এক
শ্রীপুর স্টেশনটিকে ফ্ল্যাগ স্টেশন বললেই ভালো হয়। না আছে স্টেশনের বাড়ী, না টেলিগ্রাফ, না সিগন্যাল। খানকয়েক ইঁটের উপর একখানা মালগাড়ী বসিয়ে রেখে সেইটে হয়েছে স্টেশন। দুটি বাবু এবং জনকয়েক খালাসী এই হল স্টাফ। মালপত্র এখানে নামে না, সব গাড়ীও দাঁড়ায় না। যে ক’খানি প্যাসেঞ্জার গাড়ী দাঁড়ায়, তার জন্যেও যাত্রী বিশেষ হয় না।
কিন্তু সেদিন এই নগণ্য স্টেশনটারই চেহারা বদলে গেল। ফুলে, পাতায়, পতাকায় এই ন্যাড়া স্টেশনটাই ঝলমল করে উঠলো। যে প্ল্যাটফর্মে সাধারণত লোক দেখাই যায় না, সেই প্ল্যাটফর্মেই লোক যেন ভেঙে পড়েছে।
ব্যাপারটা খুব গুরুতর কিছু নয় :
মহেন্দ্র আসছে।
মহেন্দ্র একজন মস্ত বড় ব্যক্তি নয়। এই গ্রামেরই জমিদারের ছোট ছেলে। মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাশ করেই যুদ্ধে গিয়েছিল। বর্মায় ইংরেজ বাহিনী হেরে যেতে অন্যান্য অফিসারের সঙ্গে সেও বন্দী হয় এবং শেষে নেতাজির আজাদ হিন্দ ফৌজে যোগদান করে।
তার পরের ইতিহাসও সকলেই জানে।
ইংরেজের হাতে বন্দী হয়ে মহেন্দ্রও অন্যান্য আজাদ হিন্দ অফিসারের সঙ্গে ভারতে ফেরে। সম্প্রতি তাঁদের সঙ্গে সেও ছাড়া পেয়েছে।
তারই সম্বর্ধনার জন্যে পাশাপাশি চার-পাঁচখানি গ্রামের ছেলেরা মিলে এই আয়োজন করেছে।
কিন্তু ট্রেন আর আসে না।
তিনটে-ছয়ে আসার কথা। এখন চারটে বেজে গেছে। অথচ এঞ্জিনের ধোঁয়ারও দেখা নেই। স্টেশনে টেলিগ্রাফ না থাকায় কখন ট্রেন আসবে, অথবা আদৌ আসবে কি না জানবার কোনোই উপায় নেই।
তবু অসহিষ্ণু ছেলের দল মাঝে মাঝে গিয়ে বেচারা স্টেশন মাস্টারের উপর হানা দিচ্ছে, যদি কোনো মানসিক বেতার প্রক্রিয়ায় তিনি কিছু বলতে পারেন।
এমন সময় বাইরে চিৎকার উঠলো : ওই ধোঁয়া, ওই ধোঁয়া।
হ্যাঁ। অনেক দূরে বাঁকের মুখে ধোঁয়ার মতো কি যেন একটা জিনিস দেখা যাচ্ছে। আর একটু পরেই বোঝা গেল এঞ্জিনেরই ধোঁয়া। ট্রেন আসছে।
সমবেত জনতা তৎক্ষণাৎ সুশৃঙ্খলে শ্রেণীবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে গেল।
স্টেশনের কর্মচারীরাও চঞ্চল হয়ে উঠলো।
মাথায় পাগড়ী জড়িয়ে খালাসী দিল ঘণ্টি বাজিয়ে। স্টেশনমাস্টার টুপিটা মাথায় দিয়ে খাতাপত্র বগলে নিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ালেন।
ট্রেন প্ল্যাটফর্মে থামতেই “নেতাজি কী জয়”, “আজাদ হিন্দ ফৌজ কী জয়” ইত্যাদি ধ্বনিতে চারিদিক মুখরিত হয়ে উঠলো।
ধীরে ধীরে একটি ইন্টার ক্লাস কামরা থেকে মহেন্দ্র নামলো। তার পরনে আজাদ হিন্দের পোশাক।
সম্বর্ধনার বিপুলতায় তার আর বিস্ময়ের শেষ নেই।
বললে, এ সব করেছ কি হে!
তার প্রশ্নের জবাব দেবার প্রয়োজনও কেউ অনুভব করলে না। শতকণ্ঠে আবার গর্জন উঠলো : নেতাজি কী জয়!
কাছের ছেলেটিকে চুপি চুপি মহেন্দ্ৰ জিজ্ঞাসা করলে, সব ভালো তো?
তার উত্তর ডুবিয়ে আবার গর্জন উঠলো : আজাদ হিন্দ ফৌজ কী জয়!
মহেন্দ্রকে গার্ড অফ অনার দেওয়া হল। এবং একটা বিরাট শোভাযাত্রার সঙ্গে তাকে বহু রাস্তা ঘুরিয়ে অবশেষে নিজের বাড়ীর দ্বারদেশে এনে হাজির করা হল।
এইখানে এসে মহেন্দ্র থমকে দাঁড়ালো।
তার কারণ আছে এবং সেটা জানা দরকার :
চিন্তাহরণবাবুর দুই পুত্র : জ্যেষ্ঠ নরেন্দ্র, কনিষ্ঠ মহেন্দ্র। গ্রামের স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করে নরেন্দ্র বাপের সহকর্মীরূপে জমিদারী এবং তেজারতি দেখতে লাগলো। তার বেশি কিছু করার প্রয়োজনও ছিল না। চিন্তাহরণবাবুর জমিদারী বিশেষ বড় নয়, কিন্তু নগদ টাকা প্রচুর। লোকে সেই টাকার ঠিক পরিমাণ আন্দাজ করতে না পেরে তাঁকে ‘টাকার কুমীর’ বলে অভিহিত করত। তাঁর দশগুণ যাঁদের জমিদারী, তাঁদেরও তাঁর কাছে টাকা ধার করতে হত। বস্তুত: আশেপাশে বিশ ক্রোশের মধ্যে এমন জমিদার খুব কমই ছিলেন যিনি তাঁর কাছে ঋণগ্রস্ত ছিলেন না। নরেন্দ্র এই সমস্ত কাজে বৃদ্ধ পিতাকে সাহায্য করতে লাগলো।
মহেন্দ্র নরেন্দ্রের চেয়ে বছর দশেকের ছোট। শেষ বয়সের সন্তান বলে ছেলেবেলায় বাপ-মায়ের কাছে অত্যধিক আদর পেয়েছিল। সম্ভবত: তারই ফলে তার স্বভাব ভয়ানক একরোখা হয়ে উঠলো।
যেমন দেহে তেমনি মনে দুই ভাই সম্পূর্ণ বিপরীত। নরেন্দ্র দেখতে শ্যামবর্ণ, নাতিদীর্ঘ, ঈষৎ স্থূল; মহেন্দ্ৰ তপ্তকাঞ্চনবর্ণ, দীর্ঘদেহ এবং ছিপছিপে। নরেন্দ্র শান্ত, ধীর, স্বল্পভাষী; মহেন্দ্ৰ চঞ্চল, উগ্র এবং অমিতভাষী। পড়াশুনায় নরেন্দ্র ছিল মাঝারি গোছের। সকালে সন্ধ্যায় দুটি গৃহশিক্ষকের তত্ত্বাবধানে সে কোনোমতে দ্বিতীয় বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করে। মহেন্দ্র বড়লোকের ছেলের গৃহশিক্ষক নামধেয় মোসাহেবকে একেবারেই দেখতে পারত না। সে গৃহশিক্ষকের সাহায্য ব্যতীতই, শুধু পাস করে গেল না, একেবারে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করলে। অথচ আশ্চর্য এই যে, নরেন্দ্র যখন পাস করলে তখন সব শিক্ষকই বারবার বলতে লাগলেন, স্কুলটা তার অভাবে অন্ধকার হয়ে গেল। এমন সত্যবাদী, বিনয়ী এবং সাধু ছাত্র তাঁরা কেউই সুদীর্ঘ শিক্ষক-জীবনে দেখেন নি। আর মহেন্দ্র যেদিন স্কুল থেকে বেরিয়ে এল, সেদিন সমস্ত শিক্ষকই এই উদ্ধত, শৃঙ্খলাভঙ্গকারী জমিদারপুত্রের হাত থেকে অব্যাহতি পেয়ে মুক্তির নিশ্বাস ফেললেন।
নিজের চোখের সামনেই মহেন্দ্র উত্তরোত্তর যেরকম দুর্বিনীত ও খামখেয়ালী হয়ে উঠেছিল তাতে, সে এমন ভালো করে পরীক্ষা পাস করলেও, চিন্তাহরণবাবুর তাকে উচ্চতর শিক্ষার জন্যে বাইরে পাঠাতে ঘোরতর অনিচ্ছা ছিল। কতকটা নরেন্দ্রর জন্যেই তিনি শেষ পর্যন্ত সম্মত হন।
ইন্টারমিডিয়েটেও মহেন্দ্র প্রথম স্থান অধিকার করলে এবং মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হল। কিন্তু মাঝে মাঝে ছুটিতে যে ক’টা দিনের জন্যে মহেন্দ্র বাড়ী আসত, সেই ক’টা দিনেই তার নানা আচরণে এবং অনাচারে নিষ্ঠাবান চিন্তাহরণের চিত্ত তার বিরুদ্ধে তিক্ত হয়ে উঠতে লাগলো। মহেন্দ্রের সঙ্গে পারতপক্ষে তিনি কথাই বলতে চাইতেন না।
এই তিক্ততা চরমে উঠলো যখন মেডিক্যাল কলেজ থেকে সসম্মানে উত্তীর্ণ হবার পর মহেন্দ্র কাকেও কিছু না বলে হঠাৎ যুদ্ধে চলে গেল।
তার পর থেকে যে সামান্য ক’টা বৎসর চিন্তাহরণবাবু বেঁচে ছিলেন, তার মধ্যে মহেন্দ্রের নাম পর্যন্ত তিনি উচ্চারণ করতেন না। অন্য কেউ তাঁর কাছে মহেন্দ্রের উল্লেখ করতেও সাহস করত না। এমন কি মৃত্যুকালেও তিনি মহেন্দ্রের নাম মুখে আনেন নি।
ভারতবর্ষের ভিতর থেকে এবং বাইরে থেকেও মহেন্দ্র প্রথম প্রথম যথানিয়মিত পিতাকে পত্র দিত। কিন্তু তার উত্তর পিতার পরিবর্তে নরেন্দ্রের কাছ থেকে আসত। আর কোনো মনিঅর্ডারই কেউই গ্রহণ করতেন না। তার সম্বন্ধে পিতার মনোভাব তার অবিদিত ছিল না। সুতরাং এর অর্থ সে সহজেই উপলব্ধি করলে। অতঃপর চিঠি যা লিখত, দাদাকেই লিখত, এবং টাকা পাঠাত না।
.
পিতার মৃত্যু সংবাদ মহেন্দ্র বেন গাজীতে থাকতে পেয়েছিল। এতকাল পরে তাঁরই কথা স্মরণ করে সে দ্বারপ্রান্তে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো।
এমন সময় বৃদ্ধ গোমস্তা রামলোচন এবং তার পিছু পিছু আরও কয়েকটি ভৃত্য ব্যস্তভাবে বাড়ীর ভিতর থেকে এসে সেই পথের ধূলোতেই গড় হয়ে প্রণাম করলে।
—চলুন, ভিতরে চলুন।
মহেন্দ্র জিজ্ঞাসা করলে, দাদা কোথায়?
—তিনি বিশেষ জরুরী কাজে পরশু সদরে গেছেন। আজ সন্ধ্যার ট্রেনেই ফিরবেন।
স্টেশনে যে-সম্বর্ধনা সে পেয়েছে, মহেন্দ্র তা প্রত্যাশা করেনি। কিন্তু যে-দাদাকে সে মনে-প্রাণে একান্ত করে প্রত্যাশা করেছিল তাকেই না দেখে অজ্ঞাতসারে তার মনের মধ্যে এতক্ষণ শুধু অভিমান জমা হচ্ছিল। রামলোচনের কথায় সেই অভিমান বাষ্প হয়ে উড়ে গেল।
রামলোচন আবার বললে, ভিতরে চলুন। মা…
হ্যাঁ, তার পরে আছেন মা। এবং বিধবা জননীর সামনে সে যে কি করে দাঁড়াবে ভাবতেই তার পা যেন অবশ হয়ে গেল। দাদা থাকলে এই সমস্যার মীমাংসা হত সহজেই। কিন্তু সে তো নেই। ফিরবে সন্ধ্যায়। তার এখনও দেরি আছে।
জিজ্ঞাসা করলে, মা কেমন আছেন রামলোচন দা?
—মা?- রামলোচন বললে, সে কি জিগ্যেস করবার কথা ছোটবাবু? নিজের চোখেই দেখবেন চলুন।
মহেন্দ্রের বুকের ভিতরটা যেন মোচড় দিয়ে উঠলো।
বললে, এখন থাক রামলোচনদা। কাউকে বরং বলো, হাত-মুখ ধোবার জন্যে এইখানে একটু জল দিয়ে যাক।
রামলোচন দ্বিধাগ্রস্তভাবে বললে, কিন্তু মা যে বড্ডই ব্যস্ত হয়েছেন ছোটবাবু।
—সে আমি জানি ভাই। কিন্তু আমার বুকের ভিতরটা কি রকম করছে বুঝতে পারছ না? আমাকে একটু সামলাতে দাও। হাত-মুখ ধুই, এই পোশাকগুলো ছাড়ি, তারপর যাব।
বলে সেইখানে সিঁড়ির উপরেই মহেন্দ্র বসে পড়লো।
তার কথা শুনে এবং বসা দেখে রামলোচন হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো।