মহাত্মা গান্ধী – দাশরথি বন্দ্যোপাধ্যায়
চক্ষের সম্মুখে অনিত্য এই যে জগৎ, ইহার অন্তরাল রয়েছে অনন্ত এক মহাশক্তি। সেই শক্তি যে ব্রহ্ম ও ব্রহ্ম একই বস্তু। আবার ব্রহ্ম সগুণ ও নির্গুণ, সগুণ ব্রহ্মই ঈশ্বর বা ভগবান। সেই ভগবান নিজ শক্তি সহায়ে সৃষ্টি করেছেন জীব জগৎ ও চতুর্ব্বিশতি তত্ত্ব এবং ”তৎসৃষ্ট´ তবেবন্নু প্রাবিশৎ” সৃষ্টি করিয়া তাহারই ভিতরে তিনি সর্ব্বদা নিরবচ্ছিন্ন ভাবে বিরাজমান। তিনি আধার আধেয় দুই—ই আমার সময়ে সময়ে প্রয়োজন অনুসারে তিনিই নরদেহে এই জগতে আবির্ভূত হইয়া থাকেন। পুরাণ ইতিহাস চিরকাল তাহার সাক্ষ্য দিতেছে। আমাদেদর বৈষ্ণব শাস্ত্রে বিদিত আছে, ”অন্য চাংশকলাঃ সর্ব্বে কৃষ্ণস্তু ভগবান স্বয়ম” সেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কুরুক্ষেত্র সমরক্ষেত্রে তাঁহার প্রিয় শিষ্য অর্জ্জুনের নিকট উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করিয়াছিলেন,
”যদা যদা হি ধর্ম্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত।
অভ্যুত্থানমধর্ম্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম।।
পরিত্রাণায় সাধূনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাং।
ধর্ম্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।।”
‘যখনই ধর্ম্মের গ্লানি বা অধর্ম্মের অভ্যুত্থান হয়, সেই সময়ে সাধুদিগের পরিত্রাণ করিবার নিমিত্ত এবং দুরাচারীদিগকে ধ্বংস করিয়া ধর্ম্ম—সংস্থাপনের জন্য যুগে যুগে আমি এই ধরাধামে অবতীর্ণ হই।’
ধর্ম্ম, সমাজ, কৃষ্টি, সংস্কৃতি, মানব সমাজের নৈতিক জীবন প্রভৃতি যখন বিপন্ন হয় তখন দেখা যায়, সেই ভগবৎ শক্তিই সংস্কারকরূপে আধিকারক পুরুষ বা সময়ে প্রয়োজন অনুসারে বিশ্বকল্যাণে অবতাররূপে এই ধরাধামে আবিভূর্ত হইয়া থাকেন।
সমগ্র জগৎ যখন সাম্রাজ্যবাদিত্বের ও ধনতান্ত্রিকতার মোহে পরস্পরের মধ্যে হিংসা ও হানাহানিতে উন্মত্ত, একে অপরের শোষণে ও শাসনে ব্যস্ত ও তৎপর, পরস্পরের মধ্যে ভালবাসা, প্রেম বা ভ্রাতৃত্বের কোনও সন্ধান রাখে না, সেই যুগ—সন্ধিক্ষণে বিশ্বের রাজনীতি ক্ষেত্রে সেই ভগবৎ শক্তিই যেন একাংশে ভারতমাতার ক্রোড়ে মহাত্মা গান্ধীরূপে প্রকাশিত হইলেন। যুগোপয়োগী এই ঋষি বিশ্বজগৎকে শুনাইলেন এক অপূর্ব্ব প্রেমের বাণী, ”সত্য ও অহিংসা—রাজনীতিক্ষেত্রে অহিংসা”—এই অভিনব বাণী, আর ব্যক্তি মাত্রেরই স্বাধীনতায় আছে অধিকার এবং সেই স্বাধীনতা অর্জ্জন করিতে হইবে এই সত্য ও অহিংসা দ্বারা, আর দেখাইলেন হরিজনে প্রেম ও জাতি ধর্ম্ম—নির্ব্বিশেষে ভ্রাতৃত্বের ও মিত্রতার প্রেমের বন্ধন, আর ভারতের হিন্দু মুশ্লিম জটিল সমস্যার ঘোর দুর্দ্দিনে গাহিলেন সেই মিলনের গান, ”ঈশ্বর আল্লা তেরে নাম সবকো সম্মতি দে ভগবান” এবং অনিষ্টের বিরুদ্ধের করিলেন ইষ্ট সাধনের এক নব অভিযান, যে অভিযানে দেশমাতৃকা আজ হারাইলেন তাঁহার অন্যতম একটি শ্রেষ্ঠ সন্তান এবং সমগ্র বিশ্ব হারাইল প্রেমিক ও সত্যিকারের দরদী বন্ধু এক জন।
বিশ্বের রাজনৈতিক গগনে নবরাগে রঞ্জিত এই উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক অভিনব রাজনৈতিক জাতির জনক পুণ্যভূমি ভারতভূমির মহান আদর্শে অনুপ্রাণিত এই মহাত্মাজীর নশ্বর জীবন ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির রীতি অনুযায়ী আজ এক আততায়ীর হস্তে ধ্বংস হইল। হায়! কি দুদ্দৈব বিধাতৃ—লিখন। এই নিকৃষ্ট আদর্শবাদী আততায়ী নিমিত্ত মাত্র, কারণ তিনি আজ মৃতুঞ্জয়ী, কিন্তু ”আজ কাঁদিছে বিশ্ব কাঁদিছে প্রকৃতি।”
মনে পড়ে আজ শ্রীরামকৃষ্ণালোকে উদ্ভাসিত বিশ্ববিশ্রুত যুগাচার্য্য স্বামী বিবেকানন্দের কথা, যাঁহার অন্তরাত্ময় জেগেছিল সমগ্র বিশ্বের কল্যাণ, যাঁর হৃদে ফুটেছিল ভবিষ্যৎ এক প্রেমের জগৎ! মনে পড়ে আজ তাঁর সেই মর্ম্মস্পর্শী বাণী—”ব্রাহ্মণ ভারতবাসী, চণ্ডাল ভারতবাসী, দরিদ্র ভারতবাসী, পণ্ডিত ভারতবাসী, মূর্খ ভারতবাসী …কটি মাত্র বস্ত্রাবৃত হইয়া সদর্পে বল ভারতবাসী আমার ভাই…আর মনে পড়ে, আজ সারা বিশ্ব যখন পাশ্চাত্য সভ্যতার জড়বাদিত্বের ও হননকারী বৈজ্ঞানিক যুগের মাদকতায় অন্ধ ও উন্মত্ত, আমেরিকার অন্তর্গত ধনজনমুখরিত শিকাগো শহরে সেই ধর্ম্ম মহাসভার অধিবেশন ও বিশ্বের আধ্যাত্মিক গগনের সূর্য্যস্বরূপ ও ও মহাজ্ঞানের আকর স্বায়ী বিবেকানন্দ এই পুণ্যভূমি ভারতভূমির পরম সম্পদ ধর্ম্মের বার্ত্তা সেখানে বহন পূর্ব্বক যখন বজ্রকণ্ঠে উচ্চচারণ করিলেন প্রাচ্য প্রতীচ্যের মিলনের সেই অমৃতত্বের বাণী—”সর্ব্বং খল্বিদং ব্রহ্ম নেই নানাস্তি কিঞ্চন” একমাত্র চৈতন্য বা আত্মা সর্ব্বত্র বিরাজমান ও সর্ব্ব ভূতে তাহার একত্ব অনুভূতিই মাত্র প্রকৃত ধর্ম্ম, সর্ব্বভূতে সেই প্রেমত্ব বয়, নাহি যেথা ভেদাভেদ নাহি সেথা জাতিভেদ শূদ্র কি ব্রাহ্মণ সকলেই সেই এক অমৃতের সন্তান।
”ব্রহ্ম হতে কীট পরমাণু সর্ব্বভূতে সেই প্রেমময়,
মন প্রাণ শরীর আপন কর সখে এ সবার পায়।
বহু রূপে সম্মুখে তোমার ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর। জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।”
এই মহীয়ান আদর্শে প্রভাবান্বিত গান্ধীজীর কথা মনে পড়ে আজ বিলাতে রাউণ্ড টেবিল বৈঠকে গান্ধীজীকে যখন আহ্বান করা হইল, স্বাধীনতার এই নির্ভীক সৈনিক ও বীর সাধক কটিমাত্র বস্ত্রাবৃত হইয়া রাজ—দরবারে উপস্থিত হইয়া যখন সদর্পে ঘোষণা করেলেন ”আমি আমার ভারতবাসীর স্বাধীনতা লাভের জন্য আজ আপনাদের দ্বারে উপস্থিত, আপনারা আমার কামনা পূর্ণ করুন।” কি প্রগাঢ় স্বদেশানুরাগ ও স্বদেশবাসীর প্রতি প্রীতির নিদর্শন!
আবার যখন সাম্রাজ্যবাদিত্বের ও ধনতান্ত্রিকতার মোহে আচ্ছন্ন, বিলাতের প্রাক্তন প্রধান মন্ত্রী মিঃ চাচ্চির্চল ইঁহাকে আখ্যা দিয়াছিলেন—Half necked seditious Fakir’—”অর্দ্ধনগ্ন ফকির,” তখন তিনি ইহার প্রত্যুত্তরে বলিলেন—”হে আমার প্রিয়বন্ধু! ফকির হইতে আমি বহু দিন যাবৎ চেষ্টা করতেছি বটে, কিন্তু নগ্ন হওয়া আরও কঠিন ব্যাপার, আপনি আমাকে এই আখ্যা দিয়া প্রকারান্তরে আমার সম্মান ও গৌরব বুদ্ধিই করিয়াছেন। হে বন্ধু! আপনি আমাকে বিশ্বাস করুন ও কাজে নিযুক্ত করিয়া আমাকে দেশের সেবা করিবার সুযোগ দিন!” কি নিরভিমান ও দীনতার পরিচয়। মনে হয়, যেন নিকৃষ্ট অহংটা স্তব্ধ হইয়া গিয়াছে।
আবার পাশ্চাত্য জগৎকে স্তম্ভিত করিয়া দেয় যখন তাহারা দেখে, ছলনাকারী এই বৈজ্ঞানিক যুগে সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে তাহার অহিংসার সংগ্রামের রীতি!—”হে বৃটিশ বন্ধু! তোমরা স্বেচ্ছায় ভারত ত্যাগ কর, স্বাধীনতার জন্মগত অধিকার হইতে আমাদে বঞ্চিত না করিয়া প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের ভ্রাতৃত্ব ও মিত্রতার মধুর মিলনের দ্বার উন্মুক্ত করিয়া দাও, নচেৎ সত্যাগ্রহ বা আমরণ অনশন—ব্রত গ্রহণ করিয়া জীবন আহুতি দিব।”
আবার সমগ্র বিশ্বকে বিস্ময়ে হতবাক হইতে হয়, কারণ ইতিহাস কি পুরাণে সংগ্রামের যাহা আছে পরিচয় তাহার মদ্যে আছে ধ্বংস বা নিষ্ঠুরতা, এমন কি কুরুক্ষেত্রে প্রমুখ ন্যায় ও ধর্ম্মযুদ্ধেও আছে ধ্বংসের মধ্যে নিষ্ঠুরতা, কিন্তু স্বাধীনতার মূর্ত্ত প্রতীক এই মহান পুরুষের অদ্ভূত সংগ্রামে নাহি হিংসা নাহি নিষ্ঠুরতা—ইহাই বিশ্বে তাঁহার একটি অভিনব দান।
জন্মভূমির অথনৈতিক, সামাজিক ও নৈতিক জীবনকে দুর্দ্দশাগ্রস্ত দেখিয়া শাক্যসিংহের ন্যায় ভোগৈশ্বর্য্যের চরম অধিকারী হইয়াও অনিত্য ভোগ তুচ্ছ জ্ঞানে, সমাজের নিকৃষ্ট স্তরের জীবিকাবলম্বীদের ন্যায় জীবনযাপন পূর্ব্বক একাত্মবোধে আচণ্ডাল দুঃস্থের সেবা করিয়া দেখাইলেন তিনি হরিজনে প্রেম এবং তাঁহার আদর্শ বিশ্বের মাঝে প্রতিপন্ন করাইল যে সত্যই তিনি এক জন মহাত্মা।
আধ্যাত্মিক গগনের ভাস্কর স্বরূপ স্বামী বিবেকানন্দ উচ্চৈচঃস্বরে ঘোষণা করিয়াছিলেন—Lord Sri Ramkrishna can do create thousands of Swami Vivekananda from the particles of dust’’ যে ”শ্রীরামকৃষ্ণ ধূলিকণার মধ্য থেকে সহস্র সহস্র স্বামী বিবেকানন্দ সৃষ্টি করতে পারেন, সেই শুদ্ধ সত্ত্বগুণের ঐশ্বর্য্যবিশিষ্ট আধ্যাত্মিক চরম উৎকর্ষ শ্রীরামকৃষ্ণ এক দিন তাঁহার অতি সহজ ও সরল ভাষার ব্যক্ত করিয়াছিলেন—”দেখ, যেখানে দেখবি দশ জনে গণে মানে সেখানে জানবি মা জগদম্বার প্রকাশ—তিনিই প্রকাশিতা হইয়াছেন,”—যিনি সময়ান্তরে ব্যক্ত করিয়াছিলেন, ”মা বলেছেন, মা ও আমি এক” (যেমন Lord Jesus বলিয়াছিলেন, ‘‘I and my Father in Heaven are one’’ আমি ও আমার স্বর্গীয় পিতা একই বস্তু।” আবার গীতার ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জ্জুনকে লক্ষ্য করিয়া যেমন বলিয়াছিলেন, ”যদ যদ্ধি ভূতি মৎ সত্ত্বং…’
যেখানেই শক্তির বিকাশ সেখানেই আমার সত্তা বর্ত্তান…
তাই আজ ভারতমাতার শীর্ণ দুর্ব্বল এই সন্তানটির মধ্যে বিশ্ব দেখিল, অমিত বিক্রম ও সেই মহাশক্তির খেলা।
মহাকালের বিধানে—নশ্বর দেহ বিনষ্ট হইয়া দেহীতে মিলিল, কিন্তু বিশ্বে রহিল অমর কীর্ত্তিসম্পন্ন পুণ্য আদর্শ আর রহিয়া গেল সাম্প্রদায়িকতার বহ্নি—নির্ব্বাণের জ্বলন্ত আদর্শ;—যমুনা—তীরে আত্মাহুতির সেই লেলিহান চিতানল শিখায়—রচনায় এক ভবিষ্যৎ অখণ্ড ভারত।
হে মহান আদর্শবাদী হৃদিবান নিঃস্বার্থ বিশ্বের প্রেমিক, ভারতের স্বাধীনতার ওহে অগ্রদূত। তোমার চরণে আজ কোটি নমস্কার!
ওঁ শান্তি! ওঁ শান্তি!! ওঁ শান্তি!!!