নয়
সাত দিন সাত রাত্রি রোগিণীর শিয়রে ঠায় জেগে এবং একবার ডাক্তারখানা আর একবার রোগিণীর ঘর ছুটোছুটি করে মহেন্দ্র শেষ পর্যন্ত গায়ত্রীকে বাঁচালে। সবাইকে বলতে হল, এমন বাঁচা কেউ কখনও দেখেনি। যাকে বলে মরা বাঁচানো। সবাই বললে, হিন্দুর ঘরের বিধবার কই মাছের প্রাণ, তাই বাঁচলো। অন্য কেউ হলে বাঁচতো না।
জ্বর ছেড়ে যাবার পরদিন গায়ত্রী মহেন্দ্রর দিকে চেয়ে হেসেছিল। অনেকদিন পরে তার মুখে এই প্রথম হাসি।
বলেছিল, মরা গাছ বাঁচালে তো? সারা জীবন ধরে তার কত প্রায়শ্চিত্ত করতে হয় দেখো।
মহেন্দ্র বলেছিল, দেখবো’খন। সেজন্যে তোমাকে ব্যস্ত হতে হবে না।
গায়ত্রী বলেছিল, সেজন্যে ব্যস্ত হচ্ছিও না। কিন্তু খৃস্টানের হাতে জল খেয়েছি, ফল খেয়েছি, তার প্রায়শ্চিত্ত কি, সে তো আমাকে ভাবতেই হবে।
বলে হেসে পাশ ফিরে শুয়েছিল।
তার পর থেকে মহেন্দ্র আর ওবাড়ী যায়নি। যাবার প্রয়োজনও হয়নি, কেউ তাকে ডাকতেও আসেনি। কিন্তু সেই থেকে এ পর্যন্ত একটা কথাই সে দিনরাত্রি ভাবছে, গায়ত্রীকে সে বাঁচালো কেন? রোগী বাঁচানোই ডাক্তারের পেশা। সাধারণ ক্ষেত্রে ডাক্তারের মনে এ প্রশ্ন ওঠেই না। কিন্তু শুধু সেই উত্তর কিছুতেই সান্ত্বনা দিতে পারছে না।
কিছুদিন থেকে মহেন্দ্র বাইরে বেরুনো ছেড়েই দিয়েছে। দু’চার জন বন্ধুবান্ধব মহেন্দ্রর কাছে সবে মাত্র আসতে আরম্ভ করেছিল। মহেন্দ্রর গম্ভীর মুখের দিকে চেয়ে তারাও আসা বন্ধ করেছে। মহেন্দ্র একাই সারাদিন কাটায়। কখনও বারান্দায়, কখনও বাগানে একা-একা ঘুরে বেড়ায়। ভালো না লাগলে ইজি চেয়ারে শুয়ে বই খুলে বসে। বইপড়া ভালো না লাগলে আবার বারান্দায় পায়চারী করে।
এমনি সময়ে নরেন কলকাতা থেকে ফিরলো এবং ফেরার এক ঘণ্টা পরেই এক গাদা কাগজ বগলে মহেন্দ্রর কাছে এসে উপস্থিত হল।
এসেই বললে, সমারোহটা বোধ হয় বেশিই হয়ে গেল মহিন। ঠিক আন্দাজ করতে পারিনি। এইটে নিমন্ত্রিতের ফর্দ। এঁরা সবাই বড় বড় ব্যাঙ্কওয়ালা। সবাই দয়া করে আসবেন। এঁদের জন্যে তিনখানা বগি রিজার্ভ করে এসেছি। থাকতে কেউ পারবেন না। ঘণ্টা কয়েক থেকে ফিরতি ট্রেনে চলে যাবেন। কাজের লোক, বুঝছ না? থাকবার উপায় নেই। শুধু অত্যন্ত ধরা-পাড়া করাতেই আসতে রাজি হয়েছেন। এই গেল ওদিকের। এদিক থেকে আসছেন, ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব, জজ সাহেব, পুলিশ সাহেব, এস. ডি. ও. তারপরে পাবলিক প্রসিকিউটার খান বাহাদুর সাদেক আলি আর আমাদের উকিল মনোহর বাবু। এঁরা সবাই রাত্রিটা এখানে থাকবেন। ডিনারের আয়োজনটা কি হবে সেটা বিবেচনা করতে হবে। এই সব নানা ঝঞ্ঝাট। তারপরে আমার অভিভাষণটাও মনোহর বাবুকে দিয়ে লিখিয়ে এনেছি। ছাপতে দিচ্ছিলাম। ভাবলাম, তোমাকে একবার দেখানো দরকার। আজকেই সেটা দেখে দিলে কাল…তোমার শরীর কি ভালো নেই মহিন? কেমন অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে?
মহিন তাড়াতাড়ি বললে, ভালোই তো আছি। আপনার সব কথাই তো শুনছিলাম। আমি বলছিলাম, আমাকে এমন চুপচাপ বসিয়ে রাখবেন না। আপনার কাজের কিছু কিছু ভাগ আমাকে দিন।
নরেন হো হো করে হেসে উঠলো।
বললে, সেই জন্যই তো তোমার কাছে এলাম মহিন। এই সব অতিথিদের সম্বর্ধনার সমস্ত ভারই তো তোমাকে নিতে হবে।
—তাই নোব। এরকম করে বসে থাকতে আমার ভয়ানক কষ্ট হচ্ছে।
নরেন বললে, আর একটি কাজ করে এসেছি ভাই। তোমার সঙ্গে পরামর্শ করার জন্যে আর অপেক্ষা করতে পারলাম না।
—কি কাজ?
—একখানা মোটর গাড়ী কিনে ফেললাম। ওটাও দরকার, বুঝলে। এদিকে রাস্তা– ঘাট অবশ্য মোটর চলবার পক্ষে খুব ভালো নয়। তবু কয়েকটা মাস চলা যায়। সদরে যাওয়া আসা তো আমার আছেই। মোটর হলে নিজের সুবিধামত সময়ে যাওয়া-আসা করা যায়। তারপরে স্টেশন যাতায়াত তো দিব্যি চলে।
মহিন উৎসাহিত হয়ে উঠলো। বললে, বেশ করেছেন। সদরে যাবার রাস্তা তো মিলিটারীর কল্যাণে চমৎকার হয়েছে।
নরেন খুশি হয়ে বললে, তাহলে তোমার সম্মতি আছে?
—খুব সম্মতি আছে। আমি তো একটা ঘোড়া কেনবার কথা ভাবছিলাম। হয়তো কিনতেও হবে।
—ঘোড়া!
—আজ্ঞে হ্যাঁ। ক’দিন থেকে আমি ভাবছি দাদা, কলকাতায় না গিয়ে যদি এখানেই প্র্যাকটিস করতে বসি, তাহলে মন্দ কি হয়?
—এখানে?
—আজ্ঞে হ্যাঁ। আমার তো খুব বেশি টাকার দরকার নেই। অথচ এদিকে ডাক্তারের খুব দরকার। সত্যিকার চিকিৎসা হয় না বললেই চলে।
—কিন্তু এরা তো পয়সা দেবে না মহিন।
—না দিকগে। আমার টাকার দরকারই বা কি?
নরেন এবার হাসলে। বললে, ওইটি বাজে কথা ভাই। বিনাপয়সায় কোনো কাজ হয় না। দু’দিন পরোপকারের উৎসাহে খুব হয়তো খাটলে। তারপর আর ভালো লাগবে না। তখন রোগী ডাকতে এলে শরীর খারাপ করছে বলে শুয়ে থাকবে। ও আমি জানি কি না।
নরেন হাসতে লাগলো।
বললে, একটা রোগী যদি বিনাপয়সায় দেখ, তার পর থেকে আর কেউ তোমাকে একটি পয়সাও ঠেকাবে না। এমনি এখানকার দস্তুর।
মহেন্দ্র হেসে বললে, ভেবে দেখি।
নরেন বললে, হ্যাঁ, ভেবে দেখ। আরও নানা কারণেই গ্রামে থাকা হয়তো তোমার সুবিধা হবে না, কিন্তু সে সব ভাবনা এখন নয়। এখন আমি উঠলাম। রাত্রে তোমার খাওয়া-দাওয়ার পরে আর একবার হয়তো আসব।
বলে চলে গেল।
.
হাতে কাজ পেয়ে মহেন্দ্র নতুন উৎসাহে উদ্দীপিত হল।
ব্যাঙ্কের আসবাবপত্র এসে গেছে। সেগুলো সাজানো এবং আবশ্যকীয় মিস্ত্রির কাজ চলছে। এর পরে উৎসবের জন্যে পত্রপুষ্প দিয়ে সাজানোর কাজ আছে। অভ্যাগতদের জলযোগ, রাত্রের ডিনার এবং শয়নের ব্যবস্থা করতে হবে। কি কি খাওয়ানো হবে তার ফর্দ সে রোজ করছে আর রোজ কাটছে। এর পরে সেই ফর্দ অনুযায়ী কলকাতায় লোক যাবে জিনিস আনতে।
ইতিমধ্যে মোটরগাড়ীখানা এসে গেল। ঝকঝকে নতুন মোটর গাড়ী।
মহেন্দ্র বৌদির কাছে গিয়ে ধর্ণা দিলে।
বললে, চলো বৌদি, তৈরী হয়ে নাও।
—কোথায় যাব?
—বেড়াতে।
সুবর্ণ আকাশ থেকে পড়লো। বললে, বেড়াতে যাব কি? এ কি কলকাতা শহর পেয়েছ?
—আরে হেঁটে কি আর যাবে, মোটরে।
—কাদের মোটর?
—আমাদেরই। দাদা নতুন কিনলেন। চলো তোমাকে নিয়ে খানিকটা ঘুরে আসি।
—সত্যি?–আনন্দে সুবর্ণর চোখ চকমক করে উঠলো। তোমার দাদা কিছু বলবেন না তো?
—কিছু বলবেন না। তুমি চলতো। ছেলেদুটোকেও সঙ্গে নাও
—কে চালাবে?
—আমি।
—তুমি চালাতে পারো? যুদ্ধে গিয়ে শিখেছ বুঝি?
—হ্যাঁ। তুমি আর দেরি কোরো না। সন্ধ্যের আগে ফিরতে হবে।
সুবর্ণর নিজেরও মোটরে চড়বার লোভে তর সইছিলো না। সে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিয়ে গাড়ীতে বসলো। মাথায় এক হাত ঘোমটা। বড় ছেলেটি সামনে কাকার পাশে গিয়ে বসলো। ছোটটি মায়ের কাছে। তাদের মুখ থেকে হাসি যেন উপচে পড়ছে।
গ্রাম পার হতেই মহেন্দ্র বললে, রাস্তায় লোক নেই, এইবার তোমার ঘোমটা খুলে ফেল। তোমার ঘোমটা দেখে আমারই গরম লাগছে।
বাদশাহী সড়কটা মিলিটারীর জন্যে সত্যই চমৎকার হয়েছে। কালো মিশমিশে পিচ- ঢালা রাস্তা। গাড়ী যেন উড়ে চলেছে দুই পাশের ধান-ক্ষেতের মধ্য দিয়ে।
এক জায়গায় একটা প্রকাণ্ড দীঘি। তার চারপাশে অনেকখানি মজে সমান হয়ে এসেছে। সেইখানে মোটরখানা পাশ কাটিয়ে ঘুরিয়ে রেখে মহেন্দ্র বললে, এইখানে একটু বসা যাক বৌদি। কি বল?
চারিদিকে দিগন্ত প্রসারিত মাঠ। বহু দূরে দূরে গ্রামের শ্যাম তরুরেখা দেখা যাচ্ছে। পশ্চিমে সূর্য অস্ত যাচ্ছে, আকাশ লালে লাল। ছেলেরা সেই পুকুরের ধারে ছুটে ছুটে লাফিয়ে লাফিয়ে খেলা করতে লাগলো। ওরা দু’জনে ঘাসের উপর বসলো।
সুবর্ণর জীবনে এমন দিন কখনও আসেনি। এমনি উন্মুক্ত মাঠের উপর এসে বসবার কল্পনা সে জীবনে কোনো দিন করেনি। পশ্চিমের টকটকে লাল মেঘের আভা এসে পড়েছে তার মুখের উপর। চোখ যেন খুশিতে নাচছে।
দূরের একখানা গ্রাম দেখিয়ে বললে, ওইটে আমাদের শ্রীপুর। না ঠাকুরপো?
মহেন্দ্ৰ হেসে বললে, শ্রীপুর? সে এখান থেকে পনেরো মাইল দূরে। আমরা অনেক দূর এসে পড়েছি। ভয় করছে?
—না, ভয় কি? তুমি মিলিটারী বীর সঙ্গে রয়েছ।
মহেন্দ্র বললে, আমার কি ইচ্ছা করছে জানো? দাদা সঙ্গে থাকলে তোমার মুখখানা একবার দেখতেন। বাড়ীর ভিতরে তোমাকে দেখলে মনে হয় ষষ্ঠি বুড়ী। যেন কত তোমার বয়স, কত গিন্নি। এখানে দেখে মনে পড়ছে, প্রথম যেদিন আমাদের বাড়ী এলে সেইদিনের কল্যাণী মূর্তি। এ মূর্তি ভুলেই গেছলাম।
সুবর্ণ লজ্জা পেয়ে অন্য দিকে মুখ ফেরালে। বললে, তোমার দাদা এ মূর্তি দেখতে চানও না।
—এ মূর্তি ভুলে গেছেন বলেই চান না। এর পরে যেদিন আসব মাকেও নিয়ে আসতে হবে। আর আনব কিছু হালকা খাবার। এইখানে একটা তোয়ালে বিছিয়ে সবাই মিলে খাব। কি বল? না, আমার সঙ্গে তোমরা খাবে না?
সুবর্ণ হাসলে। শেষ কথাটার জবাব আর দিলে না। আগের বিষয়টা নিয়ে বললে, মা আসবেন, তবেই হয়েছে! আমাকে এনেছ, এতেই তোমার দাদা কি বলেন দেখ।
—বলেন, বয়ে গেল। এক কান দিয়ে ঢুকবে, আর এক কান দিয়ে বেরিয়ে যাবে। গায়ে তো আর ফোস্কা পড়বে না?
—তোমার হয়তো পড়বে না ঠাকুরপো। কিন্তু আমি মেয়েমানুষ, আমি তো অত শীগগির নিষ্কৃতি পাব না।
ওদের বেরুতে একটু দেরী হয়ে গেল। কারও যেন উঠতে ইচ্ছা করছিল না। যখন উঠলো, তখন সূর্য ডুবে গেছে। মাঠের উপরও ধীরে ধীরে অন্ধকার নেমে আসছে। হেড-লাইট জ্বালিয়ে মহেন্দ্র মোটরে স্টার্ট দিলে।
এও এক নতুন অভিজ্ঞতা। অন্ধকারের মধ্য দিয়ে মোটরের এই তীব্র গতি সুবর্ণর সমস্ত দেহে এক অদ্ভুত অনুভূতি আনছিল। সেই অনুভূতি সে যেন সর্বাঙ্গ দিয়ে উপভোগ করতে লাগলো।
আর একটা মাঠ পার হলেই শ্রীপুর।
হঠাৎ মহেন্দ্রের মনে হল, ওদের গ্রামের কোল থেকে অনেকগুলো আলো আসছে।
বললে, সর্বনাশ বৌদি। দাদা বোধ হয় পাইক-বরকন্দাজ পাঠিয়েছেন।
চক্ষের পলকে অনুভূতির সমস্ত জাল গেল ছিঁড়ে। সুবর্ণ ভয়ে ও দুশ্চিন্তায় সোজা হয়ে উঠে বসলো।
জিজ্ঞাসা করলে, কি করে জানলে?
—ওই আলোগুলো দেখছ না? মনে হয়, ফিরতে দেরি দেখে আমাদেরই খুঁজতে বেরিয়েছে।
—তুমি তাহলে আরও জোরে চালাও ঠাকুরপো।
ওদের লোকই বটে। অল্পক্ষণ পরে ওদের পাশ কাটিয়ে মোটরখানা বিদ্যুৎ বেগে বেরিয়ে গেল।
বাড়ীতে ঢুকতে সামনেই দাদা। উদ্বেগে ভদ্রলোকের মুখ শুকিয়ে গেছে।
সুবর্ণ তো একগলা ঘোমটা টেনে ছেলেদের হাত ধরে সুড় সুড় করে ভিতরে চলে গেল। নরেন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গজগজ করতে লাগলো :
—কী কাণ্ড তোমাদের! ভাবলাম, কোনো বিপদই বা হল। তাও বিচিত্র নয়। বিশেষ, (নরেন গলাটা খাটো করে বললে) কিছু দিন থেকে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ রীতিমত দেখা দিয়েছে। এখন এরকম করে বেরুনো নিরাপদ নয়। তুমি তো দেশে থাকো না, দেশের বর্তমান অবস্থাও জানো না। ছেলেদের নিয়ে এরকম বেরুনো মোটেই নিরাপদ নয়, বুঝলে?
মহেন্দ্র তা বুঝলে কি না বোঝা গেল না। মোটরখানা গ্যারাজে রেখে নিঃশব্দে বাগানবাড়ীর উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লো।
পিছন থেকে নরেন চীৎকার করলে দাঁড়াও, দাঁড়াও। অন্ধকারে বেরুনো হবে না। সাপ-খোপের ভয় বেড়েছে। ওরে রাম সিং, একটা আলো নিয়ে সাহেবের সঙ্গে সঙ্গে যা।
মহেন্দ্ৰ হাসলে। এত গোলযোগের মধ্যেও নরেনের মহেন্দ্রকে সাহেব বলতে ভুল হল না!