পনেরো
আমন ধান কাটা আরম্ভ হয়ে গেছে।
নিহত সৈন্যের মতো কাটা ধান মাঠময় শুয়ে আছে। সোনায় ডুবে গেছে সমস্ত মাঠ। ধান বেশ ভালোই হয়েছে। তবু গৃহস্থ গালে হাত দিয়ে বসে আছে। ধান কাটবার লোক নেই। যারা রয়েছে তারা ম্যালেরিয়ায় ধুঁকছে। একদিন পেটের জ্বালায় কোনোমতে মাঠে যাচ্ছে তো তিন দিন আর উঠতে পারছে না।
নবান্নর পরেই গ্রামের কোলের জমিগুলির ধারে ধারে ধান কাটা হয়ে গেছে। তারই উপর দিয়ে গরুর গাড়ীর রাস্তা পড়েছে। কিন্তু ধান আনার অভাবে এখনও তাতে প্রচুর ধুলো জমতে পারে নি।
কি করে যে মাঠের লক্ষ্মী ঘরে আনা হবে সেই চিন্তায় সবাই পীড়িত। কেবল সান্ত্বনা এই যে, ধান চুরি যাবার ভয়ও নেই। যারা চুরি করতে পারে তারা সবাই শয্যাগত। কেউ কেউ ভালো থাকলেও শীতের শিশির ভোগ করে আনতে গিয়ে প্রাণ খোয়াবার আগ্রহ তাদের নেই।
চিন্তা বেশী নরেনের।
অন্য লোকের কম জমি। কোনোরকমে টেনেটুনেও ধান হয়তো ঘরে তুলবে। কিন্তু নরেনের তো তা নয়। তার প্রচুর জমি। সে জমির ধান এই সব রোগী মজুরদের দিয়ে রয়ে-বসে ঘরে আনতে হলে বাংলা বৎসর শেষ হয়ে যাবে।
রামলোচন তাকে পরামর্শ দিলে বাইরে থেকে কিছু সাঁওতাল নিয়ে আসতে। তাতে মজুর সমস্যাও মিটবে।
সেই পরামর্শই হচ্ছিল।
এমন সময় ছোট একটি ছেলের কাঁধে হাত দিয়ে অন্ধ বেণীমাধব এসে সদরের প্রকাণ্ড বড় উঠানে দাঁড়ালেন। অন্ধ-চক্ষু চারিদিকে ঘুরিয়ে ডাকলেন, নরেন বাবাজি আছ নাকি?
—আসুন, আসুন। ওরে কাকাবাবুকে একটা জলচৌকি দে।
উঠানের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বেণীমাধব বললেন, এইখানেই দাও বাবা। খাসা রোদ আছে এখানে। বুড়ো মানুষ ছায়ায় বসলে শীতে যেন জমে যাই।
নরেন কাছে এসে দাঁড়ালো।
তার পায়ের শব্দে আন্দাজে তার মুখের দিকে চেয়ে বেণীমাধব বললেন, তোমার কাছে একটা পরামর্শ নিতে এলাম বাবাজি।
প্রতি বৎসর এই সময়ে বেণীমাধব একবার করে নরেনের কাছে পরামর্শ নিতে আসেন।
নরেন হেসে বললে, গায়ত্রীর শ্বশুরবাড়ীর জমির সেই ধান তো? ও সমস্যা তো প্রতি বৎসরই একবার করে ওঠে। বলি চুকিয়ে ফেলুন, তাও ফেলবেন না।
—কি করে ফেলি বল? নিঃসন্তান বিধবা, ওর তো দানবিক্রির অধিকার নেই।
নরেন ঝাঁঝের সঙ্গে বললে, অধিকার তো জোরের। জোর থাকলেই অধিকার থাকে।
—ওর জোরই বা কোথায় বাবা?
—ওর নিজের না থাকে, যার জোর আছে তাকে বেচে দিক। দু’টাকা দাম হয়তো কম পাবে, কিন্তু বছর বছর এই ঝঞ্ঝাটের হাত থেকে তো বাঁচবে।
—মেয়েটা বড় ভালো, বুঝলে না বাবা। দেওর-ভাসুরে জমির ধান যে বছর বছর লুটে নিচ্ছে কখনও তা নিয়ে একটা অভিযোগও করে না। আমি বললে হেসে বলে, নিক গে বাবা, ওঁদেরই তো জমি। শুনলে কথা!
নরেন চুপ করে রইলো।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেণীমাধব বললেন, ওই যে বললাম বাবা, লক্ষ্মীর প্রতিমা। এ জন্মে কোনো পাপ তো করে নি। হয়তো আর জন্মে করে থাকবে, সেই পাপে এত কষ্ট পাচ্ছে।
বেণীমাধব আর একবার দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
বললেন, চোখে যে দেখি না, সে বোধ করি ভালো হয়েছে বাবাজি। ওর মুখ দেখলে আমি তো একটা দিনও এ সংসারে থাকতে পারতাম না। এখনো থাকতে ইচ্ছা করে না বাবা। বড় দুটো খুঁটে খেতে শিখেছে, তাদের জন্যে চিন্তা নেই। কিন্তু এই দুটো যে নিতান্তই শিশু, এদের কার কাছে রেখে দিয়ে যাই? নইলে তোমার কাকীমা আর গায়ত্রীকে নিয়ে কবে চলে যেতাম কাশী। সংসারে আর থাকতাম না। কিন্তু বিশ্বনাথ সে পথও যে বন্ধ করে রেখেছেন।
কাপড়ের খুঁটে চক্ষু মার্জনা করে বেণীমাধব বলতে লাগলেন, এই তো গেল একদিক। আবার দেখ, বয়স হয়েছে, চোখে দেখি না, দেহ জীর্ণ। ভগবানের নাম করে এখন শান্তিতে দু’চোখ বন্ধ করতে পারলেই নিশ্চিন্ত হবার কথা। কিন্তু তারও তো জো নেই। হতভাগীর কথা ভাবলে মরার চিন্তাও তো করা করা যায় না।
বৃদ্ধ চুপ করলেন।
মামলার গন্ধে রামলোচন অনেকক্ষণ থেকেই উসখুস করছিল। এইবার সুযোগ পেয়ে বললে, গায়ত্রীর শ্বশুরবাড়ীর জমি আপনি বেচে দিন বাঁড়ুয্যে মশাই। বলেন তো আমি ভালো দামেই বিক্রির ব্যবস্থা করে দিতে পারি।
—পারো?-বেণীমাধব নরেনকে লক্ষ্য করে জিজ্ঞাসা করলেন—তুমি কি বল বাবাজি?
নরেন বললে, আমিও তাই বলি। কিন্তু একটা কথা ভাববার আছে।
—কি বল?
নরেন একটু চিন্তা করে বললে, জানেনই তো কথায় বলে বিধবা মেয়ের সর্বনাশ বাপ-ভাইতে করে। কথাটা অপ্রিয়। কিন্তু সংসারী লোক সব দিক ভেবে চিন্তে কাজ করে।
—তাহলে তুমি কি জমি বেচতে বলছ না?
—জমি বেচতে বলছি, কিন্তু টাকাটা হাতে রাখতে পাবেন না। অভাবের সংসার, হয়তো খরচ হয়ে যাবে। তখন মেয়েটা একেবারে পথে বসবে।
বেণীমাধব উৎসাহিত হয়ে উঠলেন।
—নরেন তো ভালো কথাই বলছেন রামলোচন। এতো সত্যিই একটা ভাববার কথা। তাহলে এক কাজ তো করা যায় নরেন, তোমার ব্যাঙ্কেও তো টাকাটা রাখা যায়। মাসে মাসে সুদ যা আসবে,
নরেন হেসে ফেললে।
বললে, টাকা তো খুব বেশী পাওয়া যাবে না কাকাবাবু। সুদ তার সামান্যই আসবে। তাতে কিছুই হবে না। ওই টাকা দিয়ে ওই পরিমাণ জমি আমি এইখানেই কিনে দোব।
উৎসাহে বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে উঠলেন।
বললেন, এই হল জমিদারী মাথা! রামলোচন, শুনলে তো বুদ্ধিটা? এ সব আমার মাথায় আসবে কোত্থেকে? বেঁচে থাকো বাবা, দীর্ঘজীবি হও। মা-লক্ষ্মী তোমার সংসারে অচলা হোন। তোমার উপরই ভার দিলাম বাবা। যাতে অভাগীর ভালো হয় তাই করো।
পুনঃ পুনঃ নানা ভাষায় আশীর্বাদ করতে করতে বেণীমাধব চলে গেলেন।
রামলোচন বললে, বড় ভালো লোক, বড়বাবু। এ ধরনের লোক ক্রমেই কমে যাচ্ছে। আর বড় দেখতে পাওয়া যায় না।
.
সেইদিন দুপুরেই গায়ত্রী এল বাবুদের অন্দরে।
মহেন্দ্র চলে যাবার পরে গ্রামময় এমন একটা বিশ্রী কলঙ্ক ওদের দু’জনকে জড়িয়ে উঠেছিল যে, গায়ত্রী বাইরে বেরুনো এক প্রকার ছেড়েই দিয়েছিল। একে তো কলহ করা তার স্বভাব নয়, তার উপর এটুকু সে বুঝেছিল যে, এসব ব্যাপারে কলহ করায় লাভের চেয়ে লোকসানই হয় বেশী। তাই সকলকে এড়িয়ে সে নিজের গৃহকোণে কাজ নিয়েই মগ্ন থাকতো।
কিন্তু আজ আর পারলে না।
সুবর্ণর কাছে এসে দাঁড়াতেই সুবর্ণ ওকে জড়িয়ে ধরে বললে, আসিস নি যে এতদিন? শরীর কি ভালো ছিল না?
গায়ত্রীকে অত্যন্ত ক্লান্তই দেখাচ্ছিল।
বললে, শরীর ভালোই ছিল বৌদি। কাজের ভিড়ে আসতে পারিনি। আজ একটা বিশেষ দরকারে পড়েই এলাম।
দরকারের নামে সুবর্ণর মুখটা গম্ভীর হল। অভাবগ্রস্ত লোক দরকারের কথা বললে সবাই ভয় পায়। গায়ত্রীর উপর সুবর্ণর একটা অকৃত্রিম স্নেহ আছে সত্য। তবু তারও মুখ গম্ভীর হয়।
গায়ত্রী বললে, নরেনদা আমার শ্বশুরবাড়ীর জমিগুলো সম্বন্ধে বাবাকে কি পরামর্শ দিয়েছেন শুনেছ?
দরকারটা টাকার নয় শুনে সুবর্ণ খানিকটা আশ্বস্ত হল।
বললে, না, শুনিনি তো।
—পরামর্শ দিয়েছেন, সেখানকার জমিগুলো বিক্রি করে এখানে জমি কিনতে।
—এ তো ভালোই পরামর্শ গায়ত্রী।
গায়ত্রী মাথা নেড়ে বললে, হ্যাঁ, পরামর্শ ভালোই। কিন্তু এতে আমার মন সায় দিচ্ছে না। সেই কথাটাই তোমাকে বলতে এলাম। ও জমি বিক্রি করতে আমার মন নেই।
—কিন্তু ও জমি তো তোর কোনো কাজেই আসে না গায়ত্রী। তুই তো ও থেকে আজ পর্যন্ত একটা দানা ধানও পাস নি। ও জমি রেখে লাভ কি হবে?
—এ লাভ-লোকসানের কথাই নয় বৌদি। কিন্তু তুমিই বলো, ও জমি, আমি বিক্রি করব কোন অধিকারে?
সুবর্ণ একটু চিন্তা করে বললে, কিছু একটা অধিকার আছে নিশ্চয়ই। উনি আইন জানেন। আইনে হারবি জানলে উনি তোকে সে পরামর্শ কখনই দিতেন না।
—আইনে!—গায়ত্রী হাসলে,- আইনের কথা, আমি মুখ্যু মেয়েমানুষ, কিছুই বুঝি না। কিন্তু কি সুবাদে ওঁদের জমি দখল করব আমি? যাঁর সুবাদে অধিকার, তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয়ই হয়নি যে।
কথাটা যে সত্য তা সুবর্ণ জানতো।
গায়ত্রীর বর যখন বিয়ে করতে এলো তখনই প্রবল জ্বরে কাঁপছে। বিয়ের পর বাসরটা কাটালে লেপ মুড়ি দিয়ে। বয়স হয়েছিল, তার উপর ম্যালেরিয়া জ্বর। সোজা ব্যাপার তো নয়। এমনি করেই কাটে ফুলশয্যার রাত। তার পরেই তো গায়ত্রী বাপের বাড়ী ফিরে এল। এবং ছ’টা মাসও গেল না, বিধবা হল।
সুবর্ণ গায়ত্রীর সমবয়সী নয়। কিন্তু বয়সের ব্যবধানে মেয়েদের সখিত্ব কোনো কালেই আটকায় না। বৌদি সুবাদে গায়ত্রীর সঙ্গে সুবর্ণর সখিত্বই গড়ে উঠেছিল। গায়ত্রীর খবর গ্রামের সকল মেয়েই জানতো। সুবর্ণ আরও বেশিই জানতো।
তথাপি বললে, তবু ওই একটি দিনের মন্ত্রপড়া ভাই, ওর মূল্য কি কম? আমাদের জোর তো স্বামীর ঘর করবার সময়ের উপর নির্ভর করে না ভাই, আমাদের জোর ওই মন্ত্রের জোর।
গায়ত্রী বললে, কি জানি বৌদি, কিসের জোর। কিন্তু ওই জমি-বিক্রির টাকা হাত পেতে নিতে হবে ভাবতেই আমার বুক কেঁপে উঠছে। ও আমি পারব না বৌদি।
সুবর্ণ একটুক্ষণ নিঃশব্দে ওর দিকে চেয়ে থেকে বললে, তাহলে তোর চলবে কি করে ভেবে দেখেছিস? বাপের ওই তো অবস্থা! তবু তিনি যতদিন বেঁচে আছেন, একবেলা এক মুঠো তোর জুটবেই। কিন্তু ভায়েরা যদি খেতে না দেয়?
—তখন যে কি করব ভাবিনি বৌদি। তোমাদের পাঁচ বাড়ীতে ভিক্ষে করেও যদি পেট না ভরে, নদীতে তো জল আছে। সে ভাবনা তখন ভাবব। কিন্তু এখন,
গায়ত্রী দৃঢ়ভাবে মাথা নাড়লে।
বললে, তোমাকে সমস্তই বলে গেলাম। নরেনদাকে তুমি একটু বোলো বৌদি, বাবাকে বুঝিয়ে বলতে। তাঁর অভাবের সংসার। জমি-বিক্রির জন্যে লোভ হওয়া বিচিত্র নয়। কিন্তু নরেনদা বুঝিয়ে বললে, নিশ্চয় তিনি শান্ত হবেন। বলবে বৌদি?
বিষণ্নমুখে সুবর্ণ বললে, বলব। কিন্তু কাজটা তোর ভালো হচ্ছে না ভাই। শেষে পস্তাবি।
গায়ত্রী হেসে বললে, পস্তাচ্ছি তো গোড়া থেকেই বৌদি। এর যে একটা শেষ আছে, আজকে ভাবতেও পারি না।
—তাহলে এই তোর মত?
—হ্যাঁ।
সুবর্ণ আর কিছু বললে না।
গায়ত্রী আরও কিছুক্ষণ বসে এটা-ওটা আরও পাঁচটা হাসি-পরিহাসের পর একসময় উঠে চলে গেল।