মহাকাল – ৫

পাঁচ 

অনেক রাত্রি পর্যন্ত বিছানায় ছটফট করে ভোরের দিকে মহেন্দ্রের নিদ্রা এল। যখন ঘুম ভাঙলো, একটু বেলাই হয়েছে। 

হাত-মুখ ধুয়ে চা খেতে খেতে খবরের কাগজে চোখ বুলোচ্ছে, এমন সময় সিঁড়িতে লাঠির খট খট শব্দে এবং গোলকবিহারীর কর্কশ কণ্ঠস্বরে সে বাইরে এসে দাঁড়ালো। 

আগে বেণী বাঁড়ুয্যে, পিছনে গোলক। 

মহেন্দ্র তাড়াতাড়ি একখানা কাঠের চেয়ার বের করে দিলে। তারপর প্রণাম করে বললে, প্রণাম করছি কাকাবাবু। পা ছোঁব আপনার? 

চেয়ারে সাব্যস্ত হয়ে বসে বাঁড়ুয্যেমশাই বললেন, ছোঁবে বই কি বাবা। তুমি ছেলে, পা ছোঁবে না? 

মহেন্দ্র পায়ের ধূলো মাথায় নিয়ে আর একখানা চেয়ার টেনে এক পাশে বসলো। রেলিঙের কাছে মেঝের উপর বসলো গোলক। 

বেণীমাধব বললেন, বাইরে কোন ছেলে যে খাওয়া-দাওয়ার অনাচার করে না তা তো জানি না। তার জন্যে আজকাল আর কেউ সমাজচ্যুতও হয় না, ধর্মচ্যুতও হয় না। নরেন বাবাজি কেন যে গ্রামের বুকের উপর বসিয়ে তোমাকে দিয়ে এই সব অনাচার করাচ্ছেন তিনিই জানেন। কিন্তু কাজটা ভাল হচ্ছে না বাবাজি। সমাজকে বলে দেবতা। তাকে অকারণ অপমান করতে নেই। 

মহেন্দ্র বলে, কিন্তু আমি তো বাড়ী ছেড়ে এমন করে এখানে থাকতে চাইনি।

—তাই নাকি? তবে যে শুনলাম, 

—কি শুনলেন? 

—যে, তুমি নাকি দিশী খাওয়া খেতে পারছ না? 

—মিথ্যে কথা। এ সব কারা রটাচ্ছে, কেন রটাচ্ছে তারাই জানে। সুতরাং ও প্রসঙ্গ থাক। কেমন আছেন বলুন। 

—আমি? বুড়ো হয়েছি, চোখে দেখতে পাই না। নইলে ভালোই আছি। বেণীমাধব হা হা করে হাসতে লাগলেন। 

এবারের সংসারযাত্রায় এই সন্তোষই তাঁর একমাত্র মূলধন। বৃত্তি যজমানী, জমি- জায়গা নেই বললেই চলে, অনেকগুলি ছেলে মেয়ে—খুব দুঃখেরই সংসার। লোকে তাঁর জন্যে দুঃখ করেছে, কিন্তু তিনি নিজে কোনোদিন করেন নি। কোথাও তার জন্যে মুখ নামিয়েও থাকেন নি। ধনী ও দরিদ্রের মর্যাদা যে এক নয়, বহুবার অপদস্থ এবং লজ্জিত হয়েও তা তিনি উপলব্ধি করতে পারলেন না। তিনি সব সময় ভালোই আছেন এবং ভালোই থাকেন। 

মহেন্দ্ৰ হেসে বললে, আপনি তো সব সময় ভালোই থাকেন কাকাবাবু। 

—থাকব বই কি বাবা। আমার দুঃখটা কি বলো। তবু মাঝে মাঝে ভগবান দুঃখও দেন বই কি! মেয়েটা বিয়ের দু মাসের মধ্যে বিধবা হল, দুঃখ পেলাম বই কি বাবাজি। আবার দেখ, আজকে দুঃখ হচ্ছে চোখ নেই বলে। তোমাকে দেখতে ভয়ানক ইচ্ছা হচ্ছে বাবা! 

বৃদ্ধের শুষ্ক চোখের কোণ বয়ে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। গোলকও নিঃশব্দে মলিন কাপড়ের খুঁটে চোখ মুছলো। 

একটুক্ষণ নিঃশব্দে বসে থেকে বেণীমাধব বললেন, আজ তাহলে উঠি বাবাজি। আর একদিন এসে অনেকক্ষণ ধরে যুদ্ধের গল্প শুনব। গোলকবিহারী, চল বাবা 

লাঠিটায় ভর দিয়ে উঠতে গিয়েই গোলক আবার বসে পড়লো। বললে, যে জন্যে আসা সেই কথাটাই যে বললেন না খুড়োঠাকুর। বিস্মিতভাবে বেণীমাধব জিজ্ঞাসা করলেন, কি কথা বল্ তো? 

—সেই যে দিদিমণি বলে দিলে। 

—ও হো! 

বেণীমাধব আবার বসলেন। বললেন, তুমি এখন দিনকয়েক আছ বাবাজি?

—তা আছি। 

—তাহলে কাল একবার আমাদের বাড়ীতে দুটো শাক-ভাত খেতে যাবার সুবিধে হবে? এই ধরো দুপুরের দিকে? 

—কিন্তু তাতে আপনার কোনো ক্ষতি হবে না তো? 

—ক্ষতি? কিছুমাত্র না। 

মহেন্দ্ৰ বুঝলে, ইঙ্গিতটা বৃদ্ধ ঠিক ধরতে পারলেন না। তাই পরিষ্কার করে বললে, সমাজে কোনো গোলযোগ হবে না তো? 

—না, না, বাবা। তা হবে কেন? তা হলে তোমার অসম্মান করবার জন্যে আমি কি তোমাকে খেতে বলতে পারি? 

—তাহলে যাব কাল দুপুরে। 

একটুক্ষণ চিন্তা করে বৃদ্ধ বললেন, আমি ছেলেদের কাউকে পাঠিয়ে দোব বরং।

—কিছু দরকার নেই কাকাবাবু। আপনার বাড়ীর রাস্তা তো আমি ভুলে যাইনি। নিজেই যেতে পারব। 

বৃদ্ধ হা হা করে হেসে বললেন, বেশ বাবা, বেশ। 

এবং আর এক প্রস্থ আশীর্বাদ করে লাঠির শব্দ করতে করতে প্রস্থান করলেন। বেণীমাধব চলে যাওয়ার একটু পরেই ব্যস্তভাবে নরেন এল। 

—তুমি কালকে একাই নদীর ধারে বেড়াতে বেরিয়েছিলে বুঝি? 

—আজ্ঞে হ্যাঁ। 

—ভালো করোনি। কেন, দারোয়ানরা কি কেউ ছিল না? 

—ছিল বোধ হয়। কিন্তু একলা বেড়াতে ভয় কি দাদা? 

—ভয় অনেক। এই হতভাগা গাঁয়ের অবস্থা তুমি জানো না। এরা সবাই আমাদের হিংসা করে। সুযোগ পেলে অনেকেই আমাদের শত্রুতা করতে ছাড়বে না। এদের সবাই কোনো-না-কোনো ভাবে আমাদেরই খাচ্ছে পরছে। অথচ সুবিধা পেলে আমাদেরই সর্বনাশ করবে। এত বড় বজ্জাত, হারামজাদা এরা। তুমি অনেক দিন গ্রামছাড়া, এদের খবর তো ঠিক রাখো না। 

নরেন নিঃশ্বাস নেবার জন্যে থামলে। 

মহেন্দ্ৰ শান্তকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলে, এরা আমাদের হিংসা করে কেন? 

—কেন? তার অনেক কারণ আছে। প্রধান কারণ, আমাদের টাকা আছে।

—টাকা তো আমাদের অনেক দিন থেকেই আছে। 

—তা আছে। কিন্তু কি জানো, সম্প্রতি পাঁচ রকম ব্যবসায় আরও দু’পয়সা হয়েছে তো। সেই জন্যে। যাকগে, সে কিছু নয়। শকুনের শাপে কিছু আর গরু মরে না। তবু রাত-বিরেতে একলা না বেরুনোই ভালো। বুঝলে না? 

নরেন চলে গেল। 

মহেন্দ্রের ইচ্ছা ছিল, ক’টি প্রশ্ন করে : চোরাবাজারের প্রশ্ন, আর সাহেব সাজিয়ে তাকে বাগান-বাড়িতে রাখার হেতু। কিন্তু সঙ্কোচবশে জিজ্ঞাসা করতে পারলে না। নরেনের সম্বন্ধে একটি বিষয়ে সে নিঃসংশয় ছিল। সে হচ্ছে তার উপর দাদার স্নেহ। এই স্নেহ সর্বত্র হয়তো খুব বলিষ্ঠ নয়। অনেক ক্ষেত্রে হয়তো নারীর মতো কোমল, অত্যাচারের মতোই বাজে। তবু তার অকৃত্রিমতা সম্বন্ধে সন্দেহের অবকাশ কোথায়? তার একটি চোখ সমস্ত কাজের মধ্যেও যে তারই দিকে নিবদ্ধ রয়েছে তার প্রমাণ তো এখনই পাওয়া গেল। 

মহেন্দ্ৰ জামাটা গায়ে দিয়ে বাড়ীর দিকে বার হোল। সদর দিয়ে যাওয়ার অনেক ঝামেলা। আবার হয়তো দাদার সামনে পড়বে এবং সতর্কতা ও গ্রামের দুরভিসন্ধি সম্বন্ধে অনেক উপদেশ শুনতে হবে। স্থির করলে খিড়কি দিয়ে যাবে। সে সোজা রাস্তা ধরলে। বাগানবাড়ী পেরিয়েই আমবাগান। তার পরে বাঁশবন এবং মিত্রদের পচা ডোবার ধার দিয়ে একটু গেলেই তাদের খিড়কি। চোখে পড়লো বাঁশবনের ফাঁক দিয়ে বেণীমাধবের খড়ের চালের কিয়দংশ। 

মনে পড়লো বেণীমাধবকে : 

সরল সেকেলে ব্ৰাহ্মণ। 

গতকাল গায়ত্রীর তার কাছে আসা সম্বন্ধে একটি কথাও ভদ্রলোক বললেন না। নিশ্চয়ই জানেন না। জানলে তাঁর পেটের মধ্যে কথা বেশিক্ষণ থাকত না। মহেন্দ্র তার জন্যে আশ্বস্ত বোধ করলে। 

হঠাৎ তার চোখ পড়লো পচা ডোবার ঘাটের দিকে। গায়ত্রী বাসনমাজা বন্ধ রেখে তারই দিকে চেয়ে আছে। মহেন্দ্রের চোখে চোখ পড়তেই তাড়াতাড়ি পিছন ফিরে বাসন মাজতে বসলো। 

মহেন্দ্রের একবার লোভ হল একটি ছোট ঢিল কুড়িয়ে তার পিঠের উপর ছুঁড়ে মারে। কিন্তু তখনই নিজেকে সামলে নিয়ে নিঃশব্দে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। 

ওদের নিজেদেরও খিড়কির ঘাটে ঝিয়েরা বাসন মাজছিল। হঠাৎ খিড়কির পথে ছোটবাবুকে আসতে দেখে তারাও সন্ত্রস্ত হয়ে পড়লো। মহেন্দ্র সেদিকে ভ্রূক্ষেপমাত্র না করে সোজা ভাঁড়ারের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। 

—বৌদির গলা যেন এইদিক থেকেই আসছিল? 

—ঠিকই ধরেছ ভাই! এ কোকিল-কণ্ঠ কি ভুল করার উপায় আছে? তুমি একটু ওপরে বোসো, আমি আসছি। 

মিনিট দশেক পরে সুবর্ণ চা আর খাবার নিয়ে উপরে এল। 

মহেন্দ্র বললে, ও কি বৌদি? তুমি কি জানো না, সাহেবরা যখন-তখন, যেখানে- সেখানে চা খাবার খায় না? 

সুবর্ণ মেঝের উপর চায়ের প্লেটটা নামাতে যাচ্ছিল। থমকে দাঁড়িয়ে বললে, তাই নাকি? 

মহেন্দ্ৰ হাত বাড়িয়ে প্লেটটা নিয়ে গম্ভীরভাবে বললে, তাই। অবশ্য আমার মতো সাহেবে খায়, কিন্তু আসল সাহেবে খায় না। 

—তবে আর চিন্তা কি?-বলে সুবর্ণ খাবারের প্লেটটা নামিয়ে দিলে। 

মহেন্দ্ৰ বললে, তোমাকে কতকগুলো নতুন রান্না শিখিয়ে দোব বলেছিলাম। বলো তো, আজই তোমার হাতে-খড়ি… 

সুবর্ণর মুখে একটা কালো ছায়া পড়লো। 

বললে, আজ নয় ভাই। আজ আমার একেবারেই ফুরসৎ নেই। কাল মায়ের একাদশী গেছে। আজ দ্বাদশী। এতক্ষণ সেই ব্যাপারেই ব্যস্ত ছিলাম। এখন স্নান করে এসে মায়ের হবিষ্যি চড়াব। আজ আর আঁশের রান্নাঘরে ঢুকতেই পারব না। 

ওর গিঁটবাঁধা এলোচুলের দিকে চেয়ে মহেন্দ্র বললে, কিন্তু স্নান যেন একবার করেছ মনে হচ্ছে। 

—তবু আবার একবার করতে হবে। 

—কেন? আমি ছুঁয়ে ফেললাম বলে? তাহলে তো ভারি অন্যায় হল। 

লজ্জিতভাবে সুবর্ণ বললে, শুধু সেইজন্যেই নয় ঠাকুরপো। একবার স্নান করে এসে মায়ের দ্বাদশীর উজ্জুগ করলাম। তারপর ঝি-চাকর ছোঁয়া কত কি তো করলাম। আর একবার স্নান না করলে ওঁর হবিষ্যি চড়াতে ইচ্ছে হবে না। 

এ কৈফিয়ৎ মহেন্দ্ৰ ঠিক বিশ্বাস করলে কি না বোঝা গেল না। সে নিঃশব্দে প্লেটের খাবার এবং চা নিঃশেষ করলে। 

তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললে, দ্বাদশী থাকবে না এমন একটা দিন স্থির করে আমাকে জানিও। সেইদিন এসে তোমাকে রান্না শিখিয়ে দিয়ে যাব। আজ উঠি। 

সুবর্ণ সিঁড়ির কাছ পর্যন্ত পিছু পিছু এসে কুণ্ঠিতভাবে জিজ্ঞাসা করলে, তুমি রাগ করে যাচ্ছ না তো ঠাকুরপো? 

—না, না। রাগ করে যাচ্ছি না। কিন্তু তোমাকে সত্যি কথাই বলি, জিনিসটা কেমন যেন ভালো লাগছে না। 

—কে, বৌমা? কার সঙ্গে কথা বলছ?-তেতলা থেকে বিরাজমোহিনীর কণ্ঠস্বর শোনা গেল। 

সুবর্ণ বললে, ঠাকুরপো এসেছে। 

বিরাজমোহিনী নেমে এসে বললেন, মহীন? এখনই চলে যাচ্ছিস? বসবি না?

মহেন্দ্র অভিমান ভরে বললে, বসে আর কি করব মা? খেতে তো আর দেবে না। 

এক গাল হেসে বিরাজমোহিনী বললেন, শোনো পাগলা ছেলের কথা বৌমা! তুই কত বড় লোক হয়ে ফিরেছিস। নরেন বলে, এ জেলায় তোর সমান লোক নাকি নেই। জজ-মেজিস্টর সকলের ওপরে তুই! তাই নিয়ে নরেনের কত গর্ব! তুই খাবি এবাড়ীর ডাল-ভাত? 

বার বার সেই এক কথায় মহেন্দ্ৰ ক্ৰমেই চটে যাচ্ছিল। বললে, ওসব বাজে কথা মা, একেবারে বাজে কথা। কিন্তু কবে আমি তোমাদের বলেছি যে আমি এবাড়ীতে থাকব না, মা-বৌদির হাতে খাব না, আমি সাহেব হয়েছি, ইব্রাহিমের হাতে খানা খাব আর বাগান বাড়ীতে থাকব? কবে বলেছি বলো? 

শান্তকণ্ঠে বিরাজমোহিনী বললেন, তুই বলবি কেন বাবা। সংসারে যে তোকে সব চেয়ে ভালোবাসে এ ব্যবস্থা সেই করেছে। সেই তোকে গাঁয়ের মাথার ওপরে সাহেব করে সাজিয়ে রেখেছে। সেই তোকে খেতে দেবে না ডাল-ভাত। তুই বললেও না। 

এর পরে মহেন্দ্র আর কি বলতে পারে? নিজের দাদাকে সেও তো ভাল করেই চেনে। মায়ের কথা মনে-মনেও মিথ্যা বলে উড়িয়ে দেওয়ার সাধ্য তার নেই। 

আর কোনো কথা না বলে ধীরে ধীরে সে বেরিয়ে গেল। মনে হল, আসার সময় যে অস্বস্তি তার মনের মধ্যে জমেছিল, মায়ের কথায় তার সমস্তটুকুই উড়ে নিঃশেষ হয়ে গেল। মনের মধ্যে একটা গভীর তৃপ্তির ভাব নিয়েই সে বাগানবাড়ীতে ফিরে এল। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *