চার
মহেন্দ্র বাগান বাড়ীতে ফিরতেই ইব্রাহিম জানালে, গোসলখানায় পানি দেওয়া হয়েছে। জানতে চাইলে ছোটবাবু এখন গোসল করবেন কি না।
বৌদির কাছ থেকে ফিরে মহেন্দ্রের মনটা খুশি হয়ে ছিল। পরিহাসের ভঙ্গিতে বললে, না, বাবা ইব্রাহিম, গোসলখানায় নয়, নদীতে রীতিমত অবগাহন স্নান করে আসব। তেল-টেল আছে?
ইব্রাহিমের চোখ বিস্ময়ে কপালে উঠলো।
বললে, তেল!
জামা ছাড়তে-ছাড়তে মহেন্দ্র জবাব দিলে, হ্যাঁ, হ্যাঁ, তেল। মাখবার তেল। বললাম না, নদীতে চান করতে যাব? নেই তেল?
ছোটবাবু সাহেব হয়ে ফিরেছেন ভেবে ইব্রাহিমের মহেন্দ্রের উপর শ্রদ্ধা জেগেছিল। তেলের কথায় সে রীতিমত ক্ষুণ্ণ হল। কোনো রকমে ঘাড় নেড়ে জানালে, আছে।
—নিয়ে এস। আর দেখ, একজন কাউকে বলো আমার কাপড়-জামা নদীর ঘাটে নিয়ে আসতে।
মহেন্দ্র সাবান নিলে না, কিচ্ছু না। শুধু মাথায় একটু সর্ষের তেল ঘষে খোলা গায়ে একখানা তোয়ালে জড়িয়ে ঘাটে গেল।
ইব্রাহিমের মনটা আরও খারাপ হয়ে গেল।
নদীর ঘাট দূরে নয়। একটু যেতেই তর্কালঙ্কার মহাশয়ের সঙ্গে মহেন্দ্রের দেখা। তিনি স্নানান্তে একখানি গামছা পরে ভিজে কাপড়খানি কাঁধে ফেলে, বাঁ হাতে জলপূর্ণ কমণ্ডলু নিয়ে মৃদু অথচ সুমিষ্ট কণ্ঠে স্তোত্রপাঠ করতে করতে ফিরছিলেন।
মহেন্দ্র সেইখানে গড় হয়ে প্রণাম করে সবিনয়ে জিজ্ঞাসা করলে, ভালো আছেন পণ্ডিতমশাই?
—কে? মহেন্দ্ৰ? বেশ, বেশ। কল্যাণ হোক বাবা। ভালো আছ তো?
–আজ্ঞে হ্যাঁ।
তর্কালঙ্কারমশাই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মহেন্দ্রের গলায় যজ্ঞোপবীতটা খুঁজছিলেন। সেখানে না পেয়ে সে-দৃষ্টি তার কোমরের দিকে নেমে এল। সেখানেও যজ্ঞোপবীতের চিহ্নমাত্র দেখা গেল না।
অবশেষে ভগ্নকণ্ঠে তিনি বললেন, পৈতৃক ধর্মটা কি একেবারেই ত্যাগ করেছ বাবা?
মহেন্দ্ৰ ব্যথিত বিস্ময়ে বললে, আজ্ঞে না। ধর্মত্যাগ করব কেন?
আশ্বস্তভাবে তর্কালঙ্কার মশাই বললেন, বাঁচালে বাবা। পৈতেটা দেখছিলাম না কি না, ভাবলাম…
উপবীত মহেন্দ্রের সত্যই ছিল না।
নিজেকে লজ্জার হাত থেকে বাঁচাবার জন্যে বিব্রতভাবে বললে, ধর্মত্যাগ করব কেন পণ্ডিতমশাই? হিন্দু ছিলাম, হিন্দুই আছি।
—বেশ, বাবা, বেশ।
তর্কালঙ্কার মশাই বাড়ীর দিকে চলে গেলেন। মহেন্দ্রও নদীর ঘাটের দিকে চললো।
ঘাটে অনেক লোক স্নান করছিলো। কিন্তু নদীর সুশীতল জল এমনই করে তাকে টানছিল যে, কারও দিকে চাইবার পর্যন্ত তার ফুরসৎ ছিল না। সে ছেলেবেলার পুরানো দিনের মতো গামছাটা দাঁত দিয়ে চেপে ধরে পাড়ের উপর থেকেই সেই শীতল কালো জলে ঝাঁপিয়ে পড়লো। আঃ!
.
সুবর্ণলেখা তার কথা রেখেছিল। কিছু তরকারী লুকিয়ে পাঠিয়েছিল। কথা হয়েছে, কাল থেকে দিনের সমস্ত রান্নাই বাড়ি থেকে আসবে। ইব্রাহিম একবেলা রান্নার পরিশ্রম থেকে অব্যাহতি পেয়েও খুব খুশি হল বলে মনে হল না। ছোটবাবু যেন তাকে প্রবঞ্চিত করেছে, প্রতারিত করেছে, দস্তুরমতো হতাশ করেছে।
মহেন্দ্র দুপুরটা শুয়ে, বই পড়ে কাটালে। দিনে ঘুমানো তার অভ্যাস নেই। সি. এইচ. মুখার্জি অ্যান্ড সন্সের আফিস প্রাচীন দেশীমতে সকালে বিকেলে বসে। মহেন্দ্ৰ গোপনে বিভূতিকে একখানা চিঠি পাঠিয়েছে, সন্ধ্যার পরে তার সঙ্গে বাগানবাড়ীতে দেখা করবার জন্যে।
ইতিমধ্যে কি করা যায়?
বিকেলে পাঞ্জাবিটা গায়ে চড়িয়ে মহেন্দ্র নদীর ধারে বেড়াবার জন্যে বেরিয়ে পড়লো।
ওই দূরে দেখা যাচ্ছে তাদের খেলার মাঠ। এখনও ছেলেরা সেখানে খেলা করে কিনা কে জানে। গোলের খুঁটি তো নেই। তার এদিকেই ছিল একটা প্রকাণ্ড শিমুল গাছ। সেটাও নেই। তার গুঁড়ির খানিকটা শিকড় সমেত উলটে পড়ে আছে। হয় ঝড়ে, নয় নদীর ভাঙনে সেটার এই দুরবস্থা হয়েছে বোধ হয়।
ঘাটের অদূরে সেই করবীগাছের ঝোপটি এখনও রয়েছে। সেইখানে এসে মহেন্দ্র একটুখানি দাঁড়ালো। অনেক স্মৃতি জড়ানো রয়েছে এই জায়গাটির সঙ্গে।
বস্তুত গায়ত্রীর সঙ্গে তার একবার বিয়ের কথাও উঠেছিল। দরিদ্র ব্রাহ্মণের কন্যা, চিন্তাহরণবাবু উপেক্ষার সঙ্গে সে-প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।
করবীঝাড়ের পাশে দাঁড়িয়ে গায়ত্রীর কথা মনে হতেই তার বুকটা কি রকম একটা অজানিত বেদনায় টনটন করে উঠলো।
কে জানে কোথায় তার বিয়ে হল। এখন সে কোথায় কি ভাবে আছে তাই বা কে জানে?
মহেন্দ্র স্থির করলে, কাল একসময় ওদের বাড়ী গিয়ে খোঁজ নিতে হবে। কিংবা বিভূতি তো সন্ধ্যার পরে আসবে, তার কাছেও খোঁজ পাওয়া যেতে পারে। তারই তো খুড়তুতো বোন।
গায়ত্রীর বাবা বেণীমাধব বাঁড়ুয্যে। দরিদ্র ব্রাহ্মণ, যজমানী করে কায়ক্লেশে দিনযাপন করেন। ভদ্রলোক মহেন্দ্রকে বড় স্নেহ করতেন। তিনি বেঁচে আছেন কিনা কে জানে? বেঁচে থাকলে নিশ্চয় একবার দেখা করতে আসতেন।
আর দু’পা এগিয়ে যেতেই গোলক বাগদীর সঙ্গে দেখা হল।
ডান হাতের হুঁকোটা আলের মাথায় ঠেস দিয়ে রেখে গোলক সেইখানেই গড় হয়ে প্রণাম করলে।
—ভালো আছেন ছোটবাবু?
গোলককে মহেন্দ্র প্রথমে চিনতেই পারেনি। অসুরের মতো তার গায়ে জোর ছিল। কালো, লম্বা চেহারা। যেমন বুকের ছাতি, তেমনি পরিপুষ্ট কাঁধ এবং ঘাড়, তেমনি গুলি- পাকানো দেহ। কিন্তু তার কিছুই অবশিষ্ট নেই। শরীরের হাড় গোনা যায়, দেহ নুয়ে পড়েছে। বয়স তার চল্লিশও বোধহয় হয়নি। কিন্তু দেখলে মনে হয় ষাট, এমন বুড়ো হয়ে গেছে।
—গোলকদাদা? চিনতেই পারিনি তোমাকে? এ রকম চেহারা হল কেন?
—আর ছোটবাবু, চেহারা! মালোয়ারীতে খেয়ে ফেললে।
—বাড়ীর খবর?
—বাড়ীর তো আর খবর নেই ছোটবাবু। সব মরে গেছে।
—ছেলে-মেয়ে?
—সব মরে গেছে। ছা-পোনা কিচ্ছু নেই। কতক দুর্ভিক্ষে, কতক জ্বরে। আমাদের পাড়ায় কত লোক, আর কত হৈ হৈ ছিল মনে পড়ে? এখন মোটে আমরা ছ’জন বেঁচে আছি। তাও জ্বরে ধুঁকছি।
—সব পাড়ার অবস্থাই কি এই রকম?
—আজ্ঞে হ্যাঁ। তাঁতিপাড়া, কুমোরপাড়া, সাওপাড়া সব এই অবস্থা। মানুষ দেখতে পাবেন না।
—মুসলমানপাড়া?
—সবই এক অবস্থা। জ্বর-দুর্ভিক্ষের কাছে কি আর জাত আছে ছোটবাবু?
–তা বটে।
মহেন্দ্রের হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ে গেল।
বললে, তোমাদের বাড়ীতে লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁচা পেঁয়াজ আর মাছপোড়া দিয়ে পান্তা ভাত খেতাম, মনে পড়ে?
—তা আর মনে পড়বে না ছোটবাবু? এ তো সেদিনকার কথা। কতই বা আপনার বয়েস? আমাদের বাড়ীতেই তো আপনি মানুষ।
গোলকের চোখ ছলছল করে উঠলো।
বাঁ হাতের উলটো পিঠে চোখ মুছে বললে, আপনি এসেছেন শুনে প্রাণটা আপনার সঙ্গে দেখা করবার জন্যে কি রকম করে উঠলো।
মহেন্দ্ৰ সেইখানে আলের উপর বসে পড়ে বললে, তা এলে না তো কই? বোসো গোলকদা, বসে বসে একটু গল্প করা যাক।
গোলক তার পায়ের কাছে জমির উপর বসে বললে, আসতাম ছোটবাবু, কিন্তু সবাই মানা করলে যে।
—মানা করলে? কেন?
—সবাই যে বললে, -কি বললে?
একটা ঢোক গিলে গোলক বললে, আচ্ছা, ছোটবাবু, সত্যি কি আপনি খিস্টান হয়েছেন?
এই কথাটা দুপুরে স্নানের পথে তর্কালঙ্কার মশাই একবার জিজ্ঞাসা করেছিলেন। এখন গোলকও জিজ্ঞাসা করলে।
বিরক্তভাবে মহেন্দ্র বললে, না। ক্রিশ্চান হব কোন্ দুঃখে? এ-কথাটা কে রটাচ্ছে বলো তো?
মাথায় একটা ঝাঁকি দিয়ে গোলক বললে, সবাই বলছে বাবু। কিন্তু আমি বিশ্বাস করিনি। বললাম, ওরে, সে যে আমাদের রাখালের রাজা রে! আমি গেলে দেখা না করে কি পারে? পারো ছোটবাবু? সত্যি বলো।
—কখখনো পারি না।
—তাই বলো ছোটবাবু। আজ না হয় তুমি মথুরায় রাজা হয়েছ, হাকিমদের মাথার উপর বসে খানা খাও। কিন্তু আমরা যে তোমার আপনজন। নয় কিনা বলো?
—সত্যিই গোলকদাদা। কিন্তু এসে পর্যন্ত কেউ যে আমার সঙ্গে দেখা করছে না, সে কি এই জন্যে?
—এইজন্যেই তো। আহা! বেণী বাঁড়ুয্যে অন্ধ হয়ে গেছেন। আজ সকালে কী তেনার কান্না! ‘চোখে দেখতে পাই না গোলক, আমাকে একবার নিয়ে চল তোদের ছোটবাবুর কাছে।’ তা কি কেউ আসতে দিলে? সবাই বললে, তিনি সাহেব হয়ে গেছে। গেলেই কুকুর লেলিয়ে দেবে। কানা মানুষ, চোখে দেখে না। শেষে কি বুড়ো বয়সে ডালকুত্তার হাতে প্রাণটা দেবে?
মহেন্দ্র খপ করে গোলকের একখানা হাত চেপে ধরে বললে, কাল সকালে তাঁকে একবার তুমি আমার কাছে নিয়ে আসবে গোলকদাদা?
—নিশ্চয় নিয়ে আসব ছোটবাবু।
—আমার গা ছুঁয়ে বলছ তো?
হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়িয়ে গোলক বললে, গায়ে হাত দিয়ে আর বলতে হবে না ছোটবাবু। কাল সকালে আমি নিশ্চয় তাঁকে নিয়ে আসব।
বলে আর একবার গড় হয়ে প্রণাম করে গোলক চলে গেল।
আরও অনেকখানি মাঠে-মাঠে এলোমেলো ঘুরে যখন সে বাগানবাড়ীতে ফিরলো, তখন সন্ধ্যার অন্ধকার নেমেছে।
ইব্রাহিম এসে আলো জ্বেলে দিলে। মহেন্দ্র বসবার ঘরে একখানা সোফায় আড় হয়ে বসে একখানা বই খুলে বিভূতির প্রতীক্ষা করতে লাগলো।
কিন্তু বিভূতি এলো না। তৎপরিবর্তে একটি নারীমূর্তির আবির্ভাবে সচকিত হয়ে মহেন্দ্ৰ বললে, কে?
মূর্তি চৌকাঠের ওপার থেকেই গলায় আঁচল দিয়ে ভূমিষ্ঠ প্রণাম করলে। তারপর মাথার কাপড় সরিয়ে দিয়ে নিঃশব্দে স্থিরনেত্রে মহেন্দ্রের দিকে চাইলে।
বয়স তার কুড়ির বেশি হবে। পরনে মলিন থান কাপড়। কিন্তু তাতেও রূপ ঢাকা পড়েনি।
মহেন্দ্ৰ বললে, গায়ত্রী? তুমি? এ কি বেশ?
গায়ত্রী জবাব দিলে না। পাশের দেওয়ালে ঠেস দিয়ে অন্য দিকে চেয়ে তেমনি নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল।
শান্তকণ্ঠে মহেন্দ্র বললে, ওখানে দঁড়িয়ে কেন গায়ত্রী? ভিতরে এসো।
—না, এই বেশ আছি মহিনদা।
বলে চৌকাঠের বাইরে জড়োসড়ো হয়ে বসে দূরের দিকে উদ্দেশ করে বললে, তুমি যেন চলে যেও না গোলকদা। আমি এখনই তোমার সঙ্গে যাব।
ক্ষুণ্ণকণ্ঠে মহেন্দ্র বললে, ভিতরে এসে বসলে জাত যেত না গায়ত্রী। আমি সত্যি খৃস্টান হইনি।
গায়ত্রী এবারে হেসে ফেললে।
বললে, সে আমি জানি। কিন্তু তোমার খাওয়া-দাওয়ার বিচারও তো নেই। কিছু মনে কোরো না। আমি এইখানেই বসলাম।
খাওয়া-দাওয়ার বিচার যে মহেন্দ্রের নেই এ তো সত্য কথা। মহেন্দ্র একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললে! তারপর শান্তকণ্ঠে বললে, কিছু কি বলতে এসেছিলে গায়ত্রী?
—হাঁ। বাবা অন্ধ হয়েছেন শুনেছ তো?
—একটু আগে শুনলাম গোলকের কাছে। কাল তিনি হয়তো একবার আসবেন।
—হ্যাঁ, কিন্তু তিনি এলে হবে না বলে আমি নিজেই আজ এলাম।
—বলো।
—তোমার কাছে টাকা আছে? আমাদের বড় কষ্ট।
দু’ বৎসর পরে প্রথম সাক্ষাতের দিনে এই গায়ত্রীর কথা! ধাক্কাটা কাটাতে মহেন্দ্রের একটু সময় লাগলো।
বললে, দেখি কি আছে।
শোবার ঘরে সুটকেসটা খোলবার সময় মহেন্দ্রের বুকের ভিতর থেকে আবার একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল।
খুব বেশী টাকা মহেন্দ্র সঙ্গে আনেনি। খরচ-খরচা বাদ দিয়ে যা আছে তার পরিমাণ খুচরো নিয়ে দুশো টাকার কাছাকাছি হতে পারে। সেই মনিব্যাগটি বের করে নিয়ে এসে সে গায়ত্রীর প্রসারিত করতলের উপর আলগোছে ফেলে দিলে।
গায়ত্রী ভয়ে ভয়ে বললে, খুব ভারী মনে হচ্ছে, তুমি বেশি টাকা দিলে না তো?
—না। কিন্তু তুমি আর দেরি কোরো না গায়ত্রী। রাত হয়ে যাচ্ছে।
—হ্যাঁ। এই যে যাই।
বলে চৌকাঠে মাথা ঠেকিয়ে আর একবার প্রণাম করে গায়ত্রী নেমে গেল।