কুড়ি
মহেন্দ্রের মনে একটা আশা ছিল, গায়ত্রী অন্তত একবার তার সঙ্গে দেখা না করে থাকতে পারবে না। এর আগের বারও দু’দিন সে নিজে এসে মহেন্দ্রর সঙ্গে দেখা করে গেছে। কিন্তু সকাল কেটে দুপুর আসে, দুপুর কেটে বিকেল, তারপর রাত্রি আসে। মুহূর্তগুলি যতই বয়ে যায়, মহেন্দ্রর আশাও তত ক্ষীণ হয়।
অবশেষে মঙ্গলবার সকালে মহেন্দ্র বললে, আর নয় পেনিলোপী। বসন্তর কষ্ট হচ্ছে। কলকাতায় বহু কাজই পড়ে আছে। কাল সকালে রওনা দেওয়া যাক।
—বেশ তো! আজ বিকেলে কথা আছে তোমার বৌদি আর গায়ত্রীকে নিয়ে মোটরে একটু বেড়াতে যাব।
—সেই ব্যবস্থা হয়েছে বুঝি?
—হ্যাঁ, তোমার বৌদির ভয়ানক সখ। একদিন নাকি তোমার সঙ্গে গিয়েছিলেন।
—হ্যাঁ। দাদার উৎপাতে কোথাও তো বেরুতে পায় না। নিয়ে যাও বেড়াতে।
—তুমি যাবে? চল না।
—না!
—এর মধ্যে একদিনও ওবাড়ী যাওনি বোধ হয়?
উদাসভাবে মহেন্দ্ৰ বললে, কই আর গেলাম!
পেনিলোপী আর কিছু বললে না।
হঠাৎ এক সময় মহেন্দ্র জিজ্ঞাসা করলে, তুমি সাঁতার জানো পেনিলোপী?
—জানি। কেন?
—চল। আজ নদীতে সাঁতার কেটে আসা যাক। হাত-পায়ের গাঁটগুলো যেন জমে যাচ্ছে।
পেনিলোপী উৎফুল্ল হয়ে বললে, চলো। কিন্তু আমার পোশাক নেই যে! কিনতে পাওয়া যাবে এখানে?
—পাগল! তার দরকারও নেই। মেয়েদের প্রকাশ্যে সাঁতার কাটাই তো এখানে একটা ভীষণ ব্যাপার। তার ওপর সুইমিং-কস্ট্যুম পরলে তো আর রক্ষেই নেই।
পেনিলোপী বললে, কস্ট্যুমে কাজ নেই তাহলে। শাড়ীতেই যা সাঁতার কাটব, তা তুমি পারবে না।
—তাই নাকি? চলো বিদেশিনী, সাঁতার কি করে কাটতে হয়, তোমাকে শিখিয়ে দিই।
দু’জনে তখনই বেরিয়ে পড়লো।
পেনিলোপীর সঙ্কোচের বালাই নেই। আঁচলটা কোমরে জড়িয়ে মহেন্দ্রর সঙ্গে সঙ্গে সেও নদীর উপর থেকে জলে ঝাঁপিয়ে পড়লো। স্নান করবার জন্যে যারা ঘাটে ছিল তারা তো অবাক! পুরুষ মানুষের গা ঘেঁষে মেয়েরা যে এমন করে সাঁতার দিতে পারে এ তারা স্বপ্নেও ভাবেনি। তারা আমোদ দেখতে দাঁড়িয়ে রইলো আর ওদের দু’জনকে নিয়ে যে আলোচনা আরম্ভ করলে, তা কানে শোনা যায় না।
বহু দূর অবধি ওরা দুজনে সাঁতার কেটে চলে গেল।
খালি গায়ে পেনিলোপী মহেন্দ্রকে কখনও দেখে নি। বুঝলে মহেন্দ্ৰ দুৰ্বল নয়। জিজ্ঞাসা করলে, তুমি তো ব্যায়াম কর না মহিন। কিন্তু চমৎকার তোমার দেহ! এই গ্রামের লোক বলে মনেই হয় না।
মহেন্দ্র হাসলে। পেনিলোপীর দিকে সে চাইতেই পারছিল না। মাঝে মাঝে তার দেহের যেটুকু আভাষ পাচ্ছিল তাতেই তার মনে হচ্ছিল, বাঙালী মেয়ের দেহের গড়ন এমনি বলিষ্ঠ, এমনি সুন্দর কবে হবে।
স্রোতের বিরুদ্ধে চলছে ওরা। আরও খানিক যাওয়ার পরে পেনিলোপী বললে, আর নয়। অনেক দূর এসে গেছি। চল এইবার ফিরি।
—তা হবে না পেনিলোপী। হার তুমি যতক্ষণ না স্বীকার করছ, ততক্ষণ ফিরব না। হার পেনিলোপী কিছুতেই মানবে না। প্রাণপণ শক্তিতে সে সাঁতার কেটে চলে। কিন্তু বেশিক্ষণ পারলে না। শেষকালে বললে, হার স্বীকার করছি মহিন। চল ফিরি। অনেক দিন অভ্যাস নেই, হাত ক্লান্ত হয়ে আসছে।
—ধরব?
—ধর একটু।
ফেরবার সময় মহেন্দ্রের কাঁধে ভর দিয়ে পেনিলোপী অনেকখানি এল। গ্রামের মধ্যে যারা অতিরিক্ত উৎসাহী তারা তাও দেখলে।
ওরা গ্রাহ্যও করলে না। নদীর কাছেই বাগানবাড়ী। ওরা ভিজে কাপড় সটপট করতে- করতে হাসতে-হাসতে বাগানবাড়ী চলে গেল।
.
কাপড় ছেড়ে বাইরে এসে বসতেই নরেন এল।
ভূমিকায় প্রথমেই নানা কাজের ভিড়ে আসতে না পারার জন্যে নরেন পেনিলোপীর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিলে। তারপর মহেন্দ্রের দিকে চেয়ে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললে, এদিকে ব্যাপার তো বিশেষ সুবিধা মনে হচ্ছে না মহিন।
—কিসের ব্যাপার?
—এই গ্রামের ব্যাপার আর কি! মুসলমান পাড়ার ছেলেরা ক’দিন থেকে মসজিদে খুব মিটিং করছে।
—কিসের মিটিং?
—পাকিস্তানের। মধ্যে মধ্যে ‘মারকে লেঙ্গে’ ‘লড়কে লেঙ্গে’ ধ্বনিও শুনতে পাই।
—গোলমাল হবে বলে কি আশঙ্কা করছেন?
—গোলমাল হবার তো কথা নয়। অধিকাংশই শান্তিপ্রিয় নিরীহ মুসলমান। কিন্তু ছেলেদের মেজাজ যেন গরম-গরম।
—ম্যাজিস্ট্রেটকে জানিয়ে রাখা উচিত।
—তাই ভাবছি। এর পর যেদিন সদরে যাব, জনসন সায়েবকে জানিয়ে আসব ভাবছি।
মহেন্দ্র আশ্বাস দিলে, ভয়ের কারণ কিছু নেই। এদিকে কোনো গোলমাল হবে না।
নরেন পেনিলোপীর দিকে চেয়ে বললে, আপনারা আজ বেড়াতে যাচ্ছেন তাহলে?
—ইচ্ছা আছে।
—যান। আপনি সঙ্গে থাকলে ভয়ের কিছু নেই। তুমিও যাচ্ছ নাকি মহিন? মহিন বললে, আজ্ঞে না।
—গেলে পারতে। একজন ব্যাটাছেলে থাকা ভালো
উনি থাকলে কিচ্ছু দরকার হবে না।—বলে মহেন্দ্ৰ পেনিলোপীর দিকে চাইলে। তারপর বললে, আমার একটু কাজও আছে।
—তা বেশ, তা বেশ।
বলে আর এক দফা নমস্কার করে নরেন চলে গেল। পেনিলোপী জিজ্ঞাসা করলে, এই যে তোমাদের দেশের সাম্প্রদায়িক বিরোধ-এর কি কোনো মানে হয় মহিন?
—না। কিন্তু পরাধীন দেশকে এ দুর্ভোগ পোহাতেই হবে। এর জন্যে হিন্দুও দায়ী নয়, মুসলমানও দায়ী নয়। তাদের পরাধীনতাই তাদের মাথায় আনছে যত রাজ্যের মুঢ়তা, দুর্বুদ্ধি এবং বিভ্রান্তি। ইংরেজ চলে না গেলে এর থেকে তারা মুক্তি পাবে বলে আমরা আশা করি না। ইংরেজের আওতার বাইরে নেতাজির অধীনে আমাদের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মিলতে কতক্ষণ লেগেছিল?
কথাটা পেনিলোপীর মনে লাগলো। বললে, ঠিক বলেছ মহিন। ইউরোপেও এর নজিরের অভাব নেই। স্বাধীন ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলো জার্মানীর দখলে আসবার সঙ্গে সঙ্গেই সেখানে গজিয়ে উঠলো বিশ রকম দল, ঘনিয়ে উঠলো কলহ। এমনিই হয়।
মহেন্দ্র বললে, এর জন্যে আমি খুব ভয় পাই না পেনিলোপী। এগুলো বুদ্বুদ, ঘোলালেই ওঠে। এই বিরোধ হল দুর্বলের অস্ত্র। কিছুক্ষণের জন্যে তালপাতার অস্ত্র ঘুরিয়ে তারা রঙ্গমঞ্চে আস্ফালন করে মাত্র। তাদের হারতেই হবে। জেতে তারাই যাদের কণ্ঠে বাজে কল্যাণ এবং শান্তির বাণী। তারাই ইতিহাস সৃষ্টি করে। ইউরোপের কথা তুলছিলে পেনিলোপী, সেইদিকেই চাও। হিটলারের আকস্মিক আবির্ভাব হল একটা অতিকায় দৈত্যের মতো। মুখে তার লেবেলশ্রাম আর ব্লিৎসক্রাইগ, ঘৃণা, বিদ্বেষ আর বিরোধের অগ্ন্যুদ্গার! কিন্তু শেষ কি হল? অথচ তার পাশের রাশিয়ার দিকে চাও। নিপীড়িত মানুষের জন্যে সে গড়ে তোলবার চেষ্টা করছে নতুন রাষ্ট্র। হিটলারের বজ্রাঘাত তাকে মারতে পারলে না, বরং আরও বলিষ্ঠই করে তুললে।
একটা সিগারেট ধরাবার জন্যে মহেন্দ্ৰ থামলে।
তারপর বললে, গৃহযুদ্ধের নামে সকলের মুখেই দেখি শঙ্কার ভাব। আমি কিন্তু এতটুকু ভয় পাই না। লোকক্ষয়, ধনক্ষয় হয়তো অনেক হবে। কিন্তু তার বিনিময়ে যে শক্তি এবং পাথেয় আমরা সঞ্চয় করব, পৃথিবীর ভবিষ্যৎ জয়যাত্রার পথে তার মূল্য অনেক। তার পরেই দেখো, সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে সত্যিকার মিলন প্রতিষ্ঠিত হবে। তারা বুঝবে, কি রাষ্ট্রক্ষেত্রে, কি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে একজনকে ছেড়ে আর একজন এক পাও চলতে পারে না। একই মহৎ এবং বৃহৎ স্বার্থে অনুপ্রাণিত হয়ে সেইদিন তারা পরস্পর’ পরস্পরকে যথার্থ ভালোবাসতে শিখবে।
.
বিকেলে পেনিলোপী বেরিয়ে গেল মোটর নিয়ে। মহেন্দ্র বাগানবাড়ীতেই বসে রইল।
একবার মনে করলে গোলকের বাড়ীর দিকে যায়। তারপর ভাবলে, থাকগে। খবরের কাগজগুলো উলটে-পালটে দেখতে লাগলো। কিন্তু তাও ভালো লাগলো না। খবরগুলোর মধ্যে যেন সজীবতা নেই, তার সঙ্গে আজ সে কিছুতেই হৃদয়ের সংযোগ করতে পারছে না। বারান্দায় পায়চারী করতে লাগলো। শেষে আলোয়ানটা জড়িয়ে গোলকের বাড়ীর দিকেই বেরুলো।
জীর্ণ একখানি কুঁড়ে। চালে সর্বত্র খড় নেই। যেখানে আছে সেখানেও এত পাতলা যে হাত দিলে ধুলোর মত ঝরে পড়বে। গেল বর্ষাটা রোখবার জন্যে নিরুপায় হয়েই বোধ হয় গোলক কতকগুলো তালের বাগড়া এখানে-ওখানে রেখেছিল। সেগুলো এখনো রয়েছে। কিন্তু বৃষ্টি কতখানি আটকেছিল, সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। কারণ ঘরের দেওয়ালগুলো ঠিক আস্ত নেই। দেওয়ালের গা বেয়ে ধারা নেমেছিল জলের। তার দাগ রয়েছে। দেওয়ালের উপরাংশ বৃষ্টিধারায় পাতলা হয়ে গেছে। কোথাও কোথাও ফুটোও হয়েছে।
এই কুঁড়ে! আর সামনে এক ফালি উঠান, তার বেড়ার বালাই নেই। একদিন এই কুঁড়েই তার কত পরিচিত ছিল! এই উঠানে, ওই ঘরে শিশুকালে কত উৎপাত করেছে! সেই বুড়ীমাও নেই, তার সমবয়সীর দলেরও অনেকে মারা গেছে। যারা বেঁচে আছে তাদের এখন চিনতেও কষ্ট হয়।
ঘরের দরজা নেই। একটা ঝাঁপ আছে, তা বন্ধ।
উঠানে দাঁড়িয়ে মহেন্দ্র চারিদিকে চাইলে। অধিকাংশ বাড়ীই পতিত। কতকগুলোর দেওয়াল যেন বাইরের পৃথিবীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেই এখনও উদ্ধত, উলঙ্গভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। দুর্বলতরেরা পৃথিবীর কোলে আত্মসমর্পণ করেছে।
পাড়া জনশূন্য। এই সময় আগে যেখানে উঠানে উঠানে লোক গিসগিস করতো, আজ সেখানে জীবনের স্পন্দনমাত্র নেই। খানিকটা দূরে একটা বাড়ীর উঠানে একটা নয়-দশ বছরের উলঙ্গ মেয়ে পিছন ফিরে কি যেন করছিল।
তাকেই সে চীৎকার করে জিজ্ঞাসা করলে, ওরে শুনছিস, গোলক কোথায় গেল জানিস?
মেয়েটি মনুষ্যকণ্ঠের জন্যে যেন প্রস্তুত ছিল না। চমকে পিছন ফিরে চেয়ে মহেন্দ্রকে দেখেই, বোধ হয় নিজের নগ্নতা ঢাকবার জন্যেই, দ্রুতবেগে পাশের আতাগাছটার আড়ালে গিয়ে লুকোলো।
মহেন্দ্র আবার জিজ্ঞাসা করলে, গোলক গেল কোথায় জানিস?
আতাগাছের আড়াল থেকেই মেয়েটি শীর্ণকণ্ঠে চীৎকার করে উত্তর দিলে, সে বাড়ীতে নাই!
—তা তো দেখতেই পাচ্ছি। গেল কোথায় জানিস?
—মদ খেতে গিয়েছে।
ভিতর থেকে কে যেন মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করলে, কে রে ক্ষ্যান্ত? কার সঙ্গে কথা কইছিস?
ক্ষান্ত ফিসফিস করে বললে, ছোটবাবু।
ভিতর থেকে বড় মেয়েটি বললে, এখুনি ফিরবে। আপনি যাও। এলেই তাকে আপনার কাছে পাঠিয়ে দোব।
—তাই দিও।
মহেন্দ্ৰ সেখান থেকে বেরিয়ে মাঠে এসে পড়লো। শীতকালে বিকালের এই রোদটা তার বড় ভালো লাগে। উজ্জ্বল সোনালী রোদ ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে। মহেন্দ্র ঘুরতে ঘুরতে নদীর ঘাটের পথটা ধরলে।
সেই করবী গাছটা।
তার থেকে একটু দূরেই বেণী বাঁড়ুয্যের খিড়কি। বাঁশ ঝাড়ের আড়ালে তাদের ঈষদুম্মুক্ত খিড়কির দরজা দেখা যাচ্ছে। মহেন্দ্র অকারণেই চেয়ে রইলো সেই দিকে।
হঠাৎ মনে হোল, ঘড়া কাঁখে কে যেন একটি মেয়ে সেই বাড়ী থেকে বেরুচ্ছে। বাঁশ ঝাড়ের আড়ালটা কাটতেই চিনতে পারলে : গায়ত্রী। নদীর ঘাটে জল নিতে আসছে বোধ হয়।
মহেন্দ্র সরে যাবে কি না ভাবছে, এমন সময় গায়ত্রীও তাকে দেখতে পেয়ে থমকে দাঁড়ালো। তারপরে হাত-ইসারায় ডাকলে।
মহেন্দ্র একটু দ্বিধা করলে।
কিন্তু গায়ত্রী আবার ডাকতেই ধীরে ধীরে সেই দিকে অগ্রসর হল।
গায়ত্রী ঘড়াটা নামিয়েছে। কিন্তু কাপড় ভিজে সপ সপ করছে।
মহেন্দ্র জিজ্ঞাসা করলে, তুমি যাওনি যে বেড়াতে?
গায়ত্রী বললে, না। মায়ের জ্বর। ঘরে জল নেই এক ফোঁটা। যাচ্ছিলাম আনতে। তারপর ছোট দুটি ভাই, তাদের জন্যে দুটো ভাতে-ভাত ফুটিয়েও দিতে হবে। তাই পারলাম না যেতে।
তা এই শীতে ভিজে কাপড়ে বেরিয়েছ যে? আর কাপড় নেই বুঝি? গায়ত্রী হেসে বললে, আছে আরও একখানা।
—তারও অবস্থা আশা করি এই রকমই জমকালো?
ছেঁড়া কাপড়ের উল্লেখে জড়সড় হয়ে গায়ত্রী কাপড়খানা টেনে-টুনে নিজেকে সম্বত করে নিলে।
হেসে বললে, প্রায় এই রকমই। শোনো, আর কতদিন থাকবে এখানে?
তীক্ষ্ণকণ্ঠে মহেন্দ্ৰ বললে, কেন বলো তো? আমার যাওয়া-না-যাওয়ার সঙ্গে তোমার কী সম্পর্ক?
—আছে একটু। আজ সকালে মেমটাকে নিয়ে নদীর ঘাটে যে কেলেঙ্কারী করেছ, তাতে গাঁয়ে ঢি ঢি পড়ে গেছে। তুমি না হয় লজ্জা-সরমের মাথা খেয়েছ। কিন্তু আমাদের তো লজ্জা আছে। তোমায় পায়ে পড়ি মহিনদা, আর এখানে থেকে আত্মীয়-স্বজনের চোখের সামনে ঢলাঢলি কোরো না। এইবারে কলকাতা চলে যাও।
শেষের দিকটায় গায়ত্রীর কণ্ঠস্বর তীক্ষ্ণ হয়ে উঠলো।
মহেন্দ্র হাসলে।
তার মুখে-চোখে একটা অস্বাভাবিক ক্রূরতা ফুটে উঠলো। বললে, ঢি ঢি তো এ গাঁয়ে কথায় কথায় পড়ে গায়ত্রী। তোমাকে নিয়েও আমার সম্বন্ধে কম ঢি ঢি পড়েনি। তবু তার মধ্যে কিছু সত্যি ছিল। তাতে তো আমাকে তাড়াবার জন্যে এত ব্যস্ত হওনি গায়ত্রী, আর এই মিথ্যে টি টি-তে এত কাতর হচ্ছ কেন?
—এ মিথ্যে? অতগুলো লোক সব ভুল দেখলে?
—তারা হয়তো ঠিকই দেখেছে গায়ত্রী। তবু এ যে সত্যি হতে পারে না সে তো তুমি জানো।
একবার অস্ফুটস্বরে ওর কথার প্রতিধ্বনি করে গায়ত্রী বললে, আমি জানি! একবার স্থির দৃষ্টিতে ওর মুখের দিকে চাইলে। তারপর বললে, বড় শীত করছে। আর দাঁড়িয়ে
থাকতে পারছি না। পথ ছাড়। এইবার যাই।
মহেন্দ্র পথ ছাড়লে না। নির্নিমেষে ওর দিকে চেয়ে রইলো। ধীরে ধীরে বললে, অনেক দিন পরে দু’জনে মুখোমুখি দাঁড়িয়েছি। মনে হচ্ছে, অনেক জন্ম পরে। আজকে আমাকে কি কিছুই তোমার বলবার নেই গায়ত্রী?
গায়ত্রী প্রথমে জবাব দিলে না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর বললে, না।
মহেন্দ্র আর কিছু বললে না। শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওদিকের মাঠ দিয়ে হন হন করে চলতে লাগলো। পিছন দিকে একবারও ফিরে চাইলে না।
.
কিছুদূর গিয়েই মহেন্দ্রের চোখে পড়লো, টলতে টলতে এবং বিড় বিড় করে কি যেন বকতে বকতে গোলক এই দিকেই আসছে। মহেন্দ্রের খেয়াল হোল, আর একটু আগে বাঁদিকের মোটা আলটাই বাগদীপাড়া যাওয়ার পৃথ। সে একটু এগিয়ে গিয়ে আলটার উপর দাঁড়ালো।
গোলক আপন মনেই আসছিল। হঠাৎ সামনে চেয়ে মহেন্দ্রকে দেখে থমকে দাঁড়ালো।
—ছোট বাবু?
গোলক ভক্তিভরে প্রণাম করতে গিয়ে সেইখানেই শুয়ে পড়লো, আর উঠতে পারলে না। নেশার মাত্রা একটু বেশি হয়েছে।
অবস্থা দেখে মহেন্দ্ৰ হেসে ফেললে।
বললে, নেশাটা একটু বেশি করে ফেলেছ গোলকদা। না ধরলে বোধ হয় উঠতে পারবে না।
গোলক অম্লানবদনে বললে, না বোধ হয়।
মহেন্দ্র তাকে উঠিয়ে বসালে।
গোলক হাতড়ে হাতড়ে ওর পায়ের ধুলো নিয়ে বললে, সেইদিনকার মতো আর একটিবার বোসো ছোটবাবু, দুটো প্রাণের কথা কই।
গদগদ কণ্ঠে বললে, সব মরে হেজে গেল ছোট বাবু, দুটো প্রাণের কথা বলি এমন লোক নাই। সেই হারামজাদী মাগীটা শেষ পর্যন্ত ছিল, তা সেও মরে গেল।
পরলোকগত স্ত্রীর সম্বন্ধে এই সপ্রেম উক্তি করে গোলক পৃথিবীর দুরবস্থায় হতাশভাবে হাতের তালু ওলটালে। কিন্তু মাঠের মধ্যে এই মাতালটার সঙ্গে বসে দুটো প্রাণের কথা কইবার প্রস্তাবে মহেন্দ্রের তালু শুকিয়ে উঠলো।
বললে, সে সব নিরিবিলি কাল হবে গোলোক দাদা। আজকে বাড়ী যাও। তোমার বাড়ী আমি গিয়েছিলাম যে!
—আমার বাড়ী তুমি গিয়েছিলে?—গোলক উঠছিল, আবার বসে পড়ল, ওরে আমার রাখালরাজা! ওরে আমার রাখালরাজা!
বলে আর কাঁদে আর হাতড়ে হাতড়ে মহেন্দ্রের পায়ের ধূলো নেয়। মহেন্দ্ৰ প্ৰমাদ গণলে।
গোলক বললে, আমার বাড়ী কেন ছোটবাবু?
—কাল আমি কলকাতা যাচ্ছি।
গোলক আপন মনে বিড় বিড় করে বললে, তাই যাও। এখানে আর সুখ নেই।
—এই দশটি টাকা, এখন নিলে তুমি হারিয়ে ফেলবে না তো?
—না, হারাব না, আপনি দাও।
বলে হাত বাড়ালে।
একখানি দশ টাকার নোট তার হাতে দিয়ে মহেন্দ্র বললে, তোমার যা ইচ্ছে হবে, তাই কিনে খেও।
জড়িত কণ্ঠে গোলক বললে, খাবো। ভালো মন্দ জিনিস এক এক সময় খেতে ভারি মন হয়। তাই খাবো।
বলে আর একবার হাত বাড়িয়ে মহেন্দ্রের পায়ের ধূলো নিয়ে নোটখানা হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরে উঠে দাঁড়ালো এবং টলতে টলতে নিজের বাড়ীর দিকে চলতে লাগলো।