সাত
রাত্রে আহারান্তে নিচের বিছানায় তাকিয়া ঠেস দিয়ে বসে নরেন গড়গড়া টানছিল। সামনে কতকগুলো কাগজপত্র পড়ে। সমস্তটা দিন আজ সে ব্যাঙ্কের বাড়ীটা মেরামত করা নিয়েই ব্যস্ত ছিল। দিন আর বেশি নেই। এরই মধ্যে সমস্ত আয়োজন সম্পূর্ণ করে ফেলা সহজ কাজ নয়। ব্যাঙ্কের কতকগুলো আসবাবপত্রের জন্যে কলকাতায় লোক গেছে। সে এখনো ফিরলো না কেন, তাও এক চিন্তার বিষয়। আজ রাত্রের ট্রেনে না এলে, কাল তাকে টেলিগ্রাম করার দরকার হবে। এর পর তাকে একবার সদরে যেতে হবে, ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ সাহেব, সরকারী উকিল প্রভৃতির সঙ্গে উদ্বোধন সম্পর্কে আলোচনা করার জন্যে। সেখান থেকে সোজা তাকে যেতে হবে কলকাতায়। সেখানে নিমন্ত্রণপত্র ছাপানো আছে, কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ীকে নিমন্ত্রণ করা আছে এবং আরও কত যে কাজ আছে তা বলে শেষ করবার নয়। এর সঙ্গে তার নিত্যকার কাজ আছে। সেও অনেক। অথচ মাঝে আর পনেরোটা দিনও নেই।
কতকগুলো জরুরী বিল সে চেক করছিল। এমন সময় সুবর্ণলেখা এসে তার সামনে পানের ডিবেটি খুলে ধরলে।
তা থেকে একটি পান নিয়ে নরেন আবার হিসাবে মন দিলে।
সুবর্ণ জিজ্ঞাসা করলে, এবার তাহলে ‘রায়বাহাদুর’ না হয়ে আর ছাড়ছ না?
নরেন হেসে বললে, সেই রকমই তো মনে হচ্ছে। আমাদের উকিল জানাচ্ছেন, ম্যাজিস্ট্রেট এসম্বন্ধে তাঁকে এক রকম পাকা কথাই দিয়েছেন।
—আবার গেল বারের মতো ভেস্তে যাবে না তো?
নরেনের মুখ মলিন হল। গেল বারে ব্যাপারটা সে এমন জানাজানি করে ফেলেছিল যে, উপাধির তালিকায় নাম না দেখে লজ্জায় তিন দিন বাইরে বার হতে পারে নি।
বললে, কি জানি। তবে যাবে না বলেই বিশ্বাস। এ ম্যাজিস্ট্রেট খাস বিলিতি। মিথ্যে আশ্বাস দেবার লোক নন।
সাহেব জাতের উপর নরেনের আবাল্য গভীর বিশ্বাস এবং শ্রদ্ধা।
বিলিতি সাহেবের কথায় ঘরের দিশি সাহেবটির কথা সুবর্ণর মনে পড়লো।
বললে, ভালো কথা, এর মধ্যে ঠাকুরপোর সঙ্গে তোমার দেখা হয়েছে?
হিসাবের খাতা থেকে মুখ তুলে নরেন সবিস্ময়ে বললে, না, কেন বলো তো?
—সাহেবের মেজাজ যেন গরম গরম ঠেকছে।
—কেন বলো তো? তার যত্নের কোনো ত্রুটি হচ্ছে বোধ হয়। কাজের ভিড়ে আমি এ ক’দিন আর ওদিকে যাবার সময় পাইনি। না, না। ওর দিকে তুমি নিজে লক্ষ্য রাখবে। ভারি অভিমানী ছেলে। কোনো অসুবিধা যেন না হয়।
—সেদিকে আমার লক্ষ্য আছে মশাই। কিন্তু সে সব নয়।
—তবে?
—ওর মনে বোধ হয় সন্দেহ হয়েছে, সমুদ্র পার হয়েছিল বলেই ছলে-ছুতোয় আমরা ওকে বাইরে রেখেছি। বাড়ীতে জায়গা দিইনি।
—তাই নাকি?
—হ্যাঁ।
চিন্তিতমুখে নরেন কিছুক্ষণ নিঃশব্দে বসে রইল। তারপর বললে, ভায়ার এখানে যা হিতৈষীর ভিড়! সন্দেহ আসা বিচিত্র কিছু নয়। কালই গিয়ে ওকে তোয়াজ করে আসতে হবে।
দৃঢ়কণ্ঠে সুবর্ণ বললে, না।
—কি না?
—তোয়াজ করতে যেতে পাবে না।
—কেন?
—কিসের জন্যে তোয়াজ করবে? আমরা তো অন্যায় কিছু করিনি। ঠাকুরপো কালাপানি পার হয়েছিল, খাদ্যাখাদ্যের বিচার নেই, সে তো সত্যি কথা। বাড়ীতে আমাদের রাধাবল্লভের নিত্যভোগ। কী করে আমরা তাকে বাড়ীতে জায়গা দিই? এ কি অন্যায় আবদার!
—বাড়ীতে জায়গা তো দিই-ই নি। আবদারও সে কিছু করেনি। কিন্তু বাবা আজকে বেঁচে নেই। নিজের বাড়ী থেকে সে যদি দুঃখ পেয়ে চলে যায়, সে কি ভালো হবে?
—দুঃখ যদি পায় নিজের দোষেই পাবে। সে দায়িত্ব আমাদের নয়।
নরেন হেসে বললে, নয় মানি। কিন্তু ভায়ে ভায়ে সম্পর্ক তো কেবল দায়িত্ব আর কর্তব্যের নয়, হৃদয় বলে একটা বস্তু আছে যে! তাদের যে নাড়িতে নাড়িতে যোগ কিন্তু তুমি আর রাত্রি জেগো না বড় বৌ। আমার এগুলো শেষ করে উঠতে অনেক রাত্রি হবে। তুমি শুয়ে পড় গো।
সুবর্ণ উঠলো না। আরও কিছুক্ষণ নিঃশব্দে সেইখানে বসে রইল।
তারপর বললে, ঠাকুরপোর উপর আমারও যে স্নেহ নেই সেকথা ভেবো না। কিন্তু কারও কাছে তুমি মাথা নোয়াবে, কারও সেবার জন্যে তুমি ব্যস্ত হয়ে উঠবে, এ আমি সইতে পারি না।
নরেন হেসে বললে, কারও জন্যে তো নয় বড় বৌ, ভায়ের জন্যে। এটা স্বতন্ত্র ব্যাপার।
সুবর্ণ চুপ করে রইল।
তার পর বললে, তুমি যে বলছিলে অনেক হিতৈষীর ভিড় হয়েছে সেকথা মিথ্যে নয়। বেণী বাঁড়ুয্যের বাড়ীতে সাহেবের যে সেদিন নিমন্ত্রণ ছিল, শুনেছ?
নরেন চমকে উঠে বললে, তাই নাকি? শুনিনি তো!
—হয়েছিল। নিজেদের তো শুনিছি দুবেলা নুন-ভাত জোটে না। অথচ খাবার আয়োজন হয়েছিল নাকি গুরুতর।
নরেন নিঃশব্দে শুনে যেতে লাগলো।
—খাইয়ে-দাইয়েও গায়ত্রী নাকি তাকে ছেড়ে দেয়নি। সারা দুপুরটা সাহেব সেইখানেই শুয়ে কাটিয়েছে। বিকেলে রোদ পড়লে ফিরেছে।
সুবর্ণ হাসতে লাগলো।
বললে, আচ্ছা ঠাকুরপোর তো হিদুয়ানীর বালাই নেই। বিধবা-বিবাহও তো এখন চলছে, না?
নরেন বিব্রতভাবে উঠে পড়লো। বললে, রাত অনেক হল বড় বৌ। ঘুম পাচ্ছে ভয়ানক। আলোটা নিবিয়ে দাও।
বলে নিজের বিছানায় শুয়ে পড়লো।
.
সকালে উঠেই নরেন সর্বাগ্রে বাগানবাড়ী গেল।
ইব্রাহিম নিতে মহেন্দ্রর ছোট হাজরীর ব্যবস্থা করছিলো।
নরেন জিজ্ঞাসা করলে, সাহেব উঠেছেন?
—না হুজুর।
—এখনও ওঠেননি? সকালেই তো ওঠেন শুনেছি।
—অন্যদিন তাই ওঠেন বাবু। কিন্তু কাল সারারাত তাঁর ঘুম হয়নি।
—ঘুম হয়নি কেন?
—তা জানিনে বাবু। দারোয়ান বলছিলো, কাল সারারাত সাহেব একবার ঘর একবার বারান্দা করেছেন।
—সন্ধ্যেবেলায় কেউ কি এসেছিলেন?
—না হুজুর।
—শরীর ভালো আছে তো? রাত্রে খেয়েছিলেন?
–খেয়েছিলেন বই কি।
নরেন্দ্র চলে গেল, এবং আবার ঘণ্টা দেড়েক পরে ফিরে এল। ইব্রাহিম জানালে সাহেব ছোট হাজরী খেয়ে ওদিকের বারান্দায় বই পড়ছেন।
ওদিকের বারান্দায় যেতেই মহেন্দ্ৰ সসম্ভ্রমে উঠে দাঁড়াল।
নরেন বললে, কাল রাত্রে তোমার কি ভাল ঘুম হয়নি? আমি আর একবার এসে ফিরে গেছি। শরীর ভাল আছে তো?
মহেন্দ্র ঘাড় নেড়ে জানালে, আছে।
নরেন বললে, অনেক দিন এদিকে আসতে পারিনি, সেই ব্যাঙ্কের ব্যাপারে। তারও তো আর দেরি নেই। দু’এক দিনের মধ্যে একবার সদরে যেতে হবে। সেখান থেকে কলকাতায়। এই তো অবস্থা। আজ ব্যাঙ্ক বলেই নয়, বারো মাস ত্রিশদিন এই একই অবস্থা। না সময়ে নাওয়া-খাওয়া, না বিশ্রাম।
—শরীরের দিকে দৃষ্টি রাখবেন।
—রাখি কি করে বলো? এমন একটা দোসর নেই যার উপর চোখ বুজে নির্ভর করা যায়। মাঝে মাঝে ভাবি তোমাকে এই জোয়ালে যুতে দি। আবার এই অজ পাড়াগাঁয়ে তোমার মতো লোককে আটকে রাখতেও ইচ্ছা করে না। কি করি বলো তো?
মহেন্দ্ৰ হেসে ফেললে। বললে, আমি কি করে বলব?
—আচ্ছা, দেখি বিবেচনা করে। ততদিনে এই ব্যাঙ্কের ঝামেলাও মিটে যাবে। তুমি কিন্তু রাত জাগবে না, শরীরের ওপর কোনো অনিয়ম করবে না। বুঝলে? খাবে, দাবে আর ঘুরে বেড়াবে। আমার যদি তোমার মতো একটা দাদা থাকতো!
মহেন্দ্র হেসে বললে, হিংসে করছেন?
—হিংসে একটু হচ্ছে। কিন্তু এখন আর আমার বসবার সময় নেই। খবর পেলাম, কাল রাত্রের ট্রেনে কলকাতা থেকে আসবাবপত্রগুলো এসেছে। তার জন্যে স্টেশনে কাউকে পাঠাতে হবে। বীরপুর মহাল থেকে নায়েব এসেছেন। মহালটা কিনে পর্যন্তই গোলমাল চলছে। তাঁর কি বলবার আছে সেও শুনতে হবে। এমনি অসংখ্য ঝামেলা। আজকে উঠলাম। তুমি কিন্তু শরীরের বিশেষ যত্ন নেবে। আর রাত্রি জাগরণটা শরীরের পক্ষে খুবই খারাপ।
নরেন যেমন ব্যস্তভাবে এসেছিল, তেমনি ব্যস্তভাবে বেরিয়ে গেল।