মহাত্মা গান্ধীকে নিয়ে যত কবিতা

সূর্য্য-বীজ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

শতাব্দী যায় গড়িয়ে
—সময়—সমুদ্রের সামান্য একটা ঢেউ।
হে কালের অধীশ্বর
অন্য মনে তুমি কি থাক ভুলে?

পৃথিবীর আবর্ত্তিত অন্ধ নিয়তির চক্রে।
মানুষের ইতিহাস হিংসার বিষে ফেনিল।

ক্ষুব্ধ যারা, লুব্ধ যারা, মাংসগন্ধে মুগ্ধ যারা
একান্ত আত্মার দৃষ্টিহারা, শ্মশানের প্রান্তচর
আবর্জনা—কুণ্ড ঘিরে, বীভৎস চীৎকারে’
নির্লজ্জ হিংসায় তারা, হানাহানি করে,—
‘মানুষ জন্তুর হুহুঙ্কার’ দিকে দিকে বেজে ওঠে।
তুমি কি তখনও নির্লিপ্ত নির্বিকার?

মন বলে,—না।
যুগে যুগে তুমি পাঠাও তোমার দূত
—সূর্য্যংশের অনির্ব্বাণ প্রাণ—শিখা।
দেশে দেশে হৃদয়ে হৃদয়ে সমস্ত দীপ যখন নির্ব্বাপিত,
মৃত্যুর তমিস্রায় সমস্ত পৃথিবীর যখন নিমগ্ন,
অকম্পিত সে শিখা
তখনও জ্বলে পরম দুঃসাহসে,
অন্ধ রাত্রির সমস্ত বিভীষিকাময় ভ্রূকুটির বিরুদ্ধে দাঁড়ায় একা ;
বলে,—এ দ্যুলোক মধুময়, মধুময় পৃথিবীর ধূলি।

এই শিখা বার বার আমাদেরই মাঝে জন্ম নেয়,
ধন্য করে
এই ধরণীর ধূলি—মলিন— শতাব্দী।

যে আধারে সে শিখা মূর্ত্ত হয়ে ওঠে,
সে আভার যায় ভেঙে;
তবু সে শিখা ত’ হারিয়ে যাবার নয়।

আকাশের তারায় আর একটু অপরূপ দীপ্তি
সে শিখা রেখে যায়,
পৃথিবীর শ্যামলতায় বুলিয়ে দিয়ে যায়
আর এক অনির্ব্বচনীয় স্নিগ্ধতা,
আকাশের নীলিমা তার কাছে পায়
রহস্য—নিবিড় আর এক মহিমা।

দেশে দেশে মানব—সত্যের যে সংশপ্তক বাহিনী
আজও সাজছে নিঃশব্দে চরম সংগ্রামের জন্যে,
যুগে যুগে যারা সাজবে,
তাদের মশালে সেই শিখারই আলো,
তাদের পতাকায় তারই অম্লান দীপ্তি।
কত শতাব্দীর ঢেউ
সময়ের সমুদ্রে হবে লীন,
মানুষের ইতিহাস কত আত্মঘাতী মুঢ়তায়
পথ হারাবে;
তবু সে কালের অধীশ্বর
হতাশ আমরা হব—না।

এই অকিঞ্চন পৃথিবীর মৃত্তিকায়
যে সূর্য্য—বীজ তুমি রোপণ করো
তা ব্যর্থ হবার নয়।
মোহাচ্ছন্ন বর্ত্তমানের সমস্ত কুজঝটিকা অতিক্রম করে’
সুদূর যুগান্তে তার সঙ্কেত প্রসারিত;
মানবতার গভীর উৎস—মূলে
অক্ষয় তার প্রেরণা।

হে মহাকাল, তোমার অনন্ত পারাবারে
আমরা ক্ষণিকের বুদবুদ,
তবু সেই সূর্য্য—শিখা যে আমাদের মাঝ
প্রতিফলিত হয়,
এই আমাদের গৌরব।

.

গান্ধীজী – সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত

”দিনে দীপ জ্বালি’ ওরে ও খেয়ালি! কি লিখিস হিজিবিজি?
নগরের পথে রোল ওঠে শোন ‘গান্ধীজী!’ ‘গান্ধীজী!’
বাতায়নে দ্যাখ কিসের কিরণ! নব জ্যোতিষ্ক জাগে!
জন—সমুদ্রে ওঠে ঢেউ, কোন চন্দ্রের অনুরাগে!
জগন্নাথের রথের সারথির কে রে ও নিশানধারী,
পথ চায় কার কাতারে কাতার উৎসুক নরনারী!
কৃষাণের বেশে কে—ও কৃশ—তনু—কৃশাণু পুণ্যছবি,—
জগতের যাগে সত্যাগ্রহে ঢালিছে প্রাণের ছবি!
কৌসুলি—কুলি করে কোলাকুলি কার সে পতাকা ঘেরি’,
কার মৃদুবাণী ছাপাইয়া ওঠে গর্ব্বী গোরার ভেরী!
ক্রোর টাকা আর ভিক্ষা—ঝুলিতে, অপরূপ অবদান,
আগুলিয়া কারে ফেরে কোটি কোটি হিন্দু—মুসলমান!
আত্মার বলে কে পশু—বলের মগজে ডাকায় ঝিঁঝিঁ
কে রে ও খর্ব্ব সর্ব্বপূজ্য?—’গান্ধীজী’! গান্ধীজী!’
* * * *
এশিয়ার হক, হারুণের স্মৃতি, ইসলাম—সম্মান,—
মর্ম্ম—বীণার তিন তারে যার পীড়িয়া কাঁদাল প্রাণ,
দরাজ বুকেতে সারা এশিয়ার ব্যথার স্পন্দ বহি,
সব হিন্দুর হ’য়ে যে, খোলসা খেলাফতে দিল সহি,
চিত্ত—বলের চিত্র দেখায়ে গেল যে পূর্ণ সাড়া,
সত্যাগ্রহ—ছন্দে বাঁধিল ঝড়েরে ছন্দ—ছাড়া,
প্রীতির রাখী যে বেঁধে দিল দুহুঁ হিন্দু—মুসলমানে,
পঞ্চনদের জালিয়াঁর জ্বালা সদা জাগে যার প্রাণে,
ভারত—জনের প্রাণ হরণের হরিবারে অধিকার
নৈযুজ্যের হ’ল সেনাপতি যে রথী দুর্নিবার,
বিধাতার দেওয়া ধর্ম্ম রোষের তলোয়ার যার হাতে
সোনা হ’য়ে গেছে সত্যাগ্রহ—রসায়ন—সম্পাতে;
ঘোষি’ স্বাতন্ত্র্য শাসন—যন্ত্র আমলা তন্ত্র—সহ
অভয় মন্ত্র দিয়ে দেশ দেশে ফিরিয়ে যে অহরহ;
”মহাবাণী যার শকতি—আধার, অনুদার কভু নহে,
লুকানো ছাপানো কিছু নাই যার, হাটের মাঝে যে কহে—
স্বরাজ—প্রয়াসী জাগো দেশবাসী, স্বরাজ স্থাপিতে হবে,
ত্যাগের মূল্যে কিনিব সে ধন, কায়েম করিবে তপে।”
যা’ কিছু স্ববশে সেই তো স্বরাজ, সেই তো সুখের খনি,
আপনার কাজ আপনি যে করে—পেয়েছে স্বরাজ গণি;
স্বপাকে স্বরাজ, স্বরাজ—স্বকরে নিজের বসন বোনা;
স্বরাজ—স্বদেশী শিল্প—পোষণে স্বাধিকারে আনাগোনা,
স্বরাজ—আপন ভাষা—আলাপনে, স্বরাজ—স্ব—রীতে চলা,
স্বরাজ—যা’ কিছু অশুভ তাহারে নিজের দু’পায়ে দলা;
স্বরাজ—স্বয়ং ভুল করে তারে শোধরানো নিজ হাতে,
স্বরাজ—প্রাণীর প্রাণে আকার বিধাতার দুনিয়াতে।
সেই অধিকার দ্যায় যারা হাত প্রেষ্টিজ অজুহাতে,—
স্বরাজ—সে নৈযুজ্য তেমন আমলাতন্ত্র সাথে।
হাতে—হাতিয়ারে শিক্ষা স্বরাজ, স্ব—প্রকাশের পথে
স্বরাজ—সে নিজ বিচার নিজেরি স্বদেশী পঞ্চায়েত,
চরিত্র—বলে আনে যে দখলে এই স্বরাজের মালা,
কর—গত তার সারা দুনিয়ার সব দৌলৎশালা,
হাতেরি নাগালে আছে এর চাবী, আয়াস যে করে লভে,
অক্ষম ভেবে আপনারে ভুল কোনো না।’ কহে যে সবে;
আত্ম—অবিশ্বাসের যে অরি, মূর্ত্ত যে প্রত্যয়,
পরাজয় আজো জানেনি যে, সেই গান্ধীর গাহ জয়”।

.

গান্ধী-কথা – প্রভাতমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়

সেদিন গান্ধী বলিয়াছিলেন সাহসে বাঁধিয়া হিয়া;
‘ভারতবিভাগ হয় হবে মোর শবের উপর দিয়া’।
এবে যবে লীগে তুষ্ট করিতে সৃজিয়া পাকিস্তান
চাহিল ব্রিটিশ : কংগ্রেস তাতে রাজি হল, দীনপ্রাণ
জহরলাল ও প্যাটেলের মতে—ভেবেছিল এইভাবে
খণ্ডিত দেশে দু’দিকে মানুষ শান্তি ফিরিয়া পাবে।
ছ’হাজার বছরের সভ্যতা ক’টি মানুষের ভুলে,
ধ্বংস করিতে ধর্মান্ধের হাতে দেওয়া হল তুলে
এইভাবে ক্রুর স্বার্থান্ধের প্ররোচনে। অসহায়
গান্ধীজী শুধু দেখিলেন চাহি, বাধা নাহি দিলা তায়।
বাংলা ও পঞ্জাবের অংশ, সিন্ধু, বেলুচিস্থান,
যেথা মুসলিম সংখ্যায় বেশি, হইল পাকিস্তান।
হায়দরাবাদে করিল রাজভি, নিজামের অনুচর,
রাজাকার দল লয়ে উৎপাত হিন্দু প্রজার ‘পর।
কাশ্মীর লয়ে বাধিল বিবাদ; পাইতেই স্বাধীনতা
হাজার হাজার পাকিস্তানের সৈন্য পশিল তথা—
সম্মুখে রাখি লুণ্ঠনলোভী উপজাতি বর্বর।
কাশ্মীরে তারা বিভীষিকা সৃজি হইল অগ্রসর।
রাজধানী প্রায় যায় যায়, কাঁদের প্রজারা পরিত্রাহি—
রাজা মাগিলেন ভারতভূক্তি সেনা—সাহায্য চাহি।
হাজার হাজার ভারতের সেনা পৌঁছি আকাশযানে
বাধা দিল দ্রুত আততায়ীদের ধ্বংসের অভিযানে।
গ্রাম হতে গ্রামে শত্রুরে তারা ঠেলিয়া বাহির করি
অধেক পথ লয়ে গেছে যবে, সংগ্রাম পরিহরি
জানাল ভারত অভিযোগ জাতিসংঘের আদালতে।
আধা কাশ্মীর জুড়ি আততায়ী আছে বসি সেই হতে।
পাকিস্তানের স্পর্শা বেড়েছে প্রবলের প্রশয়ে।
অগস্ট মাসের পনেরো তারিখে দেশ গেল ভাগ হয়ে,
এল স্বাধীনতা বহুদিবসের বহু সাধনর ধন!
পাকিস্তানের হিন্দুরা সহি অসহ নির্যাতন
তখনো আসিছে পলায়ে ভারতে লাখে লাখে প্রতি মাসে,
আশ্রয়হীন পথে যাপে দিন: তাদের দুর্দশা সে
প্রতিহিংসায় আগুন জ্বালিল হিন্দুর অন্তরে,
পুন হল শুরু হত্যাকাণ্ডড। বৎসরকাল দরে
ছিল কলিকাতা অর্ন্তগূঢ় বিদ্বেষানলে ভরি,
এখন সময় অনুকূল জানি জ্বলিল তা ধু—ধু করি।
গান্ধীজী ছিলা মেথরপাড়ায় সে সময়ে দিল্লীর
রত হরিজন—উন্নয়নেতে, না রহিতে পারি স্থির
এলেন ছুটিয়া; বেলিয়াঘাটায় বসিলেন বাধা দিতে
ভ্রাতৃদ্বন্দ্বে, মুসলমানের ধনপ্রাণ রক্ষিতে।
শান্তিদূতের আগমনে কাজ হল মন্ত্রের মতো,
স্বাধীনতা—উৎসবে দু’পক্ষ গেল মিলিয়া আপাতত।
কিন্তু বিরোধ মিটিল না, মাঝে দিনকত চাপা থাকি
পুন হল শুরু। কাতরে গান্ধী উভয়পক্ষে ডাকি
বুঝালেন, তাতে না পাইয়া ফল, শুরু করি অনশন
চাহিলেন তিনি বিদ্বেষাগ্নি করিতে নির্বাপণ।
তখন তাঁহার জীবন বাঁচাতে শান্তি ফিরিল দ্রুত;
উভয় সম্প্রদায়ের নেতারা হলেন প্রতিশ্রুত
হিংসার স্রোত করিবারে রোধ। অনশন—অবসানে
গান্ধীজী ছাড়ি বঙ্গ তখনি ছুটিলা দিল্লীপানে।
পঞ্জাবী, কাশ্মীরী ও সিন্ধী বাস্তুহারার দল
সেথায় সেদিন হিন্দু ও শিখে করিয়াছে চঞ্চল।
লাঞ্ছিতা নারী, আহত পুরুষ হাজারে হাজারে আসি,
কহিয়া তাদের করুণ কাহিনী শান্তি দিয়াছে নাশি।
পাকিস্তানের নরপশুদের শান্তি না দিতে পারি—
স্থানীয় মুসলমানের উপরে শোধ নেওয়া হল তারি
নরপশুরূপে : জনতা লইল আইন হস্তে স্বীয়,
শুরু হল খুন, লুণ্ঠন আর গৃহদান নারকীয়।
মন্ত্রীরা ডাকি সৈন্য পুলিস ঠেকালেন হানাহানি;
পেল আশ্রয়শিবিরেতে ঠাঁই বহু সহস্র প্রাণীঃ।
ভগ্নহৃদয়ে ফিরি গান্ধীজী শিবিরে শিবিরে ছুটি
বিতরলিয়া সেবা সান্ত্বনা; যেথা কুশলকর্মে ত্রুটি
যা পড়িল চোখে তখনি জানায়ে কংগ্রেসী সরকারের
চাহিলেন প্রতিকার—ব্যবস্থা সে সবের। অবিচারে
স্বধর্মিগণ করে যে পাপ—প্রায়শ্চিত্তে তারি
করিলেন পণ দিবেন জীবন অনশনে দেহ ছাড়ি।
নেতারা মিলিয়া বিড়লা—ভবনে বাঁচাতে জীবন তাঁর
কথা দিলা সবে : উচ্ছেদ হবে সাম্প্রদায়িকতার,
নিজ নিজ সম্প্রদায়ের মধ্যে তাঁদের প্রয়াসফলে
মত্ততা গেল থামিয়া অচিরে দিল্লী নগরতবে।
গান্ধীজী মনে শান্তি লভিয়া লাগিলেন পুন কাজে।
বিশে জানুয়ারি দিতেছিলা তিনি প্রার্থনাসভা মাঝে
ভাষণ যখন—ফাটিল নিকটে বোমা, এক গৃহহারা
যুবা রোষান্ধ মারিতে তাঁহারে মেরেছিল তারি দ্বারা।
অবিচলচিতে মদনলালেরে ক্ষমিলেন সেইখনে
গান্ধীজী নাহি দিয়া গুরুত্ব। কি জানি কি ছিল মনে,
উনত্রিশে রাতে কথাপ্রসঙ্গে সাথীদের উদ্দেশে
কহিলা গান্ধী, ‘যদি আমি মরি দীর্ঘ রোগের শেষে
অথবা বিস্ফোটকের কারণে তোমরা সবারে বোলো—
”ঈশ্বরের বিশ্বাসী” বলি মোর দাবি নিরর্থ হল।
সেদিনের মতো হত্যাচেষ্টা যদি হয় পুন, মোরে
যদি কেহ মারে গুলি করি, কোনো কাতরোক্তি না করে
যদি মুখে লয়ে বিভুনাম আমি পারি ত্যজিতে এ প্রাণ—
তবে সে দাবি জীবন দিয়াই করিব সপ্রমাণ।’
শয়নের আগে পৌত্রীরে তাঁর কহিলা রাত্রিবেলা :
‘অদ্ভূত এই পৃথিবী, খেলিব কতদিন এই খেলা?’
ত্রিশে পুছিলেন কলম্বয়ার প্রতিনিধি যবে তাঁরে,
‘আশা যে রাখেন একশ’ পঁচিশ বৎসর বাঁচিবারে,
কিসে হেন আশা হল আপনার?’ ম্লান হাসি’ তিনি কন
সাংবাদিককারে : ‘সেই আশা আমি দিয়াছি বিসর্জন।’
‘কেন?’ এ প্রশ্নে কহিল গান্ধী : ‘এ ধরণীমণ্ডলে
অত্যাচারী ও ব্যভিচারীদের তাণ্ডবলীলা চলে—
এ আঁধারে আর বাঁচিয়া রবার ইচ্ছা আমার নাহি।’
বেদনাবিধুর কণ্ঠ কাঁপিল, ক্ষণিক নীরবে চাহি
রহি কহিলেন, ‘আমার সেবার থাকে যদি প্রয়োজন,
একশ’ পঁচিশ বশরই তবে রবে মোর এ জীবন।’
বিকালে এলেন বল্লভভাই উপদেশ নিতে কাজে,
ফিরিলেন যবে আলোচনা সারি তখন পাঁচটা বাজে।
প্রার্থনাসভা বসে প্রতিদিন নিয়মিত পাঁচটায়
দেরি হয়ে বুঝি গান্ধীজী চলিলেন দ্রুত পায়
রাখি দুই হাত মানু আর আর দু’টি পায়
দুই পাশে তাঁর। মঞ্চের কাছে আসিতেই জয়নাদে
জনতা তাঁহারে প্রণতি জানাল। গান্ধীজী যথারীতি
হাসিয়া দু’হাত তুলি করজোড়ে জানালেন স্বীকৃতি
চলিতে চলিতে। ভিড় ঠেলি আসি বাহিরি’ আচম্বিতে
মারাঠী যুবক দাঁড়াল সম্মুখে নত হয়ে। বাধা দিতে
গেল তারে মানু—চরণধূলির প্রার্থী ভাবিয়া তারে,
ধরি তার কর। ঠেলিয়া ফেলিয়া সবলে সে বালিকারে
তুলিল সে হাত; সহসা গরজি উঠিল সে হাতে তার;
তিন—তিনবার অনলোদগারী হিংস্র রিভলভার।
তিনটি গুলিই সিধা গান্ধীর বিঁধিল উদরে বুকে;
উদ্ধৃত বাহু আসিল নামিয়া, ‘হে রাম’ বলিয়া মুখে
চেতনা হারায়ে পড়িলা গান্ধী ক্ষণিক দাঁড়ায়ে রহি,
দরদরধারে নামিল রুধির খাদির চাদর বহি।
ফুল্লবদনে নিমেষে নামিল মৃত্যুর শ্যামছায়া।
ভক্ত গেলেন শেষনিবেদনে অর্পিয়া মরাকায়া;
কবি গেলা চলি জীবনকাব্য—রচনা করিয়া বাকী।
ক্লান্ত তনয়ে জননী নিলেন স্নেহ—অঞ্চলে ঢাকি।
ধূলিলুণ্ঠিত দেহ গান্ধীর ভক্তেরা তুলি লয়ে
গেল গৃহপানে; হাঁকিল জনতা, ‘গান্ধী অমর রহে।’

মহামানবেরে রেখেছিল মারি’ ভাইয়ে—ভাইয়ে মারামারি,
কোটি গৃহহারা মানবের ব্যথা, রমণীর আঁখিবারি,
অবোধ ভাইয়েরে অছুৎ বলিয়া অমানুষী অপমান,
ধর্মের নামে কপটতা আর মূকপশু বলিদান,
জিন্না, রাজভি, সুরাবর্দির হিংসা ঘৃণার ডালি,
মেরেছে বিহার, পঞ্জাব আর কলিকাতা, নোয়াখালি,—
মুসলিম লীগ, হিন্দুসভা ও বিপ্লবী রাজাকার,
মূঢ় কংগ্রেস ভারতবিভাগের সম্মতি দিয়া তার।
হিন্দু ও শিখ দিল্লীতে যারে মেরেছিল আগে থেকে—
সে ছাড়িল দেহ নিমিত্ত করি নাথুরাম গডসেকে।
চেয়েছিল বীর ছিঁড়ি পৃথিবীর হিংসার নাগপাশ
মুক্তি আনিতে : এবারের মতো বৃথা হোক সে প্রয়াস,
কে বলিতে পারে আগামী যুগে সে সফল হবে না কভু?
হিংসাদেবীর বেদীমূলে আজ সে হয়েছে বলি তবু,
কে বলিতে পারে, তার জীবনের স্থিরজ্যোতি দীপশিখা
জ্বালিয়া দীপালি করিবে না দূর ভবিষ্য—বিভীষিকা?

কাঁদিল ভারত, কাঁদিল পৃথিবী, জাতি হারাইল পিতা।
যমুনার তীরে চন্দনকাঠে ধু—ধু—ধু জ্বলিত চিতা।
মহাকারুণিক গেলেন শুধিয়া মোদের পাপের দেনা
বড়ো দুখে দহি। তাঁর দেনা দেশে আর কেহ শুধিবে না?

গান্ধী—কথা (প্রথম প্রকাশ, অক্টোবর ১৯৬) কাব্যগ্রন্থের অংশ বিশেষ।

.

বেঁচে আছ শুধু তুমি…. —ব্লীৎজ, পত্রিকার সৌজন্যে

আমরা সবাই মৃত।
আজ শুদু বেঁচে আছি তুমি—
বেঁচে আছ বাঁচিয়ে তুলতে আমাদের।
একটা দুর্ব্বার শক্তিকে পেছনে রেখে
তুলি চলে গেছ।
ক্ষয় নেই, শেষ নেই সেই শক্তির।
তোমারই সে অঙ্গুলি—সংকেতে
আমরা এতদিন চলেছি।
দ্বিধা—দ্বন্দ্ব —সংশয়ের অন্ধকারে
আজও তুমি আমাদের সারথি।
ইতিহাসে অমরত্ব—লাভ!
অতি সাধারণ সৌভাগ্য।
ইতিহাস তুমি যে স্বয়ং।।
অতীত, বর্ত্তমান, ভবিষ্যৎ—সে তুমি,
জাতির দেহ, মন, আত্মা—তাও তুমি।
আমাদের সত্তায় অনুভব করি তোমাকে
অনুভব করি আমাদের মূর্চ্ছিত চেতনায়—
প্রচণ্ড ঝড়ের সুগভীর সে অনুভূতি।
আশ্চর্য্য হই অন্ধ রাধার স্পর্দ্ধা দেখে
যখন সে তোমার গতিপথ রোধ করে দাঁড়ায়।
আরো আশ্চর্য্য হই
তুমি ক্ষমা করো তাকে।
তোমারই নিশ্বাসে অনুভব করি
আমাদের জীবন—
আমাদের প্রাণের স্পন্দন।
তুমি কি শুধু স্মরণীয়?
আত্মার আত্মা যে তুমি প্রতি মানবের।
অদৃশ্য সমাহিত শান্তির মধ্যে তুমি বসে আছ
মানবমৈত্রীর দৈববাণী কণ্ঠে নিয়ে।
হিংসায় ভরা পৃথিবীতে আজ উঠেছে
সেই বাণীর প্রতিধ্বনি।

জীবনের ঊর্ধ্বলোকে তোমার আসন,
তোমার তাই মৃত্যু নেই।
এই শোকার্ত্ত সংকীর্ণ পৃথিবীতে
তুমি যে মৃত্যুহীন আলোকস্তম্ভ!
নিশ্চল নিষ্কম্প দ্যুতি তুমি,
আশা তুমি,
আশ্রয় তুমি,
হিংস্র অন্ধকারের মধ্যে।
তুমিই ভরসা ব্যথাহত নিখিল মানবের,
দুঃখ ও দুর্দ্দৈবের একমাত্র ভ্রাতা তুমি।
শঙ্কা ও সন্দেহ,
বঞ্চনা ও বেদনা,
মাথা নত করে তোমার বিশ্বাসের কাছে।

হে সত্যাশ্রয়ী!
তোমারই উপলব্ধ সত্যের মধ্যে
উৎকীর্ণ হ’য়ে রইলো শাশ্বত জয়ের ঘোষণা
শত—শতাব্দীর ইতিহাসের পটে।

.

মহাশ্রাদ্ধ – বিমলচন্দ্র ঘোষ

দীর্ঘ যুগ অতিক্রান্ত অজ্ঞতার দীর্ঘ বিভাবরী
অতিক্রান্ত করেছে পৃথিবী
তবু তুমি হে—অভ্যাস রোমাঞ্চিত প্রাচীন অভ্যাস
অজ্ঞতার আষ্টে—পৃষ্ঠে অর্থহীন যুক্তির বন্ধনে
ঈশ্বরের জন্য দাও,
যে ঈশ্বর বাণী দেয় বুদ্ধিকে আত্মাভিমুখী করে
নির্বিরোধী মানুষের লঘুচিত্তে জাগায় বেদনা
যে ঈশ্বর জন্ম নেয় মানুষের ধ্যানের ঔরসে।
জাতক দেবত্ব পায়
আপন পিতৃত্ব ভুলে পিতা করে পুত্রের ভজন
অভ্যাসের দীর্ঘ তপে যে পুত্র ভূমিষ্ঠ নয় আজো
অনন্ত শ্মশান—ভস্মে অনন্ত অশ্রুর কলরোলে
ক্ষীরোদ লবণ দধি সমুদ্র—মন্থনে
অমৃতে ও হলাহলে
ঈশ্বরের মহাজন্ম তবু চলে প্রাচীন অভ্যাসে।
ঈশ্বর ঈশ্বর শোনো অতিপূজ্য অদ্ভূত ঈশ্বর
ঋষিশ্রাদ্ধে মাতৃশ্রাদ্ধে পিতৃশ্রাদ্ধে আজো শ্রাদ্ধ করি

মহাগুরুনিপাতনে শ্রাদ্ধ করি যুগ—যুগান্তর
নগ্নপদে নতমুখে একবস্ত্রে জনসিন্ধু তীরে
শ্মশান—বৈরাগ্যে গৌণ মন
ক্ষোভে দুঃখে অনুতাপে বিদীর্ণ বিহ্বল
শ্রাদ্ধ করি মহাভিক্ষু নিহত—পিতার
শ্রাদ্ধ করি শ্রদ্ধেয় আত্মার।

ক্ষমা প্রেমে অহিংসার শ্রাদ্ধের বাসরে
মুণ্ডিত মস্তকে মহাপাপের অনলে দগ্ধ মন
শ্রাদ্ধ করে স্বয়ং ঈশ্বর
অরক্ষিত জনকের নিহত আত্মার
অন্তরের বাণীমূর্তি শ্রাদ্ধ করে—মহামানবের
বিধাতার মহাশ্রাদ্ধ
ক্ষমা প্রেম শান্তি অহিংসার
পিতৃদ্রোহী ভগবান শ্রাদ্ধ করে আপন সত্তার।

.

শেষ প্রণাম – সজনীকান্ত দাস

ওই শোন ওই শোন বাজে
শোকার্ত ভারতের বিষণ্ণ অন্তর মাঝে—
জয়তু গান্ধীজী, প্রণাম গান্ধী মহারাজে।।

এ নাম একদা হবে দুঃখী—দুঃস্থজন আশা
নির্বাক মূঢ় মূক মুখে দিবে জীবনের ভাষা,
আনিবে চেতনা নব ও এ মৃত সমাজে।
জয়তু গান্ধীজী, প্রণাম গান্ধী মহারাজে—
 ওই শোন ওই শোন বাজে
শোকার্ত ভারতের অস্থির অন্তর—মাঝে।

যে আনিল এ কুটিল কুৎসিত হিংসার পাথারে
মা ভৈঃ মন্ত্র আজি নমি সেই মানুষের ত্রাতারে।
কবি সম্বল সবে নির্ভয় অহিংস—মন্ত্র
পার হবে সে পাথার ভেঙে লোভ—স্বার্থের তন্ত্র;
 হত্যা—হিংসা মুখ লুকাইবে লাজে।
জয়তু গান্ধীজী, প্রণাম গান্ধী মহারাজে—
 ওই শোন ওই শোন বাজে
শোকার্ত ভারতের শঙ্কিত অন্তর—মাঝে।।
পীড়িত পতিত ভীত মানুষের জন্য
 ধরণীতে হ’লে অবতীর্ণ।
যাদের জীবন ছিল ব্যবসার পণ্য,
 শোষণে শোষণে যারা জীর্ণ,
তুমি তাদের লাগি অনুখন ছিলে জাগি’,
অহিংস—পন্থায় শান্তির অনুরাগী—
পুড়ালে জীবন—দীপ সত্যের আলো মাগি’
 সংশয়—কালো করি দীর্ণ!
পীড়িত পতিত ভীত মানুষের জন্য
 ধরণীতে হ’লে অবতীর্ণ।।
তোমারে প্রণাম করি এ যুগের ভীষ্ম,
 প্রণমি নূতন—যুগ—বুদ্ধ,
মহাভারতের যীশু নমো নমঃ গান্ধী,
 ত্যাগ—হোমানল—পরিশুদ্ধ!
ত্যজি মরদেহভার আরো হ’লে আপনার
দেখালে ক্ষুব্ধজনে শান্তির পারাবার,
প্রেমের প্রদীপ জ্বালি সুনিবিড় এ আঁধার
 করিলে আলোক—সমাকীর্ণ।
পীড়িত পতিত ভীত মানুষের জন্য
 ধরণীতে হ’ল অবতীর্ণ।।

 এই হ’ল ভালো হে ভগবান,
 ধন্য তোমার মহাবিধান
মানব—প্রেমিক পুত্র তেমার
 মানুষের হাতে ত্যজিল প্রাণ।।

 আজো হিংসার বিরাম নেই,
 যুগে যুগে তাই ঘটিয়েছে এই,
 তোমার মহিমা প্রচারিতেই
 বিশ্বাসীদের আত্মদান।
 এই হ’ল ভালো হে ভগবান।।
হিংসার স্রোত রুধিতে পাঠাও
 অবতারদের বারংবার,
কভু পাপ কভু পুণ্য প্রবল—
 বিচিত্র তব এ সংসার!

 পাপ—পুণ্যের সে সংগ্রাম
 এখনো মথিছে সত্যধাম,
 এবার ধন্য গান্ধীনাম—
 সবে গাই তাঁর বিজয়—গান।
এই হ’ল ভালো হে ভগবান।।
 

___

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *