পঁচিশ
মহেন্দ্র ক্লিনিকের কাজে একেবারে ডুবে গেল। রেশন এবং আরও নানা ব্যবস্থার কল্যাণে শহরে রোগের অন্ত নেই। সুতরাং কেস্ কিছু কিছু থাকেই। এর উপর মহেন্দ্র এবং বসন্ত জানা-শোনা বড় বড় ডাক্তারদের কাছেও ধরনা দেয়, কিছু কিছু কেস তাদের ক্লিনিকে পাঠাবার জন্যে। পাঠানও তাঁরা কিছু।
দু’জনের প্রাণপাত পরিশ্রমে মাস দুয়েকের মধ্যেই ক্লিনিকটা দাঁড়িয়ে যাবার অবস্থায় এল। কাজকর্ম বেশ চলতে লাগলো।
ইতিমধ্যে ১৬ই আগস্ট।
সূর্য ওঠার আগে থেকেই হাঙ্গামা সুরু হয়ে গেল। বারোটার মধ্যে আর বাইরে বেরুবার অবস্থা রইলো না।
বসন্ত বললে, কী কাণ্ড আরম্ভ হোল হে! কদ্দিন এমনি চলবে কে জানে!
মহেন্দ্রর মুখখানা কঠিন হয়ে উঠলো। শুধু বললে, তাইতো!
অবস্থা দেখতে দেখতে আয়ত্তের বাইরে চলে গেল। লুঠতরাজ, অগ্নিদাহ, নরহত্যা, নারীহরণ, দলবদ্ধ আক্রমণ কিছুই আর বাকি রইলো না। মনে হোল, কত সহস্র বৎসরের সংস্কার ও সংস্কৃতি মুহূর্তের মধ্যে ঝেড়ে ফেলে বাংলা দেশের মানুষ আবার সেই আদিম বর্বর যুগে ফিরে গেছে। ‘জয়হিন্দ’, ‘বন্দে মাতরম্’ আর ‘আল্লা-হো আকবর’ ধ্বনিতে স্তব্ধ রাত্রি থেকে থেকে উচ্চকিত হয়ে ওঠে। রাইফেলের গুলি চলে, বোমা ফাটে, রাজপথে মৃতদেহের স্তূপ জমে। শকুনি নামে শহরের বুকের উপর।
ট্রাম-বাস, ট্যাক্সি-রিক্সা সমস্ত যানবাহন বন্ধ। রাজপথ জনহীন। কে বেরুবে? গলির মোড়ে-মোড়ে আততায়ী ছুরি নিয়ে লুকিয়ে রয়েছে। শুধু অসহায় আশ্রয়প্রার্থীর দল কচি- কাচা, মেয়ে-ছেলে, বোচকা-বুচকি নিয়ে মূষিকের মত এক গলি থেকে আর এক গলি দিয়ে পথ চলেছে দ্রুত ত্রস্ততায়। তাদেরই অবারিত জনস্রোত মুমূর্ষু কলিকাতাকে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চঞ্চল করে রেখেছে।
মৃত্যুর সে কি বীভৎস শোচনীয় রূপ!
মানুষের জীবন কীটের চেয়েও তুচ্ছ হয়ে গেল। প্রাণ-নেওয়া যেন নিতান্ত সহজ ব্যাপারে পরিণত হল। স্কুলের ছেলে খেলতে গেল, আর ফিরলো না। যে আপিসে বেরুলো দুপুরে, আর সে ফিরে এল না। লক্ষপতি সমস্ত ফেলে এক বস্ত্রে পরিবারবর্গ নিয়ে পালিয়ে গেল। কেউ বা তাও পারলে না, সেইখানেই সবংশে নিহত হল। কত লক্ষ লক্ষ টাকার দোকান লুঠ হোল। কত গৃহস্থ সর্বস্বান্ত হোল, কত নারী বিধবা, পুত্রহারা এবং কত ছেলে পিতৃমাতৃহারা অনাথ হোল তার আর সীমা-সংখ্যা রইল না।
কলকাতায় গুণ্ডার রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হোল।
বসন্ত বললে, পেনিলোপী, তুমি মেমসাহেব, তোমার সাত খুন মাপ। কেউ তোমার গায়ে হাত দেবে না। বের কর তোমার পুরোনো মেমের পোশাক। আমাদেরও আছে সামরিক পোশাক। গাড়ীখানা নিয়ে একবার ঘুরে আসি। যাবে মহিন?
—চল।
রাস্তার মোড়ে-মোড়ে তখন পুলিশ এবং মিলিটারী পিকেট বসেছে। মাঝে মাঝে হু হু শব্দে বেরিয়ে যাচ্ছে মিলিটারী ট্রাক। তাদের হাতের সঙ্গীনওয়ালা বন্দুক উঁচানোই রয়েছে।
ওদের গাড়ী বড় রাস্তায় একটু যেতেই পেনিলোপী নাকে রুমাল চেপে ধরলে। বললে, এত দুর্গন্ধ কিসের?
গাড়ী চালাচ্ছিল বসন্ত। বললে, দেখতে পাচ্ছ না?
পেনিলোপী দেখলে, রাস্তার দু’ধারে আবর্জনার স্তূপ জমেছে। মেথররা ভয়ে বেরুতে সাহস করছে না। জঞ্জাল পরিষ্কার হচ্ছে না। যে যার বাড়ীর জঞ্জাল বড় রাস্তায় ফেলে দিয়ে যাচ্ছে।
সামনে একটা কাপড়ের দোকান তখনও ধোঁয়াচ্ছে। এইখানে পেনিলোপী কাপড় কিনতে আসতো। দরজাগুলো পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। কোলাসি গেট তোবড়ানো। ভিতরের এবং বাহিরের দেওয়ালগুলো পুড়ে কালো হয়ে গিয়েছে। জিনিসপত্র কিচ্ছু নেই, সমস্ত লুণ্ঠিত।
পেনিলোপী বললে, দেখ, দেখ, দোকানটার অবস্থা! কয়েক লক্ষ টাকার জিনিস এখানে ছিল। ইন্দ্রপুরীর মতো সাজানো দোকান, কী হয়ে গেছে দেখ!
—আরে, এ পার্কের রেলিং কি হল?
—লোহার ডাণ্ডাগুলো দিয়ে দাঙ্গা করেছে বোধ হয়।
—সম্ভব।
হঠাৎ মহেন্দ্ৰ বললে, ওই দেখ।
গাড়ীর গতি মন্দীভূত করে ওরা চমকে চাইলে :
প্রকাণ্ড একটা লাস। ফুলে ঢোল হয়েছে। মাথাটা তার জঞ্জালের মধ্যে গোঁজা। উবুড় হয়ে পড়ে। উন্মুক্ত পিঠের খানিকটা দু’ফাঁক হয়ে হাঁ করে রয়েছে। রক্তাক্ত মাংস বেরিয়ে পড়েছে! সম্পূর্ণ উলঙ্গ। একটা কাক তার কোমরের পাশে ঠুকরে ফুটো করে নাড়িভুঁড়িগুলো বের করে পরমানন্দে চীৎকার করে অন্য কাকগুলোকে ডাকছে।
পেনিলোপী চীৎকার করে উঠলো :
ফেরো, ফেরো বসন্ত। এ নরক আর দেখা যায় না। ঈশ্বরের দোহাই, ফেরো ফেরো।
দেখা যায় না সত্যই। মহেন্দ্র এবং বসন্তর মুখ একটা নিষ্ঠুর ক্রুরতায় শক্ত হয়ে উঠেছে। বসন্ত বাড়ীর দিকে গাড়ী ফেরালে।
.
সান্ধ্য আইন আর ১৪৪ ধারার রাজত্ব।
দাঙ্গার প্রচণ্ডতা স্তিমিত হয়ে এসেছে। কিন্তু মানুষের মনে আস্থা ফিরে আসেনি এখনও। ট্রাম-বাস চলেছে মিলিটারী পাহারায়। তাও সব রাস্তায় নয়। কোনো কোনো রাস্তায় অ্যাসিড ছোঁড়ার খবরও পাওয়া যাচ্ছে। ইতস্তত: গুপ্ত ছুরিকাও চলেছে। এখনও লোকে নিশ্চিন্তে নিদ্রা যেতে পারছে না। পাড়ার ছেলেরা সতর্কভাবে পাহারা দিচ্ছে। মাঝে মাঝে উঠছে ‘জয় হিন্দ’, ‘বন্দেমাতরম্’ ধ্বনি। লোকে ত্রস্তভাবে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ছে। কোথায় কি হচ্ছে, অথবা আদৌ কিছু হচ্ছে কি না, বোঝবার উপায় নেই। ধ্বনি তরঙ্গের পর তরঙ্গে শহরের একপ্রান্ত থেকে আর একপ্রান্তে ছড়িয়ে পড়ছে। বাইরে বারান্দায় দাঁড়াবার উপায় নেই, মিলিটারী গুলি চালাচ্ছে এলোপাথাড়ী। ঝড়ের মতো, সমুদ্রগর্জনের মতো শব্দ করে ট্যাঙ্ক বেড়াচ্ছে টহল দিয়ে।
দিনে অপেক্ষাকৃত শান্ত অবস্থা।
বিপজ্জনক এলাকায় মূল বাজার থেকে নিরাপদ দূরত্বে গলির ভিতর দু’পাশে বসেছে বাজার। দোকান-পাটও ধীরে ধীরে খুলছে। লোকে, যদিচ ভয়ে ভয়েই, তবু বাজার-হাট, অফিস-কাছারী, কাজ-কর্ম করছে। ধীরে ধীরে শহরে জীবনের লক্ষণ ফিরে আসার আশা হচ্ছে। অবশ্য আশা অতি ক্ষীণ। কারণ নাগরিক জীবন যে রকম আমূল বিপর্যস্ত হয়েছে তাতে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসতে অনেক দেরি।
এই রকম অবস্থায় হঠাৎ এক দুঃসংবাদে মহেন্দ্ৰ যেন বজ্রাহত হয়ে গেল :
তাদের শ্রীপুর এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলেও ভীষণ হাঙ্গামার খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হোল। প্রকাশিত বিবরণের কিয়দংশ সত্য হলেও ব্যাপার গুরুতর। ওই অঞ্চলটি বরাবর মুসলমানপ্রধান। বাইরের লোক এসে কিছুদিন থেকেই তাদের উত্তেজিত করছিল। হঠাৎ একদিন সন্ধ্যার পরে প্রায় পাঁচ হাজার লোকের এক জনতা একখানি গ্রাম আক্রমণ করে। অপ্রস্তুত এবং সংখ্যাল্প হিন্দুরা কতক পালিয়ে যায়, কতক বা হতাহত হয়। সারারাত্রি মশালের আলোয় হিন্দুদের বাড়ী লুঠ হয়। আক্রমণকারীদের হাতে বন্দুক থেকে আরম্ভ করে নানারকম অস্ত্র ছিল।
পরদিন সকালে সেই জনতা কুচকাওয়াজ করে একটির পর একটি গ্রাম আক্রমণ করতে আরম্ভ করে। ইচ্ছা করলে, নরেন মোটরে করে সপরিবারে পালিয়ে যেতে পারত। ইব্রাহিম পূর্বাহ্ণেই গোপনে তাকে সংবাদ দিয়েছিল এবং পালিয়ে যাবার জন্যে সাধ্যসাধনাও করেছিল। তখন অবশ্য সময় বেশি ছিল না। আক্রমণকারীদের ব্যান্ডের বাজনা এবং উদ্দাম উল্লাসধ্বনি শোনা যাচ্ছিল।
নরেন স্থির করলে, পালিয়ে যাওয়ার মানে হয় না। আক্রমণকারীদের বাধা দেওয়া ছাড়া কোন সম্মানজনক পথ নেই। গ্রামের সমস্ত হিন্দু নরনারীকে সে নিজের অট্টালিকায় নিয়ে এল। অন্দরে পাঠিয়ে দিলে মেয়েদের এবং পুরুষদের নিয়ে নিজে সে সদরে বন্দুক হাতে করে আক্রমণকারীদের প্রতীক্ষা করে রইল।
সেই অল্প লোক নিয়েই সেদিনটা সে আক্রমণ প্রতিহত করলে। তারপর বন্দুকের গুলি গেল ফুরিয়ে। পরের দিন আবার যখন আক্রমণ আরম্ভ হোল তখন লাঠি হাতেই যতখানি পারলে বাধা দিলে। কিন্তু সে আর কতক্ষণ সম্ভব? নরেন এবং আরও কয়েকজন নিহত এবং অবশিষ্ট আহত হোল।
যারা বেঁচে রইল, তারা ধর্মের বিনিময়ে বেঁচে রইল। খবরের কাগজে প্রকাশ, জোর করে তাদের মুসলমান করা হয়েছে। সধবা বিধবা কুমারী নির্বিশেষে স্ত্রীলোকদেরও মুসলমান-ধর্মে দীক্ষিত করে স্থানীয় মুসলমানদের সঙ্গে বিবাহ দেওয়া হয়েছে।
এই বিবরণ পড়তে পড়তে মহেন্দ্রের রক্ত মাথায় চড়লো।
বললে, আমাকে এখনই যেতে হবে বসন্ত। আমি চললাম। যদি না ফিরি…..
বসন্ত বললে, বিলক্ষণ! আমি সুদ্ধ যাব যে। রিভলবারটা নিয়ে আসি। তোমারও একটা আছে না?
মহেন্দ্ৰ হেসে বললে, দুটো রিভলবারে দশ হাজার লোকের জনতা তুমি কতক্ষণ ঠেকাবে বসন্ত?
—যতক্ষণ পারি। তবু সঙ্গে থাকা ভালো।
পেনিলোপী নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে ছিল। বললে, আর তোমাদের ছেড়ে দিয়ে আমি এখানে আহারনিদ্রা বন্ধ করে জীবস্মৃত হয়ে থাকি! কেমন? সে হবে না। আমি সুদ্ধ সঙ্গে যাব।
বসন্ত আর মহেন্দ্র এক সঙ্গে বলে উঠলো : তুমি যাবে কী!
—যেতেই হবে। উপায় কি বল?-ওদের দুজনের সমস্ত আপত্তি যেন দু’হাতে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে পেনিলোপী বলে চললো,—আমি বলি কি, তোমাদের জেলার শহর পর্যন্ত তো মোটর যায়। ট্রেনের উপর এখন নির্ভর করা চলে না। সুতরাং ততদূর অবধি মোটরে যাব। সেখানে মিঃ জনসনের সঙ্গে আলোচনা করব। তারপর সম্ভব হলে মোটরে, নয়তো যাতে-করে-হোক শ্রীপুর যাব। সেই ভালো হবে না?
প্রস্তাবটির সমীচীনতা ওরা উপলব্ধি করলে। মোটরে যাওয়াই ভালো। বিশেষ, ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে দেখা করে যাওয়া দরকার। পুলিস এবং মিলিটারী সাহায্যের আবশ্যক হতে পারে। খুব সম্ভব, জায়গাটা এখন একেবারেই অরাজক হয়ে আছে। একলা যাওয়া নিরাপদ তো নয়ই, নিরর্থকও।
ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই সামান্য কিছু জামা-কাপড় এবং কিছু টাকা নিয়ে ওরা তিনজনে রওনা হয়ে পড়লো। পেনিলোপীকে নিবৃত্ত করা কিছুতেই সম্ভব হোল না।