মহাত্মা গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথ – সি.এফ.এণ্ডরুজ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরে মহাশয়ের প্রতি গভীর প্রীতি ও শ্রদ্ধার উদ্রেকের অল্পকাল মধ্যেই আমি মহাত্মা গান্ধীর প্রতিও অনুরূপ প্রীতি ও শ্রদ্ধান্বিত হই। ১৯১৩ সালে যখন দক্ষিণ আফ্রিকার অসহযোগ আন্দোলন সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অবস্থায় উপনীত হয়, সেই সময় রবীন্দ্রনাথ আমাকে সেখানে প্রেরণ করেন। দক্ষিণ আফ্রিকার অভাব ও প্রয়োজন সম্পর্কে কবিকে আমি সচেতন করিয়াছিলাম। আমার আন্তরিক ইচ্ছার আতিশয্যে তিনি আমাকে বলেন, ”বিলম্ব করিবেন না; আপনার যাওয়াই বিধেয়, দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়া আপনি তাঁহার কার্যে আত্মনিয়োগ করুন।” কবির আশীর্বাদ লইয়া আমি যাত্রা করি।
পরবর্তীকালেও, যখন আমি দক্ষিণ আফ্রিকায়, কেনিয়া, উগান্ডা, ফিজি, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি প্রদেশে আমার পরলোকগত বন্ধু উইলি পিয়ার্সনের সহিত যাতায়াত করি, প্রতিবারই কবি তাঁহার আশীর্বাদ আমায় পাঠাইয়াছেন, তথাকার অধিবাসিবৃন্দের ভিতর তাঁহার প্রীতির বাণী প্রচার করিতে আমায় বলিয়াছেন।
১৯১৯ সালে পাঞ্জাবে সামরিক আইনের ঘন দূর্যোগে কবি আমাকে আশ্রমে কালক্ষয না করিয়া ঘটনাস্থলে উপস্থিত হইতে বলেন, আমিও মহাত্মাজীর নেতৃত্বে সেখানে কর্মরত হই। অবশেষে কবির সম্মতিক্রমে মহাত্মাজী আমায় পুনরায় দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রেরণ করেন।
মালাবারের হাঙ্গামার সময়, যখন মোপলা ও হিন্দু উভয়েই ভয়াবহ নিপীড়ন সহ্য করিতে বাধ্য হইয়াছিল, মহাত্মা গান্ধী পুনরায় আমাকে উহাদের সাহায্যের নিমিত্ত তখন যাইতে অনুরোধ করেন। এই উদ্দেশ্যে আমি কবির অনুমতি প্রার্থী হইলে আশ্রমে আমার সহায়তার যথেষ্ট প্রয়োজন সত্ত্বেও কবি আমাকে মালাবারে দুর্গতদিগের সাহায্যার্থে যাইতে বলেন। মালাবারে আমার থাকাকালে কবি কোনদিনও আমার আশ্রম হইতে অনুপস্থিতিজনিত অসুবিধার উল্লেখমাত্র করেন নাই, অধিকন্তু আমাদ্বারা যেটুকু সম্ভব আর্তত্রাণে সাহায্য হইতেছে বলিয়া আনন্দ প্রকাশ করেন। বর্তমান ক্ষেত্রেও গুরুতর অস্ত্রোপচারের পর মহাত্মার অতিশয় অসুস্থাবস্থায় তাঁহার সন্নিধানে থাকিবার নিমিত্ত কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (আশ্রমে তাঁহাকে আমরা সকলে ”গুরুদেব” বলি) স্বেচ্ছায় ও আনন্দে দ্বিধামাত্র না করিয়া আমাকে পুনরায় শান্তিনিকেতন হইতে পুণায়, অতঃপর আন্ধোবিতে প্রেরণ করিয়াছেন। গ্রাম্য জীবনের আধাবিকাবহুল তৎকৃত ছোট গল্পগুলি কবির গদ্য রচনার শ্রেষ্ঠতমাংশ বিবেচিত হয়। কলিকাতা হইতে পলায়ন করিয়া গ্রামবাসী বিগের সহিত অবস্থান করিতে তিনি বড় ভালবাসিতেন। এই প্রকার নির্জন প্রবাসের সুযোগেই আমি কবি—হৃদয়ের গুরুত্ব ও গভীরতার পরিচয় পাইয়াছি। তাঁহার প্রকৃতি প্রীতি, নির্জনতার অভিলাষ, ভারতের পল্লী জীবনের প্রতি তাঁহার অসীম অনুরাগ এবং দরিদ্রের প্রতি সহজ ও সুগভীর সহানুভূতি এই সময়ে পরিস্ফুট হইয়া উঠে। শান্তিনিকেতনে বিচিত্র কর্মব্যস্ততার ভিতরেও কবির দরিদ্র—প্রীতি কদাপি ম্লান হয় নাই।
মহাত্মাজীর পূণ্য সঞ্চারী প্রভাব
মহাত্মা গান্ধীর জীবনে প্রথম ও গভীরতম অনুভূতি দুর্দশাগ্রস্ত দারিদ্র্যপীড়িতকে কেন্দ্র করিয়া পরিস্ফুট হইয়েছে। তাঁহার সহির দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রবাসকালে তাঁহার এই মহতী সহানভূতির পরিচয় পাইয়াছি। জাতি—বর্ণনির্বিশেষে দরিদ্রের প্রতি তাঁহার করুণা সমভাবে প্রবহিত দেখিয়াছি। অসহযোগ আন্দোলনের সময় বহুবার দেখিয়াছি তামিল শিশু ও নারী পরিবৃত হইয়া তিনি অবস্থান করিতেছেন। চালানী চুক্তিবদ্ধ হতভাগ্য মজুরদের প্রতি তাঁহার আন্তরিক প্রীতি কত গভীর আমি তাহা স্পষ্ট বুঝিয়াছি। আর্ত—মানব মাত্রের প্রতি তাঁহার করুণা বিদ্যমান। দারিদ্র—পীড়িতের প্রতি তাঁহার অনুকম্পা ও নিষ্ঠার নিদর্শন প্রকৃতপক্ষেই অতীব অতীব বিস্ময়জনক। ওতপ্রোতভাবে তাহারা তামার মন—প্রাণ অভিভূত করিয়েছে। ভারতবর্ষে পদার্পণ করিয়াই তিনি ইহারই পরিচয় নিঃশব্দে অবিরত দিতেছেন। বাক্যাপেক্ষা কার্য দ্বারাই পীড়িত নির্যাতিত, অক্ষম, রুগ্ন ও অসহযোগের প্রতি তাঁহার অপার করুণা প্রকটিত করিতেছেন।
অস্পৃশ্যতা দূরীকরণ তিনি সর্বপ্রথম কর্তব্য বলেন কেন? মাদক দ্রব্য ও পানীয় বর্জনের জন্য তিনি সাতিশয় নির্বন্ধ প্রকাশ করেন কেন? চরকায় সুতাকাটা ও বস্ত্রবর্জনের ব্যবস্থা প্রতি কুটীরে প্রচলনের প্রচেষ্টাই তাঁহার কর্মপদ্ধতির শীর্ষে স্থানলাভ করিয়াছে কেন? এই জন্য অর্থনীতির দোহাই তিনি দেন নাই, রাজনৈতিক কারণও তাঁহার নিকট সর্বপ্রকৃষ্ট নহে। বস্তুত তাঁহার নিকট ইহর প্রয়োজন সম্পূর্ণভাবে ধর্মমূলক। প্রাথমিক কর্তব্য হিসাবে তিনি এইগুলি গ্রহণ করিয়েছেন শুধু এই কারণেই যে, দরিদ্রতম ভারতীয় গ্রামবাসীকে দারিদ্রের শাপমুক্ত করিতে হইলে ইহাই প্রকৃষ্ট পন্থা। এই উপরে তাহার স্বীর পরিবারবর্গের প্রয়োজনমত খাদ্যবস্ত্রের সংস্থান করিতে পরিবে, অর্ধাহারী বা দূর্ভিক্ষাবস্থার সম্পূর্ণ অনাহারী থাকিয়া বৎসরের পর বৎসর আজীবন দুঃখ দারিদ্র ও ঋণভারে নিষ্পেষণ হইতে অব্যাহতি লাভ করিবে।
একদা মহাত্মা গান্ধীকে পত্রযোগে আমি জানাইছিলাম যে, অস্পৃশ্যতা বর্জন যেরূপ প্রাধান্য পাওয়া উচিত তাহা না হইয়া জাতীয় আন্দোলন গঠন উদ্দেশ্যে পরিণত হইতে চলিয়াছে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই ক্রমশ তৎ—পরিবর্তে মুখ্য প্রতিভাত হইতেছে। মহাত্মাজী ঐ পত্রের উত্তরে লেখেন যে, যতদিন তিনি এই আন্দোলনে সহিত সংশ্লিষ্ট থাকবেন, ততদিন আমার এরূপ আশঙ্কার কোন কারণ নাই। কেননা, তাঁহার জীবনের গূঢ়তম সত্তা এই সমস্যা—কেন্দ্রিক। বস্তুত এই বিষয়ে তাঁহার নিজের অনুভূতির সুগভীরত্বের জন্যই তিনি এই বিষয়ে সমধিক বাগবিন্যাস করিতে পারেন না।
উক্ত পত্রে আমি আর একটি বিষয়ের আলোচনা করিয়াছিলাম, মাদক দ্রব্য ও সুরা পানের সম্বন্ধে। মহাত্মা গান্ধী পানদোষ বর্জনের উপরও সমতুল্য গুরুত্ব আরোপ করেন। সুরা ও মাদক দ্রব্য ব্যবহারের ফলে ভারতবর্ষে অতি দ্রুতভাবে অধঃপতনে অগ্রসর হইতেছে। মহাত্মা গান্ধী যথাসাধ্য এই দুর্দশা হইতে মুক্তির প্রচেষ্টা করিতেছেন। কেবলমাত্র এই পানদোষ ও মাদক দ্রব্যের নেশার জন্য দরিদ্র লোকে কোনমতেই দুঃখ—দৈন্য হইতে অব্যাহতি লাভের নিমিত্ত প্রকৃষ্ট প্রচেষ্টা করিতে পারে না। মহাত্মা গান্ধী আধুনিক যুগের এই দুরপনেয় কলঙ্কের কৃতপ্রতিজ্ঞ বিরুদ্ধপন্থী। আমার জ্ঞাতসারে, অদ্যকার দিনে মহাত্মা গান্ধীর ন্যায় সমগ্র জগতের (কেবলমাত্র ভুক্তভোগী ভারতবাসী নয়) দরিদ্র—বন্ধু অপর কেহ নাই, দরিদ্রের জন্যে তাঁহার মত আজীবন কঠোর ত্যাগ স্বাকীর কেহই করেন নাই।
উভয়ের মানব প্রীতি
এই প্রবন্ধে যথাসাধ্য প্রাঞ্জলভাবে আমি মহাত্মা গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতি আমার শ্রদ্ধা ও প্রীতির নিষ্ঠা এবং উদ্রেকের কারণ নির্দেশ করিয়াছি। উভয়ের মধ্যেই সমানভাবে জাজ্জ্বলামন মানবপ্রীতি এবং নির্যাতন ও দারিদ্র্যপীড়িতের সেবার আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়।
শুধু কণ্ঠনীতিতেই নয়, সাক্ষাৎ কর্মক্ষেত্রেও কবি অনুরূপ কর্মসাফল্যের পরিচয় দিয়াছেন। কর্মপথের ধূলিতে কবি স্বয়ং অবতীর্ণ হইয়াছেন। মহাত্মা গান্ধীর ন্যায় তিনিও দরিদ্রের সহিত একত্র বাস করিয়া তাহাদের দুঃখ—দৈন্যের ভার বহন করিয়াছেন। ইহাদের উভয়েরই এক মত যে, দেশসেবিবৃন্দ যতদিন না সমস্যার আদ্যন্তস্থিত অন্তিম দরিদ্রগ্রস্ত, সমাজে সর্বনিম্নস্থ, সর্বহারা হতভাগ্যের শেষ তৎপর না হইবেন ততদিন ভারতের স্বাধীনতালাভ কদাপি হইবে না। বাস্তবিকপক্ষে ইহই সমগ্র সমস্যার মূল কেন্দ্র এবং এই কারণেই আমার চিত্ত এতদূভয়ের প্রতি এরূপ গভীরভাবে আকৃষ্ট হইয়াছে।
উভয় জাগ্রত দেশাত্মবোধ
স্বদেশ প্রীতির ক্ষেত্রেও উভয়েই সমগ্র মন—প্রাণ দিয়া ভারতবর্ষকে ভালোবাসেন। উভয়েই এক্ষেত্রে আমার গুরুস্থানীয়। ভারতভূমিতে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন বলিয়া উভয়েই সর্বান্তঃকরণে আনন্দ প্রকাশ করেন। ভারতের অপমানে (১৯১১ সালে পাঞ্জাবের দূর্ঘটনা উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায়) তাঁহাদের স্বঃস্ফূর্ত অবদান মানবতার আত্মবোধ নিদর্শন। সেই সময় আমি উভয়ের সহিত অবস্থান করিয়াছি। তাঁহাদের প্রত্যেকেরই মানসিক ক্লেশ ও অসহ্য অশান্তির আমি প্রত্যক্ষদর্শী। সামরিক আইনের অজুহাতে সেই নিদারুণ অত্যাচারের ফলে স্তম্ভিত বিস্ময় ও দ্বিধার ভাগ ভঙ্গ করিয়া কবি রবীন্দ্রনাথ যেভাবে সর্বপ্রথম প্রতিবাদ জ্ঞাপনে অগ্রসর হইয়াছিলেন, তাহা কি কখনও, কেহ ভুলিতে পারেন? ক্ষুব্ধ ক্রোধবশে তিনি ‘স্যার’ উপাধি প্রত্যাখ্যান করিয়া জ্বালাময়ী ভাষার যে পত্র রচনা করেন, তাহার দরুণ সমগ্র বিশ্বলোকে ঐ জঘন্য অত্যাচারের জটিল গুরুত্ব উপলব্ধি করিতে সমর্থ হয়। এই পত্রই সম্ভবত অসহযোগ আন্দোলনের সর্বাধিক জ্বলন্ত ও প্রাথমিক নিদর্শন। রবীন্দ্রনাথ এই পত্র কলিকাতার যখন রচনা করেন, আমি তাঁহার সহিত তখন অবস্থান করিতেছিলাম। তাহার অব্যবহিত পূর্বে আমি বোম্বাইতে মহাত্মা গান্ধীর নিকট ছিলাম। এ সময় মহাত্মার মনের অশান্তি ও গ্লানি আমি প্রত্যক্ষভাবে অবগত আছি। অবিলম্বে পাঞ্জাবে গিয়া কারাবরণের সঙ্কল্প হইতে তাঁহাকে বহু কষ্টে নিবৃত্ত করা হয়। ঠিক করিয়াছিলাম কিনা জানি না, কিন্তু তাঁহাকে পাঞ্জাব গমনের সঙ্কল্প হইতে নিবৃত্ত করিতে আমিও প্রবৃত্ত হইয়াছিলাম। আমার বিশ্বাস, সে সময় তখনও আসে নাই। ব্যাপারটির উল্লেখ করিবার উদ্দেশ্য আমার এই যে, এই সময় আমি প্রত্যক্ষ করিয়াছি, দেশের সেই সঙ্কটকালে উভয়েরই স্বাধীনচেতা সৎসাহস, জুলুমবাজীর বিরুদ্ধে তীব্র আক্রোশ, ফলাফলের নিঃশঙ্ক উপেক্ষা এবং কর্তব্যপালনে প্রাণদানের আকুল আগ্রহ সম্যক পরিস্ফুট হইয়া উঠিয়াছিল।
ত্যাগ স্বীকারে অভিন্নতা
আমার এই প্রবন্ধের দ্বারা কোনরূপ ভ্রান্তি ধারণার উৎপত্তি আমার বাঞ্ছনীয় নয়। মহাত্মা গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মধ্যে মনস্বীতা এবং নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গীর অসামঞ্জস্য আমার অজ্ঞাত নহে! এই কারণেই রবীন্দ্রনাথ প্রত্যক্ষভাবে অসহযোগ আন্দোলনে যোগদান করেন নাই। কিন্তু এই পার্থক্য সত্ত্বেও উভয়ের মধ্যে একটা গভীরতর ঐক্যসূত্রের সাধন আছেন এবং তাহারই অনুসন্ধানে আমার প্রবন্ধটি রচিত। সাধারণ মানবের নিকট যাহা প্রিয় ও বিশেষভাবে কাম্য, উভয়েই আদর্শের খাতিরে তাহা বিসর্জন করিয়াছেন। হয়তো তাঁহাদের এই ত্যাগ স্বীকার উভয়ের ক্ষেত্রে বিভিন্নরূপে প্রকাশ পাইয়াছে, কিন্তু তাহার মূল উৎস একই।