মহাকাশের যাযাবর

মহাকাশের যাযাবর

একটা চেয়ারে চারজন মিলে ধরাধরি করে ওঁকে তোলা হতে লাগল রকেটে৷ পাশে পাশে উঠতে উঠতে ক্যাপটেন সাহেব ভয় ভয় মুখে বলতে লাগলেন, ‘দেখো, দেখো, সাবধান৷ ফেলে দিও না৷ এই, এই, এই, একদিকটা নীচু হয়ে যাচ্ছে!’

যে মানুষটাকে তোলা হচ্ছে, তিনি হাঁটতে পারেন না, উঠে দাঁড়াতে পারেন না, কথা বলতেও পারেন না৷

এই মানুষটি যাবেন মহাশূন্য অভিযানে? বিশ্বাস করাই যায় না৷ সকলেই ভেবেছিল অসম্ভব!

কিন্তু তিনি যাবেনই যাবেন৷ জেদ ধরে বসে আছেন তিনি৷ সবাইকে জানিয়ে দিয়েছেন, রকেটে যেতে যেতে যদি তিনি মরেও যান, তাহলেও তিনি দারুণ আনন্দ পাবেন৷ সেইরকম মৃত্যুই তিনি চান৷

মহাশূন্য অভিযানে যে-কেউ তো ইচ্ছে করলেই যখন-তখন যেতে পারে না৷ তার জন্য ট্রেনিং নিতে হয়৷

এই পঙ্গু মানুষটিও ট্রেনিং নিয়েছেন কয়েকবার৷ ভারসাম্যহীন অবস্থায় ওলোট-পালোট খেয়েছেন৷ তাতে তিনি একটুও দমে যাননি৷ এবং তাঁর মুখে ফুটে উঠেছিল হাসি৷

তাঁকে নিষেধ করার সাধ্যও তো কারুর নেই৷ তিনি যে স্টিফেন হকিং৷ একালের সবচেয়ে বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক৷

এক সাংঘাতিক রোগে তাঁর সারা শরীর অসাড় হয়ে গেছে৷ সবাই ধরেই নিয়েছিল, উনি আর কয়েক মাসের বেশি বাঁচবেন না৷ তবু অসম্ভব মনের জোরে তিনি বেঁচে আছেন বছরের পর বছর৷ শুধু তাই নয়, এখনও চালিয়ে যাচ্ছেন বৈজ্ঞানিক গবেষণা৷ এমনকি বইও লিখছেন, অন্যদের সাহায্য নিয়ে৷

তাঁর শরীরটা অকেজো হয়ে গেলেও মাথাটা ঠিকই কাজ করছে৷ এখন তিনি শুধু হাতের একটা আঙুল নাড়তে পারেন আর মুখের হাসিটা বোঝা যায়৷

মুখ দিয়ে কথা বলতে পারেন না, তবে তাঁর গলার কাছে একটা যন্ত্র লাগানো আছে৷ এ যন্ত্রটা তৈরি হয়েছে শুধু তাঁরই জন্য৷ সেই যন্ত্র দিয়ে তিনি মনের ভাব প্রকাশ করতে পারেন, কঠিন কঠিন অঙ্কও করে দেন৷ সে আওয়াজ শুনে তাঁর কথাগুলো সবাই বুঝতে পারে না, মাত্র কয়েকজন অনেক চেষ্টা করে বুঝতে শিখেছে৷ তাদের মধ্যে একটি মেয়ের নাম লিজা৷

স্টিফেন হকিং কিছু বলতে চাইলে লিজা তা শুনে নিয়ে অন্যদের বুঝিয়ে দেয়৷ সেইজন্য লিজাকেও সঙ্গে নেওয়া হয়েছে এই অভিযানে৷

শেষ পর্যন্ত নিরাপদেই চেয়ারসুদ্ধু স্টিফেন হকিংকে তোলা হল রকেটের মধ্যে৷

এই অভিযানের ক্যাপটেনের নাম গ্রেগরি হাওয়ার্ড৷ তিনি একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন৷

মহাশূন্য অভিযান সবসময়ই খুব বিপজ্জনক৷ ওঠার সময়ই আগুন লেগে যেতে পারে, ওপরে উঠেও বিস্ফোরণ হতে পারে৷ এরকম তো আগেও হয়েছে অনেকবার৷

তবে, এই দু’হাজার দশ সালে রকেট প্রায় নিখুঁতভাবে গড়া হয়েছে৷ দুর্ঘটনার সম্ভাবনা খুবই কম৷ কিন্তু যেতে যেতেই যদি কোনো কারণে হকিং-এর মৃত্যু হয়, তাহলে ক্যাপটেনের আর আপসোসের শেষ থাকবে না৷

হকিং অবশ্য জানিয়ে দিয়েছেন, মাঝপথে যদি তিনি মারা যান, তাহলে তাঁর মৃতদেহ আর ফিরিয়ে আনার দরকার নেই৷ গভীর সমুদ্রের জাহাজে কোনো নাবিকের মৃত্যু হলে যেমন তার দেহটা ফেলে দেওয়া হয় সমুদ্রে, সেইরকম তাঁর দেহটাও ভাসিয়ে দিতে হবে মহাশূন্যে৷

রকেটটা ঠিকঠাক ওপরে উঠে গেল৷

পৃথিবীর টান ছাড়িয়ে ছুটে চলল আরও দূরে৷

হকিং মুখ দিয়ে কিছু খাবারও খেতে পারেন না৷ কোনো কিছু গিলে ফেলার ক্ষমতাও তাঁর নেই৷ তাই খুব পাতলা সুপ তাঁকে খাওয়ানো হয় নল দিয়ে৷

লিজা সেইভাবে খাওয়াচ্ছে তাঁকে৷

ক্যাপটেন হাওয়ার্ড এসে বসলেন তাঁর পাশে৷

একটু পরে তিনি লিজাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘স্যারকে কি এখন দু-একটা প্রশ্ন করা যেতে পারে?’

লিজা বলল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, করুন না৷ উনি শুনতে পান সব, ওঁর উত্তরগুলো আপনাকে আমি বুঝিয়ে দেব৷’

হাওয়ার্ড বললেন, ‘স্যার, আপনার শরীরে এত অসুখ, তবু আপনি এত কষ্ট করে এই অভিযানে যেতে চাইছেন কেন?’

স্টিফেন হকিং খলখল করে হেসে বললেন, ‘কই, কিছু কষ্ট হচ্ছে না তো! তুমি যদি অন্য কোনো কথা চিন্তা করো, তা হলে শরীরে কষ্ট হলেও টের পাওয়া যাবে না৷’

হাওয়ার্ড জানতে চাইলেন, ‘আপনি এখন কী চিন্তা করছেন?’

হকিং জানালেন, ‘আমি মনে মনে ছটফট করছি৷ এতকাল আমি এই মহাশূন্যের জগৎ নিয়ে কত অঙ্ক কষেছি৷ এবার তার কিছুটা অন্তত নিজের চোখে দেখতে পাব৷ চাঁদ আর কত দূরে?’

‘বেশি দূরে নয়৷ আমরা কি চাঁদে নামব?’

‘না, হাওয়ার্ড৷ চাঁদ সম্পর্কে আমাদের অনেক কিছু জানা হয়ে গেছে৷ আমি আরও দূরে যেতে চাই৷’

‘স্যার হকিং, পৃথিবীর সবচেয়ে কাছে মঙ্গল গ্রহ৷ এখন আমরা ইচ্ছে করলে সেখানেও নামতে পারি৷’

‘মঙ্গল গ্রহেও আমার নামার ইচ্ছে নেই৷ সেখানে এখনও কোনো প্রাণীর খোঁজ পাওয়া যায়নি৷ তোমার রকেট আরও দূরে যেতে পারবে না?’

‘নতুন ধরনের জ্বালানি আবিষ্কারের পর আমাদের গতি অনেকটা বেড়েছে৷ তাই সময়ও অনেকটা কম লাগছে৷ এখন আমরা অনেকটা দূর পর্যন্ত যেতে পারি৷ স্যার আপনি কি মনে করেন, অন্য কোনো গ্রহে মানুষের মতন প্রাণী থাকতে পারে?’

‘হাওয়ার্ড, সূর্যের এই কয়েকটা গ্রহ ছাড়াও তো মহাকাশে আরও কত লক্ষকোটি গ্রহ আছে৷ পৃথিবীটা তো নেহাত একটা ছোটো গ্রহ৷ এখানে মানুষের জন্ম হয়েছে আকস্মিকভাবে৷ মানে, আগে ছোটো ছোটো প্রাণী, তারপর বড়ো বড়ো জন্তু-জানোয়ার আর মানুষ৷ তা শুধু পৃথিবীতেই প্রাণী থাকবে, আর এত লক্ষ-কোটি গ্রহগুলোর মধ্যে কোনো একটাতেও মানুষ কিংবা অন্যরকমের প্রাণী থাকবে না, তা কি হয়?’

লিজা বলল, ‘মানুষকে তো ভগবান সৃষ্টি করেছেন৷’

হকিং একটু হেসে বললেন, ‘তা হতেও পারে৷ কিন্তু ভগবান শুধু এই পৃথিবীটাকেই এত দয়া করবেন কেন? আরও যে এতসব গ্রহ-নক্ষত্র, এ সবেরও তো তিনিই মালিক৷ আর কোথাও তিনি মানুষ বানালেন না কেন? আর একটা কথা, ভগবান থাকেন কোথায়? স্বর্গে? সেই স্বর্গটাও নিশ্চয়ই আকাশের কোথাও একটা গ্রহ৷ সেটা কোথায়, তাও তো খুঁজে বার করতে হবে৷’

হাওয়ার্ড বললেন, ‘স্যার, আমি স্বর্গ খুঁজতে চাই না৷ সেটা খুব বিপজ্জনক ব্যাপার হবে৷ একবার স্বর্গে পৌঁছানো মানেই তো, মানুষ আর পৃথিবীতে ফিরতে পারবে না৷ আমি এত তাড়াতাড়ি স্বর্গে যেতে চাই না, পৃথিবীতে ফিরে আসতে চাই৷ আমার স্ত্রী আছে, দুটি ছেলেমেয়ে আছে৷’

হকিং আবার হাসলেন৷

মজা করে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘হাওয়ার্ড, তোমার ভগবানকে দেখতে ইচ্ছে করে না?’

হাওয়ার্ড খানিকটা ভয় পাবার ভান করে বললেন, ‘না, না, মাপ করবেন স্যার৷ ভগবানকে দেখলেই তো আমি আর মানুষ থাকব না৷ দেবতা হয়ে যাব৷ না স্যার, দেবতা হতে চাই না৷ মানুষ হয়েই বেঁচে থাকতে চাই৷ মরে যাবার পর যা হয় তা হবে৷’

হকিং বললেন, ‘ঠিক আছে, স্বর্গ-টর্গর কথা এখন থাক৷ আমি কী চাই জানো? আমি চাই এমন একটা গ্রহ, যেখানে মানুষ কিংবা কোনো প্রাণী-টানি না থাকলেও চলবে৷ তবে দেখতে হবে, সেখানে কার্বন আছে কি না৷ আর জল৷ জল থাকলে হাইড্রোজেন-অক্সিজেনও থাকবে৷ তা হলেই সেখানে মানুষ বাঁচতে পারবে৷’

‘আপনিই তো বললেন, সেখানে মানুষ না থাকলেও চলবে৷’

‘হ্যাঁ৷ যদি সেরকম গ্রহ পাওয়া যায়, তা হলে পৃথিবীর মানুষরাই একসময় সেখানে গিয়ে থাকবে৷ পৃথিবীর আবহাওয়া দিন দিন যেরকম দূষিত হয়ে যাচ্ছে, ওখানে আর বেশিদিন মানুষ টিকতে পারবে না৷ গরম বেড়ে যাচ্ছে৷ হিমবাহগুলো গলতে শুরু করবে৷ আর তাতে সমুদ্রগুলো ফুলে-ফেঁপে উঠবে, সব দেশ ডুবে যাবে একসময়৷ মনুষ্যজাতিকে বাঁচাতে হলে, অন্য গ্রহে বসতি করা ছাড়া গতি নেই৷’

‘স্যার, চাঁদেও তো মানুষ থাকতে পারে৷ চাঁদ খুব একটা দূরেও না৷’

‘চাঁদে খুব একটা সুবিধে হবে না৷ চাঁদে তো সহজভাবে চলাফেরার উপায় নেই, মুখে অক্সিজেন মাস্ক পরে থাকতে হবে৷ থাকতে গেলে বিশাল বিশাল কাচের ঘর বানিয়ে কৃত্রিম আবহাওয়া তৈরি করতে হবে৷ পৃথিবীর এত মানুষের মধ্যে কতজন আর সেখানে ধরবে! নতুন গ্রহ চাই৷’

‘অনেক তো খোঁজাখুঁজি করা হল৷ কোনো গ্রহেই ঠিকমতন জলের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না৷ অবশ্য আরও লক্ষ কোটি কোটি গ্রহ আছে ঠিকই, আমরা তো এখনও বেশি দূর যেতে পারি না৷ বহু দূরের কোনো গ্রহে মানুষের মতন কোনো প্রাণী যদি থেকেও থাকে, তারাও আসতে পারে না৷ কারণ, তারা ফিরতে পারবে না৷’

হকিং বললেন, ‘তা ঠিক৷’

তারপর তিনি লিজাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আলোর গতিবেগ কত তুমি জান?’

লিজা বলল, ‘তা জানব না কেন? এক মুহূর্তে এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল৷’

হকিং বললেন, ‘এই গতিবেগ দিয়ে মাপা হয়েছে আলোকবর্ষ৷ আমাদের রকেট যদি কখনও আলোর গতিবেগের সমান হতে পারে, তা হলে এক-দু-বছরের মধ্যে আমরা বহু বহু দূরে পৌঁছে যেতে পারব, ফিরেও আসতে পারব৷’

হাওয়ার্ড বললেন, ‘তা কী কখনও সম্ভব হবে?’

হকিং বললেন, ‘অসম্ভব কিছুই নয়৷ তবে, আমাদের জীবদ্দশায় সেই গতিবেগে না পৌঁছালেও, পরে হতে পারে!’

লিজা বলে উঠল, ‘একী, আকাশটা হঠাৎ এরকম অন্ধকার হয়ে গেল কেন?’

সত্যিই এতক্ষণ ঝকঝক করছিল নীল আকাশ, এখন একেবারে মিশমিশে কালো৷

হাওয়ার্ড বললেন, ‘আমরা চাঁদের উল্টোপিঠ দিয়ে যাচ্ছি৷ এদিকে সূর্যের আলো পৌঁছয় না৷’

লিজা বলল, ‘দিনের বেলা আমাদের পৃথিবীতে সূর্যের আলো আসে বলেই আমরা তখন চাঁদটা দেখতে পাই না৷’

একসময় সেই অন্ধকার কেটে গিয়ে আবার আলোয় ঝলমল করে উঠল আকাশ৷

হকিং পোর্টহোলের কাছে বসে তাকিয়ে থাকেন বাইরে৷ অনন্ত শূন্য ছাড়া কিছুই দেখার নেই, তাই ওঁর ভালো লাগে৷

পৃথিবী থেকে রাত্রির আকাশের তারাদের যেমন দেখায়, তার চেয়েও আরও উজ্জ্বল মনে হয় এখান থেকে৷

কয়েকদিন কেটে যাবার পর হঠাৎ রকেটের মধ্যে খুব হুড়োহুড়ি পড়ে গেল৷

রকেটের পর্যবেক্ষণ যন্ত্রে একটা কিছু ছুটন্ত বস্তুর সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে৷ এটা কী হতে পারে?

মহাকাশে অনেক ছোটো-বড় পাথরের টুকরো উড়ে বেড়ায়৷ পৃথিবীর কাছাকাছি এসে সেগুলো সাধারণত পুড়ে ছাই হয়ে যায়, কিংবা গুঁড়োগুঁড়ো হয়ে যায়৷ দু-একটা পৃথিবীকে আঘাতও করেছে অতীতে৷ রকেট চালাবার সময় আগুনের থেকে সাবধান থাকতে হয়৷

খানিক পরে আবার বিস্ময়ের ব্যাপার হল৷

যে বস্তুটার গতি টের পাওয়া যাচ্ছে, সেটা পাথর নয়, একটা যন্ত্র৷ তার আওয়াজ আছে৷

তার মানে কি অন্য একটা রকেট?

রাশিয়া কি এই সময় রকেট পাঠিয়েছে? কিংবা চিনদেশ অথবা ভারত? তা তো হতে পারে না৷ আজকাল কোনো দেশই গোপনে কিছু করে না৷ রাশিয়া-আমেরিকা একসঙ্গে অভিযান চালায়৷ একসঙ্গে দুটো দেশ কখনও আলাদা আলাদা রকেট উৎক্ষেপণ করবে না৷

তা হলে?

অন্য গ্রহ থেকে আসছে?

টিভির স্টার ওয়ার সিরিয়ালে যেমন থাকে? কিন্তু সেসব তো গল্প৷ সূর্যের কোনো গ্রহেই তো কোনো বুদ্ধিমান প্রাণীর খোঁজ পাওয়া যায়নি৷ তবে কি আসছে আরও দূর থেকে? তা কি সম্ভব?

আরও কিছু পরে নিশ্চিতভাবে বোঝা গেল, একটা রকেটই ধেয়ে আসছে এদিকে৷

সবার মুখে একটা ভয়ের ছায়া৷ খবর পাঠানো হতে লাগল পৃথিবীর রকেট সেন্টারে৷ এখন কী হবে?

ওরা যদি কোনো হিংস্র প্রাণী হয় কিংবা উন্নত কোনো অস্ত্র সঙ্গে আনে, তা হলে এই রকেট আক্রমণ করলে তো বাঁচার কোনো উপায়ই নেই৷

স্টার ওয়ারে যাই-ই দেখাক, পৃথিবীর এই রকেট শুধু বিজ্ঞান গবেষণার জন্য, এর মধ্যে কোনো অস্ত্রই নেই৷ কামান, বন্দুক কিংবা বোমা নিয়ে এই রকেটে ওঠা নিষেধ৷

হকিং বললেন, ‘আগেই ধরে নিচ্ছ কেন যে ওরা আমাদের শত্রু হবে? কাছে আসতে দাও৷ দেখোই না কী হয়!’

সবাই তাকিয়ে রইল সামনের দিকে৷ রকেটটা সোজা ছুটে আসছে এদিকেই৷

অনেকেরই বুক ধকধক করছে৷ অচেনা রকেটটা থেকে যদি গুলি ছুড়তে শুরু করে তাহলে বাঁচার কোনো আশাই নেই৷

হকিং লিজাকে বললেন, ‘তুমি ক্যাপটেনকে বলে দাও যেন আমাদের গতি স্তব্ধ করে রাখেন৷’

অন্য রকেটটা একেবারে কাছে এসে থেমে গেল৷ এবার কি গুলি চালাবে?

সেরকম কিছু হল না৷

কারুকে দেখাও গেল না, কোনো কথাও শোনা গেল না৷ এ রকেট নিশ্চয়ই কেউ বা কয়েকজন চালাচ্ছে৷ তারা কোথায়?

কয়েক মিনিট একেবারে চুপচাপ৷

হাওয়ার্ড হকিংকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘স্যার, এখন আমরা কী করব?’

হকিং বললেন, ‘চুপ, চুপ! কথা বলার চেষ্টা করে লাভ নেই৷ ওরা পৃথিবীর কোনো ভাষা বুঝবে না৷’

তারপরেই হকিং শুনতে পেলেন ওদের ক্যাপটেনের কথা৷ ঠিক শুনলেন না, মনে মনে বুঝতে পারলেন৷

এ একটা অন্যরকম বিজ্ঞান৷ এতে ভাষাজ্ঞান লাগে না৷ একজনের চিন্তার তরঙ্গ অন্য একজনের মনের মধ্যে ঢুকে যায়৷ সে তার নিজের ভাষায় তা বুঝে নেয়৷

হকিং মনের মধ্যে শুনলেন, অন্য রকেটের ক্যাপটেন জিজ্ঞেস করছেন, ‘আপনারা কে?’

হকিং মনে মনে বললেন, ‘আমরা পৃথিবী নামে একটা গ্রহের প্রাণী৷ আমাদের নাম মানুষ৷’

অন্য রকেটের ক্যাপটেন বললেন, ‘পৃথিবী? এরকম কোনো গ্রহের নাম শুনিনি৷ মানুষ সম্পর্কেও কিছু জানি না৷’

হকিং বললেন, ‘তা তো হতেই পারে৷ আমরা নিজেরাই নাম দিয়েছি পৃথিবী আর নিজেরাও নিজেদের মানুষ বলি৷ অন্য গ্রহের প্রাণীরা তা জানবে কী করে? আপনারা কোথা থেকে আসছেন?’

অন্য ক্যাপটেন বললেন, ‘আমাদের গ্রহের নাম শুনলেও তোমরা চিনতে পারবে না৷ মোটকথা, সেটা সাত আলোকবর্ষ দূরে৷’

হকিং জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনাদের কারুকে দেখতে পাচ্ছি না কেন? আপনাদের চেহারা কীরকম? আপনারা আমাদের দেখতে পাচ্ছেন?’

অন্য ক্যাপটেন বললেন, ‘হ্যাঁ, আপনাদের দেখতে পাচ্ছি৷ আপনাদের চেহারা অনেকটা আমাদেরই মতন৷ তবে লম্বায় একটু ছোটো আর রোগা৷ আপনারা আমাদের দেখতে পাচ্ছেন না৷ তার কারণ একটাই হতে পারে৷ আপনারা মোট কটা রং দেখতে পান?’

হকিং বললেন, ‘কালো বাদ দিলে, মূল রং সাতটা৷’

অন্য ক্যাপটেন বললেন, ‘সেইজন্যই৷ আমরা দেখতে পাই উনিশটা মূল রং৷ আমাদের গায়ের রং আপনাদের চেনা সব রঙের বাইরে, তাই আপনাদের চোখ আমাদের গায়ের রং ধরতে পারছে না৷ একটা বিশেষ ধরনের চশমা পরলে দেখতে পাবেন৷’

হকিং জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনারা এদিকে কোথায় যাচ্ছেন?’

অন্য ক্যাপটেন বললেন, ‘বিশেষ কোথাও না৷ এমনিই ঘুরে বেড়াই৷ আমরা যাযাবর৷’

হকিং বললেন, ‘এমনিই ঘুরে বেড়ান মানে? কোনো উদ্দেশ্য নেই? নিজেদের গৃহে ফিরে যান না?’

অন্য ক্যাপটেন বললেন, ‘অনেকদিন পর পর ফিরি৷ না ফিরলেও চলে৷ আমরা বেড়াতে ভালোবাসি৷ কত মজার মজার গ্রহ-নক্ষত্র দেখি৷ এই তো একটা নক্ষত্র দেখলাম, সেটা সবসময় নাচে৷’

হকিং জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনারা শুধু ঘুরে বেড়ান? খাবার-দাবার পান কোথা থেকে? আপনাদের জল লাগে নিশ্চয়ই৷’

অন্য ক্যাপ্টেন বললেন, ‘হ্যাঁ, জল লাগে৷ সে জল আমরা নিজেরাই তৈরি করে নিই৷ আর আমাদের রকেটের মধ্যেই খাদ্য উৎপাদনের ব্যবস্থা আছে৷ অনেক কিছুই রিসাইক্লিং করে নিই৷’

হকিং বললেন, ‘বাঃ, চমৎকার ব্যাপার তো৷ আপনারা যাযাবর৷ আমি পৃথিবীর একজন বৈজ্ঞানিক৷ আপনারা আমাকে আপনাদের দলে নেবেন?’

অন্য ক্যাপটেন বললেন, ‘আপনি আমাদের সঙ্গে ঘুরতে চান? বেশ তো চলে আসুন৷’

হকিং বললেন, ‘আমি কিন্তু পঙ্গু মানুষ৷ হাঁটতে পারি না, উঠে দাঁড়াতেও পারি না৷ নিজে নিজে শুধু চিন্তা ছাড়া আর কিছুই করতে পারি না৷ তবু আমার খুব বেড়াবার শখ৷’

অন্য ক্যাপটেন বললেন, ‘তাতে কোনো সমস্যা নেই৷ আমরা আপনাকে সবরকম সাহায্য করতে রাজি আছি৷ চলে আসুন, তা হলে৷’

হকিং-এর মুখে হাসি ফুটে উঠল৷

সবাই চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে৷

হকিং বললেন, ‘লিজা, ক্যাপটেনকে বলো, আমাকে ওই রকেটে পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করতে৷ আমি ওদের সঙ্গে যাব৷’

লিজা দারুণ অবাক হয়ে বলল, ‘ওদের সঙ্গে যাবেন? সে কি! ওরা কারা? ওদের সম্পর্কে আপনি কতটুকু জানেন?’

হকিং বললেন, ‘যতটুকু বুঝেছি, ওরা ভালো প্রাণী৷ ওদের কোনো খারাপ উদ্দেশ্য নেই৷ ওরা সারা আকাশ ভ্রমণ করে বেড়ায়৷ আমি ওদের সঙ্গী হব৷’

লিজা বলল, ‘আপনার এই শরীর নিয়ে আপনি ওদের সঙ্গে যাবেন কী করে?’

হকিং বললেন, ‘তাতে কোনো অসুবিধে হবে না৷ ওরা সাহায্য করবে বলেছে৷’

লিজা জানে হকিং-এর জেদ৷ একবার যা বলেন, তা আর কিছুতেই ফিরিয়ে নেন না৷

সে প্রায় কান্নায় ভেঙে পড়ে বলল, ‘আপনি ফিরবেন কী করে? কতদিন পরে? ওরা কি আপনাকে পৃথিবীতে পৌঁছে দেবে?’

হকিং বললেন, ‘ওরা পৃথিবীতে ফিরিয়ে দিতে পারবে কি না জানি না৷ না ফিরলেই বা ক্ষতি কী! পৃথিবীতে আমার কাজ শেষ৷ এখন আমার প্রিয় আকাশে আকাশে ঘুরে বেড়াব৷ এইভাবেই আমি মরতে চাই৷ ক্যাপটেনকে ব্যবস্থা করতে বলো শিগগির৷’

ক্যাপটেনও হকিংকে বোঝাবার অনেক চেষ্টা করলেন৷ অন্য কর্মীরাও ঘিরে দাঁড়িয়ে বলতে লাগলেন, ‘স্যার, যাবেন না, যাবেন না!’

হকিং কোনো অনুরোধেই কর্ণপাত করলেন না৷ শুধু বলতে লাগলেন, ‘তাড়াতাড়ি৷ তাড়াতাড়ি৷ ওরা কতক্ষণ অপেক্ষা করবে!’

শেষ পর্যন্ত ডকেটিং করে হকিংকে চালান করে দিতে হল অন্য রকেটে৷ তার মধ্যে কারুকেই দেখা যাচ্ছে না, তবু কারা যেন যত্ন করে তুলে নিল তাঁকে৷

তারপরই হুশ করে বেরিয়ে গেল সেই রকেট৷ প্রায় চোখের নিমেষে মিলিয়ে গেল মহাশূন্যে৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *