ছাব্বিশ
ওদের মোটর যখন ম্যাজিস্ট্রেটের বাংলোয় গিয়ে পৌঁছলো তখন সন্ধ্যা হয়েছে। ওদের দেখে মিসেস জনসন নিজেই বেরিয়ে এসে অভ্যর্থনা করে বসবার ঘরে নিয়ে গিয়ে বসালেন।
বিষণ্ণ বদনে জিজ্ঞাসা করলেন, সবই শুনেছেন বোধ হয়?
ঘাড় নেড়ে পেনিলোপী বললে, খবরের কাগজে যেটুকু বেরিয়েছে, পড়েছি। মিসেস জনসন বললেন, ভারি শোচনীয় ঘটনা। টেলিগ্রাফের তার কেটে, থানা ঘেরাও করে রেখে এমন কাণ্ড করেছিল যে, তিন দিনের আগে আমরাও খবর পাইনি। খবর পাওয়ামাত্র পুলিশ সাহেব এবং একদল সশস্ত্র পুলিশ নিয়ে চার্লি তখনই মোটরে বেরিয়ে গেছে। সৈন্য এসে পৌঁছয় পরের দিন এবং তখনই ট্রাকে করে শ্রীপুর রওনা হয়ে যায়। আপনারা কি করবেন মনে করেছেন?
মহেন্দ্র বললে, আমরাও এখনই মোটরে রওনা হব।
চিন্তিতভাবে মিসেস জনসন বললেন, সেটা নিরাপদ হবে না। মোটর তো সবটা যাবে না। বাদশাহী সড়ক পর্যন্ত যাবে। সেখানে পৌঁছুতে আপনাদের রাত্রি হয়ে যাবে। তারপর সেইখানে মোটর রেখে হাঁটতে হবে। স্থানটা এখন খুবই বিপজ্জনক।
—কিন্তু আমাদের উপায় কি বলুন? যত বিপজ্জনকই হোক, আমাদের তো যেতেই হবে।
—সে ঠিক। তাহলে একটা কাজ করুন। এখন আর যাবেন না। শেষ রাত্রে বেরবেন, ঠিক সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে পৌঁছে যাবেন। আমি যতদূর খবর পেয়েছি, আপনাদের সেই বাগানবাড়ীতেই সরকারী ক্যাম্প বসেছে। মিসেস লাহিড়ি, আপনি নিশ্চয় যাচ্ছেন না?
—যাব বলেই তো বেরিয়েছি।
—আপনিও যাচ্ছেন?—মিসেস জনসন কি যেন চিন্তা করে মহেন্দ্রকে জিজ্ঞাসা করলেন,– তাহলে শেষ রাত্রে যাওয়াই স্থির করলেন তো? আমার মনে হয় সেইটেই ভালো হবে।
মহেন্দ্র একটুক্ষণ কি যেন চিন্তা করলে। তারপর বললে, বেশ তো। শেষ রাত্রেই বেরুনো যাবে বরং। কয়েক ঘণ্টার ব্যবধান বই তো নয়।
মিসেস জনসন সানুনয়ে বললেন, তাহলে আমাকেও অনুগ্রহ করে সঙ্গে নেবেন? বহু স্ত্রীলোক বিপন্ন শুনছি। আমার মনে হয়, আমারও সেখানে কিছু করবার আছে।
—বেশ তো, চলুন না। আপনি গেলে তো খুবই ভালো হয়।-মহেন্দ্ৰ সাগ্রহে বললে।
—মিসেস লাহিড়িকে দেখে সাহস হচ্ছে। তাই চলুন, আমিও যাই। থানায় খবর পাঠাচ্ছি একজন সশস্ত্র সিপাহী দেবার জন্যে। আপনার গাড়ী তো বড়। কুলোবে না?
—খুব কুলোবে।
থানায় খবর পাঠাবার জন্যে মিসেস জনসন ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। একটু পরেই যখন তিনি ফিরলেন, তাঁর পিছনে একটা বেয়ারা চায়ের ট্রে নিয়ে এল।
মিসেস জনসন বললেন, মুখ দেখে মনে হচ্ছে, সমস্ত দিন আপনাদের খাওয়া হয় নি। কিছু খেয়ে নিন বরং।
মিসেস জনসন ঠিকই লক্ষ্য করেছিলেন। সমস্ত দিন সত্যই ওদের খাওয়া হয়নি। কিন্তু সেকথা তাদের এতক্ষণ মনেই পড়েনি। সামনে খাবার দেখে ক্ষুধার উদ্রেক হল।
মহেন্দ্র জিজ্ঞাসা করলে, আমাদের বাড়ীর মেয়েদের খবর জানেন কিছু? বেঁচে আছেন, না মুসলমান হয়েছেন?
একটু চিন্তা করে মিসেস জনসন বললেন, জানিনে মেজর মুখার্জি। কিন্তু সেজন্যে চিন্তা করে লাভ কি? কাল গিয়ে নিজেই তো সব দেখতে পাবেন।
—মনটা বড় ব্যাকুল হয়ে আছে মিসেস জনসন।
—আমি ঠিক জানিনে মেজর মুখার্জি। অন্তত: মারা যাওয়ার খবর পাইনি। যাই হোক কাল আমাদের যাওয়া ঠিক রইলো।
মহেন্দ্র বললে, আজ্ঞে হ্যাঁ। আমরা এখন আমাদের উকিলের বাড়ী যাব একবার। রাত্রিটা সেইখানেই কাটাব। শেষরাত্রে এসে আপনাকে ডেকে নিয়ে যাব। কেমন?
.
বড় বাঁকের মোড়ে গিয়ে যখন ওদের মোটর পৌঁছুলো তখনও সূর্য ওঠেনি। একজন পুলিসের সাব-ইন্সপেক্টরের অধীনে সেখানে জনকয়েক সশস্ত্র সিপাহী পাহারা রয়েছে। এত ভোরে গাড়ী আসতে দেখে তারা গাড়ীখানা আটকালে।
গাড়ীর ভিতর থেকে পর পর দু’জন মেম সাহেবকে নেমে আসতে দেখে সাব- ইন্সপেক্টার নিজেই ছুটে এল। মিসেস জনসনকে চিনতে তার বিলম্ব হল না। সঙ্গে সঙ্গে মিলিটারী কায়দায় স্যালিউট করলে।
সেইখানেই মোটর ছেড়ে দিতে হবে। এইখান থেকে আর একটা কাঁচা সড়ক বেরিয়ে গেছে। সেইটে দিয়ে মাইল খানেক গেলেই ওদের শ্রীপুর।
মিসেস জনসন প্রত্যভিবাদন করে তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, গাড়ীখানা কোথায় রাখা যায়?
সাব-ইন্সপেক্টার জানালে, গাড়ী রাখবার জায়গা আছে। ওইখানে অনেকখানি জায়গা পড়ে আছে। তার খানিকটায় পুলিশ আর মিলিটারীর জন্যে তাঁবু খাটানো হয়েছে। আর পাশেই আর একটা তাঁবু খাটানো হয়েছে, সেখানে মোটর রাখা হয়। লোকটি আশ্বাস দিলে, এ মোটরও সেইখানেই চমৎকার রাখা যাবে। বৃষ্টির ছাঁটের জন্য কিছু অসুবিধা হবে না।
গাড়ী রাখার বন্দোবস্ত করে সশস্ত্র পাহারাওয়ালাকে নিয়ে ওরা চারজন তখন হাঁটতে আরম্ভ করলে।
কী রাস্তা!
কোথাও জল, কোথাও কাদা। সেই কাদায় কোথাও কোথাও হাঁটু পর্যন্ত ডুবে যায়। তাই ভেঙেই ওরা বহু কষ্টে চলে ঘণ্টা দেড়েক পরে বাগানবাড়ীতে গিয়ে পৌঁছুলো।
ম্যাজিস্ট্রেট এবং পুলিশ সাহেব তখন বেরিয়ে গেছেন। আর্দালীটা জানালে, একটার আগে তাঁরা ফিরবেন না।
ওরা বাগানবাড়ীটা দেখতে লাগলো। শুধু অগ্নিদগ্ধ দেওয়াল কয়টাই দাঁড়িয়ে আছে। কড়িবরগা ঝুলে পড়েছে, ছাদও ধ্বসে গেছে। বাগানটা পর্যন্ত যেন ঝলসে গেছে।
মহেন্দ্ৰ কম্পিত কণ্ঠে বললে, ও বাড়ীটা দেখে আসি চলুন। কে যে কেমন আছে…
বাগানবাড়ী থেকে ওরা চললো বসতবাড়ীর দিকে।
সমস্ত পথে ওরা জনমানবের দেখা দেখা পেলে না। দু’ধারে শুধু ঝলসানো গাছ, পোড়া বাড়ী আর ইটের স্তূপ। চলতে চলতে কয়েকটা জায়গায় পথে রক্তের দাগও দেখতে পেলে।
.
ওবাড়ীর অবস্থাও বাগানবাড়ীর মতোই। দরজা-জানালা অধিকাংশই পুড়ে খসে গেছে। গৃহে আসবাবপত্রের চিহ্নমাত্র নেই। লোহার সিন্দুক উঠানের এককোণে ভাঙা পড়ে রয়েছে। ঘরে ঘরে শুধু পোড়া কাঠ আর খসা চুন-বালির টুকরো। দুটো একটা লোহার ডাণ্ডাও ইতস্তত বিক্ষিপ্ত। আঘাতে-আঘাতে দেওয়ালগুলো পর্যন্ত ক্ষত-বিক্ষত। রান্নাঘরের উনানগুলোও অক্ষত নেই।
বারান্দার এবং সিঁড়ির রেলিংগুলো ঝুলছে।
আগুনে নিচের ঘরগুলোর তত বেশি ক্ষতি করতে পারেনি। ফ্যালার মায়ের তোষকটা পড়ে রয়েছে এককোণে। ইন্দুরে তার তুলোগুলো নিয়ে ঘরময় ছড়াছড়ি করেছে।
একটা ভাঙা কলসী, এবং গোটা কয়েক কুঁজো বারান্দায় কাত করা।
বাড়ী জনমানবহীন।
নিঃশব্দ।
কিন্তু মহেন্দ্রর এদিকে লক্ষ্যই নেই। সে খুঁজে বেড়াচ্ছে রক্তের দাগ। কিছু কিছু রক্তের দাগ এখানে-ওখানে চোখে পড়ে। কিন্তু একটা জায়গায় অনেকখানি চাপ-চাপ রক্ত জমাট বেঁধে কালো হয়ে রয়েছে। পাশের ঘরে আরও বেশি রক্ত ঘরময় মাখানো।
মহেন্দ্র দেওয়ালের একটা কোণ শক্ত করে ধরে এমন করে দাঁড়িয়ে রইলো যে সবাই ভয় পেয়ে গেল।
এক রকম টেনেই ওরা সেখান থেকে মহেন্দ্রকে বাইরে নিয়ে এল।
ভাঙা ফটকটা পার হয়ে রাস্তায় নামছে এমন সময় দেখে, গোলক আসছে টলতে টলতে। পরনে একটা নতুন লুঙ্গি, গায়ে গেঞ্জি, মাথায় কাপড়ের টুপি। এমন চেহারা হয়েছে যে, ওরা প্রথমটা চিনতেই পারলে না।
গোলক কিন্তু এসেই মহেন্দ্রকে গড় হয়ে প্রণাম করলে।
মহেন্দ্ৰ সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করলে, কে, গোলক দাদা?
ভক্তিভরে মহেন্দ্রের পায়ের ধুলো মাথায় নিয়ে গোলক বললে, আজ্ঞে না, আমি আব্বাস।
উঠে দাঁড়াতেই গোলকের মুখ দিয়ে ভক ভক করে মদের গন্ধ বেরুলো। পেনিলোপী আর মিসেস জনসন নাকে রুমাল দিয়ে সরে দাঁড়ালেন।
মহেন্দ্ৰ ব্যাকুল কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলে, এরা সব কোথায় গোলক দাদা? বেঁচে আছে তো?
মাতালটা হাত নেড়ে বললে, আজ্ঞে যারা মরেনি তারা সবাই বেঁচে আছে।
উত্তরটা এমনই যে, এই ভয়ঙ্কর শ্মশানের মধ্যে দাঁড়িয়েও সশস্ত্র সিপাহীটা ফিক করে হেসে ফেললে।
তা গোলকের চক্ষু এড়ালো না।
ভীষণ রেগে সে বললে, হাসো যে! হাসো যে হে বোনাই! হাসে কে? কে হাসে জানো?
সেইখানে মাটির উপর গোলক ধপ করে বসে পড়লো। তারপরে ডান হাতে মাটি চাপড়ে বলতে লাগলো :
—হাসে মেদিনী, যখন মানুষ তাকে নিজের ভেবে দেমাক করে। আর হাসে অসতী মেয়েমানুষ, যখন তার স্বামী তার ছেলেকে নিজের ভেবে আদর করে। আর হাসে মহাকাল। কিন্তু সে ব্যাটা কে আমি ঠিক জানি না, বুঝলে?
বলে টলতে টলতে সোজা চলে গেল।
পেনিলোপী অবাক!
বললে, এত বড় কথা ওই মাতালটা বললে!
শান্তকণ্ঠে বসন্ত বললে, তুমি তো বাংলার গাঁয়ে গাঁয়ে ঘোরোনি। এর চেয়ে কত বড় কথা কত সামান্য লোকের মুখ থেকে কত সহজে বেরোয়, শুনলে অবাক হয়ে যেতে হয়।
ওরা রাস্তা ধরে চলতে লাগলো। হঠাৎ দেখা গেল, নবাই মণ্ডল ওদের দেখে পাশ কাটিয়ে পালাবার চেষ্টা করছে। সিপাহীটাকে ইসারা করতেই সে ছুটে গিয়ে তাকে ধরে নিয়ে এল।
তারও পরনে গোলকের মতোই বেশ। চোখে ভীতি-বিহ্বল চাহনি। মহেন্দ্ৰকে দেখেই ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেললে।
বললে, আমরা সব মুসলমান হয়ে গেছি ছোট বাবু।
—কিচ্ছু হওনি তোমরা, হিন্দুই আছ।
নবাই-এর চোখটা যেন আশায় প্রদীপ্ত হয়ে উঠলো।
বললে, বলেন কি! আমরা হিন্দুই আছি! কলমা পড়েছি, অখাদ্য খেয়েছি, এর পরেও হিন্দুরা আমাদের নেবে?
—নেবে বই কি নবাই, নিশ্চয় নেবে। এখন চলো তো আমাদের সঙ্গে। কে কোথায় আছে দেখিয়ে দেবে। ভয় নেই, তোমাদের কিছু ভয় নেই। মেয়েরা কে কোথায় আছে জানো?
—সব জানি ছোট বাবু। কিন্তু ভয় নেই তো? সত্যি বলছেন?
—কিছু ভয় নেই। তুমি চলো।
.
বিকেলে বসন্তকে ডেকে সেদিনের খবরের কাগজের একটা জায়গায় আঙুল দিয়ে দেখিয়ে মহেন্দ্ৰ বললে, দেখেছ?
বসন্ত দেখলে, বাংলার পণ্ডিতসমাজ পাঁতি দিয়েছেন, জোর করে যাদের ধর্মান্তরিত করা অথবা বিবাহ দেওয়া হয়েছে তাদের হিন্দুসমাজে ফিরিয়ে নেওয়ার কোন বাধা তো নেই-ই, বরং নেওয়াই কর্তব্য। বিনা প্রায়শ্চিত্তেই তাদের গ্রহণ করা হবে।
মহেন্দ্ৰ বললে, দেখলে? আমার মনে হয় বসন্ত, যে ধাক্কা আজ হিন্দুসমাজ পেলে তা যত বড় মর্মান্তিকই হোক না কেন, তারও প্রয়োজন ছিল। নইলে বিধি-নিষেধের এই জগদ্দল পাথর কিছুতেই ঠেলা যেত না। যেদিন লোকের ঘোরা-ফেরা মহকুমার, বড় জোর জেলার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, এত বাঁধন-কষণ পাঁজি-পুঁথি তখন চলতে পারতো। আজ যখন তাকে সমস্ত পৃথিবীর সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে হবে, তখন এসব চলে না।
বসন্ত বললে, কিন্তু এত লোকক্ষয়…
বাধা দিয়ে মহেন্দ্ৰ বললে, লোকক্ষয়ের কথা আমি এখন ভাবছিই না বসন্ত। দুর্ভিক্ষে কত লোক মরেছে খবর রাখো? ম্যালেরিয়ায় মৃত্যুহারের হিসাব রাখো? কিন্তু এর বিনিময়ে হিন্দুসমাজ কত বড় জীবন পাবে! ধর্মটা যে খাওয়া-ছোঁয়া, আচার-নিয়মের ঊর্ধ্বেকার একটা বস্তু, এই বোধটা জাগছে দেখছ না?
বসন্ত জিজ্ঞাসা করলে, মেয়েদের খবর কিছু পেলে?
—পেলাম।–ঊর্ধ্বে চেয়ে মহেন্দ্ৰ শুষ্ক কণ্ঠে বলতে লাগলো,— প্রথম আক্রমণেই মা হার্ট ফেল করে মারা যান। পরের দিন দাদার মৃত্যুর খবর পেয়ে বৌদি দেন ইঁদারায় ঝাঁপ।
পেনিলোপী জিজ্ঞাসা করলে, আর গায়ত্রী?
—ইব্রাহিমের ছেলের সঙ্গে তার বিবাহ হয়ে গেছে।
ওরা স্তব্ধভাবে বসে রইলো।
ধীরে ধীরে মহেন্দ্র বলতে লাগলো :
—মিসেস জনসন তাকে আনতে গেছেন। এখনই হয়তো এসে পড়বে তারা। আমার বিশ্বাস, তার সংস্কারের শক্ত খোলাটা এইবার বোধহয় ভেঙেছে। এইবার আমার কাছে আসতে বোধহয় বাধা হবে না তার। কিন্তু এখনই আমি তার সামনে গিয়ে দাঁড়াব না। অতখানি সে হয় তো সইতে পারবে না। তুমি বাইরে গিয়ে বোসগে পেনিলোপী। সে একটু সুস্থ হলেই তাকে কানে কানে বোলো, তাকে নিয়ে যাবার জন্যেই আমি এসেছি। পেনিলোপী জিজ্ঞাসা করলে, কিন্তু তাকে তুমি শ্রদ্ধা করতে পারবে তো মহিন? সত্যি করে বলো? নিজেকে ফাঁকি দিও না।
মহেন্দ্র উঠে দাঁড়িয়ে বললে, না। অনেক ফাঁকি নিজেকে দিয়েছি। স্থির করেছি, আর ফাঁকি দেবে না। তাকে বোলো, মরা-করবীর অভিশাপ এতদিনে বুঝি শেষ হোল। সকালে দেখে এসেছি সেই অভিশপ্ত গাছটা পুড়ে ঝলসে শুকিয়ে গেছে। আর ভয় নেই। এতদিনে বুঝি আমার ঘরণী হয়ে আসার তার সময় হোল। এই সময় আমি কিছুতেই হেলায় হারাবো না। এই কথাটা বললেই সে সমস্ত বুঝবে।
জানালা দিয়ে দেখা গেল একটি দল অশ্রুমুখী নারী মিসেস জনসনের পিছু পিছু বাগানবাড়ীর ফটকে ঢুকছে।
ব্যস্তভাবে মহেন্দ্ৰ বললে, ওই সে আসছে। তুমি যাও পেনিলোপী, আর দেরী করো না। যাও।
.
সন্ধ্যা হয়ে আসে।
মহেন্দ্র পশ্চিম দিগন্তের দিকে চেয়ে একটা লোহার বেঞ্চিতে বসে ছিল। ধীরে ধীরে গায়ত্রী এসে তাকে প্রণাম করলে।
মহেন্দ্রের দৃষ্টি সেই রক্তাক্ত দিগন্ত থেকে ঝলসানো বাতাবী লেবুগাছে এবং সেখান থেকে ধীরে ধীরে গায়ত্রীর মুখের উপর নেমে এল :
পরনে তার সেই ছেঁড়া থান ধুতি!
কিছুক্ষণ একটি কথাও কেউ বললে না।
অনেকক্ষণ পরে মহেন্দ্র বললে, তুমি ওদের সঙ্গে কাল সকালের ট্রেনেই কলকাতা চলে যাও গায়ত্রী। আমার এখানে অনেক কাজ। যেতে কিছু দেরী হবে।
গায়ত্রী এক মুহূর্ত নিঃশব্দে নতনেত্রে দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর ধীরে জিজ্ঞাসা করলে, তোমার কি যেতে খুব বেশী দেরী হবে?
একটু চিন্তা করে মহেন্দ্ৰ বললে, কিছুই বুঝতে পারছি না গায়ত্রী। কিন্তু যত দেরিই হোক যাব নিশ্চয়ই।
সমাপ্ত