ষোল
হিতৈষী যারা তারা সবাই গায়ত্রীকে বোঝালে। কিন্তু কিছুতেই তাকে বোঝানো গেল না।
বেণীমাধবের সম্পত্তি অতি সামান্য। তাতে কায়ক্লেশেও দু’টা মাসের বেশী চলে না। বড় দুটি ছেলে কিছু পাঠাতে পারে বলেই নুন-ভাতটা সম্বৎসর চলে যায়। কিন্তু বেণীমাধবের অবর্তমানে তার হবে কি? বিধবার অঢেল পরমায়ু। তার জীবনটা চলবে কি করে?
গায়ত্রী বলে, বাপের সম্পত্তিতেই আমার যদি অধিকার না থাকে শ্বশুরের সম্পত্তিতে আরও অধিকার নেই।
রেগে হিতৈষীরা বললে, মেয়েটা বোকা এবং জেদী।
গায়ত্রী তাতে রাগ করলে না। নিজের কাজে চলে গেল।
সে জানে, এরা কেউ তাকে বুঝবে না। যুক্তি-তর্কের কথাই এটা নয়। কিছু জানে মহেন্দ্র। শুধু তারই কাছে একদিন রাগের মাথায়, ঝোঁকের মাথায় সে বলে ফেলেছিল, স্বামী মারা না গেলে আত্মহত্যা করা ছাড়া তার উপায় ছিল না। তার মানে মহেন্দ্র ঠিক ঠিক বুঝেছে কি না কে জানে। হয়তো ওদের মতো মহেন্দ্রও তাকে ভাববে বোকা এবং জেদী। সেও হয়তো বুঝবে না, স্বামীর সম্পত্তি গ্রহণ করা কেন গায়ত্রীর পক্ষে অসম্ভব।
মেয়েমানুষের মনকে দার্শনিকেরা অরণ্যের সঙ্গে তুলনা করেছেন। অরণ্যই বটে। বাইরে থেকে জটিল এবং দুরধিগম্য। ভিতরে গেলে অরণ্যকে আর দেখা যায় না।
দ্বাদশীর দিন।
সকাল সকাল স্নান করে গায়ত্রী ভিজে কাপড়ে কাঁপতে কাঁপতে বাড়ী ঢুকলো। শীত পড়েছে ভীষণ। বারান্দায় দড়ির উপর জীর্ণ মটকার শাড়ীখানি কোঁচানো রয়েছে। তাড়াতাড়ি সেইটে পরে গায়ত্রী উঠানে এসে দাঁড়ালো।
কিন্তু দাঁড়াতে সে আর পারছে না। আগের দিন একাদশী গেছে। নিরম্বু উপবাস। গায়ত্রীর শরীর যেন টলছে।
ডাকলে, মাগো!
উঠানের এক কোণে তার ছোট ভাইটি নিবিষ্ট মনে মাটির গরুকে ঘাস খাওয়াচ্ছিল।
বললে, মা তো নেই দিদি। এখনি যেন কোথায় গেল।
—কোথায় গেল?
—কি জানি।
গায়ত্রী রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে দেখলে, মা নেই। মেঝেয় দ্বাদশীর পারণও সাজানো নেই। পারণ আর কি! প্রাণাপেক্ষা প্রিয়তর কন্যা হলেও দরিদ্রের সংসারে সমারোহের সাধ্য নেই। গাছে শসা থাকে দু’ কুচি শসা, কি দুটি মুগের ডাল ভিজে, একখানা বাতাসা, কি একখানা পাটালী, কি মুড়ি থাকলে দুটি মুড়ি। সকাল সকাল মেয়েকে স্নান করতে পাঠিয়ে তাই নিয়ে মা বসে থাকেন। মেয়েকে খাইয়ে রান্নাঘরে গিয়ে চোখের জল মোছেন।
মা দেখেছেন, মেয়ে স্নান করতে গেল। মটকার শাড়ীখানি কুঁচিয়ে রেখেও গেছেন। বড় ঘরে ঢুকে গায়ত্রী দেখলে, আহ্নিকের ঠাই করাও আছে। শুধু মা নেই!
গায়ত্রী আপন মনেই হেসে আহ্নিক করতে বসলো।
এমন আরও কতদিনই হয়েছে। মেয়েকে স্নানে পাঠিয়ে পারণের জন্যে কিছুই খুঁজে পাননি মা। পালিয়েছেন বাড়ী থেকে। আর কোথাও নয় ঘাটে। কারো বাড়ী চাইতে যাওয়ার অভ্যাস এ পরিবারে কারো নেই। মা চলে যান ঘাটে। মেয়ে রেঁধে-বেড়ে মাকে ডেকে নিয়ে আসে। চোখের জল মুছে মা ফিরে আসে। বেণীমাধব এবং ছেলেদের খাওয়া তখন হয়ে গেছে। মা-মেয়েতে বেলা তৃতীয় প্রহরে পাশাপাশি বসে দুটি খায়।
যেন কিছুই হয়নি এমনিভাবে গায়ত্রী কত গল্প করে। মা কখনও সাড়া দেন, কখনও দেন না। সেদিনের পর্ব এমনি করেই শেষ হয়। কিন্তু গায়ত্রীর মনে প্রশ্ন ওঠে অনেক রকম।
.
মহেন্দ্রর কাছে গায়ত্রী অসঙ্কোচেই হাত পেতেছে একদিন। তার মনেই হয়নি টাকাটা ভিক্ষা নেওয়া হল। অথবা উদারতায় মহেন্দ্র তাকে দান করলে। ওই মহেন্দ্রই তাকে মরা বাঁচিয়েছে একদিন। তাকে ফি দেওয়া হয়নি, ওষুধের দাম পর্যন্ত না। দিনরাত্রি জেগে শুশ্রূষা করেছে তাকে। অথচ একটা দিনের জন্যেও মনে হয়নি, এর জন্যে মনে-মনেও কৃতজ্ঞতা জানানো আবশ্যক। কৃতজ্ঞতাও একটা ব্যবসা। দেওয়া-নেওয়ার ব্যাপার। গায়ত্রীর মনে সে প্রশ্ন ওঠেওনি।
আবার এই গায়ত্রীই একদিন দম্ভভরে মহেন্দ্রকে শুনিয়েছে, তার কাছে কোনো প্রত্যাশাই সে রাখে না। অথচ মনের কোণে কোথাও কি কোনো প্রত্যশা সত্যই নেই? মহেন্দ্রের ভরসাতেই সে কি স্বামীর সম্পত্তি ত্যাগ করতে যাচ্ছে না?
গভীর রাত্রি।
ঘরের মধ্যে শুয়ে শুয়ে গায়ত্রী ভাবছে। জীর্ণ তক্তাপোশে বৃদ্ধ পিতা নিদ্রিত। নিচে মেঝেয় একটা শতচ্ছিন্ন বিছানার ওপাশে মা, এপাশে মেয়ে, মধ্যে দুটি ভাই, একখানি কাঁথায় ঘেঁষাঘেষি শুয়ে। ঘুমের ঘোরে ভাই কাঁথা টেনে নিচ্ছে বার বার। কুঁড়েমি করে নিজের অংশ সে টেনে নিতে পারছে না। অথচ ঘুমও আসছেনা শীতে।
শুয়ে শুয়ে গায়ত্রী শুধু ভাবে।
ভাববার বয়স তার নয়। হয়তো এলোমেলো ভাবে। কিন্তু দুঃখের চাপে এই বয়সেই সে ভাবতে শিখেছে।
নিজের মন তন্ন তন্ন করে সে খুঁজে দেখছে। নিশ্চয় করে সে বলতে পারে, ভগবান ছাড়া কারও ভরসা সে করে না। মহেন্দ্রের না, অন্য কোনো মানুষেরও না।
এই মহেন্দ্র ইচ্ছা করলে তাকে সবই দিতে পারত। কিন্তু পারেনি। তাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে নিজে পালিয়ে বাঁচবার চেষ্টা করেছে। তার উপরে ভরসা কোথায়? সত্য বটে মহেন্দ্র তাকে মরা বাঁচিয়েছে। কিন্তু কে বাঁচাতে সেধেছিল? মৃত্যুর চেয়ে শীতল কোল এই তরুণী কোথায় পাবে? মৃত্যুই কি তার ভালো ছিল না?
তারপরে এই কলঙ্ক?
মৃত্যুর বিনিময়ে যে কলঙ্ক মহেন্দ্র তার ললাটে মাখিয়ে গেছে, তা ধোবার মতো জল অতবড় নদীতেও বুঝি নেই।
চোখ জ্বালা করে ওঠে গায়ত্রীর।
পাশের ছোট ভাইটি ক্ষীণকণ্ঠে ডাকলে, দিদি!
রাত তখন দুটোর কম নয়।
এই সময়ে ও যে আজ ডাকবে গায়ত্রী জানতো। রাত্রে খাবার ছিল সামান্যই। ওদের পেট ভরেনি। গায়ত্রী জানতো, রাত্রে ওর ক্ষুধা পাবে, ঘুম ভেঙে যাবে, ডাকবে দিদিকে।
দিদি তাকে আদর করে বুকে টেনে নিলে।
বললে, ঘরে কিছুই ত নেই ভাই। একটু জল খাবি?
ভারি শান্ত ছেলে। এই বয়সেই সংসারের দুঃখ বুঝতে পেরেছে।
একটু চুপ করে থেকে বললে, খেজুরের গুড় নেই?
—না ভাই।
—ওদের বাড়ীর সত্যিনারাণের পেসাদ পাঠায় নি আজ?
—কই পাঠায়নি তো আজ?
—মুড়ির মোয়া?
—তাও নেই।
—কিছুই নেই দিদি?
—কিছুই নেই ভাই। আমি মিথ্যে কথা বলি কখনও?
—না।
—তবে?
ছেলেটি শান্তকণ্ঠে বললে, তবে একটু জল দাও।
মাথার শিয়রে ছোট একটা ঘটিতে জল ঢাকা ছিল। তাই খানিকটা ঢক ঢক করে খেয়ে ছেলেটা শুয়ে পড়ল। গায়ত্রীর চোখ আর একবার জ্বালা করে উঠলো।
.
সকালে উঠে গায়ত্রী চুপি চুপি গোলককে ডাকতে পাঠালো। গোলকই ওর বিপদের কাণ্ডারী।
গোলক আসতেই গায়ত্রী সহাস্যে অনুযোগ করলে, আর যে বড় আসো না গোলক দাদা?
গোলক বললে, মাঠে কাজ পড়েছে দিদি, তাই আর আসতে পারি না।
—আজ মাঠে যাও নি?
—আজ আর যেতে পারলাম না দিদিমণি। কাল রাত্রে একটু জ্বর হয়েছিল। কতক ধান কাটার খাটুনির জন্যে, কতক ম্যালেরিয়ার জন্যে তার শরীরটা খুবই কাহিল দেখাচ্ছিল।
সহানুভূতির সঙ্গে গায়ত্রী বললে, আহা, তাইতো! মুখখানি যে তোমার একেবারেই শুকিয়ে গেছে গোলকদাদা। আজ আর তুমি রেঁধো না। এইখানেই দুটি প্রসাদ খাবে। বেশ?
গোলক সানন্দে বললে, সেই ভালো দিদি। আজ আর সত্যিই রাঁধতে পারব না।
—কিন্তু তোমাকে যে একটি কাজ করতে হবে দাদা।
গোলক আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না। সেইখানে কুলতলায় উবু হয়ে মাথাটাকে দুহাতে ধরে বসলো। বললো, বলো।
ওর শরীরের অবস্থা দেখে গায়ত্রী একটু দ্বিধা করলে। বললে, তোমার শরীরের অবস্থা দেখে যে বলতে পারছি না।
গোলক বললে, কাঠ কাটার কাজ হয়তো এবেলা নয়, দুটো খেয়ে-দেয়ে ও-বেলায় করে দোব। আর হালকা কিছু হয়তো বলো।
পেট-কাপড় থেকে গায়ত্রী একটি ছোট্ট নাকচাবি বের করলে। এই তার শেষ সম্বল। বিয়েতে বাবা তাকে কিছুই দিতে পারেন নি। শুধু শাঁখা-সিন্দুর দিয়ে বিদায় করেছিলেন। বুড়ো বরের দাবীও তার ঊর্ধ্বে ওঠেনি। ভদ্রলোক নিতান্ত অবুঝ ছিলেন না। বিবাহের বয়স যে অনেকদিন পার হয়ে গেছে, সে বোধ তাঁর ছিল।
শুধু সন্তান লাভের লোভটা তাঁর প্রবল ছিল। পরপর দু’টি বিবাহ ইতিপূর্বে তিনি করেছিলেন।
কিন্তু সন্তানাদি কারো হয়নি। বংশটা এমন কিছু সূর্যবংশ-চন্দ্রবংশ নয়। সম্পত্তিও মস্ত কিছু নয়। জমি-জিরাৎ, পুকুর-বাগান নিয়ে সম্পন্ন সাধারণ গৃহস্থ। এই সম্পত্তিটুকুই বংশধরের হাতে দিয়ে যাবার ব্যাকুলতায় আবার তিনি তৃতীয়বারের জন্যে বিবাহ করেছিলেন।
সুতরাং শাঁখা-সিঁদুরেই গায়ত্রীকে তিনি নিয়েছিলেন। নিজেই দিয়েছিলেন চুড়ি, হার আর কানের দুল। সে সব অভাবের তাড়নায় কবে বিক্রি হয়ে গেছে। ছিল শুধু বিয়ের সময় মাসীর দেওয়া এই নাকচাবিটি।
কাকুতি করে বললে, এইটি বেচে দিতে হবে দাদা। সামান্য জিনিস। তবে সোনার এখন দাম খুব, টাকা পনেরো পেতে পারো।
গোলক হাত বাড়ালে না। শুধু নিঃশব্দে ওর দিকে চেয়ে রইল। বললে, চাল কি একেবারেই বাড়ন্ত?
গায়ত্রী সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়লে।
গোলক বললে, বেশ! তার উপর আমাকেও খেতে বললে!
গায়ত্রী হাসলে।
গোলক বললে, তোমাকে বললে তো শুনবে না দিদি। কিছু না করে শুধু পুকুর-বাগানের অংশটা বেচলেও হাজার দুই টাকা পাও।
গায়ত্রী হেসে বললে, সেও তো আর এক্ষুনি পাচ্ছি না গোলক দাদা। কিন্তু চাল এখুনি চাই।
গোলক বললে, তা না হয় এনে দিচ্ছি। কিন্তু পাঁচ জন হিতকামীর কথা শোনো। কিছু বেচে দাও।
গোলক উঠে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু তখনই ধপ্ করে বসে জোরের সঙ্গে বললে, কিংবা এক কাজ করলেও তো পার। সেইখানে গিয়েই থাকো গে। আমাকে সুদ্ধ নিয়ে চল। তোমার জমি-জিরেৎ দেখব, চাষ-বাস করব, ব্যস।
এমন চমৎকার একটা সমাধান হাতের কাছে পেয়ে গোলক উৎসাহে দুই হাতে চটাং করে একটা তালি দিলে।
গায়ত্রী বললে, আচ্ছা, সে পরামর্শ খাওয়া-দাওয়ার পরে হবে। এখন ওঠো দেখি।
গোলক উঠলো।
এবং যাবার জন্যে পা বাড়াতেই গায়ত্রী বললে, বাঃ! এটা নিয়ে যাও। বলে নাকচাবিটা দিতে গেল।
হাত নেড়ে গোলক বললে, ওসব রাখ। আমি বাগদীর ছেলে, সোনা বিক্রী করতে যাব কোথায়? চোর বলে পুলিশে ধরিয়ে দিক আর কি!
—তাহলে চাল পাবে কোথায়?
—সে ভাবনা তো তোমার নয় বাপু। সে আমি যেখান থেকে পারি নিয়ে আসছি।
এমনি করে বহুদিন গোলক এদের দুঃখের সংসার চালিয়ে দিয়েছে। সে কথা জানে শুধু গোলক আর গায়ত্রী।
.
কালকে খবরের কাগজে উপাধি বিতরণের তালিকায় মহেন্দ্র তার দাদার নাম দেখেছে। এবারে আর বঞ্চিত হয়নি। ‘রায় বাহাদুর’ উপাধি নরেন পেয়েছে।
আর এল নরেনের টেলিগ্রাম :
সামনের রবিবারেই নরেন ভূরিভোজনের ব্যবস্থা করেছে। জজ, ম্যাজিস্ট্রেট প্রভৃতি তো আসবেনই, ম্যাজিস্ট্রেটের মেমসাহেবও আসবেন বলে কথা দিয়েছেন। নরেন জানিয়েছে, রামলোচন অথবা বিভূতি কাউকে সে পাঠাচ্ছে। কলকাতা থেকে ভালো ভালো কেক-বিস্কিট, নূতন তরকারী এবং বিবিধ প্রকারের মিষ্টি নিয়ে সে যেন শনিবার সন্ধ্যার ট্রেনে নিশ্চয়ই আসে।
দাদার সেই সাহেব-তোষণের নেশা!
খেতাবের নেশা নরেনের অনেক দিনের। সেই খেতাব অবশেষে যখন হস্তগত হয়েছে, তখন একটা সমারোহ না করে সে যে ছাড়বে না, মহেন্দ্র তা সুনিশ্চিত করে বুঝলে। বিভূতি অথবা রামলোচন কেউ একজন আসছেই। এবং শনিবার সন্ধ্যার ট্রেনে তাকেও বাড়ী যেতে হবে।
অথচ বহু অনুসন্ধান, চেষ্টা এবং সেলামীর নামে ঘুষের পরিবর্তে আজকেই তার ক্লিনিকের জন্যে ঘর পাবার ভরসা পেয়েছে। এখন টাকা দেওয়া এবং লেখাপড়া করা আছে, ক্লিনিকের যন্ত্রপাতি এবং আসবাবপত্র কেনা আছে। আরও অনেক কাজ আছে। এই সময় চলে যাওয়া মানেই কাজের ক্ষতি।
মহেন্দ্ৰ বিব্রতভাবে বসন্তকে বললে, ওহে, আমি তো এক ভীষণ ঝামেলায় পড়লাম।
–ঝামেলা আবার কি?
—দাদা ‘রায় বাহাদুর’ হয়েছেন।
—সে আর ঝামেলা কি! একদিন চল গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলে গিয়ে আনন্দ করে আসা যাক।
মহেন্দ্ৰ মাথা চুলকে বললে, আনন্দের অভাব হবে না হে। দাদা আমার আনন্দময়। কিন্তু মুশকিল এই যে আনন্দটা করতে হবে দেশে গিয়ে।
পেনিলোপী ওদিকের জানালার পাশে বসে বসন্তর একটা ছেঁড়া মোজা সেলাই করছিল। ওদের কাছে উঠে এসে বললে, সে তো আরও ভালো। কিন্তু আমাদের নিমন্ত্রণ আছে তো?
মহেন্দ্র উল্লাসে লাফিয়ে উঠলো। বললে, The Idea! যাবে তোমরা? বলে উৎসুক দৃষ্টিতে পেনিলোপীর দিকে চাইলে।
পেনিলোপী বললে, ওঁর কথা জানিনে। কিন্তু নিমন্ত্রণ থাকলে আমি নিশ্চয় যাব। গ্রাম দেখার ইচ্ছা আমার ভয়ানক।
বসন্ত বললে, ক্লিনিক?
মহেন্দ্ৰ বললে, সেই তো সমস্যা। সামনের শনিবার যেতে হবে। রবিবারে সমারোহ। কিন্তু সোমবারেই যে দাদার হাত থেকে নিষ্কৃতি পাব এমন ভরসা দিতে পারি না।
বসন্ত মহেন্দ্রকে জিজ্ঞাসা করলে, তুমি কি করবে?
—আমাকে যেতেই হবে। নইলে ভয়ানক দুঃখ পাবেন তিনি।
বসন্ত চিন্তিতভাবে বললে, তাই তো, হে! কিন্তু দুজনে এই সময় গেলে চলবে কি করে?
পেনিলোপী ওদের দুজনের মাঝখানে বসে বললে, দাঁড়াও। আমি তোমাদের সমস্যার মীমাংসা করে দিচ্ছি।
স্বামীর দিকে ফিরে পেনিলোপী জিজ্ঞাসা করলে, দুজনের যাওয়া কিছুতেই কি সম্ভব নয়?
—উঁহু।
—আর তোমাকে যেতেই হবে মহিন?
—নিশ্চয়।
—কবে ফিরবে তার ঠিক নেই?
—না, তা নয়। তিনি নিজেও কাজের লোক। হয় তো দু’এক দিন দেরী হবে। যাবে তুমি?
—তোমাদের অসুবিধা কিছু হবে না তো?
—আমাদের মানে দেশের বাড়ীর কথা বলছ তো? না, কিছুমাত্র অসুবিধা হবে না। স্বামীর দিকে চেয়ে পেনিলোপী জিজ্ঞাসা করলে, তুমি কি বলো? যাব মহিনের সঙ্গে? বসন্ত খুশি হয়েই বললে, ঘুরে এসো না ওর সঙ্গে। বাংলাদেশের পাড়াগাঁ দেখা হবে।
—আর তোমার সেই তরুণীটিকে দেখাবে না মহিন? আমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবে তো?—পেনিলোপী জিজ্ঞাসা করলে।
মহেন্দ্ৰ বললে, দেখাব নিশ্চয়ই। কিন্তু আলাপ করিয়ে দেবার সুযোগ পাব কি না জানি না।
—কেন? খুব পর্দানশীন?
—গ্রামের মেয়ে পর্দানশীন বলা ঠিক হবে না। তবু কিছু অসুবিধা আছে। কিন্তু আমাদের পল্লীসমাজের কথা তুমি সেখানে না গেলে বুঝতে পারবে না।
পেনিলোপী বললে, বেশ, আমি যাব। দেখেই আসি বাংলাদেশের গ্রাম আর গ্রামের মেয়ে। অবশ্য তোমার অনুমতি নিয়ে বসন্ত।
বসন্ত ওকে উৎসাহ দিয়ে বললে, যাও। দেখে এস। বাংলাদেশের সত্যিকার পরিচয় রয়েছে গ্রামে। হয়তো সব দেশেরই তাই। তবে বাংলার যেন বিশেষ করে। এখন তো বাংলা কথা বলতে মোটামুটি শিখেছ। কিছু অসুবিধা হবে না তোমার
পেনিলোপী খুশি হয়ে বললে, তাহলে এই কথাই রইল। শেষটা আমাকে ফেলেই যেন পালিয়ে যেও না মহিন।
.
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রামলোচন এল।
মহেন্দ্র বললে, এই যে এসে গেছ! কিন্তু এলে কি করে রামলোচনদা?
বিস্মিতভাবে রামলোচন বললে, কেন ট্রেনে?
মহেন্দ্ৰ হেসে বললে, সে আমি জানি। আমি সে কথা জিজ্ঞাসা করি নি।
— তবে?
—আজ বিষ্যুদবার না? দাদা তো বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ওলট-পালট হয়ে গেলেও বিষ্যুদবারে নিজেও বেরোন না, অন্য কাউকেও পাঠান না। আমি তো জানি।
এতক্ষণে ব্যাপারটা বুঝতে পেরে রামলোচন হেসে ফেললে। বললে, সে কথা আর বলবেন না ছোটবাবু, বুধবার বিকেল থেকে আমি বাড়ী ছাড়া। রাত কাটিয়েছি বাগান বাড়ীতে।
—তাই বলো। এখন ফর্দ কি রকম এনেছ রামলোচনদা? কলেবরটা একবার দেখি।
—সেটা আমি ঠিক দেখিনি ছোটবাবু। বড়বাবু খামে করে দিলেন হাত পেতে নিলাম। বেশ পুরুষ্টু বলেই মনে হল। ফর্দ নিতান্ত কম বোধ হয় হবে না।
—তাহলে কাল সকাল থেকেই বেরুতে হবে বল।
—আজ্ঞে, তা হবে বই কি! বলতে গেলে কালকের দিনটাই যা সময়।
—আচ্ছা, তাহলে তুমি হাত মুখ ধুয়ে নাও। এখানে খাওয়ার অসুবিধা আছে। তোমার জন্যে বাজার থেকে কিছু খাবার আনিয়ে দিই। খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়। কি বল? রাজসূয় যজ্ঞের ফর্দ কাল সকালে বরং দেখা যাবে।
রামলোচন ভীতকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলে, ছোটবাবু, খাবার মানে লুচি-মিষ্টি তো?
—নিশ্চয়।
হাত জোড় করে রামলোচন বললে, আজ্ঞে ওইটি পারব না। রাত্রে পেটে দুটি ভাত না পড়লে আমার ঘুমই হবে না। কথায় বলে, ভেতো বাঙালী! হাঃ! হাঃ! হাঃ!
মহেন্দ্ৰ চিন্তিতভাবে বললে, তবেই তো মুশকিল করলে রামলোচনদা। আমি নিজে খাই উপরে আমার এক বন্ধুর কাছে। সে তোমার চলবে না। তাহলে কি হোটেলে খাবে?
—বামুনের হোটেল তো?
—আশা করা যায়। তবু পৈতেটা একবার দেখে নিও।
—যে আজ্ঞে। আপনার চাকর আছে তো?
—আছে।
—হিন্দু?
—হ্যাঁ।
—সে কোথায় খায়?
—হোটেলেই খায়, কোনো কোনো দিন নিজেও রাঁধে।
—তাহলে আমি হাত মুখ ধুয়ে তাকেই নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। এক সঙ্গে খেয়ে দেয়ে ফিরব।
—তাই করো।
.
খবরটা জানাতে মহেন্দ্র উপরে গিয়েছিল। খাওয়া-দাওয়া সেরে ঘণ্টাখানেক পরে নিচে নেমে এসে দেখে, তার শোবার ঘরে দুই হাঁটুতে মুখ ঢেকে রামলোচন বসে। অদূরে দেওয়াল ঘেঁষে মহেন্দ্রর চাকরটাও দাঁড়িয়ে।
মহেন্দ্র জিজ্ঞাসা করলে, পেট ভরেছে রামলোচনদা?
—আজ্ঞে না।
—সে আবার কি?
—আজ্ঞে হ্যাঁ। খেতে বসতে যাব দেখি আমাদের গাঁয়ের নিবারণ পরিবেশন করছে।
—নিবারণ কে?
—আজ্ঞে জটাই বায়েনের ছেলে। দুর্ভিক্ষের সময় কলকাতা এসেছিল আর ফেরেনি। ভেবেছিলাম মরেই গেছে বোধ হয়। দেখি বেঁচেই আছে। চেহারা বেশ একটু চিকন হয়েছে, রংটাও ফর্সা হয়েছে। গলায় ইয়া পৈতের গোছা।
মহেন্দ্ৰ সবিস্ময়ে বললে, বলো কি হে!
—আজ্ঞে হ্যাঁ। নিজের চোখে দেখে এলাম। আমাকেও দেখলে সে। দেখেই যে কোথায় স’রে পড়লো আর পাত্তা পেলাম না। ভাগাড়ের দরুণ এখনও খাজনা পাওনা আছে তিন টাকা ছ’আনা আট পাই।
—তারপরে?
—তারপরে আর কি বাবু! আমার তো খাওয়া হলই না, ও ছোকরারও না। বলছে, আজ আর কিছু খাবে না। কাল সকালে গঙ্গা নেয়ে প্রাচিত্তির করবে। রাঁধে কেমন হে?
ছেলেটা সলজ্জভাবে বললে, তা ভালোই। রাঁধে আজ্ঞে বিশুদ্ধ বেরাম্ভণের মতোই।
কৃত্রিম উৎসাহে রামলোচন বললে, বাঃ! বাঃ! তাহলে খেলে হত, কি বল?
ছোকরা হাসলে। মহেন্দ্রও না হেসে পারলে না। বললে, তা তো হল রামলোচন দা! কিন্তু তাহলে খাবে কি? কিছু চিড়ে, দই, কলা আর রসগোল্লা নিয়ে আসুক। তাইতেই তোমরা দুজনে আজকের রাতটা কোনো রকমে কাটাও। কি বল?
—আজ্ঞে সেই ভালো। ক্ষিদেও পেয়েছে প্রচুর। রান্নার আয়োজন না করাই ভালো। কাল দিনের বেলায় সে ব্যবস্থা করা যাবে। কি বল হে ছোকরা? কি নামটি তোমার বললে ভালো?
—আজ্ঞে বনমালী।
—বেশ, বেশ। তাই কর বনমালী, বাজার থেকে চটপট যা-হোক কিছু নিয়ে এস। তারপর কাল দুপুরে তোমাকে এমন মুগের ডালের মুড়িঘণ্ট খাইয়ে দেবো যে, জীবনে ভুলতে পারবে না। যাও।
কিন্তু বনমালী চলে যেতেই রামলোচন ব্যস্ত ভাবে উঠে বসলো :
—ছোটবাবু!
—বলো।
—এ ব্যাটাও আবার নিবারণের মতো নয় তো?
সে বিষয়ে মহেন্দ্রও সুনিশ্চিত নয়। কিন্তু বললে, না, না, ও বড় ভালো জাত। ওর আত্মীয় স্বজন সব আসে তাদেরও দেখেছি যে। বেশ দেখতে!
—আমাদের কলকাতা শহরে আসা একটা ঝকমারী ছোটবাবু। খাই-দাই তবু মনটা খুঁৎ খুঁত্ করে। বিভূতিকে বললাম, তুমিই যাও বাপু, বুড়ো মানুষকে কেন আর কষ্ট দাও। আসতও সে। কাল রাত থেকে এমন জ্বরে পড়লো যে আর কিছুতেই পারলে না।
—বিভূতির জ্বর বুঝি?
রামলোচন এ প্রশ্নের আর জবাব দিলে না। মনটা তার খিঁচিয়ে গিয়েছিল। ক্ষুধা সে একেবারেই সহ্য করতে পারে না। বিরক্তভাবে আপাদমস্তক মুড়ি দিয়ে সেইখানে কম্বলের উপরই শুয়ে পড়লো।
মহেন্দ্র আর কিছু না বলে পড়বার ঘরে গিয়ে একখানা বই খুলে পড়তে আরম্ভ করলে।
.
আহারাদি করে পরিতৃপ্তির সঙ্গে রামলোচন মহেন্দ্রর শোবার ঘরেই মেঝের উপর বিছানা পাততে বসলো।
মহেন্দ্র বললে, ওঘরে কিন্তু শোবার জায়গা ছিল রামলোচনদা।
—তা হোক। এই বেশ শোব।
মহেন্দ্রর হঠাৎ মনে পড়ে গেল কথাটা।
হেসে বললে, তোমার আবার ভূতের ভয় আছে, না রামলোচনদা? এ বয়সেও যায়নি সেটা?
রামলোচন লজ্জিতভাবে হেসে বললে, আজ্ঞে ঠিক ভয় নয়; তবে একলা থাকলে গা’টা কেমন ছমছম করে!
—আশ্চর্য রামলোচনদা! দিনে দাঙ্গা-ফৈজতে তোমার অসীম সাহস। অথচ রাত্রে-
—আজ্ঞে হ্যাঁ। দিনে বাঘের সামনে ফেলে দিন, ভয় পাব না। কিন্তু রাত্রে-
রামলোচন আর একবার লজ্জিতভাবে হাসলে।
কিছুক্ষণ নিঃশব্দে শুয়ে থেকে রামলোচন ডাকলে, ছোটবাবু?
—কি বলছ?
—কিছু কুনিয়ান জোগাড় করে দিতে পারেন? গাঁ তো উজাড় হয়ে গেল।
—তবেই তো মুশকিল করলে রামলোচনদা। কুইনিন তো পাওয়া যাচ্ছে না। গাঁয়ে কি খুব ম্যালেরিয়া আরম্ভ হয়েছে?
—অসম্ভব রকমের। লোক মরে শেষ হয়ে গেল।
মহেন্দ্র চিন্তিতভাবে বললে, তাইতো। অনেক লোক মারা গেল বুঝি?
—অনেক। আমাদের বাঁড়ুয্যে মশাইও দেহ রেখেছেন।
—বেণীকাকা?—মহেন্দ্র বিছানার উপর উঠে বসলো,—কবে মারা গেলেন? কী হয়েছিল?
—কি যে হয়েছিল বাবু, কেউ জানে না। ভুগছিলেন ক’দিন থেকে। হঠাৎ একদিন সকালে শুনলাম, মারা গেছেন। গরীব মানুষ, ডাক্তার তো আর ডাকতে পারেন নি। তা দিন কুড়ি হল মারা গেছেন।
দিন কুড়ি! অথচ একটা কথাও কেউ তাকে জানাবার আবশ্যক মনে করেনি। কেনই বা করবে?
রামলোচন বলতে লাগল :
—বড় কষ্ট ওদের! বড় ছেলে দুটো পষ্ট বলে দিয়েছে, গায়ত্রীকে খেতে দিতে পারবে না। আর মেয়েটাও কি বোকা দেখুন, শ্বশুর বাড়ীর যে সম্পত্তি তার আছে তাতে একটা বড় সংসার ফেলে ছড়িয়ে চলতে পারে। কিন্তু সেখান থেকে একটি দানাও সে পায় না। বড়বাবু বললেন, আমি বললাম, বাঁড়ুয্যে মশাই নিজে কত বললেন, শ্বশুরবাড়ীর জমি বিক্রি করে দিয়ে আমাদের গ্রামে জমি কিনতে। তাতে মেয়েটার তো বটেই, বাঁড়ুয্যে মশায়েরও গোটা সংসারটাও চলে যেত।
মহেন্দ্ৰ সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করলে, তা কি হল?
বিরক্তভাবে রামলোচন বললে, হবে আমার মাথা আর মুণ্ডু। মেয়েটা না শ্বশুর বাড়ীতে গিয়ে থাকবে, না জমি বিক্রি করবে। খদ্দের পর্যন্ত জোগাড় করে দিলাম। আমার শালা—
বাধা দিয়ে মহেন্দ্ৰ জিজ্ঞাসা করলে, বিক্রি করবে না কেন?
—কেন তা সেই জানে। বলে, ও জমিতে সত্যি সত্যি আমার কোনো অধিকার নেই। ও আমি মরে গেলেও ছোঁব না।
মহেন্দ্র নীরবে ভাবতে লাগলো।
রামলোচন বললে, করলে বটে গোলক! বাগদীর ছেলে, কিন্তু ও যা করলে তা স্বজাতিতেও করতে পারে না। বড় ছেলেটা যখন মেয়েটাকে বললে, তুমি ভাই পথ দেখ, তোমার ভার নিতে আমি পারব না। ও এগিয়ে এল। বললে, কিচ্ছু তুমি ভেবো না দিদিমণি, আমি তোমার ভার নিলাম। বাগদীরা বিধবা বুনকে ফেলে না। আমি তোমাকে মাথায় করে রাখব। বললে, মালোয়ারীতে কাবু করেছে দিদি, বয়সও হয়েছে, নইলে লাঠির জোরে তোমাকে রাজার রাণী করে রাখতাম। তা সে আর হবে না দিদি। দুঃখ- ধান্ধা করে দুই ভাই-বোনে কোন রকমে থাকব। তুমি রাঁধবে, আর আমাকে প্রসাদ দেবে। বলে, আর সে কী কান্না দাদাবাবু! বাগদীর জোয়ান, উঠানময় যেন আছাড়ি-পিছাড়ি করে। বড় ছেলেটাকে বললে, তোমাদের আমরা কিচ্ছু চাইনে বড় দাদা, শুধু দিদিকে আমার মাথায় গোঁজবার একটু ঠাঁই দিও।
মহেন্দ্রর বুকের ভিতর থেকে একটা বাষ্প যেন কণ্ঠ পর্যন্ত ঠেলে ঠেলে উঠতে লাগলো।
সামলে নিয়ে অনেকক্ষণ পরে মহেন্দ্র জিজ্ঞাসা করলে, তাহলে গোলকই ওকে দেখাশুনা করছে?
রামলোচন বললে, না ছোটবাবু, তাও না। মেয়েটা দেখতে ওই রকম, কিন্তু ভেতরে ভেতরে ভয়ানক শক্ত। সে আপনাদের বাড়ীতেই চাকরী নিয়েছে।
মহেন্দ্ৰ চমকে উঠলো :
—আমাদের বাড়ীতে? কি চাকরী?
—কি চাকরী আর করবে বাবু! হিন্দুস্থানী বামুনটা মাস কয়েকের জন্যে দেশে চলে গেল। ওই এখন রাঁধছে। তা সুবিধাই হয়েছে ছোটবাবু। মায়ের রান্নাটা বৌদিকেই রাঁধতে হত। তিনি তো আর ওই হিন্দুস্থানীটার হাতে খেতে পারতেন না। এখন মেয়েটা সব রান্নাই রাঁধে। তা রান্না শিখেছিল বটে বাবু! বড়ি দিয়ে বেগুন দিয়ে টকটি রাঁধে, যেন অমৃত!
দুজনে কেউ আর কোনো কথা বললে না।
রাত তখন অনেক। মহেন্দ্র ডাকলে, রামলোচনদা ঘুমুলে নাকি?
ভয় ঠিক নয়, কিন্তু রাত্রি বেলায় রামলোচনের গা’টা কেমন ছমছম করে। মহেন্দ্রর আহ্বানে ধড়মড় করে সে উঠে বসলো। সভয়ে জিজ্ঞাসা করলে, কি ব্যাপার!
মহেন্দ্র জিজ্ঞাসা করলে, থাকে কোথায়?
—কে?
—বাঁডুয্যোদের মেয়েটা?
নিশ্চিন্তমনে র্যাগ মুড়ী দিয়ে পুনরায় শোবার আয়োজন করতে করতে রামলোচন বললে, থাকবে আর কোথায় বাবু, আমাদের বাড়ীতেই থাকে। ভাইটা তো জায়গা দিলে না। আর তাদের জায়গাই বা কই? একটি তো মোটে ঘর, আর চালায় রান্না করে। সেও এইবার বিয়ে-থা করবে, তারও এইবার ঘরের দরকার হবে। তাকেও তো দোষ দেওয়া যায় না।
তা ঠিক। সে নিয়ে মহেন্দ্র আর তর্ক করলে না। রামলোচন নাক ডাকিয়ে ঘুমোতে আরম্ভ করলে। কিন্তু তার চোখে আর ঘুম এলো না।