মহাত্মাজী – প্রমথ চৌধুরী
নন-কো-অপারেশন সম্বন্ধে আমাদের ভিতর মতের অমিল-থাকলেও, মহাত্মা গান্ধীর মাহাত্ম্য সম্বন্ধে আজকের দিনে আমরা সবাই একমত। এ কথা যে অন্তত আমার মুখে শুধু কথার কথা নয়, তাই প্রমাণ করার জন্য আমার মতে তাঁর মাহাত্ম্য যে কোথায় তা পরিষ্কার করে বলবার চেষ্টা করব।
মহাত্মা গান্ধীর চরিত্রবল অসাধারণ। এই চরিত্র কতাটা নানা লোকে নানা অর্থে বোঝে। সুতরাং তাঁর চরিত্রের বিশেষত্ব কোথায়, সেইটেই হচ্ছে দ্রষ্টব্য।
ইংরাজিতে যাকে বলে অ্যাসেটিজিম তার প্রতি আমার একটা সহজ শ্রদ্ধা আছে। কাষায়—বসনকে আমি দেখবা মাত্র উচ্চ আসন দিই। কিন্তু তাই বলে যিনি শারীরিক ক্লেশ সম্বন্ধে উদাসীন, আর যিনি শারীরিক সুখ—স্বাচ্ছন্দ্যকে বর্জন করেছেন, তাঁকেই আমি মহাপুরুষ বলতে প্রস্তুত নই। কেন যে নই, তার উত্তর গীতার এই শ্লোকে পাবেন।
”বিষয়া বিনিবর্ত্তন্তে নিরাহারস্য দেহিনঃ।
রসবর্জ্জনং রসোপস্যস্ত পরং দৃষ্টা নিবর্ত্ততে।।”
মহাত্মা আত্মার ধর্ম দেহের নয়, সুতরাং আমার কাছে মহাত্মা গান্ধীর মাহাত্ম্যের সঙ্গে উপবাসাদির বিশেষ কোন সম্বন্ধ নেই। মহাত্মা গান্ধীর চরিত্রে আমি এই ক’টি অসাধারণ গুণ দেখতে পাই। তিনি সম্পূর্ণ নির্ভীক, সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থ, কথায় এবং কাজে তিনি সম্পূর্ণ অকপট এবং সম্পূর্ণ সংযত, তাঁহার নির্ভীকতা আর পরমার্থপরতা সম্বন্ধে সকলেই একমত। সুতরাং এ বিষয়ে বেশি কিছু বলার প্রয়োজন নেই। মহাত্মা গান্ধীর বক্তৃতার ভাষা যে কত দূর স্পষ্ট ও পরিচ্ছন্ন, সকলে তা লক্ষ্য করেছেন কি না জানিনে। এ ভাষায় কোন আড়ম্বর নেই, কোন অলঙ্কার নেই, কোনও বাহুল্য নেই, কোনও অত্যুক্তি নেই; তাঁর এ ভাষা যেমন সংযত তেমনি শক্তিশালী। এর কারণ ভাষায় তাঁর মনের নগ্নরূপ লোকের চোখের সুমুখে তিনি ধরে দেন। তাঁর ভাষার শক্তি ও রূপের পিছনে আছে তাঁর চরিত্র। সম্পূর্ণ অকপট হতে পারলে মানুষের ভাষা যে কি অসাধারণ প্রাসাদপূর্ণ লাভ করে তার পরিচয় মহাত্মা গান্ধীর ভাষা, যদিও সে ভাষা তাঁর মাতৃভাষা নয়, একটি বিদেশি ভাষা। আমি তাঁর ভাষার উল্লেখ করলুম তাঁর চরিত্রের একটা গুণ দেখাবার জন্য, তাঁর বক্তৃতায় সাহিত্যিক গুণের পরিচয় দেবার জন্য নয়। আমরা যাকে ষ্টাইল বলি, সেটা যে মনের গুণ—ভাষার গুণ নয়, মহাত্মা গান্ধীর ভাষা তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। নন—কোপারেশনের ব্যাপারে প্রধান বল হচ্ছে মাহাত্মা গান্ধীর চরিত্রবল। ঐ প্রোগ্রাম যদি অপর কেউ সৃষ্টি করতেন তাহলে তাঁর জন্ম—মৃত্যু যে একই তারিখে হত, সে সম্বন্ধে আমার মনে কোনই সন্দেহ নেই।
লৌকিক মনের উপর মহাত্মা গান্ধীর যে আলৌকিকতা তার যে পরিচয় পাওয়া গেছে তাকে ঐন্দ্রজালিক বললে অত্যুক্তি হয় না এবং একটু ভেবে দেখলেই দেখা যায় যে, এ ম্যাজিক হচ্ছে তাঁর চরিত্রবলের মন্ত্রশক্তি।
মহাত্মা গান্ধীর নির্ভীকতা ও পরার্থ পরতা সম্বন্ধে আমার মনে কখনো তিলমাত্র সন্দেহ স্থান পায়নি। তবে তাঁর মুখের কথা যে পুরোপুরি তাঁর মনের কথা, এ বিশ্বাস আমার বরাবর ছিল না। আমার মনে এ সন্দেহ পূর্ব্বে হয়েছে যে, হয়ত তিনি তাঁর মনের কথা সম্পূর্ণ খুলে বলেননি। রাজনীতির সঙ্গে কূটনীতির যে একটা ঘনিষ্ঠ যোগ আছে ও নীতিতে উদ্দেশ্য যে তার উপায়কে প্লুত করে আবহমান কালের ইতিহাস তার প্রমাণ দেয়। অতএব পলিটিশিয়ানদের কথা যে সম্পূর্ণ সরল, সে বিষয়ে সন্দেহ মানুষের মনে সহজেই জন্মে। তার পর অসংখ্য নন—কো—অপারেশন ভক্তদের মুখে অগণ্য বার শুনেছি যে, একটু তলিয়ে দেখলেই দেখা যায় যে, মহাত্মা গান্ধীর কথা সাদা ভাবে বোঝা, না বোঝারই সামিল এবং এই সব ভাষাকাররা তাঁর কথার নানা গূঢ় ও কূট অর্থ আমাকে শুনিয়েছেন।
আদালতে তাঁর বিচারের সময় তাঁর কথা ও তাঁর ব্যবহার আমার মন থেকে চিরদিনের জন্য এ সন্দেহ দূর করেছে। তাঁর কথা যে সম্পূর্ণ অকপট, ঐ বিচারক্ষেত্রেই তা প্রমাণ হয়ে গেছে। যেমন কোন কবির প্রতিভা, তাঁর রচিত নানা কাব্যের ভিতর কোনও একখানি বিশেষ কাব্যের সম্পূর্ণ প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে, তেমনি উক্ত বিচারস্থলেই মহাত্মা গান্ধীর চরিত্রের সৌন্দর্য ও শক্তি সম্পূর্ণ ব্যক্ত হয়েছে। নির্ভীকতায় ও সরলতায়, সংযমে ও সৌজন্যে ও ক্ষেত্রে তাঁর আত্মোক্তি—অনোর কাছে একটি ওয়ার্ক অব আর্ট—স্বরূপে গণ্য। পৃথিবীর ইতিহাসে আর একটি মহাপুরুষের, সক্রেটিসের বিচারের বিবরণ লিপিবদ্ধ আছে, আর সে বিবরণ আজ তিন হাজার বৎসর ধরে মানুষের মনকে মুগ্ধ ও তুষ্ট করে আসছে। মহাত্মা গান্ধীর বিচারের বিবরণ পড়ে আমার ঐ সক্রেটিসের বিচারের কথাই মনে পড়ে। যে সকল গুণের সদ্ভাবে সক্রেটিসের আত্মোক্তি সাহিত্যে অমর হয়ে রয়েছে, প্রায় সে সকল গুণেরই সাক্ষাৎ মহাত্মা গান্ধীর আত্মোক্তিতে পাওয়া যায়। সক্রেটিসের এপোলজি বাঙলায় অনুবাদ করবার আমার ইচ্ছা আছে। যদি কখনো সে অনুবাদ করতে সমর্থ হই, তাহলে বাঙলা পাঠক মাত্রেই দেখতে পাবেন যে, উভয়ের ভিতর একটা মস্ত আভ্যন্তরিক ঐক্য আছে।
বর্তমানে আধুনিক ইউরোপীয় সভ্যতার প্রভাবে মানুষের মাহাত্ম্য কে কি করে, তাই দিয়ে আমরা যাচাই করি, কে কি সে বিষয়ে ততটা মন দিইনে। কিন্তু ভারতবর্ষের প্রাচীন সভ্যতার মনুষ্যত্বের মাপকাঠি ছিল স্বতন্ত্র। আজকাল আমাদের আত্মচেষ্টার লক্ষ্য হচ্ছে টু ভু, আর তা সেকালে ছিল টু বি এই দুই অবশ্য এক নয়।
অর্জ্জুন জিজ্ঞাসা করেছিলেন:—
”স্থিতপ্রাজ্ঞস্য কা ভাষা সমাধিস্থস্য কেশব।
স্থিতধীঃ কিং প্রভাযেত কিমাসীত ব্রজেত কিম।।”
এ প্রশ্নের উত্তরে শ্রীকৃষ্ণ যা বলেছেন, তার দু’টি—চারটি কথা এখানে উদধৃত করে দিচ্ছি:—
”প্রজাহাতি যদা কামান সর্ব্বান পার্থ মনোগতান।
আত্মন্যেবাত্মনা তুষ্টঃ স্থিতপ্রজ্ঞস্তদোচ্যতে।।
দুঃখেষ্কনুদ্বিগ্নমনাঃ সুখেষু বিগতস্পৃহঃ।
বীতরাগভয়ক্রোধঃ স্থিতধীমুনিরুচ্যতে।।
যঃ সর্ব্বত্রানভিসেনহস্তত্তৎ প্রাপ্য শুভাশুভম।
নাভিনন্দাতি ন দ্বেষ্টি তস্য প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিতা।।”
যে প্রতিষ্ঠিতপ্রজ্ঞ পুরুষের আদর্শ আমরা এত দিন শুধু সংস্কৃত পুস্তকেই পড়ে আসছি, মহাত্মা গান্ধীর চরিত্রে সেই আদর্শের যতটা সাক্ষাৎ পাওয়া গিয়েছে, অপর কারও চরিত্রে ততটা পাওয়া যায়নি।
এ সব কথা বলবার উদ্দেশ্য এই প্রমাণ করা যে, মহাত্মা গান্ধী একজন আদর্শ পুরুষ এ কথা সর্বান্তঃকরণে স্বীকার করেও নন—কো—অপারেশনের প্রোগ্রাম কেবল মাত্র পলিটিক্যাল প্রোগ্রাম হিসেবে বিচার করার প্রবৃত্তি ও অধিকার আমাদের আছে।
এখন অনেক লোক দেখেছি, যাঁরা মনে করেন যে, উক্ত প্রোগ্রাম রচনা করেছেন বলেই জনসাধারণের কাছে তিনি এক মহাত্মা।
মহাত্মা গান্ধী যদি এর ঠিক উলটো প্রোগ্রাম বার করতেন—অর্থাৎ নন—ভায়োলেন্স বদলে তিনি ভায়োলেন্স প্রচার করতেন, তাহলে জনসাধারণ তা প্রত্যাখ্যান করত, এমন কথা যদি কেউ মনে করেন, তাহলে তিনি স্থিতবী ব্যক্তির বশীকরণ শক্তি সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অজ্ঞ।
”যদযদাচরতি শ্রেষ্ঠস্তত্তদেবেতরো জনঃ।
স যৎ প্রমাণং কুরুতে লোকস্তদনুবর্ত্ততে।।”
এ কথা কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সময় যেমন সত্য চিল আজও তেমনি সত্য রয়েছে। এক চুল এদিক ওদিক হয়নি।
আমার শেষ কথা এই যে, নন—কো—অপারেশন সম্বন্ধে আমাদের যে মতভেদ রয়েছে, তার প্রকাশ সম্বন্ধে মহাত্মা গান্ধীর আদর্শ আমাদের চোখের সুমুখে রাখা উচিত, যদি আমরা জানি যে, তাঁর মত স্থিতধী হওয়া আমাদের পক্ষে অসম্ভব। আমরা রাগ—দ্বেষ থেকে মুক্তি নই। আমার নির্মমও নই, নিরহঙ্কার নই। উপরন্তু আমাদের মন শান্ত—নির্মমও নই, নিরহঙ্কার নই। উপরন্তু আমাদের মনে শান্তি নেই। আছে অশান্তি। তবু উক্ত আদর্শ চোখের সুমুখে রাখলে আমরা ভয়ে মিথ্যে কথা বলতে ঈষৎ সঙ্কুচিত হব এবং কথায় অসংযম ও অসৌজন্য দেখাতে কিঞ্চিৎ লজ্জিত হব।
—সবুজপত্র, ১৯২২