মহাত্মা – অতুলচন্দ্র গুপ্ত

মহাত্মা – অতুলচন্দ্র গুপ্ত

মানুষের ইতিহাসে হঠাৎ কখন এমন মানুষের আবির্ভাব হয় যাঁর জীবন মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্বন্ধের ধারণা ও অনুভূতিকে প্রচলিত স্তর থেকে অন্য স্তরে নিয়ে উপনীত করে। পশুর বংশে মানুষের জন্ম। এবং আদিম মানুষ বুদ্ধিমত্তা ও শারীরিক গড়নের বিশেষত্ব ছাড়া যে উঁচু শ্রেণির পশু থেকে আরও কিছুতে খুব ভিন্ন রকমের ছিল তা অনুমান করার কারণ নাই। মনের যেসব প্রবৃত্তি ও প্রেরণাকে সভ্য মানুষ সংক্ষেপে বলে হৃদয়বৃত্তি, তার অভাব দলবদ্ধ পশু ও দলবদ্ধ আদিম মানুষের সমান ছিল। নিতান্ত জৈবিক প্রয়োজনে যেসব সহজাত হৃদয়বৃত্তি, যেমন শিশু—অপত্যপরায়ণতা, কি দলের মধ্যে একটা সীমাবদ্ধ অবৈরতা আদিম মানুষের সমাজে অবশ্য ছিল। পশুর সমাজেও ছিল এবং আছে। তার বাইরে ছিল অবাধ নিষ্ঠুরতা—জীবনের প্রয়োজনে প্রকৃতির দান। এবং এ প্রয়োজনে প্রকৃতি যা দেয় তা প্রয়োজনের অতিরিক্ত করেই দেয়। তার বুদ্ধির সঙ্গে যোগ হয়ে মানুষের কৌশলী ক্রুরতা পশুর উগ্র ক্রুরতার চেয়ে ভীষণতর ছিল। আদিম মানুষের এই সমাজ দেশে দেশে সভ্য সমাজে পরিণত হয়েছে বহু হাজার বছরে। জৈবিক নিষ্ঠরতা মানুষ দমন করতে চেয়েছে গোপন করতে চেয়েছে, রূপান্তর করতে চেয়েছে বহু উপায়ে। মানুষের মানুষে শুধু অবৈধ ভাব নয়, মৈত্রী ও প্রীতি মনে জাগাতে চেয়েছে, শেষ পর্যন্ত বলেছে ‘মা হিংসীঃ সর্বভূতনাম’—কোনও প্রাণীকেও হিংসা করবে না, সকল প্রাণীর সঙ্গেই সম্পর্ক মৈত্রী ও প্রীতি সম্পর্ক। কেমন করে সম্ভব হল? ধীরে ধীরে এ পরিবর্তন এসেছে, অনেক হাজার বছর ধরে। কিন্তু সুদীর্ঘকাল আদিম মানুব সমাজের অবশ্যম্ভাবী অপৌরুষেয় পরিণতি এ নয়। এ পরিবর্তন এসেছে একদল অসাধারণ জীবন ও কর্মের ফলে। যখন কোনও সমাজের ধর্মবুদ্ধি অন্য সামাজিকের প্রতি কর্তব্যবুদ্ধির মান এক গ্রাম উপরে উঠে তার মূল্যে থাকে সে সমাজের কোন্য অসাধারণ মানুষের কল্পনা, কর্ম ও জীবন। ধর্ম ও কর্তব্যের নূতন আদর্শ তাঁর মনেই উদয় হয় এবং তাঁর কথায়, কর্মের ও জীবনে রূপ নেয়। এ নূতন আদর্শকে সাধারণ মানুষ তাদের জীবনে কতক নিতে পারে, কতক পারে না। কখনও তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। গদানুগতিকতার শত্রু ও শান্তিঘাতী এ আদর্শকে পিষে মারতে চায়। কিন্তু এ নূতন আদর্শ একবার প্রকট বলে পূরাতন জীবনের দ্বিধাহীন অঙ্গীকার অসম্ভব হয়। ধীরে বা ত্বরায় এ আদর্শের শ্রেষ্ঠত্ব সমাজের বহুজন মেনে নেয়, সে আদর্শ পালনের চেষ্টায় ত্রুটি যতই থাকুক। নানা সমাজের এইসব অসাধারণ মানুষের পরম্পরা আদিম নিষ্ঠুরতাকে ঘুচিয়ে সমাজকে ধাপে ধাপে নিয়ে গেছে মৈত্রী ও প্রীতির পথে;সমাজের মনে জাগিয়েছে নূতন নূতন ধর্মবোধ ও কর্তব্যবুদ্ধি। মানুষের সভ্যতার সুদীর্ঘ ইতিহাসে যাঁরা অপেক্ষাকৃত নবীন সেসব অসাধারণ মানুষের নাম ও পরিচয় আমরা কতক জানি। মহান তাঁদের মহাত্মা—প্রসারের প্রাচুর্যে ও অনুভূতির গভীরতায়। তাঁর আত্মা। মহাত্মা গান্ধী এই অসাধারণ মানুষ পরম্পরার একজন। সেই বংশে তাঁর জন্ম। তাঁর লৌকিক বংশ পরিচয় অবাস্তব।

সে যুগ মহাত্মা গান্ধীর জন্মকাল ও কর্মকাল সকল সভ্য সমাজে স্বীকৃত হয়েছে। তোমার প্রতিবেশীকে ভালবাসবে নিজেকে যেমন ভালোবাসো; তার সঙ্গে তোমার সম্বন্ধ মৈত্রীর সম্বন্ধ। এ আদর্শ পালনে সভ্য মানুষের বিচ্যুতির অন্ত নেই। কিন্তু এ আদর্শের শ্রেষ্ঠত্বকে অস্বীকার স্বাভাবিক অবস্থায় অল্প লোকেই করে। একে সম্পূর্ণ পালনের সামর্থ্যকে স্বীকার করে স্বার্থ ও প্রবৃত্তির ভিন্নমুখী টানকে প্রতিরোধের ইচ্ছার দুর্বলতার ফল বলেই। কিন্তু এ যুগে মানুষে মানুষে সম্বন্ধের যে আদর্শের দৈন্য প্রকট হয়ে উঠেছে এবং মানুষকে যা ভয়চকিত করছে সে হচ্ছে একদল মানুষের সঙ্গে অন্যদল মানুষের সম্বন্ধের আদর্শ, ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির নয়, দলের সঙ্গে দলের সম্বন্ধের আদর্শ। মানুষ নানা দল বাঁধতে বাধ্য হয়েছে—গোষ্ঠী, রাষ্ট্র, মহারাষ্ট্র, ধর্মমণ্ডল, ধর্মমহামণ্ডল পৃথিবীতে টিকে থাকার প্রয়োজনে, পশুর জীবনকে সভ্য মানুষের জীবনে পরিণতির জন্যে। কিন্তু দাম না দিয়ে কিছু পাওয়া যায় না। দল বাঁধা অর্থই অন্য দল থেকে পৃথক হওয়া, তাকে দূরে রাখা প্রতি দলের মানুষের দলের মধ্যে সম্বন্ধের আদর্শ মৈত্রী। এক দলের সঙ্গে অন্য দলের সম্বন্ধের আদর্শ কি? আমাদের দেশের ধর্ম শাস্ত্রকার সর্বদলের আচরিত এ আদর্শ সরল কথায় প্রকাশ করেছে—স্বরাষ্ট্রে হবে ন্যায়বৃত্ত আর পররাষ্ট্রকে করবে পীড়ন। ”স্বরাষ্টে ন্যায়বৃত্তঃ স্যাদভৃশদণ্ডশ্চ শত্রুষু”। ভাষ্যকার বলে দিয়েছেন শত্রু অর্থ পররাষ্ট্র। দলের সঙ্গে দলের এই শত্রুতাকে অবলম্বন করে কবিরা মহাকাব্য রচনা করেছেন, চারণেরা বীরগাথা গেয়েছেন, ঐতিহাসিক ইতিহাস লিখেছেন, জনসাধারণ বিজয়ীকে জয়মাল্য পরিয়েছে, তাকে মাথার মুকুট করে রেখেছে। মানুষের আদিম নিষ্ঠুরতার এই রূপান্তরকে পরম সম্মানের আসনে মানুষ বসিয়েছে।

কিন্তু এই কবিত্ব, গাথা ও জয়ধ্বনির মধ্যে আজকের মানুষকে থমকে দাঁড়াতে হয়েছে। মানুষের বুদ্ধি দলের সঙ্গে দলের দূরত্বকে কমিয়ে কমিয়ে পৃথিবীতে অতি ছোট করে এনেছে এবং অনেক দলের হাতেই এমন মারণ অস্ত্র দিয়েছে যে, যুধ্যমান দুই দলের পরস্পর পরস্পরকে প্রায় নিশ্চিহ্ন করার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। উপায় কি? নানা দলের যারা রাষ্ট্রনেতা তারা পরামর্শ সভা ডাকছেন। জটিল নিয়ম ও শৃঙ্খলার সমিতি গড়ছেন যাতে দলের সঙ্গে দলের স্বার্থের বিরোধ অস্ত্র সংঘাতের সীমায় যেয়ে না পড়ে। তার ভীষণ পরিণামের কথা সকলে সকলকে বোঝাচ্ছেন। নানা দলের এক বড় দল নানা দলের অন্য বড় দলকে শৃঙ্খলা ভঙ্গের প্রচণ্ড শাস্তির কথা স্মরণ করিয়ে সাজাচ্ছেন। ভয়ের ভয়ে যাতে সব দল শান্তি রক্ষা করে। এই সমস্যায় মহাত্মা আনলেন দলের সঙ্গে দলের সম্বন্ধের নূতন আদর্শ। যে সম্বন্ধ শত্রুতার নয়, সর্বনাশের ভয়ে অবৈরতার নয়, যে সম্বন্ধ মৈত্রীর সম্বন্ধ। দূরদর্শী স্বার্থের হিসাব নিকাশের সম্বন্ধ নয়, হৃদয়ের প্রীতির সম্বন্ধ। তত্ত্ব হিসাবে এ আদর্শ হয়তো একেবারে নূতন নয়। কিন্তু আদর্শ যতদিন তত্ত্বমাত্র থাকে ততদিন তা থাকে দার্শনিকের চিন্তার বস্তু, সাহিত্যিকের সাহিত্যের উপাদান। মানুষের ইচ্ছাকে তখনই তা প্রবাহিত করে যখন কোনও অসাধারণ মানুষের জীবনে ও কর্মে তা রূপ নেয়। এ আদর্শ মূর্তি নিয়েছে মহাত্মা গান্ধীর জীবনের সাধনায়, তাঁদের প্রতি কর্মানুষ্ঠানে। বুদ্ধিমান এ আদর্শকে বলেছে অব্যাবহারিক। আজকের বাস্তব জগতে প্রয়োগের অযোগ্য। অত্যন্ত স্বাভাবিক। কারণ এ আদর্শ হচ্ছে সভ্যতার এক স্তর থেকে মানুষকে সভ্যতার অন্য স্তরে ওঠার চেষ্টার আহ্বান। নিশ্চয়ই পূর্ব পূর্ব কালে যখন মহাত্মারা সামাজিকের সঙ্গে সামাজিকের সম্বন্ধের অবৈরভাব বাহ্য আচরণকে অন্তরের মৈত্রীতে পরিণতির আদর্শের কথা বলেছেন তখন বুদ্ধিমানেরা তাকে বলেছেন অবাস্তব। মানুষের সমাজে যা কিছু নূতন এসেছে আসার পূর্বে তা ছিল অবাস্তব। বস্তুরূপে তার অস্তিত্ব ছিল না। মহাপুরুষের কল্পনায় ও ধ্যানে মাত্র তারা ছিল। কিন্তু বর্তমানের চেয়ে মানুষের সম্বন্ধের শ্রেষ্ঠতর আদর্শ যখন মহামানুষের জীবনে রূপ পরিগ্রহ করে তখন তাহাকে অগ্রাহ্য করে মানুষ আর শান্তি পায় না। মহাত্মা গান্ধী দলের সঙ্গে দলের যে নূতন আদর্শকে তাঁর জীবনে রূপ দিয়েছেন তাকে অসম্ভব বলে দূরে রাখা মানুষের আর সম্ভব নয়। মানুষের মনে ও ইচ্ছায় তার ক্রিয়া আরম্ভ হয়েছে। সে আদর্শে পৌঁছিবার অক্ষমতা ও তা থেকে বিচ্যুতি মানুষের মনকে পীড়া দিতে থাকবে।

মহাত্মা গান্ধী মানুষের মানুষের সম্বন্ধ সম্পর্কে নানা উপলক্ষে একটা কথা বলেছেন—Change of heart, মনের অনুভূতিকে নূতন গড়ন দেওয়া। যাঁরা মহাত্মা মহামানব সভ্যতার ইতিহাসে এইটি তাঁহাদেরই দান। বাহ্যিক কর্তব্যনিষ্ঠায় ও সম্যক আচরণে তাঁদের তৃপ্তি নেই। তাঁরা চান মানুষের অন্তরকে পরিবর্তন করতে যাতে কর্তব্যপালন ও সদাচার হয় মনের স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশ। বাইরের কোনও শক্তির সমাজের কি রাষ্ট্রের বাধ্যকর নিয়মের অনুবর্তিতা নয়। রাষ্ট্রের মধ্যে ব্যক্তিগত যে অহিংসা আচরণ আজ সকল সভ্য সমাজের স্বাভাবিক অবস্থায় মোটের উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তার একটা বড় কারণ রাষ্ট্রের শাসন, ব্যতিক্রমে দণ্ডময়। আমাদের ধর্মসংহিতাকর রাষ্ট্রের এই অতন্ত্র উদ্যত দণ্ডকে স্তুতি করেছেন। ব্রহ্মতেজোময় এই দণ্ডের ভয়েই লোকে স্বধর্ম থেকে বিচলিত হয় না। এই দণ্ড না থাকলে বলবান দুর্বলকে পুড়িয়ে মারত, শূলে যেমন মাছ পোড়ায়। এই দণ্ডই সকলকে সুপথে রাখে, কারণ স্বভাবতই শুচি এরকম মানুষ দুর্লভ। ”সর্বোদণ্ডজিতো লোকো দুর্লভো হি শুচির্ণরঃ।” পৃথিবীর যাঁরা মহাপুরুষ মহাত্মা তাঁরা চেয়েছেন মানুষের মনকে এই স্বভাবশুচিতার দীক্ষা দিতে। তাঁদের জীবন ও কর্মের ফলে যদি সমাজের বহুমানুষের মধ্যে চিত্তের এই শুচিতা অল্পবিস্তর না আসত তবে রাষ্ট্রের দণ্ড ব্রহ্মতেজে তৈরি হলেও সামাজিক মানুষকে অহিংস্র পথে রাখার চেষ্টা ব্যর্থ হত মহাত্মা গান্ধী মানুষকে এই স্বভাব—শুচিতায় দীক্ষা দিতে চেয়েছেন ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির সম্বন্ধে ক্ষেত্রেই নয় দলের সঙ্গে দলের সম্বন্ধের ক্ষেত্রে। মানুষের উপর এত বড় দাবি ইতিপূর্বে হয়নি, মানুষের স্বভাবের উপর এত বড় ভরসা পূর্বে কেউ পোষাণ করেনি। এ আদর্শের বাস্তব সম্ভাবনার পরীক্ষা মানুষের ইতিহাসে অবশ্য হবে। কিন্তু সে পরীক্ষায় কিছুটা উত্তীর্ণ না হলে কোন বিশ্ব—সমিতি, কোনও নিয়ম—শৃঙ্খলার কৌশল, কোনও সর্বনাশের ভয় দলের সঙ্গে দলের সংঘর্ষ, যার পরিণাম আজ সবাই জানে জিতজেতা নির্বিশেষে ভয়াবহ, তাকে ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না।

মহাত্মা জন্মেছেন ভারতবর্ষে। তাঁর প্রথম জীবন ছাড়া বাকি জীবনের কর্মস্থল এই ভারতবর্ষ। বিদেশির শাসন থেকে ভারতবর্ষকে মুক্ত করা তাঁর কর্মজীবনের সবচেয়ে প্রত্যক্ষ বড় কাজ। মহাত্মা ইংরেজকে বলেছেন—Quit India। কিন্তু তাকে ভারতবর্ষ ছাড়তে যে বলের প্রয়োগ করেছেন, যে পথ ভারতবাসীকে দেখিয়েছেন, তা সহজেই মানুষের ইতিহাসে অভূতপূর্ব। ভারতবর্ষের ইংরেজ শাসন থেকে মুক্তি কতটা মহাত্মার প্রদর্শিত পথে চলার ফল, কতটা অন্য নানা অবস্থার ষড়যন্ত্রের ফল, কতটা অধীন দেশ বিদেশি শাসকের বিরুধে চিরাচরিত যেসব উপায় প্রয়োগ করে তার প্রয়োগের ফল—এ নিয়ে অনেক তর্কের অবসর আছে। এই ঐতিহাসিক ঘটনার কার্যকারণের সূক্ষ্ম বিচার নানা দেশের ভবিষ্য ঐতিহাসিকেরা অবশ্য করবেন। এবং বহুরকম পরস্পর বিরুদ্ধ সিদ্ধান্তে পৌঁছবেন। কিন্তু এক বিষয়ে তর্কের অবসর নেই। সে হচ্ছে এ ব্যাপারে মহাত্মার নিজের আদর্শ—সম্বন্ধে। তিনি বর্জিত জাতির লোক, বলদর্পিত জেতাকে বলেছেন দেশ ছেড়ে যেতে। কিন্তু ইংরেজ জাতির উপর তাঁর ক্রোধ নেই, ঘৃণা নেই, তাঁর অহিত কামনা নেই। অক্রোধ দিয়ে ক্রোধকে জয় করার ব্যক্তিগত নীতিকে তিনি সবচেয়ে কঠিন রাষ্ট্রনীতিতে প্রয়োগ করেছেন—পরাধীন দেশের স্বাধীনতাহারী দেশের সঙ্গে মুক্তির যুদ্ধে। এর চেয়ে অসম্ভব ও অবাস্তব আর কী হতে পারে? কিন্তু এ অবাস্তবকে আমরা দেখেছি চোখের সামনে মূর্তি নিতে—মুক্তি—যুদ্ধের স্বয়ং সেনাপতির মধ্যে।

মহাত্মার ছোট বড় সকল কাজের মূলমন্ত্র দলের গণ্ডি ভাঙার মন্ত্র, ছোট বড় সকল গণ্ডি। রাষ্ট্রের গণ্ডি ধর্মের গণ্ডি, বর্ণের গণ্ডি, ধনবৈষম্যের গণ্ডি, বলী—দুর্বলের গণ্ডি। গণ্ডি দূর হলেই থাকে মানুষ, গণ্ডির আবরণ মুক্ত ঠিক অন্য গণ্ডির মানুষের মতো একই মানুষ, যার সঙ্গে স্বাভাবিক সম্বন্ধ। মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্বন্ধ—মৈত্রীর ও প্রীতির সম্বন্ধ। মহাত্মার রাষ্ট্রনীতি, সমাজনীতি, ধনতন্ত্র এই গণ্ডিমুক্ত মানুষকে ঘিরে। কোন নীতির কী ফল ফলবে গণ্ডিনিরপেক্ষ মানুষের জীবনে তাই দিয়ে তার বিচার। তত্ত্বকথা দিয়ে নয়, জনসমষ্টি নাম দিয়ে, দেশ না নাম দিয়ে কল্পনাকে মানুষের জায়গায় দাঁড় করিয়ে নয়। মানুষ সত্য, তাকে ঢেকে তার উপরে দল বলে কোনও বড় সত্য নেই।

মহাত্মা গান্ধী ভারতবর্ষে জন্মেছিলেন। আমরা ভারতবাসী তাঁর স্বদেশি। আমাদের বহু পুণ্যের ফল, আমরা তাঁকে চোখে দেখেছি, তাঁর কথা কানে শুনেছি। হাজার বছর পরের লোক আমাদের এ সৌভাগ্যকে ঈর্ষা করবে। কিন্তু মহাত্মার ভারতর্ষের জন্ম একটা ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক ঘটনা মাত্র। মানুষের সমস্ত সভ্যতার ইতিহাসের মধ্যে তাঁর প্রতিষ্ঠা। যেখানে তাঁর মৈত্রীর আদর্শ মানুষকে অনুপ্রেরণা অনুপ্রেরণা দেবে, সভ্যতাকে এক ধাপ উঁচুতে তুলবে সেইখানেই তাঁর যথার্থ—স্বদেশ। ভারতবাসী ছিলেন বলে ভারতবাসীর তাঁর উপর স্বতন্ত্র দাবি নেই। পৃথিবীর সভ্যতার প্ররিক্ষেপিতে তাঁকে দেখাই যথার্থ দেখা। আমাদের নিজের ঘরের কোনও ঘরোয়া মাপে তাঁকে মাপার চেষ্টা করে নিজেরা যেন ছোট না হই।

১২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৮

সংগঠন। ১ম বর্ষ। দশম সংখ্যা। ১৩৫৪

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *