মহাকাল – ৬

ছয় 

বেণীমাধবের বাড়ীর অবস্থা নিতান্ত শোচনীয়। 

ভিতরের দিকে উঁচু-দাওয়াওলা এক-কুঠুরী একখানা ঘর। চালের খড় একেবারে পাতলা ধূসর হয়ে গেছে। বাখারীগুলো স্থানে স্থানে নরকঙ্কালের মতো অনাবৃত। বোঝা যায়, খড়ের অভাবে কয়েক বৎসরই ছাওয়ানো হয়নি। সামনে সদরের দিকে একটি চালাও ঘেরা নয়। তার বাইরের রাস্তার দিকের অংশ বৈঠকখানা হিসাবে এবং ভিতরের অংশ রান্নাঘর হিসাবে ব্যবহৃত হয়। মধ্যে সংকীর্ণ একফালি উঠান। তারও আধখানায় গায়ত্রী কিছু শাক, কাঁচা লঙ্কা এবং বেগুনের গাছ লাগিয়েছে। 

যতদিন দৃষ্টিশক্তি ছিল, বেণীমাধব সংসারের কাজকর্ম নিজেই করতেন। এখন আর পারেন না, করেনও না। অধিকাংশ সময় এখন সদরের চালায় বসে তামাক খান, লোকজনের সাড়া পেলে তাদের ডেকে বসিয়ে দুটো গল্প করেন এবং গ্রামের খবরাখবরও পান। দরিদ্র সংসারের ফুটা নৌকা কি করে যে চলছে, সে খবর তিনি রাখেন না, রাখা প্রয়োজনও মনে করেন না। অসহ্য হলে গৃহিণী মাঝে মাঝে চীৎকার করে জানাতে চান, কিন্তু গায়ত্রী মুখ চেপে ধরে। 

বলে, কী হবে মা শুনিয়ে? উনি তো কোনো সাহায্যই করতে পারবেন না। শুধু মনে কষ্ট পাবেন। 

নিজের সংসার সম্বন্ধে বেণীমাধবের কোনো কৌতূহল না থাকলেও পাড়া- প্রতিবেশীদের কৌতূহলের অভাব ছিল না। কিন্তু অনেক চেষ্টাতেও তারা এই সংসার চলার রহস্য উদ্ধার করতে পারেনি। 

মাত্র দু’টি বড় ছেলে বাইরে সামান্য কি চাকরী করে। নিজেরা খেয়ে-পরে যা সামান্য কিছু তারা পাঠাতে পারে, তাতে নুন-ভাত খেয়েও এ বাজারে মাসে দশটা দিনের বেশি চলবার কথা নয়। অথচ নুন-ভাত কি শাকভাত না জানলেও এ তো সবাই দেখতে পাচ্ছে যে, দিন চলে যাচ্ছে। প্রতিবেশীর কাছে ওদের কেউ কখনো একটি পয়সা, কি এক মুঠো চাল, কি একটা বেগুন ধার করতেও যায়না। 

কি করে এমন সম্ভব হয়? 

প্রতিবেশিনীরা মাঝে মাঝেই আসে। সহানুভূতির সঙ্গে গায়ত্রীর গুণগান করে বলে, সাক্ষাৎ মা-লক্ষ্মীকে গর্ভে ধরেছিলে সতুর মা। এমন মেয়ে হয় না। ওইটুকু মেয়ে কি করে যে এই সংসার চালাচ্ছে কাকপক্ষীতে জানতে পারে না। অমন মেয়েরও কপাল পোড়ে? পোড়া বিধেতার কি চোখ নেই গা? 

বিধাতা চিরকালই শান্তিপ্রিয়। অতি বড় মিথ্যা অভিযোগেরও তিনি কখনও প্রতিবাদ করেন না! এতেও চুপ করেই থাকেন। এমন কি যার পক্ষ হয়ে প্রতিবেশিনী এই মন্তব্য করে সেও নীরব থাকে। কোনো দিকে সাড়া না পেয়ে তারা হতাশভাবে চলে যায়। রহস্যের কোনো কিনারা হয় না। 

বস্তুত ব্যাপারটায় রহস্যও কিছু নাই। সে কথা জানে একমাত্র গোলকবিহারী। 

বিধবা মেয়ের জন্য মাও রাত্রে কিছু আহার করেন না। দিনেও অর্ধেক মাসই তাঁদের দুজনকে অভুক্ত থাকতে হয়। এবাড়ীর ছেলেমেয়েরাও এমনই শান্ত যে, আহার জুটুক, না জুটুক তারা কোলাহল করে না। এই বয়সেই দুর্ভাগ্যকে আত্মমর্যাদার সঙ্গে নিঃশব্দে মেনে নেবার শিক্ষা তাদের হয়েছে। 

কিন্তু মহেন্দ্রের খাবার দিন বেণীমাধবের নির্বিকার ভাব আর রইলো না।

—ছেলেটা খাবে এখানে। কিন্তু নিতান্তই শাক-ভাত খাওয়াবি গায়ত্রী? 

গায়ত্রী বললে, তাছাড়া আর কি খাওয়াব বাবা? আর কী খাওয়াতেই বা আমরা পারি? 

—তা ঠিক। 

বেণীমাধব অনেকদিন পরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন নিজের দারিদ্র্যজনিত অক্ষমতার জন্যে। মহেন্দ্রকে সত্যই তিনি ভালোবাসেন। তাকে ভালো করে খাওয়াতে পারলে তিনি আনন্দ বোধ করতেন। 

গায়ত্রী বললে, তিনি তো পর নন বাবা। এতে দুঃখ করবার কি আছে? 

—তা বটে। 

বললেন বটে, কিন্তু বেণীমাধবের বুকের উপর ক্ষোভের পাথরটা তেমনি চেপে বসেই রইল! 

গোলক বললে, আপনি বাইরে গিয়ে বোসো গে না ঠাকুরমশাই। আমরা দুই ভাই- বোনে যা পারি তাই করব। কি বলো দিদিমণি? 

গোলকের স্বর শুনে বেণীমাধব খানিকটা আশ্বস্ত হলেন। বললেন, তাই যা হয় কর বাবা, আমি আর মিথ্যে ভাবতে পারি না। 

বলে ঠুক ঠুক করে বাইরের দাওয়ার গিয়ে বসলেন। 

একটু পরেই তাঁর কণ্ঠস্বর শোনা গেল : আমাকে একটু তামাক দিও গোলক। 

.

মহেন্দ্ৰ এল তখন একটা। 

তার গায়ে সাধারণ একটা গেঞ্জি। পরনে সাদাসিধে একখানি ধুতি গেঞ্জির উপর মালকোঁচা দিয়ে বাঁধা। এই গ্রামে ছেলেবেলায় যে বেশে সে ডাংগুলি খেলতো আর আম পেড়ে বেড়াত। 

পোশাক দেখে গায়ত্রী না বলে পারলে না : এ কী! সাহেবের এ কি বেশ!

মহেন্দ্র জবাব দিলে না। শুধু হেসে বললে, রান্নার কত দেরি বল? ক্ষিদেয় নাড়ী চুঁই ছুঁই করছে। 

হেসে গায়ত্রী বললে, দেরি নেই। জায়গা করে দিচ্ছি। 

বড় ঘরের দাওয়ায় আসন পেতে গায়ত্রী জায়গা করে দিলে। আঙট-কলাপাতা ধুয়ে পেতে দিলে। তার মধ্যে পরিপাটি করে সাজিয়ে দিলে ভাত। পাশে পাশে নানা রকমের তরকারী এবং মাছ 

আয়োজন দেখে মহেন্দ্র বললে, ভারি ভুল হয়ে গেল গায়ত্রী। 

—কি আবার ভুল হল? 

মহেন্দ্ৰ বললে, ভেবেছিলাম নিতান্তই শাক-ভাত খাওয়াবে, ধুতি আর গেঞ্জিই যথেষ্ট। এ রকম জানলে আরও ভালো পোশাক পরে আসতাম। 

মহেন্দ্র হাসতে লাগলো। 

—তার আর উপায় নেই। তুমি বসে পড় বরং। 

—সেই ভালো।—বলে মহেন্দ্র খেতে বসলো। 

গায়ত্রী বললে, কলাপাতায় খেতে বোধ হয় তোমার অসুবিধা হবে মহিনদা।

—হলেই বা করব কি বলো? ব্রাহ্মণের বাড়ী খৃস্টানের নিমন্ত্রণ। থালায় তো আর দেওয়া যায় না। 

গায়ত্রীর মুখ বেদনায় বিবর্ণ হয়ে উঠলো। 

বললে, সেজন্যে নয় মহিনদা। 

—তবে? 

গায়ত্রী আস্তে আস্তে বললে, কাঁসার থালা আর আমাদের একখানিও নেই। একে একে সবই বাঁধা গেছে। 

মহেন্দ্ৰ চমকে উঠলো। না জেনে একটা সাধারণ পরিহাস করে ফেলে তার লজ্জার আর শেষ রইল না। কি বলবে ভেবে না পেয়ে মুখ নামিয়ে নিঃশব্দে খেতে লাগলো। 

—ভাতের মধ্যেখানটা একটু গর্ত কর মহিনদা। ডাল দোব। 

মহেন্দ্র তাড়াতাড়ি পাতে খানিকটা গর্ত করে বললে, এই যে, এইখানে দাও। অল্প একটু দিও। 

এ রকম পরিতৃপ্তির সঙ্গে আহার মহেন্দ্র অনেক দিন করেনি। 

তার উপর না জেনে গায়ত্রীকে যে লজ্জা দিয়েছে তার ক্ষতিপূরণ করতে অনেক 

কিছু তাকে চেয়ে নিয়েও খেতে হল। 

ওঠবার সময় বললে, খাওয়াটা বড় বেশি হয়ে গেল গায়ত্রী। 

—কেন খেলে? শরীর খারাপ করবে না তো? 

—শরীর আমার খারাপ করবার নয়। সে ভয় করছি না। তবে… 

—একটা মাদুর বিছিয়ে দোব? একটু গড়িয়ে নেবে? 

—তাই দাও বরং। একটু গড়াতেই হবে বোধ হচ্ছে। 

গায়ত্রী বড় ঘরের মেঝেয় পরিপাটি করে একখানা মাদুর বিছিয়ে দিলে। নিজের বাক্স থেকে একখানা ফরসা তোয়ালে বার করে বালিশের উপর পেতে দিলে। 

মহেন্দ্র বললে, তুমি খেয়ে এসো। আমি ততক্ষণ একটু গড়াই।

বলে একটা সিগারেট ধরিয়ে টানতে লাগলো। 

.

অনেকক্ষণ পরে গায়ত্রী এসে দোরগোড়ায় বসলো।

বললে, কিছু যুদ্ধের গল্প বল মহিনদা। 

—যুদ্ধের গল্প তো বলা যায় না গায়ত্রী। যুদ্ধ আর দারিদ্র্য, এর সত্যিকার গল্প হয় না। 

—কেন হয় না? 

—কারণ জিনিসটা অত্যন্ত বেশি বাস্তব। ওর ঠিক রূপ দেওয়া কঠিন। তবে এটা ঠিক যে, তোমরা যুদ্ধকে যত ভয়াবহ মনে কর, তত নয়। তা যদি হত তাহলে লক্ষ লক্ষ লোক বছরের পর বছর পৈশাচিক আনন্দে যুদ্ধ করতে পারতো না। 

—তুমি কখনও মানুষ কেটেছ? 

—কেটেছি, কিন্তু তরোয়াল দিয়ে নয়, ছুরি দিয়ে। আমি তো মানুষ মারবার জন্যে যাইনি গায়ত্রী, মানুষ বাঁচাবার জন্যে গিয়েছিলাম। কাটা-কুটির মধ্যে আহতদের উপর অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে। 

—ভালো লাগতো? 

—ভালো-লাগা মন্দ-লাগার প্রশ্নই সেখানে ওঠে না। যুদ্ধক্ষেত্রে মানুষ ঠিক যন্ত্র হয়ে যায়। ট্যাঙ্কের যেমন ভালো-লাগা মন্দ লাগার বালাই নেই, যোদ্ধারও তেমনি নেই। সে এক আশ্চর্য অনুভূতি। ঠিক বোঝানো যায় না। স্নেহ নেই, দয়া নেই, ক্রোধ নেই, হিংসা নেই –যে সমস্ত প্রবৃত্তি মানুষকে ক্রমাগত এঞ্জিনের মতো ঠেলে সাধারণত সক্রিয় করে রাখে, তার কোনোটাই নেই। অথচ সক্রিয়তা শতগুণে বেড়ে উঠেছে। এ এক আশ্চর্য অবস্থা নয় কি? 

একটু থেমে মহেন্দ্র বলতে লাগলো : 

—সেই যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ছ’বছর পরে আমি ফিরে আসছি গায়ত্রী। স্নেহ ভালোবাসার ক্ষুধা আমার মনে দ্বিগুণ জ্বলছে। অথচ দেখছি, আমার আত্মীয়-স্বজনেরা, আমার বাল্যবন্ধুরা, আমার গ্রামের লোকেরা আমাকে এড়িয়ে চলেছে। কত কষ্ট হচ্ছে বলো তো? গায়ত্রী একটুক্ষণ চুপ করে কি যেন ভাবলে। তারপরে বললে, একটা বিশেষ কথা বলব বলেই তোমাকে নিমন্ত্রণ করেছি। নইলে নিমন্ত্রণ আর কি? তোমারই টাকায় তোমাকে খাওয়ানো। 

গায়ত্রী হাসলো। 

মহেন্দ্র বললে, কি বিশেষ কথা? 

গায়ত্রী বললে, আমি মেয়েমানুষ। সব কথা জানি না। বাকিটা তোমাকেই কষ্ট করে জেনে নিতে হবে। 

অসহিষ্ণুভাবে মহেন্দ্ৰ বললে, সে জেনে নোব পরে। তুমি আসল কথাটা কি তাই আগে বলো। 

একটু ইতস্তত করে গায়ত্রী বললে, তুমি এখানে আর থেকো না। 

—কেন? 

—আমি শুনেছি—

—কি শুনেছ? 

—জ্যাঠামশাই না কি কি একটা উইল করে গেছেন।

—জ্যাঠামশাই মানে আমার বাবা? 

—হ্যা। 

—তার পরে? 

—তাতে নাকি তিনি এই কথা লিখে গেছেন যে, তুমি যদি জীবিত ফেরো এবং স্বধর্মনিষ্ঠ থাকো তাহলেই তুমি সম্পত্তির অংশ পাবে, নইলে নয়। 

গায়ত্রী বললে, বাগান বাড়ীতে রেখে নরেনদা তোমাকে দিয়ে প্রকাশ্যে যে অনাচার করাচ্ছেন, সেটা আমার কেমন ভালো লাগছে না। হয়তো মেয়ে মানুষের পাপ-মন বলেই…

—খুব সম্ভবত তাই গায়ত্রী। দাদা আমাকে ছলে ছুতোয় ফাঁকি দিতে পারেন, এ আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারি না। 

—তাই হোক মহিনদা, এ যেন মিথ্যেই হয়। তবু তুমি একটু খোঁজ নিও। 

মহেন্দ্র তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে বললে, না, না। সে আমি পারব না। নিজের দাদার সম্বন্ধে অন্যের কাছে খবর নোব, সম্পত্তির এত লোভ আমার নেই। আজ আমি উঠলাম গায়ত্ৰী। 

—আর একটু বোসো। আমি এখনই আসছি। 

একটু পরেই ফিরে এসে গায়ত্রী বললে, তুমি অনেক বেশি টাকা দিয়েছিলে মহিনদা। এত টাকার দরকার ছিল না। এগুলো ফিরিয়ে নিয়ে যাও। 

মহেন্দ্ৰ সেদিকে চাইলেও না। 

হেসে বললে, তোমাদের দরকার না থাকতে পারে গায়ত্রী, কিন্তু আমার আছে। যাওয়ার আগে তোমার হাতের চমৎকার রান্না আর একদিন খাওয়ার ইচ্ছে রয়েছে, এবং সেদিন কাঁসার বাটির পর বাটি সাজিয়ে খাব। বুঝলে? 

বলে চলে গেল; গায়ত্রীকে আপত্তি জানাবার অবকাশই দিলে না। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *