাক্তদের এ চেষ্টা সফল হয় নি। শেষ পর্যন্ত মহাদেবের (শিব) সাথে সম্পর্কিত থেকেই দুর্গার মত কালীও মহাদেবীতে রূপান্তরিত হয়েছেন।
‘মহাদেবী’ হিসেবে কালীর এই উত্থান হয়েছে তান্ত্রিক মতে। তন্ত্র শিবের সাথে যুক্ত। তাই কালীকে শিবের আড়াল করা সম্ভব নয়। তাই দেখা যায় কালী নামের সাথেই শিবকে সম্পর্কিত করা হয়েছে। পণ্ডিত শ্যামাচরণ ভট্টাচার্যের মতে (শ্রীশ্রী কালীপূজা পদ্ধতি: বেণীমাধব শীল’স লাইব্রেরী) ‘কু’ ধাতু থেকেই ‘কাল’ শব্দের উৎপত্তি। ‘কালের’ অর্থ মহাকাল অথবা মৃত্যু অর্থাৎ মহাদেব। এই ‘কাল’ শব্দের উত্তরে ‘ঈপ’ প্রত্যয় যুক্ত হয়ে সৃষ্টি হয়েছে ‘কালী’ পদটি। তাঁর মতে কাল অর্থাৎ মহাকালের বিশেষ শক্তি হলেন কালী। তার অর্থ হচ্ছে মহাদেবের বিশেষ শক্তিই হচ্ছে কালী। প্রচলিত বিশ্বাসেও কালী শিবের স্ত্রী। পুরাণগুলোতে বর্ণিত কালীর উৎপত্তি কাহিনীগুলো বিচার করলেও দেখা যায় কালীর সম্পর্ক শিবের সাথে।
বিভিন্ন পুরাণে কালীর উৎপত্তি সম্বন্ধে যেসব উৎসের কথা বলা হয়েছে তার মধ্যে আছে: ক. বেদের রাত্রিসূক্তে উল্লেখিত অন্ধকাররূপিনী ‘রাত্রিদেবী’; খ. ‘শতপথ ব্রাহ্মণ’ ও ‘ঐতরেয় ব্রাহ্মণে’ উল্লেখিত কৃষ্ণবর্ণা বৈদিক ‘নিঋতি দেবী’; গ. মুণ্ডক উপনিষদ (বৈদিক সাহিত্য) এ উল্লেখিত ‘কালী’ নাম; ঘ. প্রচলিত মহাভারতে উল্লেখিত ‘কালী’; ঙ. কালীদাসের পরবর্তীকালে রচিত সংস্কৃত সাহিত্যে (খিল হরি বংশ’) উল্লেখিত শবর বর্বর পুলিন্দ কর্তৃক পূজিত এক ভয়ঙ্করী দেবী; চ. বাণভট্ট (সপ্তম শতাব্দী?) রচিত ‘কাদম্বরী’তে উল্লেখিত বনমধ্যে শবরগণ কর্তৃক পূজিত ‘চণ্ডী’ এবং ছ. ভবভূতি (সপ্তম শতাব্দী) রচিত ‘মালতী মাধব’ নাটকে উল্লেখিত নরমাংস বলিদানে পূজিতা কৃষ্ণবর্ণা ও ভয়ঙ্করী ‘করালাদেবী’ (চামণ্ডা)।
উপরোক্ত উৎসগুলোর মধ্যে কয়েকটির ভিত্তি দেখা যায় বেদ। কিন্তু বেদ থেকে কালীদেবীর উৎপত্তি হয়েছে এ কথা বিশ্বাস করা কঠিন। কারণ বেদে দেবীপূজার রীতি নেই। দেবীপূজা তান্ত্রিক একটা রীতি। তা না হলে বিভিন্ন নামে পরিচিতা দেবীগণকে শেষ পর্যন্ত শিব ও তাঁর গোষ্ঠীভুক্ত দেবী ‘সতী’ অথবা ‘পার্বতীর’ সাথে যুক্ত করা হতো না। উদাহরণস্বরূপ এখানে আমরা সুধীর চন্দ্র সরকারের সংকলিত গ্রন্থের (পৌরাণিক অভিধান : এমসি সরকার এ্যাণ্ড সন্স প্রা: লি: ১৩৯২) আশ্রয় নিতে পারি। তিনি বলছেন কালী দশ মহাবিদ্যার (কালী, তারা, ষোড়শী, ভুবনেশ্বরী, ভৈরবী, ছিন্নমস্তা, ধূমাবতী, বগলা, মাতঙ্গী ও কমলা) মধ্যে প্রথম মহাবিদ্যা। শক্তি উপাসকরা কালীকে ‘আদ্যাশক্তি’ (মহাদেবের স্ত্রী দুর্গার অন্য নাম) বলে উপাসনা করেন। এঁর চারটি হস্ত আছে। দুই দক্ষিণ হস্তে খট্রাঙ্গ ও চন্দ্রহাস, আর দুই বাম হস্তে চর্ম ও পাশ। গলায় নরমুণ্ড, দেহ ব্যাঘ্র চর্মে আবৃত। দীর্ঘদন্তী, রক্তচক্ষু, বিস্তৃত মুখ ও স্থূল কর্ণ। এঁর বাহন কবন্ধ (মস্তকবিহীন শব)।
কালীর উৎপত্তি সম্বন্ধে সরকার যে পৌরাণিক কাহিনীর বর্ণনা দিয়েছেন তাতেও দেখা যায় কালী বৈদিক কোনো দেবী নন। পৌরাণিক কাহিনী মতে এক মূল দেবী (ভগবতী) থেকেই আরও তিন দেবীর (চণ্ডী কালী চামুণ্ডা) উৎপত্তি হয়েছে। ঘটনাটি এইরূপ : দেবতা ও অসুরদের মধ্যে যুদ্ধ। দেবতারা অসুর প্রতিনিধি শুম্ভ ও নিশুম্ভের কাছে পরাজিত হয়ে স্বর্গ থেকে বিতাড়িত হয়ে প্রতিকারের জন্য যান দেবী আদ্যাশক্তি (দুর্গা) ভগবতীর কাছে। তখন দেবীর “শরীর কোষ” (দেহ) থেকে আর এক দেবীর সৃষ্টি হয়। তাঁর নাম ‘কৌষিকী’ (কোষ থেকে সৃষ্ট) বা ‘চণ্ডিকা’। কৌষিকী দেবীর জন্ম দিয়ে ভগবতী দেবী কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করেন। সেই থেকে তাঁর নাম ‘কালিকা’ বা ‘কালীদেবী’। এর পরে দেবী পুনরায় নিজের পূর্বতন মনোহর রূপে ফিরে যান। দেবী পরে অসুর শুম্ভ ও নিশুম্ভের সেনাপতি চণ্ড ও মুণ্ডকে হত্যা করে ‘চামুণ্ডা’ বলে খ্যাত হন। চণ্ড ও মুণ্ডকে হত্যা করার পর দেবী কালী (পার্বতী) ও চণ্ডিকা (কৌষিকী) শুম্ভ ও নিশুম্ভকে যুদ্ধে নিধন করেন। এই যুদ্ধে দেবীদ্বয়কে সাহায্য করেন মহাদেব ও ব্রহ্মাসহ সকল দেবতা। তা হলে দেখা যাচ্ছে এক পার্বতী (ভগবতী) দেবী থেকে উদ্ভূত হয়েছে: ক. কৌষিকী (চণ্ডিকা) দেবী, খ. কালী দেবী ও গ. চামুণ্ডা দেবী।
ওপরের পৌরাণিক কাহিনী থেকে দেখা যাচ্ছে এক দেবীই বহু দেবী হচ্ছেন, আবার বহু দেবী এক দেবীতে বিলীন হচ্ছেন। এই প্রেক্ষাপটেই কালী সম্পর্কে একটি লোকবিশ্বাস গড়ে ওঠেছে। এই বিশ্বাস মতে কালীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ‘সতীর’ সাথে (রঞ্জিত কুমার মজুমদার: দেবী কালিকা: রবিবারের প্রতিদিন: ১৮.১০.৯৮: কলকাতা)। আমরা জীবের স্রষ্টা দশ প্রজাপতির মধ্যে (মরীচি, অত্রি, অঙ্গিরা, পুলস্ত্য, পুলহ, ক্রতু, বশিষ্ঠ, দক্ষ, ভৃগু ও নারদ) এক প্রজাপতি অর্থাৎ দক্ষ ও তার যজ্ঞের কথা জানি। দক্ষ (আর্য প্রতিনিধি) একবার রাজসূয় যজ্ঞের আয়োজন করেন। এই যজ্ঞে ঋষি প্রজাপতি ও কিন্নর সবাই ছিলেন আমন্ত্রিত। আমন্ত্রণ পান নি কেবল তাঁর কন্যা সতী ও দরিদ্র জামাতা শিব। পিতার শিবহীন এই যজ্ঞের কথা সতী নারদের মারফত জানতে পারেন। সতী এতে ক্ষুব্ধ হন। তিনি শিবের অনুমতি নিয়ে যজ্ঞস্থলে গিয়ে হাজির হন। সেখানে শিবের (পতি) নিন্দা শুনে সতী যোগাসনে বসে দেহত্যাগ করেন। এই খবর শুনে শিব যজ্ঞস্থলে হাজির হন। প্রাণপ্রিয়ার অপমানের প্রতিশোধ নিতে শিব তাঁর শ্বশুরের (দক্ষ ) যজ্ঞ তছনছ ও দক্ষের মুণ্ডচ্ছেদ করেন। অতঃপর সতীর মৃতদেহ কাঁদে নিয়ে প্রলয় নৃত্য শুরু করেন। এতে পৃথিবী ধ্বংসের সম্মুখীন হয়। তখন নারায়ণ সুদর্শন চক্র দিয়ে সতীর দেহ খণ্ড খণ্ড করেন। শিব এতে শান্ত হন। এদিকে সতীর এই দেহখণ্ড ভারতের ৫১টি স্থানে ভূপাতিত হয়। এই ৫১টি স্থানই এখন ‘মহাপীঠস্থান’ বা হিন্দুর তীর্থস্থান। নিচে পীঠস্থানগুলোর সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেয়া হল (বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা : ১৪০৯):
দেবীর ৫১ পীঠস্থান
পীঠস্থান | অবস্থান | দেবীর অঙ্গ | দেবীর নাম/ ভৈরব |
১. হিঙ্গুলা (হিংলাজ) | করাচীর অনতিদূরে | ব্রহ্মরন্ধ্র | কোট্টরী/ ভীমলোচন |
২. কবরীপুর/সর্করা | করাচি/সুক্কর স্টেশন | ত্রিনেত্র | মহিষমর্দিনী/ ক্রোধীশ |
৩. সুগন্ধা | বরিশাল/ শিকারপুর | নাসিকা | সুনন্দা/ ত্র্যম্বক |
৪. অমরনাথ | কাশ্মীর/ তুষার তীর্থ | কণ্ঠ | মহামায়া/ ত্রিসন্ধ্যেশ্বর |
৫. জ্বালামুখী | পাঠানকোট | জিহ্বা | অম্বিকা/ উন্মত্ত |
৬. জলন্ধর | জলন্ধর | বামস্তন | ত্রিপুরমালিনী/ ভীষণ |
৭. বৈদ্যনাথ | বিহার (দেওঘর) | হৃদয় | জয়দুর্গা/ বৈদ্যনাথ |
৮. নেপাল | নেপাল/ পশুপতিনাথ মন্দিরের নিকট | জানুদ্বয় | মহামায়া/ কপালী |
৯. মানস | তিব্বত/কৈলাস পর্বত | দক্ষিণ হাত | দাক্ষায়নী/ অমর |
১০. বিরজাক্ষেত্ৰ | উড়িষ্যা/পুরী | নাভি | বিমলা/ জগন্নাথ |
১১. গণ্ডকী | নেপাল/গণ্ডকী নদীর উৎসস্থল | গণ্ডদেশ | গণ্ডকীচণ্ডী/ চক্রপানি |
১২. বহুলা | কাটোয়া/অজয়নদীর তীর | বামবাহু | বহুলা / ভীরুক |
১৩. উজানী | বর্ধমান | ডান কনুই | মঙ্গল চণ্ডিকা/ কপিলেশ্বর |
১৪. চট্টল/চট্টগ্রাম | চন্দ্রনাথ পাহাড়ের ওপর | দক্ষিণ বাহু | ভবানী/ চন্দ্রশেখর |
১৫. ত্রিপুরা | ত্রিপুরা /উদয়পুর | দক্ষিণ পাদ | ত্রিপুর সুন্দরী/ ত্রিপুরেশ |
১৬. ত্রিস্রোতা | জলপাইগুড়ি/ শালবাড়িগ্রাম | বামপাদ | ভ্রামরী/ঈশ্বর |
১৭. কামারূপ কামাখ্যা | আসাম/নীলাচল পাহাড় | যোনিদেশ | দেবী কামাখ্যা/ উমানন্দ |
১৮. যুগাদ্যা | বর্ধমান/ক্ষীরগ্রাম | দক্ষিণপদাঙ্গুষ্ঠি | যুগাদ্যা/ক্ষীর খণ্ডক |
১৯. কালিঘাট | কলকাতা | দক্ষিণ পদাঙ্গুলি | কালিকা/নকুলীশ |
২০. প্ৰয়াগ | এলাহাবাদ/প্রয়াগ সঙ্গম | হাতের অঙ্গুলি | ললিতা/ ভব |
২১. জয়ন্তী | জয়ন্তিকা/খাসিয়া পাহাড় | বামজঙ্গা | জয়ন্তী/ ক্রমদীশ্বর |
২২. কিরীট | মুর্শিদাবাদ/বটনগর | কিরীট অঙ্গ | বিমলা/সংবর্ত |
২৩. বারাণসী | উত্তর প্রদেশ/বারাণসী | কর্ণকুণ্ডল | বিশালাক্ষী/কাল |
২৪. কন্যাশ্রম | তামিলনাডু/অথবা চট্টগ্রাম | পৃষ্ঠদেশ | সর্বাণী / নিমিষ |
২৫. কুরুক্ষেত্র | হরিয়ানা | গুল্ক | সাবিত্রী / স্থানু |
২৬. মনিবেদ/মনিবেদিক | রাজস্থান/আজমীঢ় | কবজি | গায়ত্রী /সর্বানন্দ |
২৭. শ্রীশৈল | শ্রীহট্ট/ জৈনপুর | গ্রীবা | মহালক্ষী/ সম্বরানন্দ |
২৮. কাঞ্চিদেশ | বোলপুর/কোপাই নদীর তীর | কঙ্কাল | দেবগর্ভা/ রুরু |
২৯. কালমাধব | মধ্যপ্রদেশ/শোননদীর তীর | বাম নিতম্ব | কালী/ অসিতাঙ্গ |
৩০. শোন | মধ্যপ্রদেশ/নর্মদানদীর উৎসস্থল | দক্ষিণ নিতম্ব | নর্মদা/ ভদ্রসেন |
৩১. রামগিরি | উত্তরপ্রদেশ/চিত্রকুট | দক্ষিণস্তন | শিবালী/চণ্ড |
৩২. বৃন্দাবন | মথুরা/বৃন্দাবন | কেশজাল | উমা/ ভূতেশ |
৩৩. শুচি/অনল | কন্যাকুমারী-ত্রিবান্দ্রম | উর্ধদন্ত পংক্তি | নারায়ণী/ সংহার |
৩৪. পঞ্চসাগর | জানা নেই | অধোদন্ত পংক্তি | বারাহী / মহারুদ্র |
৩৫. করতোয়া তট | বগুড়া শেরপুর | পৃষ্ঠদেশের মাংস | অপর্ণা/ বামেশ |
৩৬. শ্রীপর্বত | কাশ্মীর লাদাখ | দক্ষিণপায়ের গোড়ালি | শ্রী সুন্দরী / সুন্দরানন্দ |
৩৭. বিভাষ | প:বঙ্গ/ তমলুক | বামগুল্ফ | ভীমরূপা/সর্বানন্দ |
৩৮. প্রভাস | সোমনাথ মন্দিরের নিকটবর্তী | উদর | চন্দ্ৰ ভাগা/বক্রতুণ্ড |
৩৯. ভৈরব পর্বত | উজ্জয়িনী/ শিপ্রানদীর তীর | উর্ধ ওষ্ঠ | অবন্তী/ দণ্ড পাণি |
৪০. জনস্থান/জলস্থল | মহারাষ্ট্র /নাসিক | চিবুক | ভ্রামরী/বিকৃতাক্ষ |
৪১. গোদাবরী তট | মাদ্রাজ/ রাজমহেন্দ্রী | বাম গণ্ড | বিশ্বেশী/দণ্ডপাণি |
৪২. রত্মাবলী | সঠিক জানা নেই | দক্ষিণ স্কন্ধ | কুমারী/ শিব |
৪৩. মিথিলা | নেপাল/ জনকপুর | বাম স্কন্ধ | উমা / মহোদর |
৪৪. নলহাটি | বীরভূম/ নলহাটি | নলা | কালী/ যোগীশ |
৪৫. কর্ণাট | সঠিক জানা নেই | কর্ণদ্বয় | জয়দুর্গা/ অভীক |
৪৬. বক্রেশ্বর | বীরভূম | মন | মহিষ মর্দিনী/ বক্ৰনাথ |
৪৭. যশোর | খুলনা/ঈশ্বরীপুর | পাণিপদ্ম | যশোরেশ্বরী/ চণ্ডক |
৪৮. অট্টহাস | বীরভূম/লাভপুর | ওষ্ঠ | ফুলরা / বিশ্বেশ্বর |
৪৯. নন্দীপুর | বীরভূম/সাঁইথি | হার | নন্দিনী/ মন্দিকেশ্বর |
৫০. লঙ্কা | সঠিক জানা নেই | নুপুর | ইন্দ্রাক্ষী/ রাক্ষসেশ্বর |
৫১. বিরাট | সঠিক জানা নেই | উত্তর পদাঙ্গুলি | অম্বিকা/ অমৃতাক্ষ |
ওপরের তালিকা থেকে দেখা যাবে যে বাংলাদেশে মহাপীঠস্থানের সংখ্যা পাঁচটি ও পশ্চিমবঙ্গে চৌদ্দটি। উল্লেখ্য সতীর সাথে সাথে ৫১টি মহাপীঠেই মহাদেব স্বয়ম্ভ (ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর এই তিন শক্তির অধিকারী) ভৈরব হিসেবে সর্বত্র অধিষ্ঠিত। সতীর নাম যেমন পরিবর্তিত হচ্ছে, তেমনি পরিবর্তিত হচ্ছে মহাদেবের নামও।
পরিশেষে বলা দরকার এক ‘দেবীর’ই অনেক নাম যথা: পার্বতী, উমা, মহামায়া, চণ্ডী, চামুণ্ডা, ভগবতী, কালী, আদ্যাশক্তি ও গৌরী ইত্যাদি। প্রকৃতপক্ষে সকলেই শিবের পরিবারভুক্ত। বিভিন্ন পরিচয়কে ছাপিয়ে এই ‘দেবীই’ দুই মহাদেবী অর্থাৎ ক. দুর্গা ও খ. কালীতে রূপান্তরিত হয়েছেন।
৩. পূজার সর্বজনীনতা : উপসংহারে মহাদেবী দুর্গা ও কালী পূজার জনপ্রিয়তা ও সর্বজনীনতা সম্বন্ধে দুটো কথা বলা দরকার। আমরা জানি শরৎ থেকে বসন্ত পর্যন্ত বাঙালি হিন্দুর পূজার মওসুম। শারদীয়া দুর্গা পূজা দিয়ে এই বাৎসরিক মাতৃপূজার শুরু। এর পরে ক্রমান্বয়ে অনুষ্ঠিত হয় লক্ষ্মীপূজা, কালীপূজা, কার্তিকপূজা, সরস্বতীপূজা, জগদ্ধাত্রী পূজা, বাসন্তীপূজা ও অন্নপূর্ণাপূজা। ভক্তদের অংশগ্রহণ ও আড়ম্বরের দিক থেকে এই দেবী পূজাগুলো প্রধান হলেও বাঙালি হিন্দুর আরও অনেক পূজা আছে। এই পূজাগুলো লোকায়ত দেবদেবীর পূজা। বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন সময়ে পারিবারিক অথবা সামাজিক পর্যায়ে এই পূজাগুলো অনুষ্ঠিত হয়। অধিকন্তু দৈনন্দিন পূজ্য হিসেবে আছে যার যার গৃহদেবতা। ইতিহাস পরম্পরায় পূজাপঞ্জিতে দুর্গাপূজাই অবশ্য সাম্প্রতিককালে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। এরপরেই কালীপূজার স্থান। অথচ একসময়ে দুর্গা ও কালীপূজা ছিল প্রধানত পারিবারিক। জমিদার ও ধনাঢ্য বৈশ্যরাই ছিল এর উদ্যোক্তা, বাকিরা দর্শক। পারিবারিক পূজা একসময় বারোয়ারি (বারো ইয়ার বা বন্ধু সম্ভবত) পূজায় রূপান্তরিত হয়। এ স্তর পেরিয়ে ইদানীংকালে দুর্গা ও কালীপূজা সর্বজনীন পূজায় রূপান্তরিত হয়েছে। সাধারণ হিন্দুদের অংশগ্রহণ ব্যাপক হওয়াতেই বোধহয় তা সম্ভব হয়েছে।
পূজার কাজ সংগঠন, চাঁদা সংগ্রহ, দেবী দর্শন, আরতি দর্শন ও প্রতিমা বিসর্জন ইত্যাদিতে সকল শ্রেণির হিন্দুর অংশ গ্রহণের নিরিখে বিচার করলে দুর্গা ও কালী পূজাকে সর্বজনীন না বলে উপায় নেই। কিন্তু এই উপাদানগুলোর বাইরে আরও দুটো উপাদান আছে। এর একটি হচ্ছে: ক. পূজার ভাষা ও খ. অন্যটি হচ্ছে পূজা অধিকার। ভাষার প্রশ্নে দেখা যায় দেবীকে আবাহন করার ভাষা অসর্বজনীন সংস্কৃত ভাষা। সংস্কৃত একটি মৃত ভাষা এবং এই অঞ্চলের কারোর মাতৃভাষা সংস্কৃত নয়। সংস্কৃতে পাণ্ডিত্য তো দূরের কথা, নিরানব্বই শতাংশ হিন্দুর এ ভাষা সম্বন্ধে কোনো ধারণাই নেই। এই অবোধ্য একটি ভাষায় পূজা করলে সাধারণ হিন্দুর নীরব দর্শক থাকতে হয়। দ্বিতীয় প্রশ্নটি হচ্ছে পূজার অধিকার সম্পর্কিত। দেখা যায় পূজার অধিকার কেবল মাত্র ব্রাহ্মণের। কোথাও অব্রাহ্মণ দুর্গা ও কালী পূজার অধিকার চর্চা করছে বলে শোনা যায় না।
এর চেয়ে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন আছে। সেটি স্বয়ং ‘পূজ্যাকে’ নিয়ে। দেখা যাচ্ছে হিন্দুদের একাংশের কাছে প্রিয় ঢাকাস্থ ‘রামকৃষ্ণ মিশন’ দুর্গা পূজার অংশ হিসেবে যে ‘কুমারী” পূজা করে সেই কুমারীও একটি ব্রাহ্মণ কন্যা। তারা কখনও অব্রাহ্মণ কুমারী কন্যাকে পূজা করেছেন বলে জানা নেই। অথচ এই ঐতিহ্য ‘রাম-কৃষ্ণ মিশনের’ গড়ে তোলার কথা নয়। কারণ ‘রামকৃষ্ণ মিশনের’ প্রাণপুরুষ স্বামী বিবেকানন্দ (নরেন্দ্রনাথ দত্ত) ১৮৯৮ সালে কাশ্মীরে একটি সাত-আট বছরের মুসলমান মেয়েকে মাতৃজ্ঞানে পূজা করেন (কৃষ্ণ কুমার দাস: প্রবন্ধ: কুমারী যখন দেবী: সংবাদ প্রতিদিন : কলকাতা : ২৬.৯.৯৮)। এই নিষ্পাপ ও পবিত্র মেয়েটি ছিল মাঝির কন্যা।
বিবেকানন্দের এই মহতী দৃষ্টান্তের পরেও দেখা যাচ্ছে রামকৃষ্ণ মিশনের ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণ কন্যাই পূজ্যা। এই ঘটনাটি দুর্গাপূজার সর্বজনীনতার পথে একটি বড় বাধা। এই বাধা দূর করা প্রয়োজন। কারণ পূজার অধিকারী ও পূজ্যা উভয়ই যদি ব্রাহ্মণ হয় তাহলে পূজাকে সর্বজনীন বলার কোনো যুক্তি থাকে না। বিশেষ করে পূজার ধারণাটিই যখন ভূমিপুত্রদের। আমরা জানি ‘পূজার’ ধারণাটি প্রাক-আর্য ও অবৈদিক। পূজা শব্দটিও ‘অষ্ট্ৰিক’, সংস্কৃত নয়। দ্বিতীয়ত পূজা প্রধানত তন্ত্রপ্রসূত দেবী ও মাতৃপূজা। তন্ত্র বেদ বিরুদ্ধ একটি শক্তি। অপরদিকে মাতৃপূজা বা দেবীপূজার রীতিও বেদে নেই। বেদে আছে যজ্ঞ ও দেবতাদের কথা। ব্রাহ্মণরা যেহেতু বেদে বিশ্বাসী তাই যজ্ঞ হচ্ছে তাদের কর্ম। এমতাবস্থায় মূল মালিকদের হাতে পূজার অধিকারটি ছেড়ে দেওয়াটা ন্যায়সঙ্গত নয় কি? এই ন্যায়সঙ্গত কাজটি যত তাড়াতাড়ি সমাধা হবে পূজা তত শীঘ্র প্রকৃত অর্থে সর্বজনীন হয়ে ওঠবে।
দেখা যাচ্ছে ইতোমধ্যেই দুর্গাপূজা উৎসবের রূপ নিয়েছে। এতে যোগ হয়েছে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও শিল্পকলা সৃষ্টির অপূর্ব উদ্যোগ। সব মিলে দুর্গাপূজা পরিণত হয়েছে মিলন উৎসবে। সামাজিক একাত্মতাবোধ, ধর্মীয় সহমর্মিতা, সমবায়ী দৃষ্টিভঙ্গি, যৌথ উদ্যোগ ও গণতান্ত্রিক দৃষ্টির মূর্ত রূপ হচ্ছে দুর্গাপূজা। এমতাবস্থায় সমানাধিকারের দৃষ্টিতে একদিকে পূজার অধিকার যেমন অবারিত করা দরকার, তেমনি দরকার তার ভাষা সংস্কার। এতে ধর্মীয় কোনো বাধা নেই। কারণ হিন্দুধর্মে রূপান্ত, পরিবর্তন ও পরিবর্ধন গ্রহণযোগ্য। প্রকৃতপক্ষে হিন্দুর সমস্যা ধর্মমতে নয়। মতের দিক থেকে সে উদার। কিন্তু আচার-অনুষ্ঠানে সে প্রবল। ঐতিহ্যের সাথে আচার-অনুষ্ঠানকে অহেতুক ও অযৌক্তিকভাবে যুক্ত করে সে এক অচলায়তন সৃষ্টি করে বসে আছে।
অচলায়তন ভাঙার দায়িত্ব বাঙালি হিন্দুর উপরাংশ নিতে পারত। কারণ সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশা লাঘব, বৈষম্য দূরীকরণ ও সাম্য প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার নিয়ে বাঙালি হিন্দুর উপরাংশ রেনেসাঁ করেছে বলে দাবি করে। তাদের শ্রেষ্ঠাংশ গত একশো বছরের মধ্যে প্রায়ই কমিউনিস্ট’ হয়েছে। কিন্তু তারা অর্থনৈতিক বৈষম্যের ওপর যত জোর দিয়েছে তার একাংশও দেয় নি হিন্দুর সামাজিক ও ধর্মীয় বৈষম্য দূরীকরণের ওপর। দিলে দুর্গাপূজাসহ সকল পূজা যেমন সত্যি সত্যি সর্বজনীন হয়ে ওঠত, তেমনি ধর্মটিও হয়ে ওঠত সর্বজনীন। তা বলে কি হবে না? হবে নিশ্চয়ই। কারণ ইতিহাস থেমে থাকে না। তবে পরিতাপের বিষয় হিন্দুর পরিবর্তনের গতি বড়ই শথ। সবকিছুর মত অর্থনীতির ক্ষেত্রেও হিন্দুর এই শথ গতি দেখে এর নাম দেওয়া হয়েছে ‘হিন্দু গ্রোথ রেইট’। সংসার যুদ্ধে ‘এন্টি-মানি’, অর্থনীতির ক্ষেত্রে ‘কমিউনিস্ট’ (মালিক না হয়ে ও পার্টির বকলমে সম্পদ নিয়ন্ত্রক) এবং সামাজিক-ধর্মীয় ক্ষেত্রে মা-মাসির অজুহাতে জাত-পাতে বিশ্বাসী বাঙালি হিন্দুর তথাকথিত বর্ণহিন্দুরা কি এই বদনাম দূর করতে এগিয়ে আসবে?