মহাত্মা গান্ধীর মহাপ্রয়াণে প্রার্থনা – কৃষ্ণচন্দ্র চক্রবর্ত্তী
ওঁ পূর্ণমদঃ পূর্ণদিং পূর্ণাংপূর্ণামিদমূচ্যতে।
পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাবশিষ্যতে।।
হে অন্তর্য্যামী পূর্ণ পরমব্রহ্ম।—যে মহামানবের স্বর্গগত আত্মার কল্যাণ প্রার্থনায় আমরা শোকসন্তপ্ত হৃদয়ে আজ এই অনন্ত আকাশ—তলে সমবেত হয়েছি, তার মধ্যেই তুমি একমাত্র সৎ, চিৎ ও, আনন্দের বিকাশ করে তোমায় মহিমা ব্যক্ত করেছ। তোমারই সত্য, অহিংসা ও প্রেমের বাণী ও আদর্শকে বাস্তবে সেই দেবমানবের জীবনে মূর্ত্ত করে তুলেছ।
হে পরমপুরুষ পরমেশ্বর!—মহাত্মা গান্ধীর অন্তরে তুমিই এই নবযুগে, ভারতের নবজন্মে চল্লিশ কোটি নরনারীর সমষ্টি আত্মার অমৃতময় আকাঙ্ক্ষারূপ জাগ্রত হয়ে করেছ লীলায়িত তোমার মহিমাকে—সেই মহিমাকে তুমি প্রকাশ করেছ আত্মিক শক্তির বিজয়—গৌরব,—আজ তোমার’ কাছে আমাদেয় কাতর প্রার্থনা, যেন আমরা সেই মহিমাকে মাথা নত করে গ্রহণ করতে পারি।
হে জ্যোতির্ম্ময় স্বতঃপ্রকাশ!—তোমার যে জ্যোতিঃ মহাত্মাজীকে আশ্রয় করে এনেছে ভারতের এই স্বাধীনতা—সেই অনির্ব্বাণ আলোকেই অদূর ভবিষ্যতে ভারতে যেন সর্ব্ব—ধর্ম্ম—জাতি—সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় ঐক্য ও প্রেম। তার সাম্য, মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্বের আদর্শে ভারত যেন বিশ্বের কল্যাণে আত্মনিয়াগ করে। আমাদের এই আকুল প্রার্থনা যেন তোমার অমৃতময় চরণ স্পর্শ করে। তোমার জ্যোতিতে, জ্ঞান ও সত্যের আলোকে মহাত্মাজীর তপস্যা যেন বিশ্বমানবকে জ্যোতিষ্মান করে তোলে।
ন তত্র সূর্য্যঃ ভাতি, ন চন্দ্রকারকাঃ
নে মা বিদ্যুতেভান্তি—কুতোয়ম অগ্নিঃ।
তম্বেব ভান্তং অনুভাতি সব্বং
তস্যা ভাসা সব্বমিদং বিভাতি।।
হে সত্যম শিবম—সুন্দরম!—তুমি অণু হইতেও অণু যাহা, মহৎ হইতেও মহৎ যাহা—তারই মধ্য দিয়া বিশ্বরূপে প্রকটিত,—ঈশা বাস্যম ইদম সব্বম তারই মধ্যে তোমারই প্রেরণায় ঈষণায় লীলায়িত মহাত্মাজীর জীবনবেদ, তাঁরই জীবন্ত জাগ্রত আত্মিক সাধনায় কর পরিপূর্ণ এই নব ভারতকে, ভারতের পুণ্যতীর্থ বেদীতে আবার ধ্বনিতে হয়ে উঠুক—”সত্যমেব জায়তে নানৃতম,’— নব ভারতের আকাশে আবার বাজিয়া উঠুক সেই মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষির বাণী ও অনুভূতি—
শৃণ্বন্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রাঃ
আ যে মে দিব্যধামানি তস্থুঃ।
বেদাহমেতং পুরুষ মহান্তং
আদিত্যবর্ণং তমসঃ পরস্তাৎ।।
হে পুরুষোত্তম!—তুমি নিরাকার, নির্গুণ অপ্রকাশ, তুমি সাকার, সগুণ, স্বতঃপ্রকাশ। মানবের মধ্যে তোমার অবতরণ ও তোমার মধ্যে মানবের লীন যুগ যুগ ধরে সত্য হয়ে রয়েছে। তাই এই যোগের মানুষ, আনন্দের উপাসক। পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণের সাধক মহাত্মাজীর মধ্যে তোমার অবতরণ আমরা যেন করতে পারি অনুভব। মৃত্যুর মধ্যে যে অমৃতের জয়গান মানব—কল্যাণে গেয়েছেন তিনি, তা যেন তোমারই বাণীরূপে শুনতে পাই।
উদয়ের পথে শুনি কার বাণী
ভয় নাই ওরে ভয় নাই;
নিঃশেষে প্রাণ যে করিল দান
ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।
হে জগন্মাতা, বরাভয়দায়িনী, আদ্যাশক্তি!—আমরা তো তোমারই সন্তান—বিশ্বের অণু—পরমাণুতে তোমার যে অপার করুণা, স্নেহ, আশীর্ব্বাদ প্রাপ্ত হয়ে রয়েছে—যে সৎ, ও আনন্দের পরশ দিয়ে আমাদের মণ্ডিত করে রেখে, আজ তোমার সেই পরম স্নেহের সন্তান, জগতের শ্রেষ্ঠ মহামানব মহাত্মাজী আর আমাদের মধ্যে বাস্তব ভাবে নেই—তোমারই চরণে লীন হয়ে রয়েছে—পূর্ণ সমর্পিত হয়ে রয়েছে তোমার মধ্যে। আমাদের এমনি শক্তি ও ভক্তি দাও, যেন জীবনের প্রতি মুহূর্ত্তে অন্তরে তাঁকে পরমাত্মীয় করে রাখতে পারি। তোমারই বাণী নিয়ে বিশ্বশান্তির অগ্রদূত হয়ে তিনি ফিরেছেন আমাদের মধ্যে—আমাদের হৃদয়—দ্বারে আঘাত দিয়েছেন—তাঁর ডাকে আমরা যেন দিতে পারি অন্তরের সাড়া।
হে চিন্ময়ি পরমেশ্বরি!—তোমারই এক শ্রেষ্ঠ ভক্তের রক্তে দুই হাজার বৎসর পূর্ব্বে এই ধরিত্রী রঞ্জিত হয়েছিল, বিশ্বপ্রেমে মানব জাতিকে করেছিল জাগ্রত—আজ আবার তোমারই এক ভক্ত সন্তান হৃদয়ের রক্ত সিঞ্চনে তোমারই সত্য, অহিংসা ও প্রেমের আদর্শকে করলেন প্রতিষ্ঠা ও এই ধরণীর বুকে,—তোমারই বিজয় পতাকায় অঙ্কিত করলেন জীবনের জয়গান—দিয়ে গেলেন অমৃতের সন্ধান। তাই আমাদের ব্যথা, বেদনা ও অশ্রুভরা প্রার্থনা—যেন তাঁর মহৎ আদর্শকে জীবনের চির সাথী করে তুলতে পারি, যেন তাঁরই প্রেরণায় অনুপ্রাণিত হ’তে পারি।
হে অনাদি, অনন্ত শাশ্বত জগন্মাতা!—মহাত্মাজীর আদর্শে তোমার এই জগৎ নবজন্ম লাভ করুক। মানব—অন্তরে নেমে আসুক এই অনির্ব্বাণ জ্যোতির্ম্ময়ের আলোক, সেই অরূপের রূপ—বাজুক বিশ্বামানব—কষ্ঠে ”জয়তু গান্ধীজী।”
হে পুরুষোত্তম! স্থূল সূক্ষ্ম চরাচরব্যাপী সত্তা ও বিকাশ—আজ পুণ্যসলিলে মহাত্মাজীর পবিত্র চিতাভস্ম বিসর্জ্জনের শুভ লগ্নে তাঁর সত্তা ও বিকাশ তোমার পৃথিবী, জল, অগ্নি, বায়ু, আকাশ, চন্দ্রমা ও সূর্য্যনারায়ণে সর্ব্বত্র এক ওঁকাররূপে রইল ব্যাপ্ত হয়ে, যুগে যুগে মানুষের ইতিহাসে এক কল্যাণবীজ রইল নিহিত তোমার সৃষ্টি—যজ্ঞ পূর্ণ করে তুলতে, আত্মা তাঁর এক হইতে বছর মধ্যে রইল—বিগ্রহ হয়ে। এই সত্তা ও বিকাশ অক্ষয়, অমর, নিত্য সর্ব্বগত—অচ্ছেদ্য, অদাহ্য,—আজ সমস্ত অন্তর দিয়ে আমরা সেই ক্ষর ও অক্ষররূপী মহাত্মাকে প্রণাম করি। আমাদের এই আত্মনিবেদন, এই পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ, এই অন্তরের প্রণতি যেন পৌঁছে যায় তোমার চরণে—হে ভগবান। আজ তোমার ইচ্ছাই পূর্ণ হউক।
‘ওঁ ব্রহ্মাপর্ণং ব্রহ্মহবিঃ
ব্রহ্মাগ্নৌ ব্রহ্মনা হুতং।
ব্রহ্মৈব তেন গন্তব্যং
ব্রহ্মকর্ম্মসমাধিনা।। ওঁ তৎসৎ
অসতো মা সদগময়ো
তমসো মা জ্যোতির্গময়ো
মৃত্যোর্মা। অমৃতং গময়ো।।
ওঁ শান্তি, ওঁ শান্তি, ওঁ শান্তি।