মহাত্মাজীর সাধনা ও আমাদের দায়িত্ব – গোপালচন্দ্র নিয়োগী
সমগ্র ভারতবাসীর—যখন বিশ্ববাসীর অন্তর মথিত করিয়া গভীরতম শোক, মর্মবেদনা এবং ক্ষোভের নাই, দুষ্কৃতকারীর গুলিতে অহিংসার প্রতিমূর্তি মানব—শ্রেষ্ঠ মহাত্মা গান্ধী তাঁহার অমূল্য জীবন বিসর্জন দিয়াছেন। হত্যাকারীর এই নৃশংস আঘাত ভারতের অন্তরাত্মাকেই আহত ও রক্তাপ্লুত করিয়া তুলিয়াছে। ১৯৪৮ সালের ৩০শে জানুয়ারি ভারতের জাতীয় জীবনে যে মর্মান্তিক আঘাত হানিয়াছে, তাহার রক্তাক্ত গভীর ক্ষতচিহ্ন কোন দিন আর বিলুপ্ত হইবে না। আমাদের স্বাধীনতা অর্জিত হওয়ার ছয় মাসও পূর্ণ না হইতেই আমাদের জাতীয় জীবনকে গভীরতম তমিস্রায় আচ্ছন্ন করিয়া ভারতাকাশের উজ্জ্বলতম জ্যোতিষ্ক অকস্মাৎ নির্বাপিত হইয়া গেল। যাহা কেহই কল্পনা করিতে পারে নাই, তাহাই বিনা মেঘে বজ্রাঘাতের মত আমাদের অন্তরকে শতধা বিদীর্ণ করিয়া দিয়াছে। আমরা এই মহাপ্রাণকে, এই অমূল্য জীবনকে রক্ষা করিতে পারি নাই, আমাদের শোণিতাক্ত সমগ্র অন্তর নিঙড়াইয়া শুধু এই আর্তনাদই আজ উত্থিত হইতেছে না, আমাদের কোন মহাপাপের প্রায়শ্চিত্ত—স্বরূপ এই মহামানবকে জীবন বিসর্জন দিতে হইল, এই প্রশ্নও সকলের অন্তরকে গভীর ভাবে পীড়িত করিয়া তুলিয়াছে, আমাদের অন্তরকে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বিশ্লেষণ করিবার জন্য আমাদিগকে করিয়াছে আত্মানুসন্ধানী। মহাত্মাজীর আরব্ধ ব্রত যে অসমাপ্ত রহিয়াছে তাহার প্রতিও আমাদের তীক্ষ্ন দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছে এই মর্মান্তিক আঘাত। মহাত্মাজী যত দিন আমাদের মধ্যেই ছিলেন, তত দিন তাঁহার আদর্শ ও নীতির প্রতি আমরা কোন আন্তরিক আগ্রহ প্রকাশ করি নাই। ১৯৪৬ সালের ১৬ই আগস্টের প্রত্যক্ষ সংঘর্ষ দিবস হইতে ১৯৪৮ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথমার্দ্ধে অনুষ্ঠিত করাচি, গুজরাট ও পারাচিনারের নৃশংস হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক উন্মত্ততার বেদীমূলে পাঁচ লক্ষেরও অধিক ভারতবাসীর জীবন বলি দিয়াও আমাদের চৈতন্যোদয় হয় নাই। পঞ্চনদের পবিত্র ভূখণ্ড সাম্প্রদায়িক উন্মত্ততার শ্মশানপ্রায় হইয়াও আমাদের চৈতন্য সম্পাদন করিতে অসমর্থ হইয়াছে। সহস্রাধিক কোটি টাকার সম্পত্তি বিনষ্ট হইয়াও আমাদের মোহ—নিদ্রা ভাঙ্গিতে পারে নাই। অর্ধ কোটির অধিক হিন্দু ও শিখ পশ্চিম পাকিস্তান হইতে ভারতে আসিয়া, এবং পূর্ব—পাঞ্জাবের ৪০ লক্ষের অধিক মুসলমান পশ্চিম পাকিস্তান চলিয়া যাইয়াও আমাদিগকে জাগ্রত করিতে অসমর্থ হইয়াছে। পূর্ববঙ্গ হইতে ১০ লক্ষ হিন্দু ভারতে চলিয়া আসিয়াছে এবং এখনও যে ১ কোটি ২০ লক্ষ হিন্দু পূর্ববঙ্গে রহিয়াছে তাহাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার, এ কথা জানিয়াও জাগ্রত হইবার ইচ্ছা আমাদের হয় নাই। কিন্তু গান্ধী তাঁহার অমূল্য জীবন দান করিয়া সেই অলৌকিক কার্য্য সম্পাদন করিয়াছেন, আমরা আমাদের দায়িত্ব ও কর্ত্তব্য সম্বন্ধে সজাগ হইয়াছি। মর্মান্তিক বেদনা ও ও দুঃখের মধ্যে আমাদের বোধশক্তি জাগ্রত হইয়াছে। মহাত্মাজীর জীবনালোকে উদ্ভাসিত সত্য—পথে যদি আমরা অগ্রসর হইতে পারি, তাহা হইলেই শুধু দুর্বার হইয়া উঠিবে আমাদের শক্তি, মহাত্মাজীর উত্তর—সাধকরূপে আমারে জীবনে সার্থক হইয়া উঠিবে তাঁহারই অসমাপ্ত সাধনা। মর্মান্তিক দুঃখে আমরা জাগিয়াছি, কিন্তু এই মর্মান্তিক দুঃখের মধ্যে ভারতীয় ঐক্য নবজন্ম লাভ করিয়াছে কি?
যুগে যুগেই মহামনবকে সত্যের জন্য, অহিংসার জন্য, আদর্শের জন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করিতে হইয়াছে। ক্ষুদ্র কপোতের প্রাণ রক্ষার জন্য রাজা উশীনরের পুত্র শিবি নিজের দেহ—মাংস দানের জন্য প্রস্তুত হইয়াছিলেন। দধীচি নিজের জীবন দিয়াছিলেন পরোপকারের জন্য। নিষাদের তীক্ষ্ন বাণে শ্রীকৃষ্ণ নিহত হইয়াছিলেন। সক্রেটিসকে তাঁহারই দেশবাসীরা হেমলক বিষ পান করাইয়া হত্যা করিয়াছিল। তাঁহার স্বজাতীয়গণই যিশুখৃস্টকে ক্রুশে বিদ্ধ করিয়াছিল। কোরেশ—বংশীষরাই হজরত মহম্মদকে মক্কা হইতে বিতাড়িত করিয়াছিল। মহাত্মা গান্ধীকেও তাঁহার দেশবাসীর হস্তেই জীবন বিসর্জন দিতে হইল। এ পর্যন্ত মানব—সভ্যতার ইতিহাস ‘Martyrdom of Man’ ছাড়া আর কিছুই হয় নাই। এই সকল মহাপুরুষের বহু সংখ্যক অনুগামী রহিয়াছে সন্দেহ নাই, তাঁহাদের মর্ম্মান্তিক আত্মত্যাগ মানব জাতির চিন্তাধারায় গভীর ছাপ অঙ্কিত করিয়া দিয়াছে, এ কথাও সত্য। কিন্তু এ কথাও আমাদের ভুলিবার উপায় নাই যে, যাহাদের কল্যাণ সাধন এই সকল মহাপুরুষ জীবনের ব্রতরূপে গ্রহণ করিয়াছিলেন, তাহাদেরই হাতে তাঁহাদিগকে জীবন দিতে হইয়াছে। জীবন দিয়াও তাঁহারা পৃথিবী হইতে হিংসা—দ্বেষ দূর করিতে পারেন নাই, মানুষের জীবনকে সুখে স্বচ্ছন্দে শান্তিতে ভরিয়া তুলিবার মহৎ ব্রত তাঁহাদের ব্যর্থ হইয়াছে। মানব—ইতিহাসের গোড়া হইতে যাহা ঘটিয়া আসিতেছে, মহাত্মাজীরে জীবন দান তাহার পরিবর্ত্তন ঘটাইতে পারিবে কি? মহাত্মা গান্ধী হিংসা, দ্বেষ, ঈর্ষা ও বৈষম্যে পরিপূর্ণ মরজগতে সত্য, অহিংসা, শান্তি ও মৈত্রীর রামরাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখিয়াছিলেন তাহা আমরা সার্থক করিতে পারিব কি? মহাত্মাজী নিহত হওয়ার মর্ম্মান্তিক ব্যথা—বেদনা আমাদিগকে বিমূঢ় করিয়াছে, ক্ষোভের অন্তর্দ্দাহ উত্তপ্ত শলাকার মতই আমাদের অন্তরকে অহর্নিশ বিদ্ধ করিতেছে দেশবাসীর এই মর্ম্মন্তদ ক্ষোভকে বিপথে পরিচালিত করিয়া হাঙ্গামা সৃষ্টি করিতেও আমরা দেখিয়াছি। মহাত্মাজীর হত্যাকারী এবং এই হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্রকারীদের প্রতি দেশাবাসীর অন্তর্দ্দাহকে প্রচণ্ড ক্রোধে উদ্দীপিত করিতেও যে আমরা দেখি নাই তাহাও নয়। কিন্তু মহাত্মাজীর পার্থিব দেহকে বিনাশ করার মধ্যেই কি শুধু এই মর্ম্মান্তিক ঘটনা নিবন্ধ রহিয়াছে? হত্যা কি শুধু দেহেরই হয়? মহাত্মা গান্ধীর এক অনশন ব্রত উপলক্ষে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে আহূত পল্লীবাসীদের সভায় বলিয়াছিলেন, ”খৃষ্টান শাস্ত্রে পড়েচি, আচারনিষ্ঠ য়িহুদীরা যীশুখৃষ্টকে শত্রু বলে মেরেছিল। কিন্তু মার কি শুধু দেহের? যিনি প্রাণ দিয়ে কল্যাণের পথ খুলে দিতে আসেন, সেই পথকে বাধাগ্রস্ত করা সেও কি মার নয়? সকলের চেয়ে বড় মার সেই। কী অসহ্য বেদনা অনুভব করে তিনি আজকের দিনে মৃত্যুব্রত গ্রহণ করেচেন। সেই ব্রতকে যদি আমরা স্বীকার করে না নিই, তবে কি তাঁকে আমরা মারলুম না?” কবিগুরু আরও বলিয়াছেন, ”বিনা ক্লেশে যা মানতে পারি, তাই মানি, কঠিনটাকে সরিয়ে রেখে দেই এক পাশে। তাঁর সকলের চেয়ে বড় সত্যটাকে নিতে পারলুম না। এইখানেই তাঁকে মারলুম।” কবিগুরু এই মানদণ্ড দিয়া মহাত্মাজীর অনুগামীদিগকে যদি বিচার করা যায়, তাহা হইলে আমরা কি দেখিতে পাই? নিজেদের দলগত স্বার্থসিদ্ধির অভিপ্রায়ে অন্তরের বিক্ষোভকে যাঁহারা প্রচণ্ড ক্রোধের মধ্যে অভিব্যক্ত করিতে প্ররোচনা দিয়াছিল, তাঁহাদিগকে যদি কবিগুরুর এই মানদণ্ড দিয়া বিচার করা যায়, তাহা হইলে কি দেখিতে পাওয়া যায়? হত্যাকারী তাঁহার পার্থিব দেহকেই শুধু বিনাশ করিতে পারিয়াছে, কিন্তু মহাত্মাজীর অনুগামীরা, প্রচণ্ড ক্রোধের উস্কানিদাতারা কি মহাত্মাজী বাঁচিয়া থাকিতেই তাঁহার আদর্শকে পুনঃ পুনঃ হত্যা করেন নাই? মহাত্মাজীর আদর্শকে বিনাশ করা এবং তাঁহার পার্থিব দেহকে বিনাশ করা, এতদুভয়ের মধ্যে কোনটি অধিকতর মর্মান্তিক, তাহার বিচার কবিরা ক্ষমতা আমাদের নাই। কিন্তু তাঁহারই নশ্বর পার্থিব জীবন নাশ হওয়ার মর্ম্মান্তিক ব্যথা—বেদনা যদি তাঁহারই প্রদর্শিত পথে আমাদিগকে পরিচালনা করিতে সমর্থ হয়, তাহা হইলে শুধু এই মহাপাপের প্রায়শ্চিত্ত করা সম্ভব হইবে।
মহাপুরুষদের জীবনের বৃহত্তম ট্রেজেডি হইতেছে এই যে, সকলেই তাঁহাদিগকে শ্রদ্ধা করে, ভক্তি করে, গদগদ কণ্ঠে তাঁহাদের স্তুতিগাথা গান করে, কাহাকেও ঈশ্বরের পুত্র, কাহাকেও প্রেরিত পুরুষ, কাহাকেও অবতার, আবার কাহাকেও স্বয়ং ঈশ্বর বলিয়াই পূজা করে, কিন্তু কেহ—ই মহাপুরুষদের উপদেশ প্রতিপালন করে না, তাঁহাদের ইচ্ছানুসারে কাজ করে না, তাঁহাদের প্রদর্শিত পন্থা অনুসরণ করে না। জর্জ বার্নাড শ’ তাঁহার অনুপম ভাষায় এই সত্য উদঘাটন করিয়া বলিয়াছিলেন, ‘‘In a stupid nation, the great of genius becomes a God, everybody worships him and nobody does his will.’’ অর্থাৎ নির্বোধ জাতির মধ্যে প্রতিভাবান ব্যক্তিদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি ঈশ্বরে পরিণত হন। প্রত্যেকেই তাঁহাকে পূজা করে, কিন্তু কেহ—ই তাঁহার ইচ্ছানুসারে কাজ করে না। কিন্তু যাহারা কোন মহাপ্রাণ ব্যক্তিকে ঈশ্বর বানাইয়া তাঁহার জীবনের ব্রতকে পর্য্যন্ত ব্যর্থ করিয়া দিতে সমর্থ, তাহাদিগকে নির্বোধের জাতি বলিয়া অভিহিত করা যায় কি? জর্জ বার্নার্ড শ’ নিজেই স্বীকার করিয়াছেন, ‘‘The most effective way of shutting our minds against a great man‘s ideas is to take them for granted and admit he was great and have done with him.’’ অর্থাৎ এক জন শ্রেষ্ঠ মানবের মতবাদের দিক হইতে আমাদের মনকে বিমুখ করিয়া রাখিবার প্রকৃষ্ট উপায় ঐ মতবাতকে সত্য বলিয়া স্বীকার করা এবং তিনি যে এক জন শ্রেষ্ঠ মানব তাহাও মানিয়া লওয়া। তাহা হইলে পুরুষকে শেষ করিয়া ফেলা হইবে।” বার্নার্ড শ’ দুর্বোধ্য কথা বলিবার খ্যাতি লাভ করিয়াছেন। কিন্তু তাঁহার উল্লিখিত উক্তি অত্যন্ত প্রাঞ্জল। বস্তুতঃ, সমাজের কায়েমী স্বার্থকামী কর্ণধারগণ মহাপুরুষের জীবন—ব্রতকে ব্যর্থ করিবার যে সহজ উপায় আবিষ্কার করিয়াছেন, যুগ যুগে তাহার অব্যর্থ কার্যকরী শক্তি নির্ভুল ভাবে প্রমাণিত হইয়াছে। মহাত্মা গান্ধী সম্বন্ধেও তাঁহাদের এই নীতি ব্যর্থ হয় নাই। মহাত্মাজী যে দেশবাসীর অন্তরে অদ্বিতীয় স্থান অধিকার করিয়া রহিয়াছেন, সে সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র সন্দেহ করিবার কোন কারণ নাই। তথাপি, তিনি বাঁচিয়া থাকিতে দেশবাসী তাঁহার আদর্শকে কতটুকু সহায় হইয়াছে তাহা অবশ্যই বিবেচনার বিষয়। হত্যাকারী অহিংসার মূর্ত প্রতীক মহাত্মাজীর পবিত্র দেহে কোন প্রাণে আঘাত হানিতে পারিয়াছে, তাহা আমরা ধারণা করিতে পারিতেছি না। মহাত্মাজীর জীবনের উপর আঘাত হানিবার চেষ্টা আরও অনেক বার হইয়াছে। মহাত্মাজী ১৯৪২ সালের আগস্ট মাসে বলিয়াছিলেন, ‘But if some one were to kill me in the belief that he was getting rid of a rascal, he will kill not the real Gandhi but one that appeared to him a rascal.’’ অর্থাৎ ”একটা দুরাত্মাকে অপসারিত করিতেছে এই বিশ্বাসে কেহ যদি আমাকে হত্যা করে, তাহা হইলে সে সত্যিকার গান্ধীকে হত্যা করিবে না, হত্যা করিবে তাহাকেই—যে তাহার কাছে দুরাত্মা বলিয়া প্রতিভাত হইয়াছে।’ বস্তুতঃ মানুষ তাঁহার নিজের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়াই জগৎকে দেখিয়া থাকে। যাহার প্রকৃতি যেরূপ, জগত তাহার কাছে সেইরূপই প্রতিভাত হয়। মহাত্মাজী মানুষের এই দৃষ্টিভঙ্গিকে বলদাতেই চাহিয়াছেন, চাহিয়াছেন মানব প্রকৃতিকে সম্পূর্ণরূপে বদলাইয়া দিতে। সুতরাং তাঁহার প্রচেষ্টাকে যে যে দিক দিয়া স্বীয় স্বার্থের ক্ষতিজনক বলিয়া মনে করিয়াছে সে, সেই দিক দিয়াই মহাত্মাজীর মহতী প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করিতে চেষ্টা করিয়াছে। কেহ কেহ তাঁহার ভক্ত সাজিয়া, তাঁহার অনুগামী সাজিয়া তাঁহার আদর্শ ও নীতিকে ক্ষুণ্ণ করিয়াছে। এই দুষ্কৃতকারী করিয়াছে মহাত্মাজীর পার্থিব দেহের বিনাশ। কিন্তু সত্যিকার মহাত্মা গান্ধী বাঁচিয়া আছেন। তিনি যে নূতন সমাজ—ব্যবস্থা প্রবর্ত্তন করিতে চাহিয়াছেন, তাহাকেই প্রতিষ্ঠিত করিতে আমাদের বলিষ্ঠ সাধনার মধ্যেই তিনি থাকিবেন অমর হইয়া।
ভারতের জাতীয় আন্দোলন বিগত ত্রিশ বৎসরের ইতিহাস মহাত্মাজীর স্বপ্নের স্বরাজকে প্রতিষ্ঠিত করিবার সাধনার কাহিনী। দক্ষিণ আফ্রিকায় সত্যাগ্রহ আন্দোলনে জয়লাভের পর ভারতবর্ষকে তিনি যখন তাঁহার কর্ম্মক্ষেত্রে পরিণত করা স্থির করিলেন, তখনই হইল ভারতে জাতীয় আন্দোলনের নূতন অধ্যায় আরম্ভ। যদিও দাদাভাই নৌরজী কংগ্রেস সভাপতির আসন হইতে কংগ্রেসের লক্ষ্যস্থল স্বরাজ বলিয়া ১৯০৬ সালেই ঘোষণা করিয়াছিলেন, তথাপি কংগ্রেসের তৎকালীন নেতৃবর্গের দৃষ্টি এই স্বরাজ ভারতের শিক্ষিত ধনী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জন্য কতক পরিমাণে শাসন—ক্ষমতা লাভ ছাড়া আর কিছুই ছিল না। বস্তুতঃ মহাত্মা গান্ধী কংগ্রেসের নেতৃত্ব গ্রহণ করিবার পূর্ব পর্যন্ত কংগ্রেসে শুধু শিক্ষিত ধনী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির আশা—আকাঙ্ক্ষাই রূপায়িত হইয়াছে। ১৮৪৮ সালের ইউরোপের বিপ্লব যেমন সমাজতন্ত্রকে গণশক্তিতে রূপান্তরিত করিয়াছিল, তেমনি মহাত্মার নেতৃত্ব কংগ্রেসের আন্দোলনকে দুর্বার গণশক্তির মহাসাগরে মিশাইয়া দিল। বস্তুতঃ গণ—আন্দোলনের নেতারূপেই ভারতের রাজনীতি ক্ষেত্রে মহাত্মাজীর প্রথম আবির্ভাব। গিরিমটিয়া প্রথা রহিতের জন্য আন্দোলনই ভারতে মহাত্মাজীর প্রথম আন্দোলন। তাঁহার আন্দোলনের ফলে সরকার এই গিরিমটিয়া—প্রথা রহিত করিতে বাধ্য হন। তাঁহার দ্বিতীয় আন্দোলন নীল চাষীদের উপর অত্যাচার নিবারণের জন্য চম্পারণ সত্যাগ্রহ আন্দোলন। চম্পারণের পর খয়রায় কৃষকদের উপর করবৃদ্ধি বন্ধ করার জন্য তিনি আন্দোলন করিয়াছিলেন। অতঃপর তিনি আহমদাবাদে মিল—মালিকদের বিরুদ্ধে শ্রমিকদের সত্যাগ্রহ আন্দোলন পরিচালন করেন। আহমেদাবাদে তিনি যে শ্রমিক—সঙ্ঘ গঠন করেন, বোধ হয় ভারতে উহাই সর্ব প্রথম শ্রমিক প্রতিষ্ঠান। কিন্তু ভারতে ব্যাপক ভাবে জন—জাগরণের সৃষ্টি করে তাঁহার অসহযোগ আন্দোলন। তাঁহার আইন অমান্য আন্দোলন হয় ত’ তেমন ব্যাপক ভাবে জনসাধারণের মধ্যে প্রসারিত হয় নাই এবং ১৯৪০ সালের আন্দোলন ব্যক্তিগত শত্যাগ্রহ ছাড়া আর কিছুই ছিল না। কিন্তু ১৯৪২ সালের আগস্ট মাসে তাঁহার ‘কুইট ইন্ডিয়া’ প্রস্তাবের পর তিনি এবং নেতৃত্ববর্গ গ্রেপ্তার হইলে দেশব্যাপী যে স্বতঃস্ফূর্ত্ত আন্দোলন আরম্ভ হইয়াছিল, তাহা অভূতপূর্ব্ব।
মহাত্মাজী যেমন ভাবী ভারতের সমাজ—ব্যবস্থায় স্বপ্ন দেখিয়াছেন, তেমনি কোন পথে এই স্বপ্ন সফল হইবে তাহার পথও নির্দেশ করিয়াছেন তিনিই। এই পথ তাঁহার নিজস্ব পথ। ভারতের জন্যও এই পথই তিনি নির্দেশ করিয়াছেন। ১৯১৭ সালে গুজরাটী রাজনৈতিক সম্মেলনের সভাপতির আসন হইতে তিনি ঘোষণা করেন, ‘‘This Satyagraha is India’s special weapon.’’ অর্থাৎ ”এই সত্যাগ্রহ ভারতের বিশেষ অস্ত্র।” এই সত্যাগ্রহ সত্য ও অহিংসার প্রতি প্রতিষ্ঠিত। স্বরাজ কোন পথে অর্জিত হইবে তাহা নির্দেশ করিয়া তিনি বলিয়াছেন, ”আমার স্বপ্নের স্বরাজ তখনই আসিবে, যখন আমরা সকলেই দৃঢ়তার সহিত স্বীকার করিবে যে, আমাদের স্বরাজ শুধু সত্য ও অহিংসার পথেই অর্জ্জিত, পরিচালিত ও রক্ষিত হইবে।”
মহাত্মাজীর স্বরাজ জনগণের স্বরাজ। ইহাকেই তিনি রামরাজ্য বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন। এই স্বরাজ প্রতিষ্ঠিত হইবে অহিংসার উপরে। কেহই কাহারও শত্রু হইবে না। সকলেই নিজ নিজ কর্ত্তব্য করিয়া যাইবে। সকলেই লেখাপড়া শিখিবে এবং তাহাদের জ্ঞান উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাইবে। রোগের আক্রমণ যথাসম্ভব কম হইবে। কেহ—ই নিঃস্ব থাকিবে না। শ্রমিকরা সকলেই কাজ পাইবে। ধনীরা তাঁহাদের সম্পদ জাকজমকে ব্যয় না করিয়া বিজ্ঞানতার সহিত কল্যাণজনক কার্যে ব্যয় করিবেন। এইরূপ সমাজ ব্যবস্থাই মহাত্মাজীর রাম—রাজত্ব। তিনি শ্রেণি—সংগ্রামে বিশ্বাস করেন না। তিনি বিশ্বাস করেন শ্রেণি—সহযোগিতায়। তাঁহার বিশ্বাস, হৃদয়ের পরিবর্ত্তন হইয়া ধনীরা স্বেচ্ছায় দরিদ্রের ন্যাস—রক্ষক হইয়া থাকিবেন। কিন্তু প্রশ্ন ওই যে, তাঁহার নির্দেশিত সত্য ও অহিংসার পথে আমাদের নেতৃবৃন্দ, ভারতের বিভিন্ন শ্রেণী ও এ পর্যন্ত কত দূর অগ্রসর হইতে পারিয়াছেন এবং মহাত্মাজী নিহত হওয়ার মর্মান্তিক আঘাতের প্রেরণায় কতটুকু অগ্রসর হইতে পারিবেন। সমালোচনার তীক্ষ্ন দৃষ্টি দিয়া আমরা এতদিন যাহা করিয়াছি, তাহা বিশ্লেষণ ও পরীক্ষা করিয়া দেখিতে হইবে। দেখিতে হইবে, আমরা মহাত্মাজীকে শুধু মৌখিক শ্রদ্ধা—ভক্তিই করিয়াছি, না তাঁহার নির্দেশও কিছু কিছু পালন করিতে চেষ্টা করিয়াছি। মহাত্মাজী নিহত হওয়ায় মর্মান্তিক আঘাতে আমরা যে বিমূঢ় ও মূহ্যমান হইয়া পড়িয়াছি তাহা যদি সত্য হয়, তাহা হইলে কৃচ্ছ্রসাধনার বলিষ্ঠ পাদক্ষেপে আমাদের কর্তব্য পথ কি ধ্বনিত হইয়া উঠিবে না? অহিংসা ও সত্যের পথ আমরা সত্যই গ্রহণ করিয়াছি কি? হৃদয়ের পরিবর্তনে আমরা সত্যই বিশ্বাসী হইতে পারিয়াছি কি?
রৌলটি আইন এবং জালিয়ানওয়ালাবাগের মর্মন্তুদ ঘটনাকে মহাত্মা গান্ধী তাঁহার সত্য অহিংসার অস্ত্র প্রয়োগের সুযোগরূপে গ্রহণ করিয়াছিলেন। ১৯১৭—১৮ সাল হইতে ১৯৪৭—৪৮ সাল পর্য্যন্ত ৩০ বৎসরব্যাপী মহাত্মাজীর সত্য ও অহিংসা—সংগ্রামে কংগ্রেসের নেতৃত্ববর্গ, দেশের শিক্ষিত চিন্তাশীল ব্যক্তিগণ এবং দেশের অর্থনৈতিক শক্তির অধিকারিকগণ দ্বিধাহীন চিত্তে অবিচলিত দৃঢ়তার সহিত অগ্রসর হইতে পরিয়াছেন কি? পুনঃ পুনঃই মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্ব তাঁহারা বর্জন করিয়াছেন, অথবা বুঝিয়া তিনি নিজেই সরিয়া দাঁড়াইয়াছেন। সঙ্কটের সময় তাঁহারা আবার তাঁহাকে ডাকিয়াছেন। নতূন নেতৃত্ব, নূতন পথ কেহ—ই সৃষ্টি করিতে পারেন নাই। অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহৃত হওয়ার পর, দ্বৈতশাসন ব্যর্থ করিবার ব্যর্থ প্রচেষ্টার গ্লানির মধ্যে, ১৯৩৭ সালে কংগ্রেসের মন্ত্রিত্ব গ্রহণের পর, ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বসংগ্রাম আরম্ভ হইলে, ক্রিপস মিশনের ব্যর্থতার মধ্যে, ১৯৪৬ সালের মে মাসে মন্ত্রীমিশনের প্রস্তাব এবং ১৯৪৭ সালের ৩য়া জুন তারিখের বৃটিশ গভর্ণমেন্টের প্রস্তাবের সময় এইরূপ অবস্থা ঘটিতে আমরা দেখিয়াছি। পরিপূর্ণ ভাবে কোন দিনই তাঁহার নেতৃত্ব তাঁহারা গ্রহণ করতে পারেন নাই, দ্বিধাগ্রস্ত চিত্তে, সংশয়—কম্পিত হস্তে তাঁহারা গ্রহণ করিয়াছেন আংশিক ভাবে—গ্রহণ করিয়াছেন সেইটুকু—যেটুকু হাঁহাদের কাছে সুখকর মনে হইয়াছে। তাঁহার যে নির্দেশ কষ্টকর মনে হইয়াছে, নিজের শ্রেণি—স্বার্থের পরিপন্থী বলিয়া মনে হইয়াছে, তাহা বর্জ্জন করিতে কোন দিনই আমরা কুণ্ঠিত হই নাই। মহাত্মাজী সত্যকে তাঁহার আন্দোলনের অন্যতম ভিত্তি করিয়াছিলেন। কিন্তু আমরা সত্যকে গ্রহণ করিয়াছি কি? যীশুখৃস্টকে যখন বিচারের জন্য পন্টিয়াস পিলেটির (Pontius Pilate) নিকটে উপস্থিত করা হইয়াছিল, তখন তিনি আত্মসমর্থনের জন্য বলিয়াছিলেন, ‘‘…I should bear witness unto the truth. Every one that is of the truth hearth my voice.’’ পিলেটি তাঁহার কথা শুনিয়া জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, ‘‘What is truth’’ ? সত্য কি? কিন্তু যীশুখৃস্টের উত্তর শুনিবার আগ্রহ তাঁহার ছিল না। আমাদেরও মহাত্মজী সত্য বিলতে কি বুঝিয়াছেন তাহা জানিবার আগ্রহ হয় নাই। মহাত্মাজী সত্যসন্ধানী ছিলেন। রাজনৈতিক, অর্থৈনৈতিক ও সামাজিক ঘটনাপুঞ্জের পারস্পরিক সঙ্ঘাতে ভারতের ইতিহাস যে পথে পরিচালিত হইতেছে, মহাত্মাজী তাহার সন্ধান পাইয়াছিলেন বলিয়াই তিনি সত্যদ্রষ্টা। এই সত্যকে তিনি সুষ্ঠু ভাবে রূপ দিতে পরিয়াছেন বলিয়াই গণানুগত্য তাঁহার নেতৃত্বকে ঘেরিয়া দানা বাঁধিয়া উঠিয়াছিল। কিন্তু তাঁহার নেতৃত্বের সার্থকতা নির্ভর করিতেছিল কংগ্রেসের নেতৃবর্গ, চিন্তাশীল শিক্ষিত সাধারণ এবং দেশের অর্থনৈতিক শক্তির অধিকারীদের কর্মশক্তির উপরেই একান্তভাবেই, এ কথা বলিলে একটুকু ভুল হয়না। মহাত্মাজীর নির্দেশ যেটুকু তাঁহাদের শ্রেণি স্বার্থের অনুকূল বলিয়া মনে করিয়াছেন সেইটুকুর উপরেই তাঁহারা জোর দিয়াছেন। কিন্তু তাঁহার উপদেশের যে অংশের উপর জোর দিলে অনুকূল, অংশটুকু শক্তিশালী হইতে পারিত, সেই অংশকে তাঁহারা উপেক্ষা করিয়াছেন। মহাত্মাজী শ্রেণিসংগ্রামের বিরোধী ছিলেন। তাঁহার এই শিক্ষার প্রতিই আমরা গুরুত্ব আরোপ করিয়াছি। কিন্তু তিনি ধনীদিগকে দরিদ্রের ন্যাসরক্ষক হওয়ার যে উপদেশ দিয়াছেন, বিলাস—ব্যসন ও জাঁকজমকে ধন ব্যয় না করিয়া দরিদ্র, সাধারণের কল্যাণের জন্য ধন ব্যয় করিতে তিনি যে উপদেশ দিয়াছেন, তাহা আমরা উপেক্ষা করিয়াছি। মহাত্মাজী বলিয়াছেন যে, কাপুরুষতা অপেক্ষা হিংসা ভাল। আর আমরা শক্তের লাঠির সম্মুখে আমাদের কাপুরুষতাকে অহিংসার আবরণে আবৃত করিয়া আত্মবঞ্চনা করিয়াছি। কিন্তু দুর্বলকে পীড়ন করিবার সময় অহিংসার ক্ষণভঙ্গুর আবরণ ভেদ করিয়া আমাদের হিংসা—প্রবৃত্তি হিংস্র হইয়া উঠিতে বিলম্ব হয় নাই। মহাত্মা সাম্প্রদায়িক মৈত্রী প্রতিষ্ঠার জন্য প্রাণান্ত করিয়াছেন। কিন্তু কতকগুলি লোক তাঁহার এই প্রচেষ্টাকে এমন ভাবেই ব্যর্থ করিয়া দিয়াছে যে, শেষ পর্যন্ত ভারত বিভাগ রোদ করা সম্ভব হয় নাই। কিন্তু ভারত বিভক্ত হওয়া সত্ত্বেও সাম্প্রদায়িক মৈত্রী প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে কি? গত ৬ই জানুয়ারি (১৯৪৮) করাচীতে এক হাঙ্গামায় বহুসংখ্যক হিন্দু ও শিখ নিহিত হয়। ১২ই জানুয়ারি (১৯৪০) গুজরাট স্টেশনে আশ্রয় প্রার্থী ট্রেন আক্রান্ত হয় সশস্ত্র পাঠান কর্তৃক। ইহার কয়েক দিন পরেই হিন্দু—মুসলিম ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য মহাত্মাজী অনশন ব্রত গ্রহণ করায় ভারতে করাচী ও গুজরাটের প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে নাই। মহাত্মাজীর এই অনশনের কোন শুভ প্রতিক্রিয়া পাকিস্তানে তো হয় নাই! পাকিস্তানে অমুসলমানদের প্রতি ঘৃণিত আক্রমণ চলতে থাকা সত্ত্বেও যাঁহার অমোঘ প্রভাবে ভারতে তাহার প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হইতে পারে নাই, সেই মহাপ্রাণ হিন্দু দুষ্কৃতকারীর হস্তে নিহত হইয়াছেন, এই মমান্তিক বেদনা ও ক্ষোভ রাখিবার স্থান আমাদের নাই। এই গভীরতম শোকে অভিভূত হইয়া কলিকাতা হইতে লুৎফুল কাদীর নামক জৈনক মুসলমান ‘স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় (৪ঠা ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৮) লিখিয়াছেন, ‘Muslims of undivided India were suspicious of Muhatma Gandhi. Muslims of divided India stand convinced that he was their sincerest firiend and truest guide.’’ অর্থাৎ ‘অবিভক্ত ভারতের মুসলমানগণ মহাত্মা গান্ধীর প্রতি সন্দেহ পোষণ করিতেন। কিন্তু বিভক্ত ভারতের মুসলমানগণ নিঃসন্দেহরূপে উপলব্ধি করিয়াছেন যে, তিনি তাহাদের অকৃত্রিম বন্ধু ও প্রকৃত পথপ্রদর্শক ছিলেন।’ ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের মুসলমানগণ যদি এই সত্য উপলব্ধি করিয়া থাকেন, তাহা হইলে পাকিস্তানে অমুসলমানদের ধন—প্রাণ নিরাপদ করিবার দায়িত্ব গ্রহণ করিয়া মহাত্মাজীর আদর্শের মর্যাদা রক্ষা করা কি তাঁহাদের উচিত নয়? মহাত্মাজীর আদর্শ তো কোন সাম্প্রদায় বিশেষের জন্য নয়, কোন জাতিবিশেষ বা দেশবিশেষের জন্যও নয়। তাঁহার আদর্শ হিন্দু মুসলমান সকলেই জন্যই। ভারতের ন্যায় পাকিস্তানের জন্যও—সমগ্র পৃথিবীর জন্যই।
মহাত্মাজী সমাজতন্ত্রবাদী বা কম্যুনিষ্ট ছিলেন কি না, সেই প্রশ্ন আলোচনা করিবার সময় ইহা নহে। মহামান্য আগা খাঁর সহিত নিভৃত আলোচনায় সময় মহাত্মাজী না কি বলিয়াছিলেন যে, রাষ্ট্রের অবসান এক দিন হইবে— (Withering away of the State) এই তত্ত্ব তিনি স্বীকার করিয়াছেন। কিন্তু মহাত্মাজীর সদ্য বিয়োগব্যথিত চিত্তে এই সকল বিষয় লইয়া কোনো আলোচনা করা সম্ভব নয়। গান্ধীবাদ ও মার্কবাদের এণ্টিথেসিস লইয়া কোন আলোচনা করিতেও আজ আমরা অসমর্থ। কিন্তু মহাত্মাজীর স্বপ্নের ভারতের চিত্র সম্মুখেই রহিয়াছে। তিনি বলিয়াছেন, ‘‘I shall work for an India in which the poorest shall feel that it is their Country in whose making they have an effective voice ; an India in which there shall be no high class and low class of people ; an India in which all Communities shall live in perfect harmony…..This is the India of my dreams …..I shall be satisfied with nothing else.’’ অর্থাৎ ‘এমন একটি ভারত গঠনের জন্য আমি সাধনা করিব, যেখানে দীনতম ব্যক্তিও ইহাকে নিজের দেশ বলিয়া ভাবিতে পারে, যাহাকে গড়িয়া তুলিতে তাহাদের কথাই কার্যকরী হইবে; এমন এক ভারত—যেখানে উচ্চ শ্রেণি বলিয়া কিছু থাকিবে না; এমন এক ভারত—যেখানে সকল সম্প্রদায় সৌহার্দ্দ্যপূর্ণ সম্বন্ধে আবদ্ধ হইয়া বাস করিবে।….ইহাই আমার স্বপ্নের ভারত। ইহা ব্যতীত আর কিছুতেই আমি তৃপ্ত হইব না।’ মহাত্মাজী তাঁহার স্বপ্নের ভারতকে বাস্তবে রূপায়িত হইতে দেখিয়া যাইত পারেন নাই। বোধ হয়, তাঁহার স্বপ্নের ভারত আজও বহু দূরবর্তী। কিন্তু তিনি আমাদিগকে স্বাধীনতার অর্জ্জন করিয়া আনিয়া দিয়া গিয়াছেন। এই স্বাধীনতা যে সত্যিকার স্বাধীনতা নয়, তাহা তিনি নিজেও জানিতেন। তাঁহার জীবনাবাসনের অব্যবহিত পূর্বে তিনি কংগ্রেসের গঠনতন্ত্রের সংশোধনমূলক যে খসড়া প্রস্তাব রচনা করিয়া গিয়াছেন তাহাতে তিনি বলিয়াছেন, ”ভারতের সাত লক্ষ গ্রামের সামাজিক, নৈতিক ও বাস্তব স্বাধীনতা এখনও লাভ হয় নাই।” কিন্তু যে স্বাধীনতা লাভ করিয়াছি, তাহাকে অবলম্বন করিয়াই মহাত্মাজীর স্বপ্নের ভারতকে ব্যস্তব রূপ দিতে আমরা সমর্থ। প্রথমে যেটুকু স্বাধীনতা আমরা পাইয়াছি তাহাকে রক্ষা করিবার সুদূঢ়ব্যবস্থা করিতে হইবে। ভারত বিভাগের পরে যে দুর্দশা ও ধ্বংসর স্তূপ গড়িয়া উঠিয়াছে—আলেয়ার পিছনে না ঘুরিয়া সেগুলিকে অপসারিত করিবার জন্য নিয়োগ করিতে হইবে আমাদের সর্ব্ব শক্তি। এইরূপে স্বাধীনতা রক্ষার সুদূঢ় দুর্ভেদ্য প্রাকার গড়িয়া মহাত্মাজীর স্বপ্নের ভারত—শ্রেণিহীন জনগণের ভারত গড়িয়া তুলিবার আয়োজন করিতে হইবে। এই পথেই দুষ্কৃতকারীর হস্তে মহাত্মাজীর প্রাণ বিসর্জন দেওয়ার মহাপাপ আমরা ক্ষালন করিতে সমর্থ হইব, সফল হইবে মহাত্মাজীর জীবন—স্বপ্ন। আমাদের এই নির্ভীক বলিষ্ঠ সাধনার মধ্যেই মহাত্মাজী অমরা হইয়া থাকিবেন।
জয়তু মহাত্মা গান্ধী!