সূর্যদেব যতই ঊর্ধ্বে উঠিতেছেন, তাপাংশ ততই বৃদ্ধি হইতেছে। হোসেনের পরিজনেরা বিন্দুমাত্র জলের জন্য লালায়িত হইতেছে, শত শত বীরপুরুষ শত্রুহস্তে প্রাণত্যাগ করিতেছে। ভ্রাতা, পুত্র, স্বামীর শোণিতাক্ত কলেবর দেখিয়া কামিনীরা সময়ে সময়ে পিপাসায় কাতর হইতেছেন, চক্ষুতে জলের নামমাত্রও নাই, সে যেন এক প্রকার বিকৃত ভাব, কাঁদিবারও বেশি শক্তি নাই। হোসেন চতুর্দিক চাহিয়া দেখিলেন, বন্ধুবান্ধবের মধ্যে আর কেহই নাই। রণসজ্জায় সজ্জিত হইয়া জয়লাভের জন্য শত্রুসম্মুখীন হইতে আদেশ অপেক্ষায় তাঁহার সম্মুখে আর কেহই আসিতেছেন না। হোসেন এক দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া বলিলেন, “হায়! একমাত্র বারি প্রত্যাশায় এত আত্মীয় বন্ধুবান্ধব হারাইলাম, তথাচ পরিজনগণের পিপাসা নিবারণ করিতে পারিলাম না। কারবালা ভূমিতে রক্তস্রোত বহিতেছে, তথাচ স্রোতস্বতী ফোরাত শত্রুহস্ত হইতে উদ্ধার করিতে পারিলাম না। এক্ষণে আর বাঁচিবার ভরসা নাই, আশাও নাই, আকাঙ্খাও নাই।”
হাসানপুত্র কাসেম পিতৃব্যের এই কথা শুনিয়া সুসজ্জিত বেশে সম্মুখে করজোড়ে দণ্ডায়মান হইয়া বিনীতভাবে বলিতে লাগিলেন, “তাত! কাসেম এখনো জীবিত আছে। আপনার আজ্ঞাবহ চিরদাস আপনার সম্মুখে দণ্ডায়মান আছে। অনুমতি করুন, শত্রুকুল নির্মূল করি।”
হোসেন বলিলেন, “কাসেম! তুমি পিতৃহীন; তোমার মাতার তুমিই একমাত্র সন্তান; তোমায় এই ভয়ানক শত্রুদল মধ্যে কোন্ প্রাণে পাঠাইব?”
কাসেম বলিল, “ভয়ানক!-আপনি কাহাকে ভয়ানক শত্রু জ্ঞান করেন? পথের ক্ষুদ্র মক্ষিকা, পথের ক্ষুদ্র পিপীলিকাকে আমি যেমন ক্ষুদ্র জ্ঞান করি, আপনার অনুমতি পাইলে এজিদের ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর সৈন্যধ্যগণকেও সেইরূপ তৃণজ্ঞান করিতে পারি। কাসেম যদি বিপক্ষ ভয়ে ভয়ার্তচিত্ত হয়, হাসানের নাম ডুবিবে, আপনারও নাম ডুবিবে। অনুমতি করুন, একা আমি সশস্ত্র হইয়া সহস্র সহস্র লক্ষ লক্ষ রিপু বিনাশ সমর্থ।”
হোসেন বলিলেন, “প্রাণাধিক! আমার বংশে তুমি সকলের প্রধান, তুমি ইমাম বংশের বহুমূল্য রত্ন, তুমি পিতার জ্যেষ্ঠ পুত্রের জ্যেষ্ঠ পুত্র, তুমি সৈয়দ বংশের অমূল্য নিধি। তুমি তোমার মাতার একমাত্র সন্তান, তাঁহার সম্মুখে থাকিয়া তাঁহাকে এবং সমুদয় পরিজনকে সান্ত্বনা কর। আমি নিজেই যুদ্ধ করিয়া ফোরাতকূল উদ্ধার করিতেছি।”
কাসেম বলিলেন, “আপনি যাহাই বলুন, কাসেমের প্রাণ দেহে থাকিতে আপনাকে অস্ত্র ধারণ করিতে হইবে না। কাসেম এজিদের সৈন্য দেখিয়া কখনোই ভীত হইবে না। যদি ফোরাতকূল উদ্ধার করিতে না পারি, তবে ফোরাতনদী আজ লোহিতবর্ণে রঞ্জিত হইয়া এজিদের সৈন্য-শোণিতে যোগ দিয়া মহাসমুদ্রে প্রবাহিত হইবে।”
হোসেন বলিলেন, “বৎস! আমার মুখে এ-কথার উত্তর নাই। তোমার মাতার আদেশ লইয়া যাহা ইচ্ছা তাহাই কর।”
হাসনেবানুর পদধূলি গ্রহণ করিয়া মহাবীর কাসেম যুদ্ধযাত্রা প্রার্থনা জানাইলে তিনি কাসেমের মস্তক চুম্বন করিয়া আশীর্বাচন প্রয়োগপূর্বক বলিলেন, “যাও বাছা! যুদ্ধে যাও! তোমার পিতৃঋণ পরিশোধ কর। পিতৃশত্রু এজিদের সৈন্যগণের মস্তক চূর্ণ কর, যুদ্ধে জয়ী হইয়া ফোরাতকূল উদ্ধার কর, তোমার পিতৃবাক্য রক্ষা কর। তোমার আর আর ভ্রাতা-ভগ্নীগণ তোমার মুখাপেক্ষা করিয়া রহিল। যাও বাপ! তোমায় আজ ঈশ্বরের পদতলে সমর্পণ করিলাম।”
হাসনেবানুর নিকট হইতে বিদায় হইয়া পিতৃব্যের পদচুম্বনপূর্বক কাসেম অশ্বপৃষ্ঠে আরোহণ করিবেন, এমন সময়ে হোসেন বলিলেন, “কাসেম! একটু বিলম্ব কর।”
অনুজ্ঞা শ্রবণমাত্র অশ্ববল্গা ছাড়িয়া কাসেম তৎক্ষণাৎ পিতৃব্যসম্মুখে দণ্ডায়মান হইলেন। হোসেন বলিতে লাগিলেন, “কাসেম! তোমার পিতার নিকট আমি এক প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ আছি, আমাকে সেই প্রতিজ্ঞা হইতে উদ্ধার করিয়া যুদ্ধে গমন কর। যুদ্ধে যাইতে আমার আর কোন আপত্তি নাই। তোমার পিতা প্রাণবিয়োগের কিছু পূর্বে আমাকে করারে আবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন, আমার কন্যা সখিনার সহিত তোমার বিবাহ দিব। তুমি সখিনাকে বিবাহ না করিয়া যুদ্ধে যাইতে পারিবে না। তোমার পিতার আজ্ঞা প্রতিপালন, আমাকেও প্রতিজ্ঞা হইতে রক্ষা কর, উভয়ই তোমার সমতুল্য কার্য।”
কাসেম মহা বিপদে পড়িলেন। এতাদৃশ মহাবিপদসময়ে বিবাহ করিতে হইবে, ইহা ভাবিয়াই অস্থিরচিত্ত। কী করেন কোন উপায় না করিয়া মাতার নিকট সমুদয় বৃত্তান্ত বলিলেন।
হাসনেবানু বলিলেন, “কাসেম! আমিও জানি, আমার সম্মুখে তোমার পিতা তোমার পিতৃব্যের নিকট এই বিবাহের প্রস্তাব করিয়া তাঁহাকে করারে আবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন। শোক তাপ এবং উপস্থিত বিপদে আমি সমুদয় ভুলিয়া গিয়াছিলাম। ঈশ্বরানুগ্রহে তোমার পিতৃব্যের স্মরণ ছিল বলিয়াই তোমার পিতার উপদেশ প্রতিপালিত হইবে বোধ হইতেছে। ইহাতে আর কোন আপত্তি উত্থাপন করিয়ো না। এখনই বিবাহ হউক। প্রাণাধিক, এই বিষাদ-সমুদ্র মধ্যে ক্ষণকালের জন্য একবার আনন্দস্রোত বহিয়া যাউক্।”
কাসেম বলিলেন, “জননী! পিতা মৃত্যুকালে আমাকে একখানি কবচ দিয়া বলিয়া গিয়াছেন যে, যে সময় তুমি কোন বিপদে পড়িবে, নিজ বুদ্ধির দ্বারা যখন কিছুই উপায় স্থির করিতে না পারিবে, সেই সময় এই কবচের অপর পৃষ্ঠ দেখিয়া তদুপদেশমত কার্য করিয়ো। আমার দক্ষিণহস্তে যে কবচ দেখিতেছেন, ইহাই সেই কবচ। আপনি যদি অনুমতি করেন, তবে আজ এই মহাঘোর বিপদসময়ে কবচের অপর পৃষ্ঠ পাঠ করিয়া দেখি কি লেখা আছে!”
হাসনেবানু বলিলেন, “এখনই দেখ! তোমার আজিকার বিপদের ন্যায় আর কোন বিপদই হইবে না। কবচের অপর পৃষ্ঠ দেখিবার উপযুক্ত সময়ই এই।” এই কথা বলিয়াই হাসনেবানু কাসেমের হস্ত হইতে কবচ খুলিয়া কাসেমের হস্তে দিলেন। কাসেম সম্মানের সহিত কবচ চুম্বন করিয়া অপর পৃষ্ঠ দেখিয়াই বলিলেন, “মা! আমার আর কোন আপত্তি নাই। এই দেখুন, কবচে কি লেখা আছে।”-পরিজনেরা সকলেই দেখিলেন, কবচে লেখা আছে-“এখনই সখিনাকে বিবাহ কর।” কাসেম বলিলেন, “আর আমার কোন আপত্তি নাই; এই বেশেই বিবাহ করিয়া পিতার আজ্ঞা পালন ও পিতৃব্যের প্রতিজ্ঞা রক্ষা করিব।”
প্রিয় পাঠকগণ! ঈশ্বরানুগ্রহে লেখনী-সহায়ে আপনাদের সহিত আমি অনেক দূর আসিয়াছি। কোন দিন ভাবি নাই, একটু চিন্তাও করি নাই, লেখনীর অবিশ্রান্ত গতি ক্রমেই আপনাদের সঙ্গে সঙ্গে বিষাদ-সিন্ধুর পঞ্চবিংশ প্রবাহ পর্যন্ত আসিয়াছি। আজ কাসেমের বিবাহ-প্রবাহ মহাবিপদে পড়িলাম। কি লিখি কিছুই স্থির করিতে পারিতেছি না।
হাসনেবানু বলিয়াছেন, ‘বিষাদ-সমুদ্রে আনন্দস্রোত!’ এমন কঠিন বিষয় বর্ণনা করিতে মস্তক ঘুরিতেছে, লেখনী অসাড় হইতেছে, চিন্তার গতিরোধ হইতেছে, কল্পনাশক্তি শিথিল হইতেছে। যে শিবিরে স্ত্রীপুরুষেরা, বালকবালিকারা দিবা রাত্রি মাথা ফাটাইয়া ক্রন্দন করিতেছে, পুত্রমিত্রশোকে জগৎসংসার অন্ধকার দেখিতেছে, প্রাণপতির চিরবিরহে সতী নারীর প্রাণ ফাটিয়া যাইতেছে, ভ্রাতার বিয়োগযন্ত্রণায় অধীর হইয়া প্রিয় ভ্রাতা বক্ষ বিদারণ করিতেছে, শোকে তাপে স্ত্রীপুরুষ একত্রে দিবানিশি হায় হায় রবে কাঁদিতেছে, জগৎকেও কাঁদাইতেছে; আবার মুহূর্ত পরেই পিপাসা, সেই পিপাসারও শান্তি হইল না;-সেই শিবিরেই আজ বিবাহ! সেই পরিজন মধ্যেই এখন বিবাহ উৎসব।-বিষাদ-সিন্ধুতে হাসিবার কোন কথা নাই, রহস্যের নামমাত্র নাই, আমোদ-আহ্লাদের বিন্দুবিসর্গ সম্পর্কও নাই, আদ্যন্ত কেবল বিষাদ, ছত্রে ছত্রে বিষাদ, বিষাদেই আরম্ভ এবং বিষাদেই সম্পূর্ণ। কাসেমের ঘটনা বড় ভয়ানক। পূর্বেই বলিয়াছি যে, মহাবীর কাসেমের ঘটনা বিষাদ-সিন্ধুর একটি প্রধান তরঙ্গ।
কাহার মুখে হাসি নাই, কাহারো মুখে সন্তোষের চিহ্ন নাই। বিবাহ, অথচ বিষাদ! পুরবাসিগণ সখিনাকে ঘিরিয়া বসিলেন। রণবাদ্য তখন সাদীয়ানা বাদ্যের কার্য করিতে লাগিল। অঙ্গরাগাদি সুগন্ধি দ্রব্যের কথা কাহারো স্মরণ হইল না;-কেবল কণ্ঠবিনির্গত নেত্রজলেই সখিনার অঙ্গ ধৌত করিয়া পুরবাসিনীরা পরিষ্কৃত বসনে সখিনাকে সজ্জিত করিলেন। কেশগুচ্ছ পরিপাটী করিয়া বাঁধিয়া দিলেন, সভ্য প্রদেশ প্রচলিত বিবাহের চিহ্ন স্বরূপ দুই একখানি অলঙ্কার সখিনার অঙ্গে ধারণ করাইলেন। সখিনা পূর্ণবয়স্কা, সকলই বুঝিতেছেন। কাসেম অপরিচিত নহে। প্রণয়, ভালবাসা উভয়েরই রহিয়াছে। ভ্রাতাভগ্নী মধ্যে যেরূপ বিশুদ্ধ ও পবিত্র প্রণয় হইয়া থাকে, তাহা কাসেম-সখিনার বাল্যকাল হইতেই রহিয়াছে। কাহার স্বভাব কাহারো অজানা নাই, বাল্যকাল হইতেই এই উপস্থিত যৌবনকাল পর্যন্ত একত্র ক্রীড়া, একত্রে ভ্রমণ, একত্র বাসনিবন্ধন উভয়েরই মনে সবিশেষ সরল প্রণয় জন্মিয়াছে। উভয়েই এক পরিবার, এক বংশসম্ভূত, উভয়ের পিতা পরস্পর সহোদর ভ্রাতা, সুতরাং লজ্জা, মান, অভিমান অপর স্বামী-স্ত্রীতে যেরূপ হইবার সম্ভাবনা, তাহা উহাদের নাই। লগ্ন সুস্থির হইল। ওদিকে এজিদের সৈন্য মধ্যে ঘোর রবে যুদ্ধবাজনা বাজিতে লাগিল। ফোরাত-নদীর কূল উদ্ধার করিতে আর কোন বীরপুরুষই হোসেনের পক্ষ হইতে আসিতেছে না দেখিয়া আজিকার যুদ্ধে জয়সম্ভব বিবেচনায় তুমুল শব্দে বাজনা বাজিতে লাগিল। সেই শব্দে ফোরাতকূল হইতে কারবালার অন্তসীমা পর্যন্ত প্রতিধ্বনিত হইয়া উঠিল। হোসেনের শিবিরে পতিপুত্রশোকাতুরা অবলাগণের কাতরনিনাদে সপ্ততল আকাশ ভেদ করিতে লাগিল। সেই কাতরধ্বনি ঈশ্বরের সিংহাসন পর্যন্ত যাইতে লাগিল। হোসেন বাধ্য হইয়া এই নিদারুণ দুঃখের সময় কাসেমের হস্তে প্রাণাধিকা দুহিতা সখিনাকে সমর্পণ করিলেন। বিধিমত বিবাহ কার্য সম্পন্ন হইল। শুভ কার্যের পর আনন্দাশ্রু অনেকের চক্ষে দেখা যায়, কিন্তু হোসেনের শিবিরস্থ পরিজনগণের চক্ষে কোন প্রকার অশ্রুই দেখা যায় নাই। কিন্তু কাসেমের বিবাহ বিষাদ-সিন্ধুর সর্বাপেক্ষা প্রধান তরঙ্গ। সেই ভীষণ তরঙ্গে সকলেরই অন্তর ভাসিয়া যাইতেছিল। বরকন্যা উভয়েই সমবয়স্ক। স্বামী-স্ত্রীতে দুই দণ্ড নির্জনে কথাবার্তা কহিতেও আর সময় হইল না। বিবাহকার্য সম্পন্ন করিয়াই গুরুজনগণের চরণ বন্দনা করিয়া, মহাবীর কাসেম অসিহস্তে দণ্ডায়মান হইয়া বলিলেন, “এখন কাসেম শত্রু-নিপাতে চলিল।” হাসেনবানু কাসেমের মুখে শত শত চুম্বন দিয়া আর আর সকলের সহিত দুই হস্ত তুলিয়া ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা করিতে লাগিলেন, “হে করুণাময় জগদীশ্বর! কাসেমকে রক্ষা করিয়ো। আজ কাসেম বিবাহ-সজ্জা, বাসরসজ্জা পরিত্যাগ করিয়া চিরশত্রুসৈন্যসম্মুখে যুদ্ধসজ্জায় চলিল। পরমেশ্বর! তুমিই রক্ষাকর্তা; তুমিই রণক্ষেত্রে পৃষ্ঠপোষক হইয়া পিতৃহীন কাসেমকে এ বিপদে রক্ষা কর!”
কাসেম যাইতে অগ্রসর হইলেন; হাসনেবানু বলিতে লাগিলেন, “কাসেম! একটু অপেক্ষা কর। আমার চিরমনসাধ আমি পূর্ণ করি। তোমাদের দুইজনকে একত্রে নির্জনে বসাইয়া আমি একটু দেখিয়া লই। উভয়কে একত্রে দেখিতে আমার নিতান্তই সাধ হইয়াছে।” এই বলিয়া সখিনা ও কাসেমকে বস্ত্রাবাস মধ্যে একত্র বসাইয়া বলিলেন, “কাসেম! তোমার স্ত্রীর নিকট হইতে বিদায় লও।” হাসনেবানু শিরে করাঘাত করিতে করিতে তথা হইতে বাহির হইয়া কাসেমের গম্য পথে দাঁড়াইয়া রহিলেন।
কাসেম সখিনার হস্ত ধরিয়া দাঁড়াইয়া আছেন। কাহারো মুখে কোন কথা নাই। কেবল সখিনার মুখপানে চাহিয়া কাসেম স্থিরভাবে দাঁড়াইয়া রহিলেন। অনেকক্ষণ পরে কাসেম বলিলেন, “সখিনা! প্রণয়-পরিচয়ের ভিখারী আমরা নহি; এক্ষণে নূতন সম্বন্ধে পূর্ব প্রণয় নূতন ভাবে আজীবন কাল পর্যন্ত সমভাবে রক্ষার জন্যই বিধাতা এই নূতন সম্বন্ধ সৃষ্টি করাইলেন। তুমি বীরকন্যা-বীরজায়া; এ সময় তোমার মৌনী হইয়া থাকা আমার অধিকতর দুঃখের কারণ। পবিত্র প্রণয় তো পূর্ব হইতেই ছিল, এক্ষণে তাহার উপর পরিণয়সূত্রে বন্ধন হইল, আর আশা কি? অস্থায়ী জগতে আর কি সুখ আছে বল তো?”
সখিনা বলিলেন, “কাসেম! তুমি আমাকে প্রবোধ দিতে পারিবে না। তবে এইমাত্র বলি, যেখানে শত্রুর নাম নাই, এজিদের ভয় নাই, কারবালা প্রান্তরও নাই, ফোরাতজলের পিপাসাও যেখানে নাই, সেই স্থানে যেন আমি তোমাকে পাই, আমার প্রার্থনা। প্রণয় ছিল, পরিণয় হইল, আর কী আশা?”-কাসেমের হস্ত ধরিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে সখিনা পুনঃপুনঃ বলিলেন, “কাসেম! প্রণয় ছিল, পরিণয় হইল, আর কী আশা?”
প্রিয়তমা ভার্যাকে অতি স্নেহসহকারে আলিঙ্গন করিয়া মুখের নিকটে মুখ রাখিয়া কাসেম বলিতে লাগিলেন, “আমি যুদ্ধযাত্রী, শত্রু-শোণিত-পিপাসু, আজ সপ্তদিবস একবিন্দুমাত্র-জলও গ্রহণ করি নাই, কিন্তু এখন আমার ক্ষুধা পিপাসা কিছুই নাই। তবে যে পিপাসায় কাতর হইয়া চলিলাম, বোধ হয় এ জীবনে তাহার তৃপ্তি নাই, হইবেও না। তুমি কাঁদিয়ো না। মনের আনন্দে আমাকে বিদায় কর। একবার কান পাতিয়া শুন দেখি, শত্রুদলের রণবাদ্য কেমন ঘোর রবে বাদিত হইতেছে। তোমার স্বামী মহাবীর হাসানের পুত্র, হজরত আলীর পৌত্র কাসেম তোমার স্বামী, এই কাসেম কি ঐ বাদ্য শুনিয়া নববিবাহিতা স্ত্রীর মুখপানে চাহিয়া বসিয়া থাকিতে পারে? সখিনা! আমি এক্ষণে বিদায় হই।”
সখিনা বলিতে লাগিলেন, “তোমাকে ঈশ্বরে সঁপিলাম। যাও কাসেম!-যুদ্ধে যাও! প্রথম মিলন রজনীর সমাগম আশয়ে অস্তমিত সূর্যের মলিন ভাব দেখিয়া প্রফুল্ল হওয়া সখিনায় ভাগ্যে নাই। যাও কাসেম! যুদ্ধে যাও!”
কাসেম আর সখিনার মুখের দিকে তাকাইতে পারিলেন না। আয়তলোচনে বিষাদিত ভাব চক্ষে দেখিতে আর ক্ষমতা হইল না। কোমলপ্রাণা সখিনার সুকোমল হস্ত ধরিয়া বারংবার চুম্বন করিয়া বিদায় হইলেন। সখিনার আশা-ভরসা যে মুহূর্তে অঙ্কুরিত হইল সেই মুহূর্তেই শুকাইয়া গেল। কাসেম দ্রুতপদে শিবির হইতে বাহির হইয়া এক লম্ফে অশ্বে আরোহণপূর্বক সজোরে অশ্বপৃষ্ঠে কশাঘাত করিলেন। অশ্ব বায়ুবেগে দৌড়িয়া চলিল।-সখিনা চমকিয়া উঠিলেন-হৃদয়ে বেদনা লাগিল।
কাসেম সমরক্ষেত্রে যাইয়া বলিতে লাগিলেন, “যুদ্ধ সাধ যদি কাহারো থাকে, যৌবনে যদি কাহারো অমূল্য জীবন বিড়ম্বনা জ্ঞান হইয়া থাকে, তবে কাসেমের সম্মুখে অগ্রসর হও।”
সেনাপতি ওমর পূর্ব হইতেই কাসেমকে বিশেষরূপে জানিতেন। কাসেমের তরবারি সম্মুখে দাঁড়াইতে পারে এমন বলবান বীর তাঁহার সৈন্যমধ্যে এক বর্জক ভিন্ন আর কেহই ছিল না। বর্জককে সম্বোধন করিয়া তিনি বলিলেন, “ভাই বর্জক! হাসানপুত্র কাসেমের সহিত যুদ্ধ করিতে আমাদের সৈন্যদল মধ্যে তুমি ভিন্ন আর কেহই নাই। ভাই! কাসেমের বলবীর্য, কাসেমের বলবিক্রম, কাসেমের বীরত্বপ্রতাপ সকলই আমার জানা আছে! তাহার সম্মুখে যাহাকে পাঠাইব, সে আর শিবিরে ফিরিয়া আসিবে না। আমি নিশ্চয় বলিতে পারি, কোন ক্রমেই কাসেমের হস্ত হইতে সে আর রক্ষা পাইবে না। নিরর্থক সৈন্যক্ষয় করা যুক্তিসিদ্ধ নহে। আমার বিবেচনায় তুমিই কাসেম অপেক্ষা মহাবীর। তুমিই কাসেমের জীবনপ্রদীপ নির্বাণ করিয়া আইস।”
বর্জক বলিলেন, “বড় ঘৃণার কথা! শামদেশে মহা মহা বীরের সম্মুখে আমি দাঁড়াইয়াছি, মিশরের প্রধান প্রধান মহারথীরা বর্জকের বীরত্ববীর্য অবগত আছে, আজ পর্যন্ত কেহই সম্মুখ যুদ্ধে অগ্রসর হইতে সাহস করে নাই; এখন কি-না, এই সামান্য বালকের সহিত ওমর আমাকে যুদ্ধ করিতে আদেশ করেন, বড়ই ঘৃণার কথা! হোসেনের সম্মুখে সমরক্ষেত্রে দণ্ডায়মান হইলে বরং কথঞ্চিৎ শোভা পায়; আর এ কি-না, কাসেমের সহিত যুদ্ধ। বালকের সঙ্গে সংগ্রাম! কখনোই না, কখনোই না! কখনোই আমি কাসেমের সহিত যুদ্ধ করিতে যুদ্ধক্ষেত্রে দেখা দিব না।”
ওমর বলিলেন, “তুমি কাসেমকে জান না। তাহাকে অবহেলা করিয়ো না। তাহার তুল্য মহাবীর মদিনায় আর নাই। ভাই বর্জক! তুই ভিন্ন কাসেমের অস্ত্রাঘাত সহ্য করে এমন বীর আমাদের দলে আর কে আছে?”
হাসিতে হাসিতে বর্জক বলিলেন, “কাহাকে তুমি কি কথা বল! ক্ষুদ্র কীট, ক্ষুদ্র পতঙ্গ কাসেম; তাহার মাথা কাটিয়া আমি কি বিশ্ববিজয়ী বীরহস্ত কলঙ্কিত করিব? কখনোই না, কখনোই না! সিংহের সহিত সিংহের যুদ্ধ হয়, শৃগালের সহিত সিংহ কোন কালে যুদ্ধ করে ওমর? সিংহ-শৃগাল! তুলনা করিলে তাহাও নহে। বর্জক সিংহ, কাসেম একটা পতঙ্গ মাত্র। কী বিবেচনায় ওমর! কী বিবেচনায় তুমি সেই তুচ্ছ পতঙ্গ কাসেমের সঙ্গে আমাকে যুদ্ধ করিতে পাঠাও? আচ্ছা, তোমার যদি বিশ্বাস হইয়া থাকে কাসেম মহাবীর, আচ্ছা, আমি যাইব না। আমার অমিততেজা চারি পুত্র বর্তমান, তাহারা রণক্ষেত্রে গমন করুক, এখনই কাসেমের মাথা কাটিয়া আনিবে।”
তাহাই, ওমরের তথাস্তু! আদেশমত বর্জকের প্রথম পুত্র যুদ্ধে গমন করিল। যুদ্ধক্ষেত্রে বর্শা চালাইতে আরম্ভ করিল। বিপক্ষ পরাস্ত হইল না। অবশেষে অসিযুদ্ধ! সম্মুখে কাসেম। উভয়ে মুখোমুখি হইয়া দণ্ডায়মান আছেন। বর্জকের পুত্র অস্ত্র প্রহার করিতেছেন কাসেম হাস্য করিতেছেন। বর্জকের পুত্রের তরবারিসংযুক্ত বহুমূল্য মণিমুক্তা দেখিয়া সহাস্য আস্যে কাসেম কহিলেন, “কী চমৎকার শোভা! মণিময় অস্ত্র প্রদর্শন করিলেই যদি মহারথী হয়, তবে বল দেখি, মণিমস্তক কালসর্প কেন মহারথী না হইবে?”
কথা না শুনিয়াই বর্জকের পুত্র কাসেমের মস্তক লক্ষ্য করিয়া অস্ত্র নিক্ষেপ করিলেন। অস্ত্র ব্যর্থ হইয়া গেল। পুনর্বার আঘাত। কাসেমের চর্ম বিদ্ধ হইয়া বাম হস্ত হইতে শোণিতের ধারা ছুটিল। ত্রস্তহস্তে শিরস্ত্রাণ ছিন্ন করিয়া ক্ষতস্থান বন্ধনপূর্বক ক্ষতযোদ্ধা পুনর্বার অস্ত্র ধারণ করিলেন। বর্জকের পুত্র বর্শা ধারণ করিয়া বলিলেন, “কাসেম! তলোয়ার রাখ। তোমার বামহস্তে আঘাত লাগিয়াছে। চর্ম ধারণে তুমি অক্ষম। অসিযুদ্ধেও তুমি এখন অক্ষম। বর্শা ধারণ কর, বর্শাযুদ্ধই এখন শ্রেয়ঃ।”
বক্তার কথা মুখে থাকিতে থাকিতে কাসেমের বর্শা প্রতিযোদ্ধার বক্ষ বিদীর্ণ করিয়া পৃষ্ঠ পার হইল। বর্জকের পুত্র শোণিতাক্ত শরীরে অশ্বপৃষ্ঠ হইতে ভূতলে পড়িয়া গেল। তাহার কটিবন্ধের মহামূল্য অসি সজোরে আকর্ষণ করিয়া কাসেম বলিলেন, “কাফের! মূল্যবান অস্ত্রের ব্যবহার দেখ।” এই কথার সঙ্গে সঙ্গেই বর্জক-পুত্রের মস্তক যুদ্ধক্ষেত্রে বিলুণ্ঠিত হইল। কাসেম বলিতে লাগিলেন, “রে বিধর্মী কাফেরগণ! আর কারে রণক্ষেত্রে কাসেমের সম্মুখে পাঠাবি, পাঠা।”
পাঠাইবার বেশি অবসর হইল না। দেখিতে দেখিতে মহাবীর কাসেম বর্জকের অপর তিন পুত্রকে শীঘ্র শীঘ্র শমনসদনে পাঠাইলেন। পুত্র-শোকাতুর বর্জক সেনাপতির আদেশের অপেক্ষা না করিয়া ভীম-গর্জনে স্বয়ং যুদ্ধক্ষেত্রে দেখা দিলেন। বীরদর্পে বলিতে লাগিলেন, “কাসেম! তুমি ধন্য! ক্ষণকাল অপো কর। তুমি আমার চারিটি পুত্র নিধন করিয়াছ, তাহাতে আমার কিছুমাত্র দুঃখ নাই। কাসেম! তুমি বালক। এত যুদ্ধ করিয়া অবশ্যই ক্লান্ত হইয়াছে। সপ্তাহকাল তোমার উদরে অন্ন নাই কণ্ঠে জলবিন্দু নাই, এ অবস্থায় তোমার সঙ্গে যুদ্ধ করা কেবল বিড়ম্বনা মাত্র।”
কাসেম বলিলেন, “বর্জক! সে ভাবনা তোমার ভাবিতে হবে না। তুমি পুত্রশোকে যে প্রকার বিহ্বল হইয়াছ দেখিতেছে, তাহাতে তোমার পক্ষে এ সময় সংগ্রাম লিপ্ত হওয়াই বিড়ম্বনা।” বর্জক বলিলেন, “কাসেম! আমি তোমার কথা স্বীকার করি, পুত্র-শোকে অতি কঠিন হৃদয়ও বিহ্বল হয়; কিন্তু পুত্রহন্তার মস্তক লাভের আশা থাকিলে, এখনই পুত্রমস্তকের পরিশোধ হইবে, নিশ্চয় জানিতে পারিলে, বীরহৃদয়ে বিহ্বলতাই-বা কী? দুঃখই-বা কী? কাসেম! বল তো, তুমি ঐ তরবারিখানি কোথায় পাইলে? ও তরবারি আমার, আমি বহু যত্নে, বহুব্যয়ে মণিমুক্তা সংযোগে সুসজ্জিত করিয়াছি।”
কাসেম বলিলেন, “বেশ করিয়াছ!-তাহাতে দুঃখ কী? তোমার মণিমুক্তাসজ্জিত তরবারি দ্বারা তোমারই চারি পুত্র বিনাশ করিয়াছি। নিশ্চয় বলিতেছি, তুমিও এই মূল্যবান তরবারি আঘাত হইতে বঞ্চিত হইবে না। নিশ্চয় জানিয়ো, অন্য তরবারিতে, অন্যের হস্তে তোমার মস্তক বিচ্ছিন্ন হইবে না! আপেক্ষা করিয়ো না। তোমার এই মহামূল্য অসি তোমার জীবন বিনাশের নির্ধারিত অস্ত্র মনে করিয়ো।”
বর্জক মহাক্রোধে বর্শা ঘুরাইয়া বলিতে লাগিল, “কাসেম! তোমার বাক্চাতুরী এই মুহূর্তেই শেষ করিতেছি! তুমিও নিশ্চয় জানিয়ো, বর্জকের হস্ত হইতে আজ তোমার রক্ষা নাই।” এই বলিয়া সজোরে বর্শা আঘাত করিল। কাসেম বর্মদ্বারা বর্শাঘাত ফিরাইয়া বর্জকের বক্ষ লক্ষ্য করিয়া বর্শা উত্তোলন করিতেই বর্জক লঘুহস্ততা-প্রভাবে কাসেমকে পুনরায় বর্শাঘাত করিলেন। বীরবর-কাসেম বিশেষ চতুরতার সহিত বর্জকের বর্শা ফিরাইয়া আপন বর্শার দ্বারা বর্জককে আঘাত করিলেন। তরবারি ঘাত-প্রতিঘাতে উভয়ের বর্ম হইতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নির্গত হইতে লাগিল। কাসেমকে ধন্যবাদ দিয়া বর্জক বলিতে লাগিল, “কাসেম্! আমি রুম, শাম, মিশর, আরব, আর-আর বহু দেশে বহু যোদ্ধার তরবারিযুদ্ধ দেখিয়াছি, কিন্তু তোমার ন্যায় তরবারিধারী বীর কুত্রাপি কখনোই আমার নয়নগোচর হয় নাই। ধন্য তোমার বাহুবল! তোমার শিক্ষাকৌশল! যাহা হউক, কাসেম! এই আমার শেষ আঘাত। হয় তোমার জীবন, না হয় আমার জীবন।” এই শেষ কথা বলিয়া বর্জক কাসেমের শির লক্ষ্য করিয়া তরবারি আঘাত করিলেন। কাসেম সে আঘাত তাচ্ছিল্যভাবে বর্মে উড়াইয়া দিয়া বর্জক সরিতে সরিতেই তাহার গ্রীবাদেশে অসি-প্রহার করিলেন। বীরবর কাসেমের আঘাত বর্জকের শির রণক্ষেত্রে গড়াইয়া পড়িল। এই ভয়াবহ ঘটনা দৃষ্টে এজিদের সৈন্যমধ্যে মহা হুলস্থূল পড়িয়া গেল।
বর্জকের নিপাত দর্শনে এজিদের সৈন্যমধ্যে কেহই আর সমরাঙ্গণে আসিতে সাহসী হইল না। কাসেম অনেকক্ষণ পর্যন্ত অপেক্ষা করিয়া, বিপদিগকে দেখিতে না পাইয়া একেবারে ফোরাত-তীরে উপস্থিত হইলেন। নদী রক্ষকেরা কাসেমের অশ্বপদধ্বনিশ্রবণে মহাব্যতিব্যস্ত হইয়া মহাশঙ্কিত হইল। কাসেম কাহাকেও কিছু বলিলেন না। তরবারি, তীর, নেজা, বল্লম, যাহা দ্বারা যাহাকে মারিতে সুবিধা পাইলেন, তাহার দ্বারা তাহাকে ধরাশায়ী করিয়া ফোরাতকূল উদ্ধারের উপক্রম করিলেন। ওমর, সীমার ও আবদুল্লাহ্ প্রভৃতিরা দেখিল, নদীকূল-রীরা কাসেমের অস্ত্র-সম্মুখে কেহই টিকিতেছে না। ইহারা কয়েকজনে একত্র হইয়া সমরপ্রাঙ্গণের সমুদয় সৈন্যসহ কাসেমকে পশ্চাদ্দিক হইতে ঘিরিয়া শর নিক্ষেপ করিতে লাগিল। অনবরত তীর কাসেমের অঙ্গে আসিয়া বিদ্ধ হইতেছে; কাসেমের সে দিকে দৃকপাত নাই; কেবল ফোরাতকূল উদ্ধার করিবেন, এই আশয়েই সম্মুখস্থ শত্রুগণকে সংহার করিতেছেন। কাসেমের শ্বেতবর্ণ অশ্ব তীরাঘাতে রক্তধারায় লোহিতবর্ণ হইয়াছে! শোণিতধারা অশ্বপদ বহিয়া মৃত্তিকা রঞ্জিত করিতেছে। ক্রমেই কাসেম নিস্তেজ হইতেছেন;-শোণিত প্রবাহে চতুর্দিকেই অন্ধকার দেখিতেছেন। শেষে নিরুপায় হইয়া অশ্ববল্গা ছাড়িয়া দিলেন। শিক্ষিত অশ্ব কাসেমের শরীরের অবসন্নতা বুঝিতে পারিয়া দ্রুতপদে শিবির সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল, হাসনেবানু ও সখিনা, শিবির মধ্য হইতে অশ্বপদধ্বনি শুনিতে পাইয়া, বাহিরে আসিয়া দেখিলেন, কাসেমের পরিহিত শুভ্রবসন লোহিতবর্ণে রঞ্জিত হইয়াছে, শোণিতধারা অশ্বপদ বহিয়া পড়িতেছে। কাসেম অশ্ব হইতে নামিয়া সখিনাকে বলিলেন, “সখিনা! দেখ তোমার স্বামীর সাহানা (লাল পোশাক।) পোশাক দেখ! আজ বিবাহ সময়ে উপযুক্ত পরিচ্ছদে তোমায় বিবাহ করি নাই, কাসেমের দেহবিনির্গত শোণিতধারা শুভ্রবসন লোহিতবর্ণে পরিণত হইয়া বিবাহবেশ সম্পূর্ণ করিয়াছে। এই বেশ তোমাকে দেখাইবার জন্যই বহুকষ্টে শত্রুদল ভেদ করিয়া এখানে আসিয়াছি। আইস, এই বেশে তোমাকে একবার আলিঙ্গন করিয়া প্রাণ শীতল করি। সখিনা! আইস, এই বেশেই আমার মানসের চিরপিপাসা নিবারণ করি।”
কাসেম এই কথা বলিয়াই সখিনাকে আলিঙ্গন করিবার নিমিত্ত হস্ত প্রসারণ করিলেন। সখিনাও অগ্রবর্তিনী হইয়া স্বামীকে আলিঙ্গন করিলেন। কাসেমের দেহ-বিনির্গত শোণিত-প্রবাহে সখিনার পরিহিত বস্ত্র রক্তবর্ণ হইল। কাসেম সখিনার গলদেশে বাহু বেষ্টন করিয়া দণ্ডায়মান রহিলেন, নিজ বশে আর দাঁড়াইবার শক্তি নাই। শরাঘাতে সমুদয় অঙ্গ জর জর হইয়া সহস্র পথে শোণিতধারা শরীর বহিয়া মৃত্তিকায় পড়িতেছে। সজ্জিত মস্তক ক্রমশঃই সখিনার স্কন্ধদেশে নত হইয়া আসিতে লাগিল। সখিনার বিষাদিত বদন নিরীক্ষণ করা কাসেমের অসহ্য হইল বলিয়াই যেন চক্ষু দুটি নীলিমাবর্ণ ধারণ করিয়া ক্রমেই বন্ধ হইয়া আসিতে লাগিল। সে সময়ও কাসেম বলিলেন, “সখিনা! নব অনুরাগে পরিণয়সূত্রে তোমার প্রণয়-পুষ্পহার কাসেম আজ গলায় পরিয়াছিল; বিধাতা আজই সে হার ছিন্ন করিয়া ফেলিলেন। জগতে তোমাকে ছাড়িয়া যাইতেছি; দৈহিক সম্বন্ধগ্রন্থি ছিঁড়িয়া গেল, কিন্তু সখিনা! সে জন্য তুমি ভাবিয়ো না;-কেয়ামতে অবশ্যই দেখা হইবে। সখিনা! নিশ্চয় জানিয়ো ইহা আর কিছুই নহে, কেবল অগ্রপশ্চাৎ মাত্র। ঐ দেখ, পিতা আমার অমরপুরীর সুবাসিত শীতলজল-পরিপূরিত মণিময় সুরাহী হস্তে আমার পিপাসা শান্তির জন্য দাঁড়াইয়া আছেন। আমি চলিলাম।”
কাসেমের চক্ষু কেবারে বন্ধ হইল!-প্রাণবিহঙ্গ দেহপিঞ্জর হইতে অনন্ত আকাশে উড়িয়া হাসানের নিকট চলিয়া গেল। শূন্যদেহ সখিনার দেহযষ্টি হইতে স্খলিত হইয়া ধরাতলে পতিত হইল। পুরবাসীরা সকলেই কাসেমের মৃতদেহ স্পর্শ করিয়া উচ্চৈঃস্বরে রোদন করিতে লাগিলেন।
সখিনা স্বামীর মৃতদেহ অঙ্গে ধারণ করিয়া করুণস্বরে বলিতে লাগিলেন, “কাসেম! একবার চাহিয়া দেখ, তোমার সখিনা এখনো সেই বিবাহ-বেশ পরিয়া রহিয়াছে! কেশগুচ্ছ যে ভাবে দেখিয়াছিলে, এখনো সেইভাবে রহিয়াছে। তাহার এক গাছিও স্থানভ্রষ্ট হয় নাই। লোহিতবসন পরিধান করিয়া বিবাহ হয় নাই; প্রাণেশ্বর! তাই আপন শরীরের রক্তভারে সেই বসন রঞ্জিত করিয়া দেখাইলে! আমি আর কী করিব? জীবিতেশ! জগতে সখিনা বাঁচিয়া থাকিতে তোমার দেহ-বিনির্গত শোণিতবিন্দু মৃত্তিকা-সংলগ্ন হইতে দিবে না!” এই বলিয়া কাসেমের দেহবিনির্গত শোণিতবিন্দু সখিনা সমুদয় অঙ্গে মাখিতে লাগিলেন। মাখিতে মাখিতে কহিতে লাগিলেন, “বিবাহ সময়ে এই হস্তদ্বয় মেহেদি দ্বারা সুরঞ্জিত হয় নাই,-একবার চাহিয়া দেখ!-কাসেম! একবার চাহিয়া দেখ! তোমার সখিনার হস্ত তোমারই রক্তধারে কেমন শোভিত হইয়াছে। জীবিতেশ্বর! তোমার এ পবিত্র রক্ত মাখিয়া সখিনা চিরজীবন এই বেশেই থাকিবে! যুদ্ধজয়ী হইয়া আজ বাসরশয্যায় শয়ন করিবে বলিয়াছিলে, সে সময় তো প্রায় আগত;-তবে ধূলিশয্যায় শয়ন কেন হৃদয়েশ?-বিধাতা, আজই সংসার-ধর্মের মুখ দেখাইলে, আজই সংসারী করিলে, আবার আজই সমস্ত সুখ মিটাইলে!-দিন এখনো রহিয়াছে। সে দিন অবসান না-হইতেই সখিনার এই দশা করিলে! যে সূর্য সখিনার বিবাহ দেখিল, সেই সূর্যই সখিনার বৈধব্য দশা দেখিয়া চলিল! সূর্যদেব! যাও, সখিনার দুর্দশা দেখিয়া যাও। সৃষ্টিকাল হইতে আজ পর্যন্ত প্রতিদিন তুমি কত ঘটনা, কত কার্য কত সুখ, কত দুঃখ দেখিয়াছ, কিন্তু দিনকর! এমন হরিষে বিষাদ কখনো কি দর্শন করিয়াছ? সখিনার তুল্য দুঃখিনী কখনো কি তোমার চক্ষে পড়িয়াছে? যাও সূর্যদেব! সখিনার সদ্যবৈধব্য দেখিয়া যাও।”
সখিনা এইরূপ নানাপ্রকার বিলাপ করিতে করিতে অস্থির হইয়া পড়িলেন। কাসেমের অবস্থা দর্শনে হোসেন একেবারে অচৈতন্য হইয়া পড়িয়াছিলেন, কিঞ্চিৎ পরে সংজ্ঞা পাইয়া বলিতে লাগিলেন, “কাসেম! তুমি আমার কুলপ্রদীপ, তুমি আমার বংশের উজ্জ্বল মণি, তুমিই আমার মদিনার ভাবী রাজা,-আমি অভাবে তোমার শিরেই রাজমুকুট শোভা পাইত। বৎস! তোমার বীরত্বে,-তোমার অস্ত্র-প্রভাবে মদিনাবাসীরা সকলেই বিমুগ্ধ। আরবের মহা মহা যোদ্ধাগণ তোমার নিকট পরাস্ত; তুমি আজ কাহার ভয়ে রণক্ষেত্র হইতে ফিরিয়া আসিয়া, লোহিতবসনে নিস্পন্দভাবে ধরাশায়ী হইয়া রহিলে! প্রাণাধিক!-বীরেন্দ্র! ঐ শুন, শত্রুদল মহানন্দে রণবাদ্য বাজাইতেছে। তুমি সমরাঙ্গণ হইতে ফিরিয়া আসিয়াছ বলিয়া তোমাকে তাহারা ধিক্কার দিতেছে। কাসেম, গাত্রোত্থান কর-তরবারি ধারণ কর। ঐ দেখ, তোমার প্রিয় অশ্ব ক্ষতবিক্ষত শরীরে, শোণিতাক্ত কলেবরে তোমাকে ধরাশায়ী দেখিয়া অবিশ্রান্ত অশ্রুবর্ষণ করিতেছে! শরাঘাতে তাহার শ্বেতকান্তি পরিবর্তিত হইয়া শোণিতধারায় লোহিতবর্ণ ধারণ করিয়াছে। তথাপি রণক্ষেত্রে যাইবার জন্য উৎসাহের সহিত তোমারই দিকে চাহিয়া রহিয়াছে, সম্মুখস্থ পদদ্বারা মৃত্তিকা উৎপ্তি করিতেছে। কাসেম! একবার চক্ষু মেলিয়া দেখ, তোমার প্রিয়তম অশ্বের অবস্থা একবার চাহিয়া দেখ! কাসেম! আজি আমি তোমার বিবাহ দিয়াছি। যাহার সঙ্গে কোন দিন কোন সম্বন্ধ ছিল না, পরিচয় ছিল না, প্রণয় ছিল না, এমন কোন কন্যা আনিয়া তোমাকে সমর্পণ করি নাই, আমার হৃদয়ের ধনকেই তোমার হস্তে দিয়াছি। তোমারই পিতৃ-আদেশে সখিনাকে তোমার হস্তে সমর্পণ করিয়াছি।”
হাসানকে উদ্দেশ করিয়া হোসেন অতি কাতরস্বরে বলিতে লাগিলেন, “ভ্রাতঃ! জগৎ পরিত্যাগের দিন ভাল উপদেশ দিয়া গিয়াছিলেন! যেদিন বিবাহ সেই দিনই সর্বনাশ! যদি ইহাই জানিয়াছিলে, যদি সখিনার অদৃষ্টলিপির মর্ম বুঝিতে পারিয়াছিলে, তবে কাসেমের সঙ্গে সখিনার বিবাহের উপদেশ কেন দিয়াছিলে ভাই! তুমি তো স্বর্গসুখে রহিয়াছ, এ সর্বনাশ একবার চক্ষে দেখিলে না!-এই অসহনীয় যন্ত্রণা ভোগ করিতে হইবে বলিয়াই কি অগ্রে চলিয়া গেলে? ভাই! মৃত্যুসময়ে তোমার যত্নের রত্ন, হৃদয়ের অমূল্য মণি কাসেমকে আমার হাতে হাতে দিয়া গিয়াছিলে, আমি এমনি হতভাগ্য যে, সেই অমূল্য নিধিটি রক্ষা করিতে পারিলাম না। আর কি বলিব! তোমার প্রাণাধিক পুত্র কাসেম একবিন্দু জলের প্রত্যাশায় শত্রুহস্তে প্রাণ হারাইল। কাসেম বিন্দুমাত্র জল পাইলে এজিদের সৈন্যের নাম মাত্র অবশিষ্ট থাকিত না, দেহসমষ্টি শোণিতপ্রবাহের সহিত ফোরাত প্রবাহে ভাসিয়া কোথায় চলিয়া যাইত, তাহার সন্ধানও মিলিত না। আর সহ্য হয় না। সখিনার মুখের দিকে আর চাহিতেই পারি না। কই আমার অস্ত্র শস্ত্র কোথায়? কাসেমের শোকাগ্নি আজ শত্রুশোণিতে পরিণত হউক। সখিনার বৈধব্যসূচক চিরশুভ্র-বসন শত্রুশোণিতে রঞ্জিত করিয়া চিরকাল সধবার চিহ্নে রাখিব!-কই আমার বর্ম কোথায়? কই আমার শিরস্ত্রাণ কোথায়? (জোরে উঠিয়া) কই আমার অশ্ব কোথায়? এখনি অন্তর জ্বালা নিবারণ করি!-শত্রুবধ করিয়া কাসেমের শোক ভুলিয়া যাই!” পাগলের মত এই সকল কথা বলিয়া হোসেন যুদ্ধসজ্জায় সজ্জিত হইতে চলিলেন।
হোসেন পুত্র আলী আকবর করজোড়ে বলিতে লাগিলেন, “পিতঃ! এখনো আমরা চারি ভ্রাতা বর্তমান! যদিও শিশু, তথাপি মরণে ভয় করি না। আমরা বর্তমান থাকিতে, আপনি অস্ত্র ধারণ করিবেন? বাঁচিবার আশা তো একরূপ শেষ হইয়াছে; পিপাসায় আত্মীয় স্বজনের শোকাগ্নি-উত্তাপে জিহ্বা, কণ্ঠ, বক্ষ, উদর সকলই তো শুষ্ক হইয়াছে; এরূপ অবস্থায় আর কয়দিন বাঁচিব? নিশ্চয়ই মরিতে হইবে। বীরপুরুষের ন্যায় মরাই শ্রেয়ঃ। স্ত্রীলোকের ন্যায় কাঁদিয়া মরিব না।” এই কথা বলিয়া পিতৃচরণে প্রণাম করিয়া আলী আকবর অশ্বে আরোহণ করিলেন। যুদ্ধক্ষেত্রে যাইয়া দ্বৈরথ যুদ্ধে কাহাকেও আহ্বান না করিয়া একেবারে ফোরাতকূল রক্ষকদিগের প্রতি অস্ত্রবর্ষণ করিতে লাগিলেন। রক্ষীরা ফোরাতকূল ছাড়িয়া পলাইতে আরম্ভ করিল। এজিদের সৈন্যে মহা হুলস্থূল পড়িয়া গেল। আলী আকবর যেমন বলবান তেমনি রূপবান ছিলেন। তাঁহার সুদৃশ্য রূপলাবণ্যের প্রতি যাহার চক্ষু পড়িল, তাহার হস্ত আর আলী আকবরের প্রতি আঘাত করিতে উঠিল না! যে দেখিল, সেই আকবরের রূপে মোহিত হইয়া তৎপ্রতি অস্ত্রচালনায় বিরত হইল। অস্ত্রচালনা দূরে থাকুক, পিপাসায় আক্রান্ত, শীঘ্রই মৃত্যু হইবে, এই ভাবিয়াই অনেক বিধর্মী দুঃখ করিতে লাগিল! আলী আকবর বীরত্বের সহিত নদীকূলরীদিগকে তাড়াইয়া অশ্বপৃষ্ঠে থাকিয়াই ভাবিতেছেন, কি করি। সমুদয় শত্রু শেষ করিতে পারিলাম না। যাহারা পলাইতে অবসর পাইল না তাহারাই সম্মুখে দাঁড়াইল। ঐশ্বরী মায়ায় তাহাদের পরমায়ুও শেষ হইল। কিন্তু অধিকাংশ রক্ষীরাই প্রাণভয়ে নদীকূল ছাড়িয়া জঙ্গলে পলাইল। আমি এখন কী করি!
ঈশ্বরের মায়া বুঝিতে মানুষের সাধ্যমাত্র নাই। আবদুল্লাহ্ জেয়াদ তাহার লক্ষাধিক সৈন্য লইয়া সেই সময়েই ফোরাত-তীরে আসিয়া আলী আকবরকে ঘিরিয়া ফেলিল! তুমুল যুদ্ধ আরম্ভ হইল! জেয়াদের সৈন্য আলী আকবরের তরবারির সম্মুখে শ্রেণীবদ্ধরূপে পড়িয়া যাইতে লাগিল। এ পর্যন্ত আলী আকবরের অঙ্গে শত্রুপক্ষেরা কোন অস্ত্র নিক্ষেপ করিতে পারে নাই; কিন্তু আলী আকবর সাধ্যানুসারে বিধর্মী মস্তক নিপাত করিয়াও শেষ করিতে পারিলেন না। যাহারা পলাইয়াছিল, তাহারাও জেয়াদের সৈন্যের সহিত যোগ দিয়া আলী আকবরের বিরুদ্ধে দাঁড়াইল। আকবর সৈন্যচক্র ভেদ করিয়া দ্রুতগতিতে শিবিরে আসিলেন। পিতার সম্মুখীন হইয়া বলিতে লাগিলেন, “ফোরাতকূল উদ্ধার হইতে ইতে কিন্তু কুফা হইতে আবদুল্লাহ্ জেয়াদ লক্ষাধিক সৈন্য লইয়া এজিদের সৈন্যের সাহায্যার্থে পুনরায় নদীতীর বন্ধ করিয়া দাঁড়াইয়াছে। যে উপায়ে হয়, আমাকে একপাত্র জল দিন, আমি এখনই জেয়াদকে সৈন্যসহ শমনভবনে প্রেরণ করিয়া আসি। এই দেখুন আমার তরবারি কাফের-শোণিতে রঞ্জিত হইয়াছে। ঈশ্বরকৃপায় এবং আপনার আশীর্বাদে আমার অঙ্গে কেহ এ পর্যন্ত একটিও আঘাত করিতে পারে নাই। কিন্তু পিপাসায় প্রাণ যায়।”
হোসেন বলিলেন, “আকবর! আজ দশ দিন কেবল চক্ষের জল ব্যতীত এক বিন্দু জল চক্ষে দেখি নাই। সেই চক্ষের জলও শুষ্ক হইয়া গিয়াছে। জল কোথায় পাইব বাপ?”
আলী আকবর বলিলেন, “আমার প্রাণ যায়, আর বাঁচি না।” এই বলিয়া পিপাসার্ত আলী আকবর ভূমিতলে শয়ন করিলেন। হোসেন বলিতে লাগিলেন, “হে ঈশ্বর! জীবনে মানবজীবন রক্ষা হইবে বলিয়া জলের নাম তুমি জীবন দিয়াছ! জগদীশ্বর! সেই জীবন আজ দুর্লভ! জগজ্জীবন! সেই জীবনের জন্য আজ মানবজীবন লালায়িত। কার কাছে জীবন ভিক্ষা করি দয়াময়?-আশুতোষ! তোমার জগজ্জীবন নামের কৃপায় শিশু কেন বঞ্চিত হইবে জগদীশ?-করুণাময়! তুমি জগৎ সৃষ্টি করিয়াছ। ভূগোল বলে, স্থলভাগের অপেক্ষা জলের ভাগই অধিক। আমরা এমনি পাপী যে, জগতের অধিকাংশ পরিমাণ যে জল, যাহা পশুপীরাও অনায়াসে লাভ করিতেছে, তাহা হইতেও আমরা বঞ্চিত হইলাম! ষষ্টি সহস্র লোকের প্রাণ বোধ হয়, এ জলের জন্যই বিনাশ হইল! মায়াময়! সকলই তোমার মায়া।”
আলী আকবরের নিকট যাইয়া হোসেন বলিলেন, “আকবর! তুমি আমার এই জিহ্বা আপন মুখের মধ্যে দিয়া একটু শান্তিলাভ কর। জিহ্বাতে রস আছে, উহাতে যদি তোমার পিপাসার কিছু শান্তি হয়, দেখ!-বাপ! অন্য জলের আশা আর করিয়ো না।”
আলী আকবর পিতার জিহ্বা মুখের মধ্যে রাখিয়া কিঞ্চিৎ পরেই বলিলেন, “প্রাণ শীতল হইল। পিপাসা দূর হইল। ঈশ্বরের নাম করিয়া আবার চলিলাম।”
এই বলিয়াই আলী আকবর পুনরায় অশ্বে আরোহণপূর্বক সমরক্ষেত্রে উপস্থিত হইয়া যুদ্ধ আরম্ভ করিলেন। অতি অল্প সময় মধ্যেই বহুশত্রু নিপাত করিয়া ফেলিলেন। এদ্দর্শনে জেয়াদ্ এবং ওমর প্রভৃতি পরামর্শ করিল যে, “আলী আকবর আর ক্ষণকাল এইরূপ যুদ্ধ করিলেই আমাদিগকে এক প্রকার শেষ করিবে। আলী আকবরকে যে গতিকেই হউক, বিনাশ করিতে হইবে। সম্মুখযুদ্ধে আকবরের নিকটে অগ্রসর হইয়া কেহই জয়লাভ করিতে পারিবে না। দূর হইতে গুপ্তভাবে আমরা কয়েকজন উহাকে লক্ষ্য করিয়া বিষাক্ত শর সন্ধান করিতে থাকি, অবশ্যই কাহারো শর আকবরের বক্ষ ভেদ করিবেই করিবে।” এই বলিয়াই প্রধান প্রধান সৈন্যাধ্যক্ষেরা বহুদূর হইতে শরনিক্ষেপ করিতে লাগিল। আলী আকবর কাফেরবধে একেবারে জ্ঞানশূন্য হইয়া মাতিয়া গিয়াছেন। শরসন্ধানীরা শর নিক্ষেপ করিতেছে। একটি বিষাক্ত শর আলী আকবরের বক্ষ ভেদ করিয়া পৃষ্ঠদেশ পার হইয়া গেল। আলী আকবর সমুদয় জগৎ অন্ধকার দেখিতে লাগিলেন। পিপাসাও অধিকতর বৃদ্ধি হইল। জলের জন্য কাতরস্বরে বারবার পিতাকে ডাকিতে লাগিলেন। সম্মুখে দেখিতে পাইলেন যেন, তাঁহার পিতৃব্য জলপাত্র হস্তে করিয়া বলিতেছেন, “আকবর! শীঘ্রই আইস! আমি তোমার জন্য সুশীতল পবিত্রবারি লইয়া দণ্ডায়মান আছি।” আলী আকবর জলপান করিতে যাইতেছিলেন; পিপাসায় তাঁহার কণ্ঠ শুষ্ক হইতেছিল; কিন্তু ততদূর পর্যন্ত যাইতে হইল না, জলপিপাসা শান্তি করিতেও হইল না, জন্মের মত জীবন-পিপাসা ফুরাইয়া গেল। আলী আকবর অশ্ব হইতে পতিত হইলেন। প্রাণবায়ু বহির্গত-শূন্যপৃষ্ঠ অশ্ব শিবিরাভিমুখে দৌড়িল। অশ্বপৃষ্ঠ শূন্য দেখিয়া, আলী আকবরের ভ্রাতা আলী আসগর এবং আবদুল্লাহ্ ভ্রাতৃশোকে শোকাকুল।-তিলার্ধকালও বিলম্ব না করিয়া, জিজ্ঞাসা কি অনুমতি অপেক্ষা না রাখিয়া তাঁহারা দুই ভ্রাতা দুই অশ্বরোহণে শত্রু সম্মুখীন হইলেন। ক্ষণকাল মহাপরাক্রমে বহুশত্রু বিনাশ করিয়া রণস্থলে বিধর্মীহস্তে শহীদ্ হইলেন। যুগল অশ্ব শূন্যপৃষ্ঠে শিবিরাভিমুখে ছুটিল। অশ্বপৃষ্ঠে পুত্রদ্বয়কে না দেখিয়া, হোসেন আহত সিংহের ন্যায় গর্জিয়া উঠিলেন। বলিলেন, “এখনো কী আমি বসিয়া থাকিব? এ সময়ও কী শত্রুনিপাতে অস্ত্রধারণ করিব না? পুত্র, ভ্রাতৃষ্পুত্র সকলেই শেষ হইয়াছে, আমি কেবল বসিয়া দেখিতেছি; আমার মত কঠিন প্রাণ জগতে কি আর কাহারো আছে?”
হোসেনের কনিষ্ঠ সন্তান জয়নাল আবেদীন ভ্রাতৃশোকে কাতর হইয়া কাঁদিতে কাঁদিতে শিবির হইতে দৌড়িয়া বাহির হইলেন। হোসেন পশ্চাৎ পশ্চাৎ দৌড়িয়া গিয়া তাহাকে ধরিয়া আনিলেন, অনেক প্রবোধ দিয়া বুঝাইতে লাগিলেন। মুখে শত শত চুম্বন করিয়া ক্রোড়ে লইয়া সাহারবানুর নিকট আসিয়া বলিলেন, “জয়নাল যদি শত্রুহস্তে প্রাণত্যাগ করে, তবে মাতামহের বংশ জগৎ হইতে একেবারে নির্মূল হইবে, সৈয়দবংশের নাম আর ইহজগতে থাকিবে না। কেয়ামতের দিন পিতা এবং মাতামহের নিকট কী উত্তর করিব? তোমরা জয়নালকে সাবধানে রক্ষা কর; সর্বদাই চক্ষে চক্ষে রাখ। কোন ক্রমেই ইহাকে শিবিরের বাহির হইতে দিয়ো না।”
হোসেন কাহারো জন্য আর দুঃখ করিলেন না। ঈশ্বরের উদ্দেশে আকাশ পানে তাকাইয়া দুই হস্ত তুলিয়া বলিতে লাগিলেন, “দয়াময়! তুমি অগতির গতি, তুমি সর্ব-শক্তিমান, তুমি বিপদের কাণ্ডারী, তুমি অনুগ্রাহক, তুমিই সর্বরক্ষক। প্রভো! তোমার মহিমায় অনন্ত জগতের সৃষ্টি হইয়াছে। দানব, মানব, পশু, পক্ষী, কীট, পতঙ্গ, তরু, তৃণ, কীটাণু এবং পরমাণু পর্যন্ত স্থাবর জঙ্গম সমস্ত চরাচর তোমার গুণগান করিতেছে। তুমি মহান্, তুমি সর্বত্রব্যাপী, তুমিই স্রষ্টা, তুমিই সর্বকর্তা, তুমি সর্বপালক, তুমিই সর্বসংহারক। দয়াময়! জগতে যে দিকেই নেত্রপাত করি সেই দিকেই তোমার করুণা এবং দয়ার আদর্শ দেখিতে পাই। কি কারণে-কি অপরাধে আমার এ দুর্দশা হইল, বুঝিতে পারি না। বিধর্মী এজিদ্ আমার সর্বনাশ করিয়া একেবারে নিঃশেষ করিল, একেবারে বংশনাশ করিল! দয়াময়! তুমি কি ইহার বিচার করিবে না?”
হোসেন শূন্যপথে যাহা দেখিলেন তাহাতে অমনি চুবন্ধ করিয়া ফেলিলেন-আর কোন কথাই কহিলেন না। ঈশ্বরের উদ্দেশে সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করিয়া কৃতজ্ঞতার সহিত উপাসনা করিলেন। উপাসনা শেষ করিয়া সমরসজ্জায় প্রবৃত্ত হইলেন।
মণিময় হীরকখচিত স্বর্ণমণ্ডিত বহুমূল্য সুসজ্জায় সে সজ্জা নহে! হোসেন যে সাজ আজ অঙ্গে ধারণ করিলেন, তাহা পবিত্র ও অমূল্য! যাহা ঈশ্বর প্রসাদাৎ হস্তগত না হইলে জগতের সমুদয় ধনেও হস্তগত হইবার উপায় নাই, জীবনান্ত পর্যন্ত চেষ্টা বা যত্ন করিলেও যে সকল অমূল্য পবিত্র পরিচ্ছদ লাভে কাহারো ক্ষমতা নাই, হোসেন আজ সেই সকল বসন ভূষণ পরিধান করিলেন। প্রভু মোহাম্মদের শিরস্ত্রাণ, হজরত আলীর কবচ; হজরত দাউদ পয়গম্বরের কোমরবন্ধ, মহাত্মা সোয়েব পয়গম্বরের মোজা, এই সকল পবিত্র পরিচ্ছদ অঙ্গে ধারণ করিয়া যুদ্ধের আর আর উপকরণে সজ্জিত হইলেন। রণবেশে সুসজ্জিত হইয়া ইমাম হোসেন শিবিরের বাহিরে দাঁড়াইলে স্ত্রী, কন্যা, পরিজন সকলই নির্বাকে কাঁদিয়া তাঁহার পদলুণ্ঠিত হইতে লাগিলেন। উচ্চরবে কাঁদিবার কাহারো শক্তি নাই। কত কাঁদিতেছেন, কত দুঃখ করিতেছেন, এক্ষণে প্রায় সকলেরই কণ্ঠস্বর বন্ধ হইয়া যাইতেছে। ইমাম হোসেন সকলকেই সবিনয় মিষ্টবাক্যে একটু আশ্বস্ত করিয়া বলিতে লাগিলেন, পরিজনেরা ইমামের সম্মুখে দাঁড়াইয়া শুনিতে লাগিলেন। হোসেন বলিলেন, “মদিনা পরিত্যাগ করিয়া কুফায় আগমন সঙ্কল্প তোমাদের অজানা কিছুই নাই। তোমরা আমার শরীরের এক-এক অংশ। তোমাদের দুঃখ দেখিয়া আমার প্রাণ এতক্ষণ যে কেন আছে, তাহা আমি জানি না।”
সকলে সেই এক প্রকার অব্যক্ত হু-হু স্বরে কাঁদিয়া উঠিলেন। ইমাম পুনর্বার বলিতে লাগিলেন, “ইহাতে নিশ্চয় বোধ হইতেছে, যে ঈশ্বরের কোন আজ্ঞা আমার দ্বারা সাধিত হইবে, মাতামহের ভবিষ্যৎবাণী সফল হইবে! আমি ঈশ্বরের দাস, ঈশ্বরের নিয়োজিত কার্যে আমি বাধ্য। সেই কার্য সাধনে আমি সন্তোষের সহিত সম্মত। মানুষ জন্মিলেই মরণ আছে, তবে সেই দয়াময় কি অবস্থায় কখন কাহাকে কালের করাল গ্রাসে প্রেরণ করেন তাহা তিনিই জানেন। ইহাও সত্য যে, এজিদের আদেশক্রমে তাঁহার সৈন্যগণ আমাদের পিপাসাশান্তির আশাপথ একেবারে বন্ধ করিয়াছে। জীবনে বিহনে জীবনশক্তি কয়দিন জীবনে থাকে? জীবনই মানুষের একমাত্র জীবন। এই অবস্থাতে শিবিরে বসিয়া কাঁদিলে আর কি হইবে?-পুত্রগণ, মিত্রগণ এবং অন্যান্য হৃদয়ের বন্ধুগণ, যাঁহারা আজ প্রভাত হইতে এই সময়ের মধ্যে বিধর্মীহস্তে সহিদ হইয়াছেন, তাঁহাদের জন্য নীরবে বসিয়া কাঁদিলে আর কি হইবে? আজ না হয় কাল এই পিপাসাতেই মরিতে হইবে।”
আবার সকলে নীরবে হু-হু শব্দে কাঁদিতে লাগিলেন। ইমাম আবার বলিতে লাগিলেন, “যদি নিশ্চয়ই মরিতে হইল, তবে বীরপুরুষের ন্যায় মরিব। আমি হজরত আলীর পুত্র মহাবীর হাসানের ভ্রাতা; আমি কি স্ত্রীলোকের সঙ্গী হইয়া কাঁদিতে কাঁদিতে মরিব?-তাহা কখনই হইবে না। পুত্রমিত্রগণের অকালমৃত্যুজনিত শোকের যাতনা শত্রু-বিনাশে নিবারণ করিয়া প্রাণত্যাগ করিব। আজ কারবালা প্রান্তরে মহানদী,-মহানদী কেন-ঐ শোকে মহাসমুদ্রস্রোতে মহারক্তস্রোত বহাইয়া প্রাণত্যাগ করিব। জগৎ দেখিবে, বৃক্ষপত্র দেখিবে, আকাশ দেখিবে, আকাশের চন্দ্র সূর্য দেখিবে, হোসেনের ধৈর্য, শান্তি ও বীর-প্রতাপ কতদূর!-আজি এই সূর্যকেই আদি মধ্য শেষ,-তাহার পরেও যদি কিছু থাকে, তাহাও দেখাইব। তোমরা আমার জন্য কেহ কাঁদিয়ো না। যদি এই যাত্রাই এ জীবনের শেষ যাত্রা হয়, বার বার বলিতেছি, আর যুদ্ধ করিও না। আর কোন প্রাণীকেও যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠাইও না, জয়নালকে মুহূর্তের জন্য হাতছাড়া করিয়ো না। আমি তোমাদিগকে সেই দয়াময় বিপত্তারণ জগৎকারণ জগদীশ্বরের চরণে সমর্পণ করিলাম,-তিনি রক্ষা করিবেন। আমি প্রার্থনা করিতেছি, তোমরাও কায়মনে সেই জগৎপিতার সমীপে প্রার্থনা কর, শত্রু বিনাশ করিয়া তোমাদিগকে যেন উদ্ধার করিতে পারি।”
পৌরজনমাত্রেই দুই হাত তুলিয়া ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা করিতে লাগিলেন, “হে করুণাময়! হে অনন্ত ব্রহ্মাণ্ডেশ্বর! আমাদিগকে আজ এই ঘোর বিপদ হইতে উদ্ধার কর। হে পরম কারুণিক পরমেশ্বর! আমাদিগকে দুরন্ত এজিদের দৌরাত্ম্য হইতে রা কর।” হোসেন বলিতে লাগিলেন, “যদি তোমাদের সঙ্গে আমার এই দেখাই শেষ দেখা হয়, তবে তোমরা কেহই আমার জন্য দুঃখ করিয়ো না-ঈশ্বরের নিন্দা করিয়ো না। আমার মরণই তোমাদের মঙ্গল। আমি মরিলে অবশ্যই তোমরা সুখী হইবে, আমি তোমাদের কষ্টের এবং দুঃখের কারণ ছিলাম!”
পরিজনগণকে এই পর্যন্ত বলিয়া জয়নালকে ক্রোড়ে লইয়া হোসেন বলিতে লাগিলেন, “আমি বিদায় হইলাম, আমার জন্য কাঁদিয়ো না। কেয়ামতে আমার সঙ্গে অবশ্যই দেখা হইবে। তুমিও তোমার মায়ের নিকট থাকিয়ো; কখনোই শিবিরের বাহির হইও না, এজিদ্ তোমাদের কিছুই করিতে পারিবে না।”
জয়নালের মুখচুম্বনপূর্বক সাহারবানুর ক্রোড়ে দিয়া সখিনাকে সম্বোধনপূর্বক হোসেন বলিলেন, “মা! আমি এক্ষণে বিদায় হইলাম। কাসেমের সংবাদ আনিতে যাই। আর দুঃখ করিও না, ঈশ্বর তোমাদের দুঃখ দূর করিবেন। আর একটি বীর পুরুষ হানুফা নগরে এখনও বর্তমান আছেন। যদি কোন প্রকারে এই লোমহর্ষণ সংবাদ তাঁহার কর্ণগোচর হয়, প্রাণান্ত না হওয়া পর্যন্ত তিনি তোমাদের এই কষ্টের প্রতিশোধ লইতে কখনো পরামুঙ্খ হইবেন না;-কখনোই এজিদ্কে ছাড়িবেন না;-হয় তোমাদিগকে উদ্ধার করিবেন, নয় এজিদের হস্তে প্রাণত্যাগ করিবেন।”
সখিনাকে এইরূপে প্রবোধ প্রদানপূর্বক অবশেষে সাহারবানুর হস্ত ধরিয়া রণবেশী রণযাত্রী পুনরায় বলিলেন, “বোধ হয় আমার সঙ্গে এই তোমার শেষ দেখা। সাহারবানু! মায়াময় সংসারের দশাই এইরূপ। তবে অগ্রপশ্চাৎ এইমাত্র প্রভেদ-ঈশ্বরে নির্ভর করিয়া জয়নালকে সাবধানে রাখিয়ো। আমার আর কোন কথা নাই-চলিলাম।”
শিবিরের বাহিরে আসিয়া ইমাম হোসেন অশ্বে আরোহণ করিলেন। ওদিকে শিবির মধ্যে পরিজনেরা একপ্রকার বিকৃতস্বরে হায় হায় রবে ধূলায় গড়াগড়ি যাইতে লাগিলেন।