প্রণয়, স্ত্রী, রাজ্য, ধন-এই কয়েকটি বিষয়ের লোভ বড় ভয়ানক। এই লোভে লোকের ধর্ম, পুণ্য, সাধুতা, পবিত্রতা সমস্তই একেবারে সমূলে বিনাশ প্রাপ্ত হয়। অতিকষ্টে উপার্জিত বন্ধুরত্নটাও ঐ লোভে অনেকেই অনায়াসে বিসর্জন দেয়। মানুষ ঐ লোভে অনায়াসেই যথেচ্ছ ব্যবহারে অগ্রসর হইতে পারে। এজিদ্ দামেস্কের রাজা, কুফা তাঁহার অধীন রাজ্য। হোসেনের সহিত আবদুল্লাহ্ জেয়াদের কেবলমাত্র বন্ধুত্বভাব সম্বন্ধ। উপরিউক্ত চারি প্রকার লোভের নিকট বন্ধুত্বভাব সর্বত্র অকৃত্রিমভাবে থাকা অসম্ভব। অধিকন্তু আবদুল্লাহ্ জেয়াদের নিকটে তাহার আশা করাও যাইতে পারে না। কারণ, আবদুল্লাহ্ জেয়াদ মূর্খ ও অর্থলোভী; মূর্খের প্রণয়ে বিশ্বাস নাই, কার্যেও বিশ্বাস নাই, লোভীও তদ্রূপ।
আবদুল্লাহ্ জেয়াদ সেই রাত্রিতেই দামেস্কের দূতকে বিদায় করিলেন। শয়নগৃহে শয্যার এক পার্শ্বে বসিয়া মনে মনে বলিতে লাগিলেন, “হোসেনের প্রণয়ে লাভ কী? শুধু মুখের প্রণয়ে কী হইতে পারে?”-এইরূপ অনেক আন্দোলন করিয়া নিদ্রাভিভূত হইলেন।
প্রধান অমাত্য, সভাসদ এবং রাজসংক্রান্ত কর্মচারিগণ কেহই এই নিগূঢ় তত্ত্বের কারণ কিছুই জানিতে পারিলেন না। কি উদ্দেশ্যে উহারা দামেস্ক হইতে আসিয়াছিল, এক দিবস অতীত না হইতেই কেনই-বা ফিরিয়া গেল, এই বিষয় লইয়া সকলে নানা প্রকার আন্দোলন করিতে লাগিলেন।
রজনী প্রভাত হইল। আবদুল্লাহ্ জেয়াদ্ রাজসিংহাসনে উপবেশন করিয়া সমুদয় সভাসদ্গণকে সম্বোধনপূর্বক বলিতে লাগিলেন, “গত রজনীতে আমি হজরত মোহাম্মদ মোস্তফাকে স্বপ্নে দেখিয়াছি। হস্তে কৃষ্ণবর্ণ আশা (যষ্টি), শিরে শুভ্রবর্ণ উষ্ণীষ, অঙ্গে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন শুভ্র পিরহান। আমার শিয়রে দণ্ডায়মান হইয়া তিনি বলিতে লাগিলেন, ‘আবদুল্লাহ্ জেয়াদ্! তোমাকে একটি কার্য করিতে হইবে।’ আমি স্বপ্নযোগে সেই পবিত্র পদ চুম্বন করিয়া জোড়হস্তে দণ্ডায়মান থাকিলাম। নূরনবী দুঃখিত স্বরে বলিতে লাগিলেন, ‘হোসেন ভ্রাতৃহীন হইয়া আমার সমাধিক্ষেত্রে পড়িয়া, নিঃসহায়রূপে দিবারাত্রি ক্রন্দন করিতেছে। তুমি তাহার পক্ষ অবলম্বন কর। তোমার সাধ্যানুসারে তাহার সহায়তা কর। সৈন্য-সামন্ত-ধন দ্বারা হোসেনের উপকার কর।’ এই কথা বলিয়াই পবিত্র মূর্তি অন্তর্হিত হইল। আমারও নিদ্রা ভাঙ্গিয়া গেল; স্বর্গীয় সৌরভে সমুদয় ঘর আমোদিত হইয়া উঠিল। সেই সময় আমার মনে যে অনুপম আনন্দ ও ভক্তিভাব উদয় হইল, তাহা এক্ষণে মুখে প্রকাশ করিতে সাধ্য হইতেছে না। আর নিদ্রাও হইল না। তখনই কায়মনে হজরত ইমাম হোসেনের প্রতি আত্ম-সমর্পণ করিলাম। এই রাজ্য, এই সৈন্য-সামন্ত, এই ভাণ্ডারস্থ ধনরত্ন মণিমুক্তা সকলই হোসেনের। এই সিংহাসন আজ হইতে হোসেনের নামে উৎসর্গ করিয়া তাঁহাকে ইহার যথার্থ অধিকারী করিলাম। আপনারা আজ হইতে মহামান্য ইমাম হোসেনের অধীন হইলেন। আজ হইতে আমি তাঁহার আজ্ঞাবহ কিঙ্করমাত্র থাকিলাম। অমাত্যগণ! এখনই আপনারা নগরের ঘরে ঘরে ঘোষণা করিয়া দেন যে, এ রাজ্য আজ হইতে ইমাম হোসেনের অধিকৃত হইল। আবদুল্লাহ্ জেয়াদ্ তাঁহার আজ্ঞাবহ হইয়া রহিলেন। অধীন রাজা, রাজপ্রতিনিধি, রাজসংস্রবী, যিনি যেখানে আছেন কিংবা রাজ্যশাসন করিতেছেন, অদ্যই তাঁহাদের নিকট এই শুভ সংবাদ অগৌণে জ্ঞাপন করা হউক। আর অদ্যই আমার স্বপ্ন বিবরণসহ রাজ্যপরিত্যাগ-সংবাদ ইমাম হোসেনের গোচরকরণ জন্য মদিনায় কাসেদ্ প্রেরণ করা হউক। রাজাবিহনে রাজ্য শাসন হওয়া নিতান্তই কঠিন, রাজসিংহাসন শূন্য থাকাও অযৌক্তিক। যত শীঘ্র হয়, ইমাম হোসেন কুফা নগরে আসিয়া রাজপাট অধিকার এবং আমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করুন। ইহাও জানাইও,-যতদিন ইমাম হোসেন এই রাজসিংহাসনে উপবেশন না করিতেছেন, ততদিন প্রধান উজির রাজকার্য পরিচালনা করিবেন। আমার সহিত রাজ্যের আর কোন সংস্রব রহিল না।”
প্রধান উজির নতশিরে রাজাজ্ঞা প্রতিপালন করিলেন। সকলেই হোসেনের নামে রাজভক্তির পরিচয় দিয়া শত শত আশীর্বচন প্রয়োগ করিতে লাগিলেন। আবদুল্লাহ্ জেয়াদকেও একবাক্যে সকলে ধন্যবাদ দিয়া বলিলেন, “এমন সাহসী ধর্মপরায়ণ সরলহৃদয় ধার্মিক জগতে কেহ হয় নাই, হইবেও না। এমন পুণ্যকার্য এ পর্যন্ত কেহ কোন দেশেই করে নাই। এ কথাও সত্য যে, যিনি ইহকাল-পরকালের রাজা, প্রাণ দিয়া তাঁহার উপকার করা সকল মুসলমানের কর্তব্য। এজিদের চক্রান্তে ভ্রাতৃহারা-রাজ্যহারা-একে একে সর্বহারা হইবার উপক্রম হইয়াছেন, এ সময় যিনি যত প্রকারে ইমামের উপকার করিবেন, ঈশ্বর তাঁহাকে তাহার কোটি কোটি গুণে পুণ্যময় করিয়া পরকালের প্রধান স্বর্গে তাঁহার স্থান নির্ণয় করিয়া রাখিবেন। আপনি সৈন্যসামন্ত সহিত রাজ্য-ধন ইমামকে দান করিলেন; আমরা চিরকাল হইতে তাঁহার আজ্ঞানুবর্তী দাসানুদাস আছি। আজ হইতে জীবন, ধন, সমস্তই হোসেনের নামে উৎসর্গ করিলাম।”
প্রধান উজির রাজাজ্ঞানুসারে সমুদয় স্থানে ঘোষণা করিয়া দিলেন। আবদুল্লাহ্ জেয়াদের স্বপ্নবৃত্তান্তও বিস্তারিতরূপে বর্ণনা করিয়া, রাজ্যদান-সংক্রান্ত সমস্ত বিবরণ লিপিবদ্ধ করিযা হোসেন-সমীপে কাসেদ্ প্রেরণ করিলেন।
ক্রমে সর্বত্র প্রকাশ হইল যে, কুফাধিপতি আবদুল্লাহ্ জেয়াদ তাঁহার সমুদয় রাজ্য হোসেনকে অর্পণ করিয়াছেন। এজিদের স্বপক্ষীয়েরা ব্যতীত সকলেই একবাক্যে আবদুল্লাহ্ জেয়াদকে শত শত ধন্যবাদ দিয়া ঈশ্বর সমীপে হোসেনের দীর্ঘায়ু ও সর্বমঙ্গল প্রার্থনা করিলেন। ক্রমে মদিনা পর্যন্ত এই সংবাদ রটিয়া গেল।
হোসেন পূর্ব হইতেই মদিনা পরিত্যাগ করিয়া কুফা নগরে আসিবার ইচ্ছা করিয়াছিলেন। কিন্তু আবদুল্লাহ্ জেয়াদ কর্তৃক আদৃত না হইয়া তথায় গমন করা যুক্তিসঙ্গত বিবেচনা করেন নাই। লোকমুখে জেয়াদের বদান্যতা, বিপদ সময়ে সাহায্য এবং অকাতরে রাজ্য পর্যন্ত দানের বিষয় শুনিয়া ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিয়া কৃতজ্ঞতার সহিত উপাসনা করিলেন। কিন্তু জেয়াদ্-প্রেরিত নিশ্চয় সংবাদ না পাইয়া অন্য কাহাকেও কিছু বলিলেন না।
মারওয়ান আজ মদিনা আক্রমণ করিবে, রওজা আক্রমণ করিবে, হোসেনের প্রাণ হরণ করিবে, সর্বসাধারণের মুখে এই সকল কথার আন্দোলন। মদিনাবাসীরা সকলেই হোসেনের পক্ষ হইয়া এজিদের সৈন্যের সহিত যথাসাধ্য যুদ্ধ করিবে, প্রাণ থাকিতে হোসেনের পরিজনদিগকে বন্দি করিয়া দামেস্কে লইয়া যাইতে দিবে না, এ কথাও রাষ্ট্র হইয়াছে। ‘আজ যুদ্ধ হয়, কাল যুদ্ধ হয়’-এই কথারই তর্কবিতর্ক। এজিদের সৈন্যগণ মদিনা আক্রমণ না করিলে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইবে কি-না এই বিষয় লইয়াই-এই চিন্তাতেই ইমাম-বংশের চিরহিতৈষী মদিনাবাসীরা সকলে মহা ব্যতিব্যস্ত। দিবরাত্রে কাহারই যেন আহার-নিদ্রা নাই।
কয়েকদিন যায়, শেষে সাব্যস্ত হইল যে, শত্রুগণ নগরের প্রান্তভাগে-প্রান্তরের শেষ সীমায় শিবির নির্মাণ করিয়া যে প্রকার শান্তভাবে রহিয়াছে, তাহাতে আশু বিরোধের সম্ভাবনা কী? কোন বিষয়ে অনৈক্য, কোন বিষয়ে বাধা কিংবা কোন কথার প্রসঙ্গে অযথা উত্তর না করিলে কী প্রকারে বিবাদে প্রবৃত্ত হওয়া যায়; এই বিবেচনা করিয়া সকলেই যুদ্ধের অপেক্ষায় বিবাদের সূচনার প্রতীক্ষা করিয়া রহিয়াছেন। একদিন কুফা নগরের কাসেদ্ মদিনায় দেখা দিল। মদিনাবাসীরা জেয়াদের বদান্যতার বিষয় পূর্বেই শুনিয়াছিলেন, নিশ্চয় সংবাদ না পাইয়া অনেকে অনেক সন্দেহ করিতেছিলেন, আজ সে সন্দেহ দূর হইল। একমুখে বলিতে শত শত মুখে জিজ্ঞাসিত হইল, “কুফার সংবাদ কী?”
কাসেদ্ উত্তর করিল, “কুফাধিপতি মাননীয় আবদুল্লাহ্ জেয়াদ তাঁহার সিংহাসন, রাজ্য, ধন, সৈন্যসামন্ত সমস্তই হজরত ইমাম হোসেনের নামে উৎসর্গ করিয়াছেন। তিনি এক্ষণে রাজকার্য হইতে অপসৃত হইয়াছেন। ইমাম হোসেন কুফা-সিংহাসনে উপবেশন না-করা পর্যন্ত প্রধান উজিরের হস্তে রাজকার্যের পরিচালনার ভার রহিয়াছে। ইমাম হোসেন কোথায় আছেন আপনারা বলুন, আমি তাঁহার নিকটে যাইয়া এই সংবাদ দিব।” একজন বলিতে শত শত লোক কাসেদের অগ্র-পশ্চাতে চলিতে লাগিল। কেহ আবদুল্লাহ্ জেয়াদের প্রশংসা, কেহ কেহ হোসেনের কুফাগমনজনিত দুঃখ, কেহ এজিদের দৌরাত্ম্যে হোসেন দেশত্যাগী, এই সকল কথার শাখা-প্রশাখা বাহির করিয়া পরস্পর বাদানুবাদ ও তর্ক-বিতর্ক করিতে করিতে হজরতের রওজায় উপস্থিত হইল। প্রধান প্রধান লোকেরা কাসেদের বৃত্তান্ত ইমামের নিকট বিবৃত করিলেন।
আবদুল্লাহ্ জেয়াদের পত্র পাঠ করিয়া হোসেন সেই পত্রহস্তে কাসেদ সমভিব্যাহারে নিজ ভবনের প্রবেশদ্বারে উপস্থিত হইয়া মদিনাবাসীদিগকে বলিতে লাগিলেন, “ভাই সকল! আপনারা কেন আর কষ্ট পাইতেছেন? যদি কুফার অন্ন-জল ঈশ্বর আমার অদৃষ্টে লিখিয়া থাকেন, তবে আপনারা আমার কৃতদোষ মার্জনা করিবেন। সময়ে আমি আপনাদের প্রত্যেকের নিকট হইতে বিদায় গ্রহণ করিব। এক্ষণে এত ব্যস্ত হইবার কোন কারণই দেখিতেছি না।”
মদিনাবাসীরা সকলেই একবাক্যে হোসেনকে আশীর্বাদ করিয়া স্ব-স্ব স্থানে প্রস্থান করিলেন।
জেয়াদের পত্র লইয়া হোসেন মাননীয়া বিবি সালেমার হোজ্রা (নির্জন স্থান) সমীপে গমন করিলেন। সংবাদ পাইয়া বিবি সালেমা হোজ্রা হইতে বহির্গত হইলেন। ইমাম হোসেন মাতামহীর (হজরত হোসেনের আপন মাতামহী বিবি খাদিজা। বিবি সালেমা হযরত মোহাম্মদের অন্য স্ত্রী।) পদধূলি গ্রহণ করিয়া জেয়াদের পত্রবিবরণ প্রকাশ ও কুফা নগরে গমন প্রসঙ্গ উত্থাপন করিলেন।
রওজা হইতে হোসেনের আগমনবৃত্তান্ত শুনিয়া পরিজন, আত্মীয়, বন্ধু অনেকেই বিবি সালেমার হোজ্রায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন।
হোসেন সকলের নিকটেই কুফা-গমনসঙ্কল্পে পরামর্শ জিজ্ঞাসা করায়, কেহই কোন উত্তর না করিয়া নিস্তব্ধভাবে রহিলেন। বিবি সালেমা গম্ভীর স্বরে বলিতে লাগিলেন, “আবদুল্লাহ জেয়াদ্ যাহাই লিখুক, আমি তোমাকে পুনঃ পুনঃ নিষেধ করিতেছি, তুমি কখনোই কুফায় গমন করিয়ো না-হজরতের রওজা ছাড়িয়া কোন স্থানেই যাইয়ো না; হজরত আমাকে বলিয়া গিয়াছেন যে, হোসেন আমার রওজা পরিত্যাগ করিয়া স্থানান্তরে গমন করিলে অনেক প্রকার বিপদের আশঙ্কা। আমি পুনঃ পুনঃ নিষেধ করিতেছি, তুমি কখনোই রওজা হইতে বাহির হইও না। এখানে কাহারো ভয় নাই, কোন প্রকার শত্রুতা সাধন করিবার ক্ষমতা কাহারো নাই, তুমি স্বচ্ছন্দে নিশ্চিন্তভাবে রওজায় বসিয়া থাক।”
হোসেন বলিলেন, “কতকাল এইভাবে বসিয়া থাকিব? কাফেরগণ ক্রমশঃই তাহাদের সংখ্যা বৃদ্ধি করিয়া মদিনার নিকটে একত্রিত হইতেছে। আমি কি করি, কতদিন এই প্রকারে বসিয়া কাটাইব? একা আমার প্রাণের জন্য কত লোকের জীবন বিনষ্ট হইবে? তাহা অপেক্ষা আমি কিছুদিন স্থানান্তরে বাস করি, ইহাতে দোষ কি? বিশেষ কুফা নগরের সমুদয় লোক মুসলমান-ধর্মপরায়ণ, সেখানে যাইতে আর বাধা কী?”
সালেমা বিবি বিরক্তভাবে বলিতে লাগিলেন, “আমি বৃদ্ধা হইয়াছি, আমার উপদেশ তোমাদের গ্রাহ্য হইবে কেন? যাহা হয় কর।” এই বলিয়া হোজ্রামধ্যে চলিয়া গেলেন। তৎপরে হোসেনের মাতার সহোদরা ভগ্নী উম্মে কুলসুম্ হোসেনের হস্তধারণ করিয়া বলিতে লাগিলেন, “হোসেন! সকলের গুরুজন যিনি, প্রথমেই তিনি নিষেধ করিতেছেন, তাঁহার কথার অবাধ্য হওয়া নিতান্তই অনুচিত। বিশেষ আমিও বলিতেছি, তুমি কুফার নাম পর্যন্তও করিয়ো না। কুফার নাম শুনিলে আমার হৃদয় কাঁপিয়া উঠে। তোমার কি স্মরণ হয় না যে, তোমার পিতা কুফায় যাইয়া কত কষ্ট পাইয়াছিলেন? কুফা-নগরবাসীরা তাঁহাকে কতই-না যন্ত্রণা দিয়াছিল, সে কথা কি একেবারে ভুলিয়াছ? কুফায় যাইবার বাসনা অন্তর হইতে একেবারে দূর কর। নিশ্চিন্তভাবে রওজায় বসিয়া থাক, আমি সাহস করিয়া বলিতেছি, জগতে এমন কেহই নাই যে, তোমার অঙ্গ স্পর্শ করে।”
হোসেন বলিলেন, “আমার মন অত্যন্ত অস্থির হইয়াছে! তিলার্ধ কালও মদিনায় থাকিতে ইচ্ছা হইতেছে না। আপনারা আর আমায় বাধা দিবেন না। মিনতি করিয়া বলিতেছি, অনুমতি করুন, শীঘ্রই যাহাতে কুফায় যাত্রা করিতে পারি।”
উম্মে কুলসুম্ বিরক্ত হইয়া চলিয়া যাইতে যাইতে বলিলেন, “ঈশ্বর অদৃষ্টফলকে যাহা লিখিয়াছেন, তাহা রদ করিবার কাহারো সাধ্য নাই। তোমার যাহা ইচ্ছা তাহাই কর।”
হোসেনের বন্ধুবান্ধব একবাক্য হইয়া সকলেই কুফাগমনে নিষেধ করিলেন। প্রতিবেশীগণের মধ্যে একজন বলিলেন, “মদিনার মায়া একেবারে অন্তর হইতে অন্তর করিবেন না। এজিদের ভয়ে মদিনা পরিত্যাগ নিতান্ত পরিতাপ ও দুঃখের বিষয়। তাহারা প্রকাশ্য যুদ্ধে কী করিবে? মদিনাবাসীদের একজনেরও প্রাণ দেহে থাকিতে শত্রুগণ কি আপনার অঙ্গ স্পর্শ করিতে পারে? কাহার সাধ্য? আমাদের স্বাধীনতা, স্বদেশের গৌরব রক্ষা, ইহা তো আছেই; তাহা ছাড়া আপনার প্রাণের জন্য এজিদের সৈন্যের সম্মুখীন হইতে আমরা কখনোই পরাক্সমুখ হইব না। আমরা শিতি নহি, তাহা স্বীকার করি; কিন্তু আপনার প্রাণরার জন্য আমাদের প্রাণ শত্রুহস্তে অর্পণ করিতে শিক্ষার আবশ্যক কি? আমরাও যদি শত্রুহস্তে বিনাশপ্রাপ্ত হই, তথাপি মদিনার একটি স্ত্রীলোক জীবিত থাকিতে এজিদ্ আপনার অনিষ্ট সাধন করিয়া কখনোই মদিনার সিংহাসনে বসিতে পারিবে না। আপনি কাহার ভয়ে-কোন্ শত্রুর শত্রুতায় মদিনা পরিত্যাগ করিবেন? আমাদের জীবন থাকিতে আমরা আপনাকে যাইতে দিব না। আপনার আজ্ঞার প্রতিবন্ধকতা করিতে আমাদের ক্ষমতা নাই। যদি আপনি মদিনা পরিত্যাগ করিতে নিতান্তই কৃতসঙ্কল্প হইয়া থাকেন, করুন; কিন্তু মদিনাবাসীরা আপনাকে কখনোই পরিত্যাগ করিবে না। যেখানে যাইবেন, তাহারাও আপনার সঙ্গে সেইখানে যাইবে।”
হোসেন বলিতে লাগিলেন, “ভাই সকল! এজিদের জীবনের প্রথম কার্যই আমাদের বংশ বিনাশ করা। যে উপায়ে হউক, এজিদ্ আমার প্রাণ বিনাশ করিবে। যখন দুই ভ্রাতা ছিলাম, তখন এজিদের সৈন্যেরা সাহস করিয়া প্রকাশ্য যুদ্ধ করিতে অগ্রসর হয় নাই। কয়েকবার পরীক্ষা করিয়া দেখিয়াছে এবং আপনারাও দেখিয়াছেন। এক্ষণে আমার সাহস, বল, বুদ্ধি ও চিন্তাশক্তির অনেক লাঘব হইয়াছে। কারণ, ভ্রাতৃশোকে আমি যে প্রকার দুঃখিত ও কাতর আছি, তাহা আপনারা স্বচক্ষে দেখিতেছেন; যে হৃদয় কখনোই ভয়ের নাম জানিত না, শত্রুনামে যে হৃদয় কদাচ আতঙ্কিত হইত না, সেই ভয়শূন্যহৃদয় আজ ভ্রাতৃ-বিয়োগ-দুঃখে সামান্য যুদ্ধের নামে আতঙ্কে কাঁপিয়া উঠিতেছে। আমার নিজের মনই যদি নিরুৎসাহ থাকিল-শত্রুভয়ে কম্পমান রহিল, তখন কাহার উৎসাহে-কাহার উত্তেজনায়, আপনারা সেই দুর্দান্ত শত্রুর অস্ত্রসম্মুখে-অসংখ্য সেনার অসংখ্য অস্ত্রসম্মুখে দণ্ডায়মান হইবেন? বলুন তো, কাহার সাহসের উপর নির্ভর করিয়া বিধর্মীর অস্ত্রাঘাতের জন্য বক্ষ বিস্তার করিয়া দিবেন? শিক্ষিতি সৈন্যের তরবারির গতি কাহার প্রোৎসাহবাক্যে প্রতিরোধ করিবেন? আমি অনেক চিন্তা করিয়া দেখিয়াছি, এক্ষণে মদিনা পরিত্যাগ করাই আমার পক্ষে শ্রেয়ঃ এবং মদিনাবাসীর পক্ষে মঙ্গল। আমার জন্য আমি আপনাদিগকে বিপদগ্রস্ত করিতে বাসনা করি না। এজিদের হস্তে, কিংবা তাহার সৈন্যের হস্তে বিধি যদি আমার জীবন-শেষের বিধি করিয়া থাকেন, তবে তাহা নিশ্চয়ই ঘটিবে। যেখানেই কেন যাই না, আমার প্রাণহন্তা সেইখানেই উপস্থিত হইবে। কারণ, জগদীশ্বরের কার্য অনিবার্য। আমার স্থানান্তর হওয়ায় মদিনাবাসীরা তো এজিদের রোষাগ্নি হইতে রক্ষা পাইবে। তাহাই আমার পক্ষে মঙ্গল।”
প্রতিবেশীগণের মধ্যে একজন প্রাচীন ছিলেন, তিনি বলিতে লাগিলেন, “ঈশ্বরের নিয়োজিত কার্য অনিবার্য, এ কথা কে না স্বীকার করিবে? কিন্তু আবদুল্লাহ্ জেয়াদ্ হঠাৎ এইভাবে এত বড় রাজ্য আপনাকে অযাচিতভাবে ছাড়িয়া দিল, ইহার কারণ কী? এ কথাও রাষ্ট্র হইয়াছে যে, এজিদ্পক্ষীয় কাসেদ্ তিন লক্ষ টাকা লইয়া কুফা নগরে জেয়াদের নিকট গিয়াছিল। জেয়াদ্ও দামেস্কের কাসেদ্কে এবং তৎসমভিব্যাহারী সৈন্যচতুষ্টয়কে বিশেষ পুরস্কৃত করিয়া বিদায় করিয়াছেন। তাহার পরদিবসই স্বপ্নবিবরণ সভায় প্রকাশ করিয়া রাজসিংহাসন ও রাজ্য আপনাকে অর্পণ করিয়াছেন। ইহারই-বা কারণ কী? যদি এজিদের মন্ত্রণায় সে অসম্মত হইবে, কি এজিদের আদেশ প্রতিপালনে অনিচ্ছুক হইবে, তবে নিঃস্বার্থ বন্ধুর চিরশত্রুপ্রেরিত কাসেদ্কে কেন পুরস্কৃত করিবে? কেন তাহার প্রদত্ত অর্থ নিজ ভাণ্ডারে রক্ষা করিবে? যে রাজ্য আপনার পিতা বহু পরিশ্রম করিয়াও নিষ্কণ্টকে হস্তগত করিতে পারেন নাই, কয়েকবার তাঁহাকে ঐ নগরবাসীরা, যে প্রকার কষ্টে নিপাতিত করিয়াছিল, তাহা বোধ হয় আপনি পরিজ্ঞাত আছেন। এইণে কুফাধিপতি জেয়াদ্ হঠাৎ নূরনবী মোহাম্মদের স্বপ্নাদেশে সেই রাজ্য অকাতরে আপনাকে দান করিল, ইহাতে আমার বিশেষ সন্দেহ আছে।”
হোসেন বলিলেন, “এমন কথা মুখে আনিবেন না। আবদুল্লাহ্ জেয়াদের ন্যায় আমার প্রকৃত বন্ধু মদিনা ব্যতীত অন্য কোন স্থানেই নাই। তাঁহার গুণের কথা কত বলিব। তিনি আমার জন্য এজিদের মুণ্ডপাত করিতেও বোধ হয় কখনোই কুণ্ঠিত হইবেন না। জেয়াদের বাক্য ও কার্যে আমার কিছুমাত্র সংশয় নাই।”
বৃদ্ধ পুনরায় বলিতে লাগিলেন, “জেয়াদের বাক্যে ও কার্যে আপনার কোন সংশয় হয় না, অবশ্যই না হইতে পারে। কিন্তু আমি বলি, মানুষের মনের গতি কোন্ সময় কী হয়, তাহা যাহার মন, সেও জানিতে পারে না। একটু চিন্তা করিয়া কার্য করায় ক্ষতি কী? আমার বিবেচনায় অগ্রে জনৈক বিশ্বাসী এবং সাহসী লোককে কুফা নগরে প্রেরণ করা হউক। কুফাবাসীরা যদি কোনরূপ চক্রান্ত করিয়া থাকে তবে অবশ্যই প্রকাশ হইবে। গুপ্ত মন্ত্রণা ক’দিন গোপন থাকিবে? একটু সন্ধান করিলেই সকল জানা যাইবে। আর জেয়াদের রাজ্যদানসঙ্কল্পও যদি যথার্থ হয়, তবে আপনার কুফা গমনে আমি কোন বাধা দিব না।”
হোসেন বলিলেন, “এ কথা মন্দ নয়; কিন্তু অনর্থক সময় নষ্ট এবং বিলম্ব। তা যাহাই হউক, আপনার কথা বারবার লঙ্ঘন করিব না। অগ্রে তথায় পাঠাইতে কাহাকে মনস্থ করিয়াছেন? এমন সাহসী বিশ্বাসী পাত্র কে আছে?”
দ্বিতীয় মোস্লেম নামক জনৈক বীরপুরুষ গাত্রোত্থান করিয়া করজোড়ে বলিতে লাগিলেন, “হজরত ইমামের যদি অনুমতি হয় তবে এ দাসই কুফা নগরে যাইতে প্রস্তুত আছে। আপনি কিছুদিন অপেক্ষা করুন, আমি কুফায় যাইয়া যথার্থ তত্ত্ব জানিয়া আসি। যদি আবদুল্লাহ্ জেয়াদ্ সরলভাবে রাজ্য দান করিয়া থাকেন, তবে মোস্লেম আনন্দের সহিত শুভ সংবাদ লইয়া ফিরিয়া আসিবে। আর যদি ইহার মধ্যে কোন ষড়যন্ত্র থাকে, তবে বুঝিবেন, মোস্লেমের এই শেষ বিদায়। আপনার কার্যে মোস্লেমের প্রাণের মায়া, সংসারের আশা, সুখ-দুঃখের চিন্তা, স্ত্রী-পরিবারের স্নেহবন্ধন, কিছুমাত্র মনে থাকিবে না। আজ মোস্লেম আপনার কার্যে জীবন উৎসর্গ করিল। এই মুহূর্তেই কুফায় যাত্রা করিবে। এখানে অনেকেই আছেন, যাহা বলিতে ইচ্ছা করেন বলুন; মোস্লেম সে কথার অন্যথা কিছুতেই করিবে না।”
বৃদ্ধ পুনরায় বলিলেন, “মোস্লেম তো যাইতেই প্রস্তুত। মোস্লেমের প্রতি আমার তো সম্পূর্ণ বিশ্বাসই হয়, কিন্তু একা মোস্লেমকে কুফায় প্রেরণ করা যুক্তিসঙ্গত বলিয়া বোধ হয় না। শিক্ষাত হউক কি অশিক্ষিত হউক, সৈন্যনামধারী কতিপয় লোককে মোস্লেমের সঙ্গে দিতে হইবে।”
বৃদ্ধের মুখে এই কথা শুনিবামাত্র নিতান্ত আগ্রহের সহিত অনেকে যাইতে ইচ্ছুক হইলেন। অতি অল্প সময়ের মধ্যে এক হাজার লোক মোস্লেমের সঙ্গী হইতে সমুৎসুক হইল। কুফার রহস্য-ভেদ ষড়যন্ত্রের মূলোচ্ছেদ করিতে তাহারা প্রাণপণে প্রস্তুত। সমুদয় কথা সাব্যস্ত হইয়া গেল; অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করিয়া মোস্লেম এক হাজার সৈন্য লইয়া কুফা নগরাভিমুখে যাত্রা করিলেন। বীরবরের দুই পুত্রও পিতার সঙ্গে চলিল।