মহাকাল – ৩

তিন 

সকালে ছোট হাজরি খেয়ে মহেন্দ্র বেরুলো। 

অনেক দিন পরে গ্রামে ফিরে গ্রামখানিকে তার নতুন-নতুন লাগছিলো। ছোট-খাটো কত পরিবর্তন যে হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। কত খালি জায়গায় জঙ্গল গজিয়েছে, কত জঙ্গল জায়গা ফাঁকা হয়েছে। কত নতুন বাড়ী উঠেছে, কত পুরোনো বাড়ী ভেঙে গেছে। 

এই সমস্ত দেখতে দেখতে কত পুরোনো স্মৃতিই না তার মনে আসছিল। হঠাৎ এক সময় দেখলে সে তাদের সদর বাড়ীর মস্ত বড় উঠানে এসে দাঁড়িয়েছে। 

কাল বিকেলে বাড়ীর এই অংশটাকে তার বেশ জমজমাট মনে হয়েছিল। কিন্তু সত্যকার অবস্থার তুলনায় সে কিছুই নয়। এখন বুঝলে কত লোক তাদের সেরেস্তায় কাজ করে। 

পূর্ব এবং দক্ষিণ দিকের সমস্ত ঘরগুলোই কর্মচারীতে ভর্তি। ফরাস নয়, সমস্ত টেবিল-চেয়ারের ব্যবস্থা। শুধু পশ্চিম দিকের বড় ঘরখানার ফরাস আগের মতোই আছে। ওখান থেকে বৃদ্ধ রামলোচনের শীর্ণ তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর ভেসে আসছিলে। 

জমকালো বেশি উত্তর দিকের অংশটা। দ্বারে একটা সবুজ রঙের পর্দা ঝুলছে। বাইরে টুলের উপর বসে একজন চাপরাসি। 

মহেন্দ্ৰ নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলো। হঠাৎ কার দৃষ্টিতে যে পড়ে যেতেই সমস্ত সদরটা মুহূর্ত মধ্যে চঞ্চল হয়ে উঠলো এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর দিকের ঘরখানার পর্দা সরিয়ে নরেন হাসিমুখে বাইরে এসে দাঁড়ালো। 

—এসো, এসো।—নরেন হাসতে হাসতে বোধ করি সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়েই বলতে লাগলো : 

—তুমি তো চিরকালই উঠতে দেরি কর। ভেবেছিলাম, এখনও ওঠোইনি বুঝি। ইউরোপে গিয়ে তোমার আগেকার অভ্যেস যে বদলে গেছে, সে কথা ভাবিইনি। চা খাওয়া হয়েছে? 

—আজ্ঞে হ্যাঁ। 

চলো তোমাকে সব ঘরগুলো দেখিয়ে আনি। দেখেই বুঝতে পারছ বোধ হয়, পশ্চিম দিকের ওটা হল আমাদের সেই জমিদারী সেরেস্তা, সেই রামলোচন ইত্যাদি ইত্যাদি। আর এই উত্তর দক্ষিণ পূর্ব সমস্তটা হচ্ছে সি. এইচ. মুখার্জি অ্যান্ড সন্স। প্রায় একশো জন কর্মচারী এখানে কাজ করেন। সবই এই গ্রামের, নয়তো কাছাকাছি গ্রামের ছেলে। অনেককেই তুমি চেন। 

অধিকাংশই মহেন্দ্রের চেনা মুখ। এরা সবাই তাদের গ্রামের স্কুল থেকেই পাশ করেছে। কেউ তার উপরে পড়তো, কেউ সঙ্গে, কেউ বা নিচে। তাকে দেখে সবাই সশ্রদ্ধভাবে উঠে দাঁড়িয়েছে। তার মধ্যে বিভূতির ভক্তিনম্র মুখের দিকে চেয়ে তার পক্ষে হাস্য সম্বরণ করা কঠিন হয়ে পড়লো। 

এই বিভূতি বোধ করি নরেনদের কিছু উঁচুতে পড়তো। মহেন্দ্র গিয়ে তার সঙ্গ ধরলো এবং পরের বৎসর তাকে ছাড়িয়েও চলে গেল। কিন্তু সেই এক বৎসরের মধ্যেই যে বন্ধুত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, মহেন্দ্র যুদ্ধে যাওয়ার আগে পর্যন্ত তা অব্যাহত ছিল। 

মেধা ছাড়া অন্য অনেক বিষয়ে উভয়ের মধ্যে একটা আশ্চর্য মিল ছিল। উভয়েই উচ্ছৃঙ্খল, খামখেয়ালী এবং স্নেহপরায়ণ। তা ছাড়া আর একটা বিভূতির ভগবদ্দত্ত ক্ষমতা ছিল, মুখে মুখে অনর্গল কবি-গান গাওয়া। এই সেদিনও, যুদ্ধে যাওয়ার আগে যখন সে বাড়ী এসেছিল, বিভূতির বাড়ী গিয়ে মুড়ি আর আলুর দম খেয়ে এসেছে। সেই বিভূতির এত ভক্তি! 

মহেন্দ্র উচ্ছ্বাসের সঙ্গে চীৎকার করে উঠলো, কিরে বিভূতি, কেমন আছিস?

বিভূতি কি বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু নরেনের শান্ত গম্ভীর কণ্ঠস্বরে সে থমকে গেল।

নরেন গম্ভীর বিরক্ত কণ্ঠে বললে, আমার ঘরে এসো মহিন, তোমার সঙ্গে কথা আছে। 

.

কথা আর কিছুই নয়, গুটিকয়েক মূল্যবান উপদেশ। 

নরেন্দ্র তাকে বুঝিয়ে বললে, এ গ্রামে এবং পাশাপাশি কয়েকটি গ্রামেও ম্যাট্রিক পাশ করা খুব কম ছেলেই আছে যারা সি. এইচ. মুখার্জি অ্যান্ড সন্সে চাকুরী করে না। যারা এখানে চাকরী করে তাদের সকলেই মহেন্দ্রের পরিচিত। কাউকে মহেন্দ্ৰ দাদা বলে, কেউ বা বন্ধু। কিন্তু সে-সব মহেন্দ্রকে ভুলে যেতে হবে। নইলে চাকুরীর ক্ষেত্রেও তারা এই সম্পর্কের সুযোগ নেবে। মহেন্দ্রকে সব সময় মনে রাখতে হবে, সে তাদের মনিব। নইলে তারা কাজে ফাঁকি দেবে, এবং এত বড় কারবার শেষ পর্যন্ত ফেল পড়ে যাবে। মহেন্দ্ৰ বললে, কিন্তু আমি তো এখানে থাকছি না দাদা! আমি কলকাতায় প্র্যাকটিস করতে বসছি। 

—অবশ্য। মেজর এম. এন. মুখার্জি ধান-চালের আর এটা-ওটার ব্যবসা নিয়ে জীবন কাটাতে পারে না। সে আমিও জানি।

—নরেন সগর্বে বললে, কিন্তু যেখানেই থাক, তুমি ওদের মনিব। সেইটেই ওদের সঙ্গে তোমার সত্যকার সম্পর্ক। 

কথাটা মহেন্দ্রের ভালো লাগলো না। 

বললে, আমি আপনার সঙ্গে তর্ক করছি না দাদা। কিন্তু আমি যদি দেশে না থাকি এবং কারবারও না দেখি, তাহলে ওদের সঙ্গে পুরোনো সম্পর্ক বজায় রাখলে ক্ষতি কি? 

—ক্ষতি? ক্ষতি অনেক। ছ’ বছর ওদের আমি চরাচ্ছি, ওদের চিনি না? ওরা এক দুঃখ দশখানা করে তোমার কাছে দরবার করবে। হয়তো আমার বিরুদ্ধেও তোমার কাছে লাগাবে। 

এবারে মহেন্দ্র হেসে ফেললে। 

বললে, এক দুঃখ দশখানা করে দরবার হয়তো করতে পারে, কিন্তু আপনার বিরুদ্ধে আমার কাছে লাগাতে সাহস করতে পারে, এ নিশ্চয় আপনি বিশ্বাস করেন না। 

—করি ভাই, করি। এর চেয়েও বেশি বিশ্বাস ওদের ‘পরে আমার আছে।

নরেন্দ্র হাসতে লাগলো। 

তারপর বললে, যাক সে কথা। তুমি যাবার কথা যখন তুললে তখন বলি, আসছে মাসের চার তারিখের মধ্যে তোমার যাওয়া তো হতে পারে না। 

—কেন? 

—চার তারিখে আমাদের নতুন ব্যাঙ্কের উদ্বোধন। 

—ব্যাঙ্ক! 

—হ্যাঁ। তোমাকে সব কথা বলা হয়নি। সেদিন সদরে গিয়েছিলাম এই ব্যাঙ্কটি নিয়েই,—পীপ্‌স্‌ ওন ব্যাঙ্ক। আমাদের শ্রীপুরে তার শাখা খুলছি। দত্তদের বাড়ীটা কেনা ইস্তক পড়েই আছে। এই ক’দিনে সেটাকে বেশ করে মেরামত করতে হবে। ওই বাড়ীটায় ব্যাঙ্ক হবে। ম্যাজিস্ট্রেট বাহাদুর রাজি হয়েছেন উদ্বোধন করতে। 

—তাতে আমার কি কোন কাজ আছে? 

—কিচ্ছু না। কাজ যা সে আমিই করব। তুমি শুধু তোমার মেজরের পোশাক পরে ম্যাজিস্ট্রেটের ডান দিকে বসে থাকবে। তিনি তোমাকে খাতির করবেন সেইটে দেখব, আর এই হতভাগা গাঁয়ের লোকগুলোকে দেখাব। 

সমস্ত কাজ ফেলে ম্যাজিস্ট্রেট কেন যে মহেন্দ্রকে খাতির করতে লেগে যাবেন সে নরেন্দ্রই জানে। মহেন্দ্র শুধু এইটুকু বুঝলে যে তার সম্বন্ধে তার দাদা একটা অসম্ভব রকমের আকাশ-কুসুম রচনা করেছে। এখনি তাতে আঘাত দিতে মহেন্দ্রের করুণা হল। 

শুধু বললে, বেশ। তাই হবে। 

তারপর উঠতে উঠতে বললে, আমি ভিতরে চললাম দাদা। বৌদির সঙ্গে একটু…

-ঝগড়া আছে? যাও। কিন্তু তোমার লাঞ্চ ক’টায়? 

লজ্জায় মহেন্দ্র আর সে কথার জবাব দিলে না। এক রকম দৌড়েই ভিতরে চলে গেল।

.

ভিতরে ঢুকতে সামনেই সুবর্ণলেখা। 

মহেন্দ্রকে দৌড়ে ঢুকতে দেখে সুবর্ণ কৃত্রিম উদ্বেগে জিজ্ঞাসা করলে, কি ব্যাপার! মেজর সাহেবকে কেউ তাড়া করলে না কি? 

—হ্যাঁ। 

—কে সে? 

—মেজর সাহেবের দাদা স্বয়ং। কিন্তু তোমরা আমাকে কি ভেবেছ বল তো? আমি সত্যিই সাহেব হয়ে গেছি? 

সুবর্ণর পরিহাস-তরল মুখের উপর হঠাৎ যেন একটা কালো ছায়া পড়লো।

জিজ্ঞাসা করলে, কেন বল তো? 

মহেন্দ্র জিজ্ঞাসা করলে, আমি শ্রীমহেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। পেটের দায়ে ডাক্তারী চাকরী নিয়ে যুদ্ধে গিয়েছিলাম। তার জন্যে দাদা আমাকে সাহেব সাজিয়ে বাগানবাড়ীতে বসিয়ে রাখতে চান কেন? 

 সুবর্ণ নিরীহভাবে উত্তর দিলে, সে আমি কি করে জানব ভাই? 

—নিশ্চয়ই জানো। তুমি জানো না দাদার এমন কোনো ব্যাপারই থাকতে পারে না।

সুবর্ণ গম্ভীরভাবে বললে, সত্যিই আমি জানি না ভাই। আমার মনে হয়… 

—কি মনে হয়? 

সুবর্ণ হেসে বললে, বোধ হয় তাঁর ধারণা ইউরোপ থেকে তুমি একটা কেও-কেটা হয়ে ফেরোনি। 

মহেন্দ্র বললে, দাদার সেই ভুলটাই তুমি ভেঙে দাও বৌদি। আমি নিতান্তই সাধারণ একটি ব্যক্তি। বাড়ী এসেছি বৌদির হাতে ঝাল-ঝোল- সুক্ত খেতে, ইব্রাহিম মিঞার হাতে ফাউল-কারি খেতে নয়। এইটে তুমি, যেমন করে হোক, দাদাকে বুঝিয়ে দাও। 

ওর আগ্রহাতিশয্য দেখে সুবর্ণ নিঃশব্দে কি যেন চিন্তা করলে। তারপর বললে, আমি চেষ্টা করব ঠাকুরপো। কিন্তু তোমার দাদাকে তো জানো কি রকম একজেদী। 

—আমি তো তাঁকে তোমার একান্ত অনুগত বলেই জানতাম। এ রকম একজেদী তো তিনি ছিলেন না। 

—সেইটেই তুমি ভুল জানতে ঠাকুরপো। উনি তোমারই মত একজেদী চিরকাল। শুধু তোমার মতো মুখে রাগারাগি করেন না। 

—তাহলে এখন উপায়? 

—জানিনে। কিন্তু উনি যখন ধরেছেন গ্রামের সকলের সামনে তোমাকে সাহেব বলে দাঁড় করাবেন, সকলের কাছে তোমার মর্যাদা ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের সমান বলে প্রতিপন্ন করবেন, তখন সহজে থামবেন বলে মনে হয় না। আমার মনে হয়, এই স্নেহের অত্যাচার অন্তত কিছুদিন নীরবে সহ্য করে যাওয়াই উচিত। পারবে না? 

—পারব। কিন্তু তার বদলে আমার কাছে তোমাকেও একটা কথা দিতে হবে।

–কি বল? 

—রোজ দুপুরে চুপি চুপি তোমাকে আমার জন্যে ভাত পাঠিয়ে দিতে হবে। ইব্রাহিম লোকটি ভালো। আশা করি কখনই দাদাকে বলে দেবে না। বরং দিনের রান্নার দায় থেকে অব্যাহতি পেয়ে নিশ্চয় আমাদের আশীর্বাদই করবে। 

—কিন্তু আমার রান্না কি এখন তোমার ভালো লাগবে ঠাকুরপো? 

—খুব ভালো লাগবে বৌদি। কিন্তু সে তো তুমি চোখে দেখতে পাবে না। সত্যি বলছি তোমাকে, রাত্রের ডিনার যদি বা পারি, দিনের লাঞ্চ উপর্যুপরি কয়েকদিন খেতে হলেই একদিন পালাব।

সুবর্ণ হেসে বললে, আচ্ছা, পালাতে আর হবে না মশাই। দিনের খাবারটা যেমন করেই হোক পাঠিয়ে দোব। তাহলেই হবে তো? 

এই মন্দের ভালো ব্যবস্থায় মহেন্দ্র খুশি হয়ে গেল। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *